এ কিসের ইঙ্গিত?
মল্লিকার করুণ অভিব্যক্তি আর ভয়াবহ ভাগ্যের পরিচয়ের সঙ্গে ওই হাসি আর প্রশ্নের সামঞ্জস্য কোথায়?
যথারীতি গণেশ এল।
প্রভাত বিনা প্রশ্নে চায়ের ট্রে-টা কাছে টেনে নিল। কিন্তু তবু চোখে না পড়ে পারল না কেমন একরকম তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে গণেশ।
কেন, ওরকম করে হাসছে কেন ও? ও কি ঘরে ঢুকেছিল? দীর্ঘ বেণী থেকে খসেপড়া কোনও দীর্ঘ অলক আর কোথাও কি চোখে পড়েছে ওর?
কোন বাক্যবিনিময় হল না অবশ্য। কিন্তু গণেশের ওই চোরা ব্যঙ্গের চাউনিটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে গেল।
আর একদণ্ডও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
.
কী হয়, ওই অফিস যাবার মুখেই যদি প্রভাত বিল মিটিয়ে দিয়ে মালপত্র নিয়ে চলে যায় ওবেলা আর আসব না বলে?
ভালোমন্দ যাই হোক হোটেল একটা জুটবেই। এরকম হিংস্র সুন্দরে তার দরকার নেই।
এর অন্তরালে কোথাও যেন বিপদের চোরা গহুর, এর শিরায় শিরায় যেন ভয়াবহ রহস্যের জাল পাতা।
চ্যাটার্জি লোকটা নোংরা নীচ ইতর কুৎসিত!
চ্যাটার্জির খদ্দেররা সৎ নয়। নির্ঘাৎ রাত্রে এখানে মাতলামি চলে, নোংরামি চলে, জুয়ার আড্ডা বসে। হয়তো বা কালোবাজারের হিসেবনিকেশ হয়, হয়তো খাদ্যে আর ওষুধে কী পরিমাণ ভেজাল দেওয়া সম্ভব, তারই পরিকল্পনা চলে।
চ্যাটার্জি এদের পালক, পোষক।
কী কুক্ষণেই স্টেশনে চ্যাটার্জির কবলে পড়েছিল প্রভাত! একবার ভেবেছিন্তে দেখল না, যার সঙ্গে যাচ্ছি, সে লোকটা কেমন!
কী নির্বোধ আমি!
কিন্তু শুধু কি ওইটুকু নির্বুদ্ধিতা! কী চরম নির্বুদ্ধিতা দেখিয়েছে কাল রাত্রে!
তুমি প্রভাত গোস্বামী, বিদেশে এসেছ চাকরি করতে। কী দরকার ছিল তোমার নারীরক্ষার নায়ক হতে যাবার? কোন সাহসে তুমি একটা অসহায় বন্দিনী মেয়েকে ভরসা দিতে গেলে বন্ধন মোচনের? যে মেয়ের রক্ষকই ভক্ষক!
জগতে এমন কত লক্ষ লক্ষ মেয়ে পুরুষের স্বার্থের আর পুরুষের লোভের বলি হয়েছে, হচ্ছে, হবে। যতদিন প্রকৃতির লীলা অব্যাহত থাকবে, ততদিনই এই নিষ্ঠুর লীলা অব্যাহত থাকবে।
প্রভাত কজনের দুরবস্থা দূর করতে পারবে? তবে কেন ওই মেয়েটাকে আশ্বাস দিতে গেল প্রভাত চরম নির্বোধের মত?
চলে যাবে। আজই। জিনিসপত্র নিয়ে।
তাকিয়ে দেখল চারিদিক।
কীই বা! এই তো সুটকেস, বিছানা, আর আলনায় ঝোলানো দুএকটা পোশাক! দুমিনিটে টেনে নিয়ে গুছিয়ে ফেলা যায়। টিফিন বাক্সটা তো জিপেই আছে।
মল্লিকা তো চোখের আড়ালে।
মল্লিকার সঙ্গে তো জীবনে আর চোখাচোখি হবে না।
.
আলনার জামাটায় হাত দিতে গেল, আর মুহূর্তে অন্তরাত্মা ছি ছি করে উঠল।
প্রভাত না মানুষ? ভদ্ররক্ত গায়ে আছে না তার?
অফিসে গিয়ে মনে হল, কাকিমার চিঠিটায় মল্লিকা সম্পর্কে দুলাইন জুড়ে দিয়ে পোস্ট করবে।
পকেট থেকে বার করতে গেল, পেল না। কী আশ্চর্য, গেল কোথায় চিঠিটা? নিশ্চিত মনে পড়ছে, কোটের পকেটে রেখেছিল।
কিছুতেই ভেবে পেল না, পড়ে যেতে পারে কি করে?
কোটটা হ্যাঙ্গার থেকে তুলে নিয়েছে, গায়ে চড়িয়েছে, গাড়ীতে উঠেছে, গাড়ী থেকে নেমে অফিসে ঢুকেছে। এর মধ্যে কী হওয়া সম্ভব?
চিঠিটা তুচ্ছ, আবার লিখলেই লেখা যায়, হারানোটা বিস্ময়কর।
কিন্তু আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করছিল প্রভাতের জন্য, তখনও জানে না প্রভাত। সে বিস্ময় তাকে স্তব্ধ করে দিল খাবারের কৌটো খোলার পর।
সিপাহী বিদ্রোহের সময় নাকি চাপাটি হয়ে উঠেছিল সঙ্কেত প্রেরণের মাধ্যম। ইতিহাসের সেই অধ্যায়টাই কি মল্লিকা কাজে লাগালো?
রুটির গোছর নীচে শাদা একটা কাগজের মোড়ক।
টেনে তুলল। খুলে পড়ল। স্তব্ধ হয়ে গেল।
দয়া করে রাত্রে জানলাটা খুলে রাখবেন।
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে ছিঁড়ে ফেলল টুকরোটা। না না না! কিছুতেই না!
এ কী কুৎসিত জালে জড়িয়ে পড়ছে সে!
মল্লিকা কী? ও কি সত্যি বিপন্ন, না মায়াবিনী?
ভদ্র মেয়ের এত দুঃসাহস হয়?
কিন্তু সেই কান্না? সে কী মায়াবিনীর কান্না?
রাত্রে প্রতিজ্ঞা করল, তবু বিচলিত হবে না সে। জানলা খুলে রাখবে না। কে বলতে পারে বিপদ কোন পথ দিয়ে আসে? তার কি মোহ আসছে?
মায়ের মুখ স্মরণ করল।
প্যাড টেনে নিয়ে চিঠি লিখতে বসল মাকে। লেখা চিঠিটা আজ আর কোটের পকেটে রাখল না, নিজের অফিসের ব্যাগে রেখে দিল।
নিশ্চিন্ত হয়ে শুলো।
কিন্তু ঘুমের কি হল আজ?
কিছুতেই যেন শান্তির স্নিগ্ধতা আসছে না! কী এক অস্বস্তিতে উঠে বসতে ইচ্ছে করছে!
পাখার হাওয়াটা যেন ঘরের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিছানায় উঁচ ফুটছে। মাথাটা ঝ আঁ করছে। জানলাটা একবারের জন্যে খুলে দিয়ে এই উত্তপ্ত বাতাসটা বার করে দিলে ক্ষতি কি?
মনস্থির করে উঠে বসল। জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুহূর্ত চিন্তা করে খুলে ফেলল ছিটকিনিটা, ঠেলে দিল কপাটটা।
হু হু করে স্নিগ্ধ বাতাস এসে ঢুকছে, জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুম এসে যাচ্ছে যেন।
আশ্চর্য, অন্য অন্য কটেজগুলোর জানলা সব খোলা! ওদের ভয় করে না? চোর, ডাকাত, বন্য জন্তুর?
প্রভাত ভাবল ওরা সকলেই অবাঙালী। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে বাক্সর মধ্যে ঘুমানোর কথা ভাবতেই পারে না ওরা।
প্রভাত কী ভীতু? থাক খোলা, কী হয় দেখাই যাক না!
কিন্তু কী দেখতে চায় প্রভাত?
দেখা গেল কিছুক্ষণ পরে।