কে জানত যে সেই তখন থেকেই মতলব ভাঁজছিল চাটুজ্যে!
তখন তো বুঝিনি মল্লিকা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, মামার মুখে মধু, ভিতরে বিষ! আমাকে কোলে জড়িয়ে বোনের নাম করে কত কাঁদল, কত আক্ষেপ করল, আমায় এতদিন আদরযত্ন করেনি বলে হা-হুঁতাশ করল। মুখের মধুর মোহে তখন খুব ভালবেসে ফেললাম। মনে হল, মামার নামে যা কিছু নিন্দে শুনেছি সব বাজে। কিন্তু বয়েস হবার সঙ্গে সঙ্গে
শিউরে ওঠে মল্লিকা। চুপ করে যায়।
প্রভাত ওর মুখের দিকে তাকায়। সরল পবিত্র মুখ।
সত্যি, মানুষ কি এতই সস্তা জিনিস যে সামান্য খুঁৎ হলেই তাকে বর্জন করতে হবে?
.
দূরপথে পাড়ি। কত কথা, কত গল্প!
সেই বাগদীদের বৌটা?
সেটা নাকি আর কার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। মামা বলত, আপদ গেছে। হাড় জ্বালিয়ে খেয়েছে আমার! এখন আর কোন কিছু নেশা নেই মামার, শুধু পয়সা আর পয়সা।
আচ্ছা তা তো হল, কিন্তু এর মাঝখানে লেখাপড়া শিখল কখন মল্লিকা? এমন কায়দাদুরস্ত হল কি করে?
তা তার জন্যে মামার কাছে ঋণী বৈকি।
যে উদ্দেশ্যেই হোক, মেম রেখে ইংরিজি শিখিয়েছে মামা, শিখিয়েছে চালচলন।
না, উদ্দেশ্যটা মহৎ নয়। দুরস্ত করেছে যত অবাঙালী খদ্দেরদের জন্যে-তবু যে ভাবেই হোক মল্লিকা তো পেয়েছে কিছু!
বাংলা? সেটা সম্পূর্ণ নিজের আকুলতায় আর চেষ্টায়। পার্সেলে বই আনিয়ে আনিয়ে
তাতে আপত্তি ছিল না মামার?
না। এদিকে যে আবার মল্লিকার তোয়াজ করতেন। বুঝতেন তো মল্লিকাই খদ্দেরদের অর্ধেক আকর্ষণ। স্টেশনে একা গেলে তোক আসতে চায় না, মল্লিকা গেলে ঠিক বঁড়শি গেলে!
তার সাক্ষী তো স্বয়ং আমিই–হেসে উঠেছিল প্রভাত।
হ্যাঁ, ওখানে সব আছে।
মদ, জুয়া, ভেজাল, কালোবাজার! তারাই তো দামী খদ্দের! আর ওইজন্যেই তো পুলিশে অত ভয় চাটুজ্যের। পুলিশের লোক বলে সন্দেহ হলেই
সব কথাই বলছি তোমায়, সব কথাই বলব। মল্লিকা বলে, প্রথম যেদিন তোমার ঘরে এসেছিলাম, সেদিন ঠকিয়েছিলাম তোমায়। অভিনয় করেছিলাম।
অভিনয়!
আড়ষ্ট হয়ে তাকায় প্রভাত।
মল্লিকা মুখ তুলে বলে, হ্যাঁ অভিনয়। অভিনয় করতে করতেই তো বড় হয়েছি। মামার শিক্ষায় অভিনয় করেছি। আবার মামাকে ঠকাতেও করেছি। সেদিন গিয়েছিলাম মামার শিক্ষায় তোমার পকেট থেকে চিঠি চুরি করতে।
চিঠি চুরি! পৃথিবীটা দুলে ওঠে প্রভাতের।
কিন্তু মল্লিকা অকম্পিত। সে সব বলবে। তারপর প্রভাত তাকে দূর করে দিক, আর মুখ না দেখুক, তাও সইতে পারবে।
মরতে ইচ্ছে হত মাঝে মাঝে। কিন্তু রূপ রস গন্ধ স্পর্শময়ী এই পৃথিবীর দিকে তাকালেই মনটা কেঁদে উঠত। নিজের ওপর মায়ায় ভরে যেত মন। আর কল্পনা করত, কবে কোনদিন আসবে তার ত্রাণকর্তা!
আরও তিনজন আশ্বাস দিয়েছিল।
প্রথমবার এক বাঙালী মহিলা, মহিলা!
হ্যাঁ, একজন নার্স! স্বাস্থ্যান্বেষণে এসেছিলেন। অনুভব করেছিলেন মল্লিকার দুঃসহ যন্ত্রণা। টের পেয়েছিলেন মল্লিকার জীবনের গ্লানি। বলেছিলেন, মল্লিকাকে নিয়ে যাবেন। তাকে সুস্থ
জীবনের স্বাদ এনে দেবেন।
কিন্তু হঠাৎ একদিন মল্লিকাকে কিছু না বলে পালিয়ে গেলেন।
তারপর আপনারই মত দুজন যুবক। সহানুভূতি দেখিয়েছেন, উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন বলেছেন, যাবার সময় ভুলে গেছেন।
তার মানে ওই আশা দিয়ে লোভ দেখিয়ে রেখে বিশেষ সুবিধে আদায় করে নিয়েছে। প্রভাত রাগ করে বলে।
মল্লিকা মুখ তুলে বলে, পৃথিবীতে দেবতা আর কজন জন্মায়?
প্রভাত তার হাতের ওপর একটা হাত রাখে, ঈষৎ চাপ দেয়। তারপর বলে, কিন্তু মনে আছে তো? তোমার পরিচয়টি কি? মনে রেখো তোমার মামা গরীব ব্রাহ্মণ, মামী হঠাৎ মারা যাওয়ায় তোমাকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছেন। দূরে প্রবাসে ছোট্ট একটি দোকান আছে, সেইটি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে ভাগ্নীর জন্যে পাত্র খুঁজবেন, এমন অবস্থা নয়। দৈবক্রমে আমার সঙ্গে পরিচয়। আমি গোস্বামী শুনে হাতে স্বর্গপ্রাপ্তি
হেসে ওঠে প্রভাত।
মল্লিকা বলে, ভুলে যাব না।
না, ভুলে গেল না তারা।
ওই গল্প দিয়ে ভোলালো বাড়ীর লোককে, আত্মীয়বর্গকে।
কিন্তু সমাজ সংসারী ঝুনো মানুষদের ভোলানো কি সোজা? নাঃ, সোজা নয়। তাই কাজটা খুব সহজ হয়নি। অনেক ভুরু কুঁচকে উঠেছিল।
প্রথম ভুরু কোঁচকালেন মা।
প্রভাত-জননী করুণাময়ী।
ভুরু কুঁচকে বললেন, বাংলা-বিহার ছাড়া পাণ্ডববর্জিত দেশ সেই পাঞ্জাব বর্ডারে লোকটা যে একা পড়ে আছে, এর কারণ কি? কোনও দোষঘাট ছিল কিনা কে জানে? শুনে মনে হচ্ছে যেন সমাজ সংসার থেকে পালিয়ে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে বসে থাকা লোক! বলি তার জ্ঞাতি-গোত্তর আত্মবন্ধু কাউকে দেখেছিস সেখানে?…দেখিস নি? তবে? বলি তার জাতকুলের নিশ্চয়তাই বা কী? সে বলল, আমি বামুন, অমনি তুই মেনে নিলি বামুন! জাত ভাঁড়িয়ে অরক্ষণীয়া কন্যে পার করার কথাও আমরা শুনি নি এমন নয়। এরপর যদি প্রকাশ পায় তেলিতামলি কি–হাড়ি ডোম–
প্রভাত মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছিল, দেখে কি হাড়িডোম বলে ভ্রম হচ্ছে তোমার?
শুনে করুণাময়ী কিঞ্চিৎ থতমত খেয়েছিলেন, বলেছিলেন, আহা, সে কথা বলছি না। তবে সময় সময় গোবরেও পদ্মফুল ফোটে না তা নয়।
সে পদ্ম তুলে নিয়ে ঠাকুরপূজো কর না তোমরা?
হল কুতকুর সুরু করুণাময়ী বলেন, ফুলের জাত আছে?
নেই। আর মানুষেরও থাকা উচিত নয়। মানুষ হচ্ছে মানুষ, এই তার পরিচয়। তার সত্যিকার পরিচয় তৈরি হয় তার আচার আচরণে, রুচি প্রকৃতিতে