মল্লিকার অশ্রুজলের আবেদন, একটি নিঃসহায় নিরুপায় মেয়ের জীবনের অনিবার্য শোচনীয়তা প্রভাতকে বিচলিত করে তুলল। তাই হঠাৎ মোহে নয়, যা করল জেনে বুঝেই করল।
মল্লিকা যে নিষ্কলঙ্ক নয়, মামার শিকারের টোপ হবার জন্যে ওকে যে অনেক খোয়াতে হয়েছে, এ বুঝতে ভুল হয়নি প্রভাতের।
তবু সে মানবিকতার সঙ্গে যুক্তি আর বুদ্ধিকেও কাজে লাগিয়েছে। ভেবেছে যুগটা আধুনিক।
এ যুগে সভ্যজগতের নিয়ম নয়, মানুষকে মাছদুধের মত নষ্ট হয়ে গেছে বলে ফেলে দেওয়া।
ভেবেছে, এ যুগে তো বিধবা বিয়ে করছি আমরা! বিবাহ-বিচ্ছেদের সমুদ্র পার হওয়া মেয়েকে বিয়ে করছি!
ভেবেছে, ও তো মানসিক পাপে পাপী নয়। দুর্ভাগ্য যদি ওকে নিদারুণতার মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলে থাকে, সে দোষ কি ওর? একটা মানুষকে যদি পঙ্কের মধ্যে থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে সুন্দর জীবনের বৃন্তে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে প্রভাত, সে কাজে নিশ্চয়ই ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাবে।
তবু মিথ্যা কৌশল অনেক করতে হল বৈকি। প্রভাতকে কলকাতা থেকে বন্ধু মারফৎ মায়ের মারা অসুখ বলে টেলিগ্রাম আনিয়ে ছুটি মঞ্জুর করতে হল, আর মল্লিকাকে স্টেশনের ধারে টাঙ্গা থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড় ভাঙতে হল।
অসহ্য যন্ত্রণার অভিনয়ে অবশ্য মল্লিকাও কম পারদর্শিতা দেখায় নি।
চ্যাটার্জি তাকে হিঁচড়ে টাঙ্গায় তুলবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জায়গাটা স্টেশন! অনেক লোকের ভিড়! তাদের পরামর্শের চাপে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ভাগ্নীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল চ্যাটার্জিকে, আর ডাক্তার নেই, চারটের সময় আসবেন। রেখে যান নার্সের এই হুকুমও মানতেই হল।
তারপর?
উৎকোচের পথেও আসতে হয়েছে বৈকি। উৎকোচ আর ধরাধরি।
এই দুই পথেই তো অসাধ্যসাধন হয়। এই তো জগতের সব সেরা পথ।
.
ট্রেনে চড়ে বসার পর আর ভয় করে না।
চ্যাটার্জি কি নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে ভাগ্নী খুঁজতে বেরবে?
আর পুলিশ?
তার কাছে জবাব আছে। মল্লিকা নাবালিকা নয়।
আর ততদিনে–পুলিশ যতদিনে খুঁজে পাবে, হয়তো রেজিস্ট্রি করেই ফেলতে পারবে।
রেজিস্ট্রি?
হ্যাঁ, ওটা চাই।
ওই তো রক্ষামন্ত্র। তারপর অনুষ্ঠানের বিয়েও হবে বৈকি! প্রভাত বলে, ওটা নইলে মন ওঠে না। সেই যে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি।
মল্লিকাও তার স্বপ্নসাধের কথা বলে, জানো, ছেলেবেলায় এক পিসতুতো দিদির বিয়ে দেখেছিলাম, সেই থেকে সেইরকম কনে হবার যে কী সাধই চেপে বসেছিল মনে–খেলাঘরে বিয়ে বিয়ে খেলতাম, কনে হয়ে ঘোমটা দিতাম, ঘোমটা খুলে অদৃশ্য অদেহী বরের দিকে চোখ তুলে তাকাতাম!
উঃ, ওইটুকু বয়সে কম পাকা তো ছিলে না? প্রভাত হেসে ওঠে।
.
চলন্ত ট্রেনের কামরা।
জানলা দিয়ে হু-হু করে দুরন্ত বাতাস আসছে, মল্লিকা গল্প করছে তার ছেলেবয়সের দুরন্তপনার কথা।
কেমন করে গাছে চড়ে বসে থেকে মাকে নাজেহাল করত। কেমন করে পারানির মাঝিদের সঙ্গে ভাব করে নৌকোয় চড়ে গঙ্গার এপার ওপার হত।
হ্যাঁ, গঙ্গার তীরেই গ্রাম।
যোগের স্নানে লোক আসত এ-গ্রাম ও-গ্রাম থেকে। মল্লিকা সেই ভিড়ে মিশে মেলাতলায় ঘুরত।
আবার মার সঙ্গে মার কাজও করেছি বৈকি। ওই অতটুকু বেলাতেই করেছি! তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়েছি। ছোট্ট কাঁচা শাড়ি পরে চন্দন ঘষেছি, ফুল তুলে রেখেছি। …তারপর কোথা দিয়ে কী হল, ফুলের বন থেকে গিয়ে পড়লাম পাঁকের গর্তে। স্বর্গ থেকে পড়লাম নরকে। ওর থেকে যে কোনোদিন উদ্ধার পাব, সে আশা
কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যায় মল্লিকার। অশ্রু টলটল করে দুটি চোখে।
আমার জীবন, যেন একটা গল্পের কাহিনী!
মল্লিকা চেয়ে থাকে সুদূর আকাশের দিকে।
তা চ্যাটার্জির জীবনও একটা গল্পকথা বৈকি।
চাটুজ্যেবামুনের ঘরের ছেলে, বাপ সামান্য কি চাকরি করে, আবার যজমানীও করে। ছেলে ছোট থেকে উচ্ছন্নের পথে। নীচ জাতের ঘরে পড়ে থাকে, তাদের সঙ্গে তাড়ি খায়, গাঁজা খায়। বাপ বকেঝকে যজমানী কাজ করতে বললে হি হি করে হাসে আর বলে, বাগদীর ঘরের ভাত খেয়ে আমার তো জাতজন্মের বালাই নেই, ছুঁলে তোমার শালগেরামের জাত যাবে না?
কিন্তু ছেলেবেলার সেই দুষ্টুমি বয়েস হতেই পরিণত হল কেউটে বিষে। একবার বাগদীদের। হাতে মার খেয়ে হাড় ভেঙে ঘরে পড়ে রইল তিন মাস, তখন বাপের কাছে দিব্যি গাললো, কান মললো, নাকে খৎ দিল, আর সেরে উঠে মানুষ হয়েই একদিন রাতের অন্ধকারে গেল নিরুদ্দেশ হয়ে।
আর সেই রাত্রে বাগদীদের সেই রঙ্গিণী বৌটাও হল হাওয়া। যার জন্যে মার খেয়ে হাড় ভাঙা।
.
তারপর বহু বহুকাল পাত্তা নেই, অবশেষে একদিন বোনকে অর্থাৎ মল্লিকার মাকে একটা চিঠি লিখে জানাল, বেঁচে আছি, তবে এমন জড়িয়ে পড়েছি যে যাওয়া অসম্ভব। ঠিকানা দিলাম, বাবা মরলে একটা খবর দিস। যতই হোক বামুনের ছেলে, নেহাৎ শূয়োর গরুটা আর খাব না সে সময়। ছেলে চলে যেতে মেয়ে-জামাইকে কাছে এনে রেখেছিল চাটুজ্যের বাপ।
তা বাপ মরতে দিয়েছিল চিঠি–বোন নয়, ভগ্নিপতি।
আর সেই খবর পেয়েই চাটুজ্যে অতকাল পরে গ্রামে ফিরে এসে বাপের ভাঙা ভিটেটুকু আর দুপাঁচ বিঘে যা ধানজমি ছিল, বেচে দিয়ে বোন-ভগ্নিপতিকে উচ্ছেদ করে আবার স্বস্থানে প্রস্থান করেছিল। . এসব কথা মল্লিকা তার মার মুখে শুনেছে। তখনও সে শিশু। তারপর তারও বাপ মরেছে। মা লোকের বাড়ী ধান ভেনে, বড়ি দিয়ে, কাজেকর্মে বেঁধে দিন গুজরান করে মেয়েটাকে মানুষ করে তুলছিল। তা সে মাও মরল। আর কেমন করে না জানি খবর পেয়ে মামা এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল।