- বইয়ের নামঃ জীবন-স্বাদ
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বদলী করে দিয়েছে
জীবন-স্বাদ – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
বদলী করে দিয়েছে, নতুন অফিসের কর্মভার গ্রহণের তারিখ নির্দেশ করে দিয়েছে, দেয়নি শুধু বাসার আশ্বাস।
বাঙালীর ছেলে পাঞ্জাব-সীমান্তের একটি মফঃস্বল শহরে, যেখানে অন্তত তিনশ মাইলের মধ্যে কোনও আত্মীয়ের ছায়ামাত্র নেই, সেখানে হঠাৎ গিয়ে পড়ে যথাসময়ে কাজে যোগ দেবার অসুবিধেটা কতদূর সেকথা বোঝবার দায় সরকারের নয়।
চাকরি নেবার সময় বন্ডে সই করনি তুমি, যে-কোন জায়গায় যেতে প্রস্তুত? মনে নেই সেকথা?
সরকার কি বন্ডে সই করেছিল, যখন যে দেশে পাঠাবে তোমাকে, তোমার জন্যে ঘর সাজিয়ে রাখবে? তুমি তো তুমি নেহাৎ চুনোপুঁটি না হও চিংড়ি-চিতলের চাইতে বেশিও নও। বলে কত রুই-কাতলাই বদলী হয়ে পরের বাসায় নাক খুঁজে থেকে দিন কাটাচ্ছে, কাপড়ের তাঁবুতে স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে সংসার পেতে বসেছে!
তবু তো তুমি প্রভাত গোস্বামী, ঝাড়া-হাত-পা মানুষ। না স্ত্রী, না পুত্র, না ডেয়ো, না ঢাকনা। একটা সুটকেস, একটা বেডিং, একটা জলের কুঁজো, একটা টিফিন-কেরিয়ার, সর্বসাকুল্যে এই তো তোমার সম্পত্তি। এতেই ভাবনায় অস্থির?
তা সত্যি বলতে প্রভাত একটু বেশিই ভাবছে। তার কারণ এযাবৎ নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেওয়ার অবস্থা ওর কখনো ঘটেনি। হাওড়ায় দেশের বাড়ীতে বাড়ীর ছোটছেলের প্রাপ্য পাওনা পুরোদস্তুর ভোগ করেছে, চাকরির প্রথম কালটা কাটিয়ে এসেছে লক্ষ্ণৌতে কাকার বাড়ী। কাকাই চাকরির জোগাড়দার। তিনি কী অফিসে, কী বাসাতে সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখে আসছিলেন ভাইপোর সুবিধে স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে। কিন্তু বিধি হল বাদী।
বদলীর অর্ডার এল।
প্রভাতের মা অবশ্য খবরটা শুনে ভেবে ঠিক করে ফেললেন, এ নিশ্চয় ছোট বৌয়ের কারসাজি, বরকে বলে-কয়ে ভাসুরপোর বদলীর অর্ডার বার করিয়ে দিয়েছে, কারণ–
কারণ আর নতুন কি, বলাই বাহুল্য, পর নিয়ে ঘর করায় অনিচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়।
খুড়ি বরং চেষ্টা করছিলেন, সামনে পূজোর ছুটিতে নিজের বিয়ের যুগ্যি বোনঝিটিকে নিজের কাছে আনিয়ে নেবেন, এবং অদূর ভবিষ্যতে দিদির কাছে ঘটকীবিদায় আদায় করবেন।
কিন্তু হল না।
জগতের বহুবিধ সাধুইচ্ছের মত সে ইচ্ছেটা আপাতত মুলতুবি রাখতে বাধ্য হতে হল তাকে। বদলিটা পূজো পর্যন্ত ঠেকানো গেল না। পূজোর ছুটিতে চলে আসবার জন্যে বারবার অনুরোধ জানিয়ে কাকা-কাকী বিদায় দিলেন। প্রভাত সেই বিষণ্ণ আদ্রতার ছোঁয়ার সঙ্গে নিজের অসহায়তার ভয়াবহতা মিশিয়ে চিত্তকে বেশ ঘনতমসায় আবৃত করে গাড়ীতে উঠল।
আর বেচারা হতভাগ্যের ভাগ্যে সঙ্গে সঙ্গেই সুরু হয়ে গেল প্রবল বর্ষণ।
সারারাত্রি ঠায় জেগে কাটিয়ে দিল প্রভাত, বন্ধ কামরার মধ্যে বৃষ্টির শব্দের প্রচণ্ডতা অনুভব করতে করতে। গাড়ীতে আরও তিনজন আরোহী ছিলেন, তাঁদের প্রতি ঈর্ষাকুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রভাত নিশ্চিত হল আর যাই হোক, ওরা কেউ বদলী হয়ে যাচ্ছে না।
তবে বৃষ্টির আওয়াজ একটু উপকার করল প্রভাতের। তিন দিক থেকে তিনটি নাকের আওয়াজ তার কর্ণকুহরকে শিহরিত করতে ততটা পেরে উঠল না। কানের থেকে মনটাই তার কাছে প্রধান হয়ে রইল।
স্টেশনে যখন নামল প্রভাত তখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু শেলেটপাথরের মত আকাশের নীচে পৃথিবীটা যেন শোকগ্রস্তের মত জড়পুটুলি হয়ে পড়ে আছে।
ভেবেছিল কুলিও পাওয়া যাবে কিনা। কিন্তু আশঙ্কা অমূলক, কুলি যথারীতি গাড়ী থামবার আগেই গাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়ে প্রভাতের অনুমতি ব্যতিরেকেই তার জিনিসপত্র টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে ফেলল এবং কোথায় যাবেন ও গাড়ী হবে কিনা শুধিয়ে মুখপানে তাকিয়ে রইল।
আর ঠিক এই মুহূর্তে–এই ভয়াবহ সঙ্গীন মুহূর্তে ঘটে গেল এক অদ্ভুত অঘটন।
সেই অঘটনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রভাতকে স্বীকার করতেই হল কলিতে ভগবান নেই, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। ভগবান আছেন, এবং আর্তের আকুল আবেদন তার কানে এক-আধ ক্ষেত্রেও অন্তত পৌঁছায়।
আর পৌঁছালে আত্রাণকল্পে দূতও পাঠান তিনি।
সেই দূত হিসাবে এসে দাঁড়ালেন একটি আধবয়সী ভদ্রলোক, ও অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, একটি রীতিমত রূপসী তরুণী। খুব সম্ভব পিতা-কন্যা।
প্রভাতের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক দরাজগলায় বলে উঠলেন, কোথায় উঠবেন?
প্রভাত প্রথমটা থতমত খেলো। এমন পরিচিত ভঙ্গীতে যিনি প্রশ্ন করলেন, তিনি পূর্বপরিচিত কিনা স্মরণ করতে চেষ্টা করল, তারপর সচকিত হল। পরিচিত নয়। কিন্তু একটি রূপসী তরুণীর সামনে বুদ্ধ বলে চুপ করে থাকার লজ্জা বহন করা চলে না। তাই মৃদু হেসে বললে, ঠিক এই মুহূর্তে নিজেকেই ওই প্রশ্ন করছিলাম!
বুঝেছি। সবজান্তার ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে ভদ্রলোক কন্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে হেসে বলেন, বলিনি তোকে? মুখ দেখেই বুঝেছি বাসার ব্যবস্থা হয়নি! নতুন বদলী হয়ে এলেন বোধহয়? ওপরওলাদের আক্কেল দেখছেন তো? বদলী করেই খালাস। সে ওঠে কোথায়, খায় কি, তার দায়িত্ব নেই। পাঁচ বছর ধরে শুনছি মশাই, গভর্ণমেন্ট কোয়ার্টার্স তৈরী হবে। তা সে শোনাই সার। ছেলেবেলায় শুনতাম আঠারো মাসে বছর, এখন দেখছি ছাব্বিশ মাসে–