আর প্রভাতের মনে হল, মল্লিকা কি জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকতে অভ্যস্ত?
২. অসমসাহসিকতা
মল্লিকা দেবী, এ রকম অসমসাহসিকতা করছেন কেন?
কী করব? কখন কথা বলব আপনাকে?
আজও ভেঙে পড়ে মল্লিকা, দিনের বেলা চারিদিকে পাহারা। ওই গণেশটা হচ্ছে মামার চর। সহস্র চক্ষু ওর। শুধু এই রাত্তিরে তাড়ি খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে।
কিন্তু কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন!
আশ্চর্য! আশ্চর্য আপনি! মল্লিকার তীক্ষ্ণকণ্ঠ ধিক্কার দিয়ে ওঠে, আপনি কী শুকদেব?
মল্লিকা দেবী! আপনার ওপর থেকে আমার শ্রদ্ধা কেড়ে নেবেন না!
মল্লিকা সংযত হয়।
ক্ষুদ্ধহাস্যে বলে, কি জানেন, পুরুষের একটা রূপই দেখেছি, তাই সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়। আর ভালো কথা, সভ্য সুশ্রী কথা, কবে শিখলাম বলুন? সেই আট বছর বয়েস থেকে মামার হোটেলের চাকরাণীগিরি করছি। মামার হুকুমে তার খদ্দেরদের আকর্ষণ করতে
থাক। শুনতে কষ্ট হচ্ছে। আজ আপনার কী বক্তব্য সেটাই শুনি!
মল্লিকা খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
জানলা দিয়ে ছায়া-ছায়া জ্যোৎস্না আসছে। ওকে মনে হচ্ছে বন্দিনী রাজকন্যা।
তবে—
আজ ওর গলা কান্নায় ভেজা নয়। ক্লান্ত বিষণ্ণ মধুর।
মিস্টার গোস্বামী, আজ আমি কিন্তু নিজের স্বার্থে আসিনি। এসেছি আপনাকে সাবধান করতে। কিন্তু তার আগে প্রশ্ন করছি, রোজ আপনি কী এত লেখেন?
লিখি! লিখি মানে? চিঠি লিখি!
কাকে? কাকে এত চিঠি
প্রভাত বিরক্ত কণ্ঠে বলে, কেন বলুন তো? এ কী অদ্ভুত কৌতূহল আপনাদের? আপনার মামাও কাল নানান জেরায়, আপনাদের হোটেলের খাতায় এ নিয়মটাও তাহলে লিখে রাখা উচিত ছিল, এখানে থাকতে হলে বাড়ীতে চিঠি লেখা নিষেধ!
আপনি রাগ করছেন? কিন্তু জানেন, মামার সন্দেহ হয়েছে আপনি পুলিশের লোক!
চমৎকার!
ওই তো–গণেশ বোজ খবর দিচ্ছে আপনি লিখছেন। মামার ভাবনা, এগুলো আপনি রিপোর্ট লিখছেন। কারণ প্রথম দিন এসে নাকি নানা অনুসন্ধান করেছিলেন।
আরও চমৎকার লাগছে!
রাগ করলেও সাবধান হোন, এই অনুরোধ। মামার এখানে অনেক রকম ব্যাপারই তো চলে। বলতে গেলে বেআইনি কাজের ঘাঁটি!
হু। সেইরকমই সন্দেহ হচ্ছিল।
হওয়াই স্বাভাবিক। আপনি সরল হলেও নির্বোধ নয়। কিন্তু জানিয়ে রাখি শুনুন, কিছুদিন আগে আপনারই মতো একটি বাঙালী ছেলে বোর্ডারের ছদ্মবেশে এসে বাসা নিয়েছিল টিকটিকিগিরি করতে। সে আর ফিরে যায়নি।
মল্লিকা দেবী!
মল্লিকা কিন্তু এ আর্তনাদে বিচলিত হয় না। তেমনি দার্শনিক ভঙ্গিতে বলে, হ্যাঁ, তাই। ওই জঙ্গলের দিকে অনুসন্ধান করলে হয়তো এখনো তার হাড়ের টুকরো পাওয়া যেতে পারে।
বিচলিত প্রভাত সহসা আত্মস্থভাবে বলে, কিন্তু কি করে বুঝব আপনিও আপনার মামার চর নয়?
কী করে বুঝবেন! মূঢ় শোনায় মল্লিকার কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ, বিশ্বাস কি? যেখানে এত সতর্ক চক্ষু, সেখানে কী ভাবে আপনি রাত্রিবেলা একজন যুবকের ঘরে
হঠাৎ প্রায় শব্দ করে হেসে ওঠে মল্লিকা।
সেটাই তো ছাড়পত্র মিস্টার গোস্বামী। ওরা সন্দেহ করেছে আর অনুমান করেছে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি। আর প্রেমে পড়ার একটামাত্র অর্থই ওরা জানে। কিন্তু আমি অনুরোধ করছি আপনি এখান থেকে পালান। মামাকে বলবেন, অফিসের দূরত্বের জন্যেই
প্রভাত আর একবার চেয়ে দেখে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ রাত্রির গভীরে আরও পরিস্ফুট হচ্ছে। মল্লিকাকে অলৌকিক দেখাচ্ছে।
ক্ষণপূর্বের কটু মন্তব্যের জন্য নিজেকে ধিক্কার দিল প্রভাত। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলল, কিন্তু গতকাল তো একথা হয়নি, আমি একা পালাব?
কাল আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এই নরকের মধ্যে আর শাসনের মধ্যে বাস করতে করতে মাঝে মাঝে বুদ্ধিবৃত্তি নষ্ট হয়ে যায়। তাই যা অসম্ভব
কিন্তু যদি আমি সম্ভব করতে পারি?
চেষ্টা করতে যাবেন না, মারা পড়বেন।
মল্লিকা, যদি আমি খোলাখুলি তোমার মামার কাছে প্রস্তাব করি আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই!
আর বুঝি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না মল্লিকা। বসে পড়ে বলে, আপনি–আপনি কি পাগল! এ প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে খুন হয়ে যাবেন, তা জানেন?
খুন!
তা না তো কি! জানেন না, বুঝতে পারেন নি, আমিই মামার শিকার ধরবার সবচেয়ে দামী টোপ!
বেশ, তবে লুকানো রাস্তাই ধরতে হবে। শুধু তুমি রাজী কিনা–
আমি রাজী কিনা–শুধু আমি রাজী কিনা!
একটা প্রবল বিক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে সহসা কি একজোড়া হিমশীতল সাপ এসে আছড়ে পড়ল প্রভাতের উপর? আর প্রভাতকে বেষ্টন করে ধরল দৃঢ় বন্ধনে?
কিন্তু নাগপাশের বিভীষিকা নিয়েও বন্ধন কেমন করে এমন আবেশময় হয়ে উঠতে পারে?
মল্লিকা!
.
চেষ্টার অসাধ্য কাজ নেই এ-কথাটা সব ক্ষেত্রে সত্য হয় কিনা জানি না, কিন্তু প্রভাতের পক্ষে হল।
ভালোমানুষ প্রভাত, মধ্যবিত্ত গৃহস্থমনা ভাত, অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে একটা অসাধ্যসাধনই করে বসলী
কিন্তু এই অসাধ্যসাধন কি সত্যিই প্রেমের আকর্ষণে?
প্রভাত এমন করেই একটা হোটেলওয়ালি মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল যে, ভয়ভাবনা ত্যাগ করে ফেলল? মস্ত একটা বিপদের ঝুঁকি নিতে পিছপা হল না?
মাত্র কয়েকটি দিনে এমন প্রেমের সৃষ্টি হওয়া সম্ভব? হয়তো তা নয়।
মল্লিকার রূপযৌবন একটা মোহের সঞ্চার করলেও, প্রভাতের ভদ্রচিত্তের কাছে সেই আবেদনই শেষ কথা হয়ে ওঠে নি।
মানবিকতার প্রশ্নটাও ছোট নয়।