Site icon BnBoi.Com

উত্তরণ – আশাপূর্ণা দেবী

উত্তরণ - আশাপূর্ণা দেবী

১. দোতলা আর তিনতলা

উত্তরণ – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

ওদের দোতলা আর তিনতলার সব আলো নিভে গিয়েছিল তখন। ঘরের দালানের সিঁড়ির। বেশ কিছুক্ষণ আগেই গিয়েছিল। এমন কি কৌশিকের দাদা কৌস্তুভের বেশী রাতে পড়াশোনার ভারী শেড দেওয়া টেবল ল্যাম্পের আলোর রেশটাও দেখা যাচ্ছিল না আর গ্যারেজের মাথার নীচু ঘরটার জানলা দিয়ে।

শুধু নীচের তলায় রান্নাঘরের আলোটা তখন জ্বলছিল তার স্বল্পশক্তি নিয়ে।

সব দিকের সব কাজ মিটিয়ে বংশী রান্নাঘর ধাওয়া মোছা করে রাখছিল আগামী সকালের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে। মাঝরাত পর্যন্ত না খেটে এখন উপায় নেই বংশীর। রান্নার লোকটা চলে গেছে কৌশিকদের, প্রায় মাসখানেক হতে চলল। বেচারা বংশীই এখন একমেবাদ্বিতীয়।

বাড়িতে আর কাজ করবার মত আছে কে?

সুলক্ষণা-কৌশিক কৌস্তুভ আর সুদক্ষিণার মা সুলক্ষণা, বিধবা হয়ে অবধি মাছ-মাংস ছোঁয়া ত্যাগ করেছেন, নিজের সামান্যতম রান্নাটুকু করে নেওয়া ছাড়া রান্নার দিকে আর কিছু হয় না তার দ্বারা।

সুদক্ষিণা তো আছে নিজেকে নিয়ে।

কলেজ, কোচিং ক্লাস, গানের স্কুল সব কিছু সামলে মরবার সময় নেই তার।

বাকী ওর বৌদি।

কৌস্তুভের স্ত্রী অপর্ণা।

ঘর-সংসারের বেশীটা দায়িত্ব যার নেবার কথা। তা যার যা দায়িত্ব নেবার কথা, সে যদি তা নিতে পারে, সংসারে তো সমস্যা বলে কিছুই থাকে না। কিন্তু সংসারে সমস্যা আছে, থাকে। এদের সংসারে আসল জায়গাতেই শূন্যতা।

অপর্ণা কোনদিন সুলক্ষণার ডান হাত হয়ে উঠতে পারল না। পারল না সংসারের কোন দায় ঘাড়ে নিতে। অপর্ণা চিররুগ্ন। বিছানায় পড়ে না থেকে অপর্ণা যেকদিন এঘর-ওঘর করে বেড়াতে পারে, শোবার ঘরে না খেয়ে খাবার ঘরে এসে খায় সে-কদিন এদের উৎসবের দিন।

অপর্ণা যদি কোনদিন কৌস্তুভের জামায় একটা বোম বসিয়ে দেয়, কৃতার্থ হয়ে যায় সংসার। অপর্ণা যদি একদিন চাদানী থেকে চা ঢালতে যায়, বাড়িসুষ্ঠু সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে তুমি কেন, তুমি কেন বলে। অপর্ণা যে বেঁচে আছে, এটাই যেন সংসার পাওনার অতিরিক্ত পাচ্ছে।

অতএব পুরনো চাকর বুড়ো বংশী ছাড়া আর কে? তাই সবাই যখন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি দেখি করছিল, বংশী তখন সকালের রসদ জোগাচ্ছিল।

রোজই তাই করে।

কিন্তু কই, কোনদিন তো আচমকা এমন আর্তনাদ করে ওঠে না বংশী! আর্তনাদটা যে অস্বাভাবিক, আর মাত্রা ছাড়ানোতাতে যে সন্দেহ নেই, তার প্রমাণ কৌশিকের ছুটে আসা। ঘুম সম্পর্কে কৌশিকের একটা বিশেষ সুনাম আছে, তা ছাড়া সে তিনতলায় শোয়। চিৎকারটা অতএব সেখানেও গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে।

দোতলার প্রশ্ন তোলা নিষ্প্রয়োজন।

ঘুমছোটা চোখ নিয়ে ওরা ছুটে এল দোতলা থেকে, তিনতলা থেকে অপর্ণাও ডাক্তারের নিষেধ ভুলে সিঁড়ি নামল। না নেমে থাকতে পারবে কেন?

কে বলতে পারে বংশীকে সাপে কামড়েছে, না ডাকাতে ছোরা মেরেছে!

কি!

কি!

কি হয়েছে!

একযোগে সকলের মুখ থেকে উচ্চারিত হল প্রশ্নটা। কিন্তু উত্তর শোনবার আর প্রয়োজন হল না। উত্তর ওরা দেখতে পেল সবাই।

সাপ নয়! ডাকাত নয়! চোর।

চোর পড়েছে বাড়িতে, এই নিশুতি রাতের সুযোগে। তবে ধরাও পড়েছে বংশীর কাছে।

.

বাড়িতে চোর পড়া এমন কিছু নতুন কথা নয়, চোর ধরা পড়াও খুব একটা অসম্ভব নয়। কিন্তু মেয়ে চোর ধরা পড়ার মত ঘটনা সচরাচর ঘটে না!

সেই অঘটন ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তের জন্য বরফ হয়ে গেল সকলেই। অবশ্য মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই সুলক্ষণা ধিক্কার দিয়ে উঠলেন, এই বংশী, ছিঃ!

সুলক্ষণার এই ধিক্কারে বোধকরি বংশীর চেতনা এল, নিজের প্রতি লক্ষ্য পড়ল, আর হুঁশ হল ওই কমবয়সী মেয়েটাকে সে একেবারে বাহুবন্ধনে বন্দী করে বুকে সাপটে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটার ক্রুদ্ধ ঝটপটানিতেও বন্ধন শিথিল করছে না।

বন্ধনটা শিথিল করে দিল বংশী।

এখন পৃষ্ঠবল আছে।

এখন ওই চোর মেয়েটার পালাবার পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে দুদুটো পুরুষ। অতএব এখন বংশী দায়িত্বমুক্ত। এখন মুখটাকে যতটা সম্ভব করুণ আর গলাটাকে যতটা সম্ভব বাষ্পচ্ছন্ন করা চলে। বংশীর পক্ষে ওই যতটা সম্ভব দুটো করে বংশী হাতের ওপর হাত বুলোত বুলোতে ক্ষুব্ধ গলায় বলে, বংশীর তো সবই ছিঃ! আর হারামজাদা মেয়েটা যে আমার হাতখানা কামড়ে নিল কুকুরের মতন, তা তো কেউ

কামড়ে!

কামড়ে নিয়েছে।

বংশীর সেই বিকট আর্তনাদের রহস্য ভেদ হল।

সুলক্ষণা মুখ ফিরিয়ে হাসি গোপন করলেন, সুদক্ষিণা প্রায় ধমকে উঠল, অসভ্যর মত খারাপ কথা বলিস না বংশী! আর কৌশিক ছাড়া পাওয়া প্রাণীটার দিকে একটা তীব্র দৃষ্টি হেনে নিয়ে বলে উঠল, মানুষের দাঁতের বিষও বাঘ ভালুকের থেকে কিছু কম বিষাক্ত নয়রে বংশী। শীগগির চলে আয় আমার সঙ্গে, ডেটল লাগিয়ে নিবি।

.

ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা একবার চারিদিকে তাকিয়েছিল ছুটে পালাবার জন্যে, দেখেছে পথ বন্ধ। যেখান দিয়ে ঢুকেছিল, উঠোনের সেই ছোট দরজাটা, যেটা জঞ্জাল ফেলে এসে বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে বংশী ওর খুবই সুবিধে করে দিয়েছিল, ঠিক তার সামনাসামনি দালানের দরজায় বংশীর বিশাল বপুখানি দেদীপ্যমান।

কাজেই চেষ্টা করা পাগলামি বুঝেই মেয়েটা ঘাড় গুঁজে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। কৌশিকের এই মন্তব্যে একবার চোখ তুলে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিল।

কৌশিক মনে মনে বলল, ওঃ খুব যে তেজ। ভস্ম করে ফেলবে যেন। তবু যদি না ভদ্রঘরের মেয়ে হয়ে পরের বাড়িতে চুরি করতে আসতিস।

মনে মনে তুই বলতে দোষ নেই। ভাবল কৌশিক, সবাইকেই বলা চলে। আর এ তো চোর। না, বাংলায় এম. এ. হলেও চট করে চোরের স্ত্রীলিঙ্গ খুঁজে পেল না কৌশিক।

কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়ে ধরে নিল কেন তাকে এরা? একা কৌশিক নয়, সবাই। পুরোপুরি পাকা চোরের মত রাতের অন্ধকারে যে বাসন কাপড় চুরি করতে আসে, তাকে ভদ্রঘরের মেয়ে ভাবার হেতুটা কি? ওর মুখ চোখ ভঙ্গী?

তা ও-রকম মুখ চোখ কি এতই দুর্লভ? রঙ তো বেশ ময়লাই। একটু টিকলো নাক, একটু সুগঠিত ঠোঁট এ তো কত শাকওলি মাছওলিদেরও থাকে।

থাকে।

কিন্তু ওই বিশেষ ভঙ্গীটা তাদের থাকে না বোধ করি। তাই সকলেই মনে মনে ভাবল, ছি ছি, ভদ্রঘরের মেয়ে, এই বয়সের মেয়ে হয়ে কিনা এতটা অধঃপাতের পথে নেমেছে?

অধঃপাতের একটা পথ মেয়েমানুষের জন্যে চিরনির্দিষ্ট আছে, সভ্যতার আদিযুগ থেকে আছে। সে পথে রাজা মন্ত্রীর ঘরের মেয়েকে দেখলেও কেউ অবাক হয় না, ভট্টচার্যির ঘরের মেয়েকে দেখলেও বিচলিত হয় না। জানে, এমন হয়েই থাকে।

কিন্তু এ যে অধঃপাতের অন্য আর একটা শাখা-পথ। এটা তো পুরুষের জন্যেই একচেটিয়া ছিল। তাই এ পথে ওকে দেখে সকলেই অবাক হচ্ছে, বিচলিত হচ্ছে।

.

কৌশিক ডেকেছিল, কিন্তু বংশী নড়ার নাম করেনি। কৌশিক আবার একটা কড়া কটাক্ষ করে তাড়া দেয় বংশীকে, এই বংশী, মরতে না চাস তো চটপট আয়। বিষ শরীরে চারিয়ে গেলে–

শরীরে বিষ চারিয়ে যাবার ভয়ঙ্কর ভয় সত্ত্বেও বংশী নির্বিকার কণ্ঠে বলে, সে যাক! এই সর্বনাশী মেয়েটা যাতে না হাওয়া হয়, সেটা দেখতে হবে তো?

হাওয়া হবে? সুলক্ষণা এবার কথা কন, আমার চোখের সামনে থেকে যদি হাওয়া হতে পারে তো সেই বাহাদুরির জন্যেই সাত খুন মাপ হওয়া উচিত ওর। দেখছি আমি ওকে। যা, তোরা শুতে যা।

শুতে যাব? আমরা শুতে যাব? সুদক্ষিণা ঠিকরে ওঠে, পুলিসে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না ওকে?

পুলিসে? সুলক্ষণা হাসেন, তবে তাই কর তোরা, আমিই নিশ্চিন্দি হয়ে শুতে যাই।

পুলিসে দেওয়া হবে না? বংশী ক্ষেপে.ওঠে, পুলিস এসে ওর ওই দাঁতের পাটি যদি না ভাঙল তো হলটা কি?

হল আর কি-কৌশিক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে বলে, তোমার রক্ত বিষিয়ে মৃত্যু, আর মার অপাত্রে দয়া প্রদর্শন। থানা পুলিসের কথা চিন্তা না করে তোর এখন হাসপাতালের কথা চিন্তা করা উচিত বংশী, কিন্তু নইলে বলা যায় না, হয়তো অদৃষ্টে তোর মৃত্যু আছে।

হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে।

হ্যাঁ, তা কাণ্ডই বৈকি। এমন অপ্রত্যাশিত ব্যাপার কে আশা করেছিল? ঘাড়গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা আসামী হঠাৎ মুখ তুলে বলে ওঠে, মানুষের দাঁতেই যে শুধু বিষ থাকে তা নয়, দেখছি। জিভেও কম বিষ থাকে না!

এ কী দুঃসাহস!

যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর প্রত্যেকেই কী যেন একটা বলতে গেল, আর কাউকেই কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে সুলক্ষণা ঈষৎ কঠিন সুরে বলে উঠলেন, বৃথা কথা বাড়াচ্ছিস কেন তোরা? তুচ্ছ একটা কারণে বাড়িসুষ্ঠু সবাই রাত জেগে রথ দোলের ভিড় করবি নাকি? বৌমা, তুমি আবার নেমে এসেছ কেন বাছা? এক্ষুনি হয়তো বুকের কষ্ট হবে। যাও যাও, শুয়ে পড়গে! খোকা, যা বৌমাকে ধরে ধরে নিয়ে যা সাবধানে।

কৌস্তুভকে সুলক্ষণা খোকাই বলেন চিরকাল। যদিও তিনি মুখে বলেন, খোকা না বলে ওকে আমার জ্যেঠামশাই বললেই ভাল মানায়।

বাস্তবিক ভারী ধীর স্থির গম্ভীর আর বিজ্ঞ সুলক্ষণার এই বড়ছেলে।

তবে– আড়ালে সুদক্ষিণা বলে, একটু যা স্ত্রৈণ।

সুলক্ষণা মেয়ের এই বাঁচালতায় তাড়া দেন। বলেন, ফাজলামির মাত্রা রাখতে হয় ক্ষে। স্ত্রৈণই যদি হয় তো, সে তোদের দাদা সাধে হয়নি। ওই বৌকে রাতদিন আঙুরের বাক্সয় তুলো পেতে না রাখলে? খোকার অতটা যত্ন আছে বলেই না বৌমা তবু একটু হেঁটে নড়ে বেড়ায়। তা নইলে বিছানায় পিঠে এক হয়ে ছাতা ধরত।

সুলক্ষণার এ মন্তব্য বাহুল্য আদৌ নয়। সত্যিই এতটা যত্ন চিকিৎসা না পেলে, অপর্ণার শরীরের অবস্থা কী হত বলা শক্ত। কিন্তু অপর্ণা প্রয়োজনের দশগুণ বেশী যত্ন আদর পায়, সেবা চিকিৎসা পায়। একা স্বামীর কাছেই নয়, সবাইয়ের কাছেই পায়। ছেলের মধ্যে ঔদাসীন্যের নামমাত্র নেই, তবু সুলক্ষণা বলেন, অ খোকা, বৌমা ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি তো? ঘুম ভেঙে একলা রয়েছে হয়তো বলেন, অ খোকা, ডাক্তারবাবু যেন কদিন আসেননি মনে হচ্ছে? খবর দিল একবার।

কৌশিক শুনতে পেলে হাতজোড় করে বলে, মাগো দোহাই তোমার, সেই যে কি বলে, মা মনসায় ধুনোর গন্ধ না কি, সেটা আর অত দিও না তুমি! ভদ্রমহিলাকে দুএকটা দিনও একটু সুস্থ থাকতে দাও।

সুলক্ষণা মৃদু হেসে বলেন, কিসে সুস্থ থাকে, আর কিসে সুস্থ থাকে না, তুই জানিস ভূতটা?

কিন্তু সুলক্ষণাই কি সবটা জানেন?

কই, উনি তো বুঝতে পারলেন না, এখন অপর্ণার আদৌ এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না। খুব ইচ্ছে করছিল ওই চোর মেয়েটাকে কী প্রকার শাসন করা হয়, তাই দেখতে!

বুঝতে পারলেন না, তাই বললেন, খোকা, ওকে সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে যা।

চোখের কোণায় এক ঝলক জল এসে পড়ল অপর্ণার, অভিমানে না অপমানে কে জানে, তবু নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি উঠতে লাগল এক পা এক পা করে।

কৌস্তুভও সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল তার পিঠে হাতটা ঠেকিয়ে। শুধু যাবার সময় মাকে উদ্দেশ করে বলল, তুমিও বেশী কষ্ট পেও না মা, যা পারে বংশী করুক।

যা পারে বংশী করুক।

তার মানে? মেয়েটাকে ধরে মারুক বংশী, না কি? বংশী ওর বেশী আর কি, ও ছাড়া আর কি পারবে? দু ঘা মেরে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া?

সুদক্ষিণা কুদ্ধস্বরে বলে ওঠে, হয়ে গেল বাড়ির কর্তার রায় দেওয়া! এবার কর্তার মা কি বলেন দেখি! চোর ধরা পড়লে পুলিস ডাকে না, এমন বাড়িও যে থাকে তা এই আজ দেখছি!

তোরা যাবি?

সুলক্ষণা প্রায় ধমকে ওঠেন, মশা মারতে কামান দাগার প্রবাদটা যে তোরা সত্যি করে তুললি দেখছি!

মশা! সুদক্ষিণা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, এই সব মশামারি পিছনে কত কত বাঘ সিংহীর গ্যাং থাকে জানো তুমি?

সুলক্ষণা যেন মেয়ের এই রাগের বহরে কৌতুক অনুভব করেন। সেই কৌতুকের স্বরেই বলেন, কি করে জানব বল, তোদের মতন তো রাতদিন ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়ছি না। আমার বুদ্ধিতে যা কুলোয় তাই করব।

চলে আয় ক্ষেণু, কৌশিক বড় একটা মোচড় দিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলে, পরিণতি বুঝতেই পারছি। স্রেফ সদর দরজাটি খুলে সসম্মানে বিদায় দেওয়া। আহা উঠোনের ওই শ্যাওলার ওপর দিয়ে কত শ্রম স্বীকার করে এসেছেন মহিলাটি, তা তার আগে বোধ হয় অতিথি সৎকার পর্বটাও ভালই হয়ে যাবে। চল, চল! মা আমাদের উপস্থিতিতে মিটসেটা খুলতে পারছেন না। সকালের জন্যে তোমার কি মজুত আছে মা? রাজভোগ? চমচম্? কেক? ডালমুট?

সুলক্ষণা হেসে ফেলে বলেন, তুই যাবি?

এই তো চলে গেছি।

সুদক্ষিণাও যায়, কিন্তু ওদের মত ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে না। সিঁড়ির ওপরকার ল্যান্ডিঙে বসে থাকে কোণ ঘেঁষে। যাতে নীচের তলার কথাবার্তা শোনা যায়।

কিন্তু সুলক্ষণা হচ্ছেন সুদক্ষিণার মা। বুদ্ধিতে ওর চেয়ে তিনি কাঁচা হবেন এমন আশা নিশ্চয়ই করা যায় না। তাই মেয়েটার হাত চেপে ধরে সরে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকে দৃঢ়স্বরে উনি বলেন, নাম কি তোর?

.

নাম কি তোর!

পাকা বুদ্ধি সুলক্ষণা কি আশা করছেন জিগ্যেসমাত্র উত্তর দেবে সে, নাম কি, বাড়ি কোথায়, বাপ কি করে, বংশপরিচয় কি রকম!

না, তা হয়তো আশা করেননি, তবু কথার মাত্রা হিসেবেই প্রশ্ন করেন, নাম কি তোর?

মেয়েটা জ্বালাভরা চোখ দুটো তুলে, রূঢ় গলায় উত্তর দেয়, নামের কি দরকার আপনার? পুলিসে দেবেন তো দিন, চাকর দিয়ে মার খাওয়াতে হয় তো তাই মারুন।

এতক্ষণে সুলক্ষণার মুখে রাগের ছাপ পড়ে।

গলায় বিরক্তির সুর ফোটে।

বলেন, দেখে তো অন্তত একটু ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল, কথাবার্তা তো তেমন নয়? শুধু চোরই নয়, ভারী অসভ্যও দেখছি।

মেয়েটা কিন্তু এ ধিক্কারেও বিশেষ দমে না, তেমনি গলাতেই বলে, চুরি করতে এসেছি, তবু ভদ্রঘরের মেয়েই বা আমায় ভাবছেন কেন?

ভাবছিলাম তোর চেহারা দেখে। চুরি অমন অনেকেই করে অভাবে পড়ে। ভিক্ষে করতে বাধলে চুরি করে বসে। কিন্তু কথাবার্তায় কিছুটা সভ্যতা রাখ। নাম কি বল্? চুরি করবার মতন এমন কি তোর অভাব পড়ল ব? পেছনে বাঘ সিংহীর দল আছে কিনা তাও বল্।

মেয়েটা এবার রূঢ়তা ছেড়ে বিদ্রূপ ধরে।

অতবড় মানুষটা বলে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করে না, বলে ওঠে, কেন, ভুলিয়ে-ভালিয়ে দলের নাম বার করে নিয়ে তবে আমায় পুলিসে দেবেন?

সুলক্ষণা নির্নিমেষনেত্রে ওর মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে বলেন, আমার বড় বড় ছেলেরা পর্যন্ত আমায় কত ভয় করে, জানিস?

জানতাম না। দেখলাম।

তবে? তুই আমার বাড়িতে চুরি করতে এসে আমায় অগ্রাহ্য করবি? বাড়ির নিয়ম উলটে দিবি? আমায় ওদের কাছে খেলো করবি? নাম বল্।

মেয়েটা এবার হঠাৎ মাথাটা হেঁট করে।

তারপর ঈষৎ ভাঙা গলায় বলে, চৈতালী!

চৈতালী? ও বাবা, এ যে একেবারে কবিতার পাতা থেকে ঝরে পড়ল! এবার বিদ্রুপের পালা সুলক্ষণার, এত বাহারি নামটি কে রেখেছিল? নাম যে রেখেছিল, সে বুঝি নামকরণ করেই মরে গিয়েছিল? তাই তারপর নামের আর কোনো দায়িত্ব নিতে পারেনি?

মেয়েটা ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, ঠিকই বলেছেন। শুনতে পাই জন্মাবার আগেই মা নামকরণটা করে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, চৈত্র মাসে জন্মাবে, ছেলে হলে নাম রাখবো চৈৎ সিং, মেয়ে হলে চৈতালী! তা মেয়ে কি ছেলে, সে আর নাকি বুঝেও যাননি। অজ্ঞানের মধ্যেই

সুলক্ষণা একটু থতমত খান।

নেহাতই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যে প্রশ্নটা করেছিলেন, তার এমন একটা উত্তর পাবেন ভাবেননি। এবার একটু শান্ত কোমল স্বরে বলেন, তোর সব পরিচয় আমায় খুলে বল্ দিকি? শুনি কার প্ররোচনায় পড়ে এই বয়সে

বংশী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হতাশ-চোখে দুই হাতের তেলো উলটে পরমহংসের ভঙ্গী করে বোধ করি বাকী কাজ সারতেই চলে যায়।

অপর্ণা শোবার ঘরে গিয়ে খাট পর্যন্ত না এগিয়ে দরজার সামনে রাখা সরু ডিভ্যানটায় বসে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, আশ্চর্য, সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে চলে এলে তোমরা!

কৌস্তুভ ব্যস্ত হয়ে পাখার রেগুলেটারটা ঠেলে দিয়ে, আর স্ত্রীর হাতের কাছে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলে, পরে কথা বোলো, আগে একটু সুস্থ হয়ে নাও।

অগত্যা জল খেয়ে আর পাখা খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে অপর্ণা বলে, কি করে যে ওকে একা মার কাছে রেখে চলে এলে

বংশী তো রয়েছে।

বংশী তো ভারী! বুড়ো একটা! আর একটু হাঁপিয়ে নিয়ে অপর্ণা বলে, যদি কোথাও ছোরা লুকনো থাকে? যদি বাইরে ওর দল থাকে? ভেবে ভয়ে আমার বুকের মধ্যে কি রকম যেন করছে।

কৌস্তুভ ওর ভয় নিরাকরণের জন্যে নীচে নেমে যায় না, বুকে হাত বুলিয়ে বুকেরই চিকিৎসা করতে থাকে।

.

সুদক্ষিণা বসে থেকে থেকে খানিক পরে বিরক্ত হয়ে উঠে এসে তিনতলায় গিয়ে বলে, ছোড়দা ঘুমোলি?

নাক ডাকাচ্ছি।

মার এই অসমসাহসিকতার অর্থ কি বলতে পারিস?

কে জানে বাবা! পূর্বকালের কোন সইয়ের কি গঙ্গাজলের মেয়ে কিনা তাই বা কে জানে? দেখে মনে হল অনেক দিনের অদেখা বোনঝি পেলেন বুঝি একটি!

থাম! ঘটনাস্থলে যাই চল্। …

পাগল হয়েছিস? এই তিনতলায় উঠে এসে আরামে শুয়ে পড়ে, আবার?

তা তো বলবিই তুই, কুম্ভকর্ণের অবতার! যদি ওর সঙ্গে ছোরা-টোরা কিছু থাকে?

থাকে শ্রীমতী সুলক্ষণা দেবীর বুকে বিদ্ধ করে পালিয়ে যাবে। আমরা তিনটি অনাথ শিশু মাতৃহীন হব, কাগজে এই লোমহর্ষক হত্যাকাহিনী ছাপা হবে

আঃ ছোড়দা! ন্যাকামি করিস না, চল বলছি।

ইচ্ছে হয় তুই যা না! আমি গিয়ে শেষে বংশীর মতন কামড় খাই আর কি!

আর আমি মার বারণ না শুনে আবার নীচে নামলে ওই বিচ্ছিরীটার সামনে মার কাছে ধমক খাই যদি? তুই সঙ্গে থাকলে তবু একটু বুকের বল–

কৌশিক বালিশটা উলটে-পালটে ঘাড়ের তলায় জুত করে গুঁজে দিয়ে বলে, কেন ফ্যাচফ্যাচ করছিস? দেখলি না একটা ভদ্রলোকের ঘরের সাধারণ মেয়ে। ডাকাতও নয়, গুণ্ডাও নয়। হয়তো নেহাতই অভাবের জ্বালায়, না হয় তো কারুর প্ররোচনার ঠেলায় মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়েছে।

উঃ! একেবারে গণকার!

আচ্ছা দেখিস, শেষ পর্যন্ত আমার গণনা সত্যি হয় কি না।

তা কৌশিকের গণনা অনেকটাই সত্যি।

সুলক্ষণারও।

যতই জীর্ণ বিবর্ণ শাড়ী হোক, তবু চৈতালীর সে শাড়ী স্কুল কলেজের মেয়েদের মত ঘুরিয়ে পরা, যতই রুক্ষ জট-পাকানো চুল হোক তবু সে চুল দুটো বেণী করে দু কাঁধে ফেলা, আর যতই শীর্ণ হোক, তবু মুখে একটা বুদ্ধিমার্জিত লাবণ্য। এ মেয়ে অনেক দিনের পাকা অপরাধী নয়, এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন সুলক্ষণা। কেন কে জানে, যে মেয়েটা রাতের অন্ধকারে তার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল, আর তার নিজেরই ব্যবহারের রুপোর গ্লাসটা আর বাটি দুটো নিয়ে পালাচ্ছিল, তার ওপর কেমন একটা মমতা অনুভব করছিলেন সুলক্ষণা। তাই ওর কথার মাঝখানে সত্যিই মিষ্টি খেতে দিয়ে জল দিলেন ওকে। ঈষৎ হেসে বললেন, ভয় নেই, বিষের নাড় নয়। খা, খেয়ে বাকী কথা বল্।…মাসীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসে তোর উচ্ছন্ন-যাওয়া বাপটা যখন তোকে তার আড্ডায় এনে ফেলল, তখন কত বয়েস তোর?

আট!

তা বলি উচ্ছন্ন তো গেছল সে, সুলক্ষণা সহসা স্বর কঠোর করে বলেন, চোর-ছ্যাচোড়দের দলে এনে ফেলে সবদিকে নষ্ট করেনি তো তোকে? মেয়ে বেচে খায়, এমন লোকেরও তো অভাব নেই জগতে? সেইটাই জিজ্ঞেস করছি।

চৈতালী মুখ তুলে পরিষ্কার চোখে স্থির গলায় বলে, না, বরং বাঘের মত আগলে রাখে।

আর এই যে রাতদুপুরে ছেড়ে দিয়েছে?

চৈতালীর এতক্ষণকার শুকনো চোখ দুটো এই তুচ্ছ কথায় সহসা জলে ভরে যায়। মাথা নীচু করে আস্তে বলে, বাড়িতে নেই, হাসপাতালে আছে।

হাসপাতালে!

হ্যাঁ, খুব অসুখ। দলের একজনের সঙ্গে ঝগড়া করে মাথা ফাটিয়েছিল, ধরা পড়বার ভয়ে ডাক্তার দেখায়নি, তারপর বিষিয়ে গিয়ে

সুলক্ষণা একটু চুপ করে থেকে বলেন, নাম কি বাপের?

তা বলতে পারবো না।

বলতে পারবি না? ধরা পড়ার ভয়? আর ওই যে হাসপাতালে গেছে?

অন্য নামে। দলের লোকেরা অন্য নাম দিয়ে ভর্তি করে দিয়ে এসেছে। এখন বলছে ইজেকশন দিতে হলে বাড়ি থেকে খরচা দিতে হবে!

সুলক্ষণা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, তাই বুঝি খরচ জোগাড় করতে বেরিয়েছিলি?

চৈতালী চুপ করে থাকে!

তা আসল নাম না হয় না বললি, কোন্ নামে কোন্ হাসপাতালে আছে তা বলবি তো?

না, না! চৈতালীর মুখে ফুটে ওঠে একটা অসহায় আতঙ্ক, ওরা যদি দেখে আর কেউ খোঁজ করছে, মেরে ফেলবে আমাকে।

হু! সুলক্ষণা আর একবার একটু চুপ করে থেকে বলেন, কিন্তু এখন আছিস কোথায়? বাপ তত বাঘের মত আগলে রাখত–

চৈতালী মাথা নীচু করে বলে, সেই তো কষ্ট!

আমার কাছে থাকবি?

চৈতালী চমকে চেয়ে বলে, কি?

বলছি আমার কাছে থাকবি?

কী বলছেন? আপনি কি পাগল?

কেন রে, পাগলের কি দেখলি? চুরি করে খাওয়ার চেয়ে খেটে খাওয়া কিছু খারাপ? অমনি তো খেতে দেব না তোকে, কাজ করিয়ে নেব। রান্নাবান্না জানিস নিশ্চয়ই!

একটা চোরকে বাড়িতে পুষতে সাহস হবে আপনার? আমি যা কিছু বলেছি, সে সব যে বানানো গল্প নয়, তাই বা কি করে বুঝছেন আপনি?

সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, সে আর বুঝবো কি করে ব! সংসারে অসুবিধেয় পড়লে যে রাস্তা থেকে লোক ধরে রাখতে হয়, কে তাদের গ্যারান্টি হচ্ছে? আর গল্প বানানোর কথা বলছিস? তা আমার নিজের ছেলেই যদি বাইরে থেকে ঘুরে এসে গল্প বানিয়ে বলে, ধরতে পারব? তবে? তা হলে তো পৃথিবীতে সদা সশঙ্কিত হয়েই বাস করতে হয়। তার চেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেললেই ল্যাঠা চুকে গেল।

চৈতালীর জীবনে চৈতালী এমন কথা কখনো শুনেছে? মানুষকে অবিশ্বাস করতে হয় তাই জানে সে।

চৈতালী হঠাৎ সুলক্ষণার পায়ের কাছে নীচু হয়ে প্রণাম করে গাঢ় স্বরে বলে, মা!

মা নয়, মা নয়, সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, মাসীমা। আমার ওই ছোট ছেলেমেয়ে দুটো বেজায় হিংসুটে, মা বলতে শুনলে হিংসেয় সারা হবে।

তারপর তিনিও ঈষৎ গাঢ় স্বরে বলেন, দেখ, আমি শুধু ভগবানের নাম স্মরণ করেই এই দুঃসাহস করতে চাইছি। হয়তো এর জন্যে সংসারে আমায় কিছু লড়তে হবে। দেখি কি হয়? তবে মনে রাখিস, তোর ভগবানও তাকে সুযোগ দিচ্ছেন। খারাপ হতে এক মিনিটও লাগে না, ভাল হতে অনেক সময় দরকার। সে সময় আমি তোকে দেব। দেখব আমার অঙ্ককষা ভুল হল, না ঠিক হল। আজ তোকে আটকাব না, যদি ইচ্ছে হয়, যদি ভয়ঙ্কর কোন কুগ্রহ তোর বাধা না হয়, আসবি আমার কাছে

চৈতালী ব্যাকুল স্বরে বলে, আমি আজ থেকেই থাকব। যাব না।

থাকবি? তা থাক তবে!

.

হ্যাঁ, থেকেই যায় চৈতালী।

দেখবে ভগবান তাকে সুযোগ দিলেন, না দুর্যোগ দিলেন। বাপ তো হাসপাতালে, নিতাই নামক সেই লোকটা, যাকে চৈতালী বাবার বন্ধু হিসাবে নিতাই কাকা বলে এবং মনে মনে জানে সে তার বাবার পরম শত্রু–সেই তার বাবাকে উচ্ছন্নে দেবার গুরু–সেই নোকটা কাল এসে বলেছে, ডাক্তার জানিয়েছে অবস্থা সংকটজনক, তবে খরচা দিলে ইনজেকশন আর রক্ত দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারে।

চৈতালী ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, তা কর সে সব?

নিতাই পরম অবহেলায় বলেছিল, কোথা থেকে? হাসপাতালে যাবার সময় কি তোর বাবা আমার হাতে একমোট টাকা দিয়ে গেছে?

চৈতালীও অবশ্য এমন কিছু নরম শান্ত মেয়ে নয়।

সেই আট-দশ বছর বয়েস থেকে বাবার ব্যবসার মাল এহাত-ওহাত চালান করে করে পোক্ত হয়েছে, আর রাতদিন বাড়িতে যে নানাবিধ লোকের আমদানী হয়েছে, তাদের আড্ডা শুনে, তর্কাতর্কি শুনে, আর তাদের জন্যে চা বানিয়ে হাতে কড়া পড়িয়েছে।

কাজে কাজেই কথাও তার কড়া কড়া।

সেই কড়া সুর আর কড়া ভাষায় প্রশ্ন করেছিল সে এযাবৎ যে চৈতালীর বাবা ব্যবসা করছিল নিতাইয়ের সঙ্গে একযোগে, সে ব্যবসার কি হল? বাবা হাসপাতালে যাবার সময় টাকার মোট না হয় না দিয়ে গেছে, ব্যবসাটাও তো তেমনি নিয়ে যায়নি। তার আয়?

তার উত্তরে নিতাই চৈতালীকে যথেচ্ছ গালাগাল দিয়ে বলেছে, সেই আয়ের উপসত্ব যদি আদায় করতে চায় চৈতালী তো আদালতের সাহায্য নিক গিয়ে। আর বাপকে যদি বাঁচাতে চায় তো, যেখান থেকে হোক টাকা জোগাড় করে এনে দিক!

প্রথমটার থেকে শেষেরটাই আগে দরকার ভেবে মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল চৈতালী। খুব একটা নতুন কিছু নয়, ছেলেবেলায় এ ধরনের কাজ অনেক করেছে। ট্রামে বাসে ট্রেনে রেস্তোরাঁয় পাড়ার লোকের বাড়িতে, সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াত বাবা, আর বলত, ওর বুকপকেট থেকে কলমটা তুলে নিতে পারিস? প্যান্টের পকেট থেকে মনি-ব্যাগটা? পারিস কাছ ঘেঁষে বসে টুক করে ঘড়িটা কেটে নিতে? দেখি তো কেমন বাহাদুর মেয়ে?

চৈতালী বলত, এ তো চুরি! বাবা, তুমি আমায় চুরি করা শেখাচ্ছ?

বাবা অনেক লম্বা লেকচার দিত। মেয়েকে বোঝাত এই দুনিয়ায় সবাই চোর। রাজা মন্ত্রী পাত্র মিত্র কোটাল কাটাল কেউ বাদ নেই, একধার থেকে সবাই চুরি করে চলেছে, শুধু চুরির রকমফের মাত্র। এ তো তবু সামান্য চুরি, সাধারণ চুরি। বড় বড় জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত বিদ্বান তারা যে তলে তলে মানুষের প্রাণ মান ধর্ম বিবেক বিশ্বাস আত্মা সব চুরি করে চলেছে।

ওষুধে ভেজালের কাহিনী শোনাত বাবা ওইটুকু মেয়েটাকে, শোনাত খাদ্যে বিষাক্ত বস্তু মিশেল দেওয়ার। যেদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে সব কিছুর কথা তুলে বিশদ ব্যাখ্যা করত, ধর্মাধর্ম পাপপুণ্য ও সব বাজে ফকিকারি। বেঁচে থাকতে হলে টাকা চাই। আর সে টাকা ছলে বলে কৌশলে যে করে হোক–

বাবার বাক্যচ্ছটায় মুগ্ধ হয়ে যেত চৈতালী। ক্রমশ ব্যাপারটা রপ্ত হয়ে গেল, এমন কি . জিনিস দেখলে নিজেরই হাত নিসপিস করত চৈতালীর। পাড়ার লোকের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে টুক করে তুলে আনত এটা-ওটা।

স্কুলেও ভরতি করে দিয়েছিল বাবা একবার, পড়েও ছিল কিছুকাল। সেখানে সহপাঠিনীদের জিনিসপত্র চুরি করে করে পয়লট্ট করতে করতে ধরা পড়ল একদিন, স্কুল থেকে দূর করে দিল।

তদবধি বাড়িতেই।

মাঝে মাঝে বাবার সব বন্ধুদের বাড়িতে চোরাই মাল পাচার করতে পাঠানো ছাড়া আর খুব কিছু করতে বেরোতে হত না।

কিন্তু বিপদ হল বাপের মাথা ফাটায়।

নাম ভাড়িয়ে ভাঁড়িয়ে আর বাসা বদলে বদলে চালাত লোকটা। প্রথমদিকে তাই ডাক্তার হাসপাতাল এসবগুলো এড়াবার চেষ্টা করেছে। তারপর এই অবস্থা।

.

সুলক্ষণাদের এই শহরতলির বাড়িটার পেছনে দিব্যি একটা পুকুর আছে, ছাত থেকে জানালা থেকে দেখতে পাওয়া যায়। আর তার সঙ্গেই দেখতে পাওয়া যায় পুকুরের ওপারে বস্তির গা ছাড়িয়ে একটা মাঠ-কোঠা। সেখানেই সম্প্রতি বাস করছিল চৈতালীর বাবা। ওখান থেকে আসতে বড় রাস্তার প্রথম বাড়িটাই সুলক্ষণার। আসতে যেতে ওদের বাড়ির নীচের ঘরের ভেতরগুলো দেখে দেখে চৈতালীর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।

চৈতালী জানত দালানের শেফে ওই যে ঝকমকে বাসনগুলো সাজানো থাকে, তার মধ্যেকার রুপোর বাসনগুলোয় গিন্নী খাওয়া-দাওয়া করেন। জানতো বৌ একটা আছে, সে দৈবাৎ নীচে নামে। জানতো দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে আছে গিন্নীর। আর জানত চাকরটা কখন কি কাজ করে।

শুধু ওদের বাড়িতে যে একদিন তাকে চুরি করতে ঢুকতে হবে, সেটাই জানত না। রুপোর বাসনগুলো শুধু লক্ষ্য করেই এসেছিল। কারণ বোঝা যেত জিনিসগুলো ভারী ভারী বনেদী। আর দামও আছে এখন ওর।

তা কথাটা সত্যিই।

বিধবা হবার পর কাসা আর কাঁচের বাসন ত্যাগ করে পাথর ধরবেন ভেবেছিলেন সুলক্ষণা, পাথর ধোপে টিকল না। বিয়ের সময় দানে পাওয়া সেই ভাল ভাল রুলোর বাসনের সে বার করে নিলেন। বললেন, এই পর্যন্ত সিন্দুকের জায়গা জোড়া করে তুলেই রেখে এসেছি, যাঁর জিনিস তিনি তো কোনদিন ভোগ করতে পারেননি। আমিই করে যাই শেষবেলায়।

জানলা দিয়ে দেখা যেত সেই বাসনের শেল্টা। চৈতালীর বাবা মেয়েকে বলত, কী রকম বাহার দিয়ে রাখে দেখেছিস? যাব একদিন। কে যাওয়াবে তা অবশ্য বলত না। একথাও বলেনি যাওয়াবার ভারটা তুই নে না।

বলেনি, তবু সে ভার নিতে এসেছিল চৈতালী।

কিন্তু স্বপ্নেও ভেবেছিল কি এ রকম একটা পরিণতি হবে?

অথচ হয়েও গেল।

বইয়ে পড়া গল্পের মতই ঘটে গেল ব্যাপারটা।

.

আচ্ছা, সুলক্ষণাও কি পরীক্ষা করতে নামলেন, বইয়ে পড়া মনস্তত্ত্ব সত্যিকার মানুষের ব্যাপারে ঘটানো যায় কি না? পরীক্ষা করতে নামলেন, মানুষ সত্যিই অমৃতের সন্তান কি না?

নাকি কারণটা একেবারেই স্থূল?

শহরতলির এই পাড়াটায় এসে পর্যন্ত লোক জোটানো যে কী বিড়ম্বনা সেটা অনুভব করে করে এবং বুড়ো বংশীটার কষ্ট দেখে, এই ঝুঁকিটা কি নিয়ে ফেললেন?

সুলক্ষণার কথা সুলক্ষণাই জানেন। ওঁর খোলা মেলা আবরণের অন্তরালে যে চাপা একটি সত্তা আছে, সে নিতান্তই কঠিন প্রকৃতির। তাই সুলক্ষণার মনের কথা সঠিক বোঝা শক্ত।

তবে সকালবেলা চায়ের টেবিলে ছেলেমেয়ের কাছে শেষোক্ত কারণটাই পেশ করলেন তিনি। বললেন, দেখিই না। সত্যিই তো তেমন কারে পড়লে রাস্তা থেকে একটা অজানা অচেনা জোয়ান লোককেও ডেকে কাজ করাতে হয়, বাড়িতে জায়গা দিতে হয়। এ তো কম বয়সী একটা মেয়ে মাত্র। সুদক্ষিণার চাইতে দুতিন বছরের বড় হয়তো ঢের।

কিন্তু শুনে প্রথমটা ওরা—

আচ্ছা একেবারে প্রথম থেকেই তবে বলা যাক।

.

একেবারে সকালবেলা সুলক্ষণাকে দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ সেটা তাঁর পুজো করার সময়। প্রথম দেখা মেলে চায়ের টেবিলে। টেবিলে আজ সবাই। অপর্ণাও!

এসে বসতেই কৌশিক বলে ওঠে, তারপর মা, তোমার কালকের অ্যাডভেঞ্চার কতদূর গড়াল? অপরাধীর জীবনকাহিনী লিপিবদ্ধ করে নিলে নাকি? যেভাবে নির্জনে ওকে নিয়ে গিয়ে গুছিয়ে বসলে।

সুলক্ষণা পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে হেসে বললেন, ভুল হয়ে গেছে। খাতাকলম যদি দিয়ে যেতিস একটা।

সত্যি মা, তুমি অপূর্ব।

শুধু অপূর্ব সুদক্ষিণা বলে ওঠে, একেবারে অভূতপূর্ব। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম সকালবেলা তোমাকে রক্তাক্তকলেবরে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পাব।

সুলক্ষণা হঠাৎ হেসে উঠলেন, ওই ধারণাটুকু মনে গেঁথে নাকডাকিয়ে ঘুমোলি তো সারারাত্তির?

তা কি করব? তুমি যেভাবে আমাদের বিতাড়িত করলে। সে যাহোক, তারপর মহিলাটি বিদায় গ্রহণ করলেন কখন? মানে, কতক্ষণ তুমি

কথার মাঝখানেই বলেন সুলক্ষণা, গেল কই? যায় নি তো! রয়েছে!

যায় নি তো!

রয়েছে!

রয়েছে মানে কি?

চার-চারটে মানুষই একযোগে চমকে উঠল। আর অপর্ণা কাদো কাদো গলায় বলে উঠল, এখনো আছে? দরজায় তালা লাগিয়ে রেখেছেন তো?

অবিরত ভুগে ভুগে অপর্ণার স্নায়ুগুলো এমন শিথিল হয়ে গেছে যে, এতটুকু ভাবের বেগও বইবার ক্ষমতা নেই তাদের! ভয় বিস্ময় ব্যাকুলতা উৎকণ্ঠা উদ্বেগ কোন কিছুর ছোঁয়া লাগলেই চোখে জল এসে যায়।

তাই রাত্রের সেই চোরাঙ্গনাকে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে কি না প্রশ্ন করতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে সে।

সুলক্ষণা যেন দেখেননি সেই অশ্রুবাষ্প, তাই নেহাৎ সহজ ভাবে বলেন, ওমা, তালা লাগিয়ে রাখব কি! তাকে যে আমি কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।

কাজে লাগিয়ে!

ছেলেমেয়ের সঙ্গে একটা পরিহাস করছেন সুলক্ষণা?

বিশ্বাসযোগ্য?

তাই আবার ওরা একযোগে একই কথা বলে ওঠে, কাজে লাগিয়েছ?

হ্যাঁ রে। যে কষ্ট যাচ্ছে বংশীটার। লোক তো এ পাড়ায় দুর্লভ রত্ন! তাই ওটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিলাম কাজে লাগিয়ে। সেই তো আজ রাঁধছে। বংশী তো বাজারে গেছে!

মা!

কৌশিক বলে ওঠে, ভাবছি তুমি পাগল হয়ে গেছ, না আমরা পাগল হয়ে গেছি?

সুলক্ষণা কিছু বলার আগে সুদক্ষিণা বলে, না তার চেয়েও বেশী কিছু ঘটেছে। পাগলামিরও একটা সীমা থাকে, ও নিশ্চয় কিছু তুকতাক করেছে।

হ্যাঁ, মায়ের সঙ্গে এ ধরনের কথা চালায় ওরা। সে প্রশ্রয় আছে।

সুলক্ষণা এসব বিষয় গায়ে মাখেন না। বলেন, তিলকে তাল করছিস তোরা। কারে পড়লে তো রাস্তা থেকে একটা

এতক্ষণ পরে গম্ভীরপ্রকৃতি বড়ছেলে একটা কথা বলল। বলল, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না মা, হঠাৎ এরকম একটা ডিসিশান নিলে কেন তুমি?

নিলাম কেন?

কৌস্তুভের প্রশ্নে একটু যেন সিরিয়াস হলেন সুলক্ষণা। বললেন, ভাবলাম দেখি না রিস্ক নিয়ে। অভাবে পড়ে কুসঙ্গে পড়ে কত হাজার হাজার মানুষই তো নষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি, একটা মানুষকেও বাঁচানো যায় কিনা, বদ-অভ্যাস তাকে একেবারে শেষ করে ফেলেছে কিনা।

আলোচনায় হঠাৎ ছেদ পড়ল।

সিঁড়ির সামনে একটা সাদা শাড়ীর কোণ দুলে উঠল, একটু বাসন-পত্রের শব্দ হল।

ও, এনেছিস?

সুলক্ষণা বলেন, চিড়ে ভাজতে দিয়ে এসেছিলাম চায়ের সঙ্গে খাবি বলে তোরা। কই আয় না এদিকে, দিয়ে যা!

সামান্য বোধহয় ইতস্ততের ভূমিকা অভিনয় করল মেয়েটা, তারপরই বেশ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে পাত্রটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে গেল।

এরা সবিস্ময় দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল ওর পরনের শাড়ীটি বড় বেশী চেনা।

সুলক্ষণার শাড়ী। চওড়া বেগুনী চুড়িপাড়।

যে সব এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে আলমারির নীচের তাকে, তারই একখানা। ওই সব অপয়া শাড়ী বৌকে মেয়েকে তিনি কোনদিন পরতে দেননি। ওরাও কোনদিন ভাবেনি, মা যেগুলো আর পরতে পাবেন না সেগুলো ওরা পরবে।

কিন্তু ওই সুন্দর পাড়ের শাড়ীটার এই গতি দেখে মেয়ের গায়ে জ্বালা ধরল, বৌয়ের চোখে জল এল। ছেলেরা অবশ্য ঠিক ধরতে পারল না, শাড়ীটা কার। তবে অনুমান করল মা ফর্সা শাড়ী সাপ্লাই করে ওকে সাজিয়ে-গুছিয়ে জাতে তুলেছেন।

মেয়েটা যে দেখতে একেবারে ভদ্রলোকের বাড়ির ভালো মেয়ের মত সেটা আজও আবার নতুন করে অনুভব করল এরা।

সুলক্ষণা বললেন, ওরে, ওইখানে মরিচের গুঁড়োর শিশিটা আছে, দিয়ে যা তো!

ভাতটা খাওয়া হয় নীচের দালানে, চা-টা দোতলায়। তাই চায়ের ব্যাপারে একটু আসা যাওয়া করতেই হয়।

সুদক্ষিণা বিরক্ত হয়ে বলে, ওই দৃষ্টিসুখকর জীবটিকে বারবার আর নাই বা সামনে আনলে মা।

সুলক্ষণা মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইলেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, ছি ক্ষেণু, ছোট হসনে। মনে রাখিস ও তোদের আশ্রিত-র পর্যায়ে পড়ল। তবে টিকে যদি থাকে, মাইনেও দেব। ওর একটা দাবি জন্মাবার জন্যেই দেব।

অর্থাৎ একখানি সুসভ্যা রাঁধুনী লাভ করছ তুমি– কৌশিক বলে, রাঁধুক তাতে ক্ষতি নেই, কাউকে কামড়ে-টামড়ে দিতে না এলেই হল।

সুলক্ষণার চোখের ইশারা, কৌস্তুভের অস্বস্তি প্রকাশ, সব ব্যর্থ করে দিয়ে কথাটা সম্পূর্ণ করল কৌশিক, চৈতালীর উপস্থিতিতেই। কারণ মরিচের গুড়োর শিশি নিয়ে সে তখন ঠিক কৌশিকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

না শোনার ভান করা যায় না।

সুলক্ষণা বলে উঠলেন, তুই যদি সব সময় ওকে ওরকম ক্ষ্যাপাস তবে তো ওর আমার কাছে থাকাই চলে না রে।

এ সুরে কাজ হল।

কৌশিক অপ্রতিভ হল। রীতিমতই হল। পেছনে ওর উপস্থিতিই একটু বিচলিত করেছিল। যতই নিন্দনীয় ইতিহাস থাক, সভ্য-ভব্য দেখতে আস্ত একটা তরুণী মেয়েকে সমীহ একটু না করে পারা যায় না। তাছাড়া, আড়ালে কথা বলারও একটা লজ্জা আছে।

কৌশিক মেয়েটার আপাদমস্তক দেখে নেয়। দেখে, সেখানে কি প্রতিক্রিয়া।

কিন্তু কই?

কিছুই তো না।

একেবারে ভাবশূন্য মুখ। গতরাত্রে চোর অবস্থায় ধরা পড়েও যে মেয়ে ফোঁস করে উঠেছিল, তার পক্ষে এটা আশ্চর্য!

কী এ?

সর্বংসহার সাধনা? সুলক্ষণা তাহলে এইটিই বুঝিয়েছেন পড়িয়েছেন ওকে, আমার ছোট ছেলেটা অতি অসভ্য, তার কথাবার্তায় কিছু মনে কোরো না তুমি।

ধ্যেৎ, বড় বিশ্রী হয়ে গেল।

তবে কি না লজ্জায় পড়ে গেছি, এটা প্রকাশ করাও আবার বেশী লজ্জা। তাই কৌশিক সেটা অপ্রকাশিত রেখে মার কথার উত্তর দেয়, নতুন করে আর ক্ষ্যাপাবার কি আছে? আমার তো ধারণা ছিল ওই কামড়-টামড়গুলো, ইয়ে, মানে–ওই আর কি ইয়েরই লক্ষণ কিন্তু তুমি যখন বারণ করছ, এ প্রসঙ্গে ইতি। বাড়িতে ডেটল কিছু বেশী করে মজুত রাখা ছাড়া

এমন ভাবে মাথা চুলকোয় কৌশিক যে মনে হয় সত্যিই বিশেষ চিন্তায় পড়েছে।

.

এই ছেলেটার জন্যেই সুলক্ষণার মন আর সংসার এত দুঃখেও সর্বদা আনন্দোজ্জ্বল। কথা দিয়েই ভরিয়ে রাখে ও চারপাশের সমস্ত শূন্যতা।

নইলে দুঃখ কম সুলক্ষণার?

নতুন বাড়িটি তৈরি করে পুরো একটা বছরও ভোগ করতে পারেননি স্বামী। নতুন পাড়ায় এসে পড়শিনীদের সঙ্গে সবেমাত্র পরিচয় হতে না হতে সুলক্ষণার বৈধব্যের লজ্জা। হ্যাঁ, লজ্জা বৈকি। শোকের চেয়ে লজ্জাই বেশী। আর লজ্জার দাঁত যে শাকের চেয়ে অনেক বেশী ধারালো।

তা ছাড়া বড়ছেলেটার ওই বরবাদ-যাওয়া জীবন। বৌয়ের সেবা করা, বৌয়ের তাওত করা ছাড়া আর কোন কিছুই রইল না কৌস্তুভের। ডাক্তার বলেছে, এ এক বিশেষ রোগ, রক্ত তৈরী হয় না ভেতরে।

অতএব, চিরদিনই রক্তশূন্যতায় ভুগবে অপর্ণা।

এর থেকে মুক্তি মানে মৃত্যু।

সে তো আরও ভয়াবহ। সে দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখাই মানবিকতা।

সুদক্ষিণার জন্যেও কত চিন্তা।

ওর বাপ থাকলে দায়িত্ব অর্ধেক হত সুলক্ষণার।

কিন্তু মায়ের মনের এই ভারগ্রস্ত অবস্থাকে কৌশিক যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে না পারুক, ও যে চেষ্টা করছে, তাতেই অনেকটা ভার লাঘব হয়।

সুলক্ষণা জানেন চৈতালীকে যতই ঠাট্টা-উপহাস করুক কৌশিক, ঘৃণা করবে না। মানুষকে ঘৃণা করার কথা ভাবতেই পারে না ও! সেই তো ভরসা সুলক্ষণার, সেই তো বুকের বল। মনের একেবারে ভেতরের ঘরের খবর নিলে দেখা যেত, কৌশিকের দরদের ভরসাতেই ওই চোর মেয়েটাকে এত সহজে বাড়িতে জায়গা দিতে সাহস করলেন সুলক্ষণা।

সুলক্ষণা দেখলেন, চৈতালী কৌশিকের মাথা চুলকোনোয় হাসি চেপে সরে গেল। সুলক্ষণাও হাসি চাপলেন।

সুদক্ষিণা মায়ের সেই ছোট হওয়ার কথায় অভিমানক্ষুব্ধ হলেও একটা কথা ভেবে হঠাৎ একটু সহৃদয়তা বোধ করল। এরকম একটা মেয়ে বাড়িতে থাকা মন্দ নয়। নেহাত ঝিও নয়, অথচ ঝিয়ের চেয়ে বেশী সম্মান দিতে হবে না, এটা বেশ। মায়ের কিছুটা ভার লাঘব হবে। কাজ কমলে মাকে বেশীক্ষণ পাওয়া যাবে।

আত্মীয়-টাত্মীয় থাকা সুবিধের নয় বাবা।

দেখেছে ওর বাবার অসুখের সময় পিসিমাকে আসতে। সুলক্ষণা একা পেরে উঠবেন না। বলেও নয়, সম্পর্কের দাবিতেই এসেছিলেন। কিন্তু তিনি আর তার দুই মেয়ের প্রয়োজনের দাবি মেটাতে মেটাতেই সুদক্ষিণার প্রাণান্ত হয়েছিল।

পিসিমা রাত জাগবেন, সুদক্ষিণার কর্তব্য প্রহরে প্রহরে হিটার জ্বেলে চা বানিয়ে খাওয়ানো। কেননা পিসিমা অবিরত তার শ্বশুরবাড়ির মেয়েদের শিক্ষা সহবৎ আর কর্তব্যনিষ্ঠার কাহিনী শোনাচ্ছেন। পিসিমার মেয়েরা দয়া করে রোগীর বাড়ি এসেছে, এই দাবিতে তাদের চারবেলার খাওয়ার সমস্ত তদারক করতে হত রোগীর মেয়েকে।

সুদক্ষিণার ইচ্ছে হত বলে, পিসিমা, তোমার মেয়ে দুটিও তো তোমার শ্বশুরবাড়ির।

সে যাক, বাবার মারা যাওয়া কালীন স্মৃতি থেকেই সুদক্ষিণার আত্মীয়ভীতি। অথচ দ্বিতীয় কেউ একটা না থাকার অসুবিধেও অনুভব করে। বৌদি তো ওই, নিজেও সে একেবারে কিছু না, তা ভাল করেই জানে। কিন্তু মাকে যে একটু দেখা দরকার, তাও তত বোঝে।

এই তো কতদিন এমন হয়েছে, সুদক্ষিণা সবিস্ময়ে বলেছে, মা, তুমি ভাত খেলে না?

সুলক্ষণা হেসে বলেছেন, নাঃ, খেলাম না। আড়ি করে দিয়েছি আজ ভাতের সঙ্গে।

সদক্ষিণা মরমে মরে গেছে।

সুদক্ষিণা চুপি চুপি বংশীকে জিগ্যেস করেছে, হারে বংশী, আজ একাদশী?

মার একেবারে হাতের কাছে একজন কেউ থাকলে যে ভাল হয় সে কথা বুঝে ফেলেই আরও অস্বস্তি সুদক্ষিণার।

তাই চৈতালী যখন মরিচের গুড়োর শিশি রেখে চলে গেল, সুদক্ষিণা ভাবল, হিস্ট্রিটায় একেবারে যে চোর। নইলে এমন কিছু মন্দ নয়। কিন্তু আশ্চয্যি, দেখে কিছুতেই মনে হচ্ছে না ওই মেয়েটা কাল রাত্রের সেই বিটকেল ঘটনার নায়িকা!

.

তা নিজের শাড়ীটাড়ী পরিয়ে বেশ তো মানুষ করে তুলেছ দেখছি এখন, কৌশিক বলে, ওর পেছনের ব্যক্তিরা যদি হঠাৎ বাড়ি-চড়াও হয়ে তোমাকে মেয়ে আটকানোর দায়ে ফেলে?

ও নাবালিকা নয়।

বেগতিক দেখলে ও উলটো স্টেটমেন্ট দেবে।

সুলক্ষণা সামান্য হেসে বলেন, বেগতিক দেখে কে কি না করতে পারে! নিতান্ত নিরীহ একটা লোক খুন করেও বসতে পারে।

কৌস্তুভ মার মুখের দিকে তাকায়, উঠে পড়ে।

বৌকে বলে, আটটার সময় ডাক্তারবাবু আসবেন মনে আছে তো? হাঁ ভাল কথা মা, মেয়েটা সম্বন্ধে একেবারে বিশ্বাসের নিশ্চিন্ত রাখা ঠিক নয়। মানুষ চেনা শক্ত।

সুলক্ষণা মৃদু হাসেন, তা শক্ত বৈকি বাবা!

এই মজলিশের মধ্যে আরও একবার এসে পড়ে চৈতালী, খালি পেয়ালাগুলো গুছিয়ে নিয়ে যেতে।

সুলক্ষণা বললেন, এত সব তুই করিস না চৈতালী, বংশী তাহলে বেকার হয়ে যাবে। তুই রান্নাটা কর পরিপাটি করে। যেমন বলে দিয়েছি আঁশ নিরামিষ করে–

সুদক্ষিণা মার কথায় চমকে উঠে বসেছিল।

ও চলে যেতেই বলে, নামটা কি বললে?

চৈতালী।

চৈতালী! চৈতালী নিজের নাম ওর? নাকি শাড়ীর মত এই নামটিও তোমার দান মা?

না রে বাপু। সুলক্ষণা জোরে হেসে ওঠেন, ওর নিজেরই। আমিও প্রথমটা নামের বাহার দেখে চমকে গিয়েছিলাম। তা দেখলাম, আসলে ভাল ঘরেই উদ্ভব। তারপর এই ভবের খেলায় পড়ে।

কৌশিক না-পড়া খবরের কাগজখানা হাতে পাকাতে পাকাতে বলে, তা যাক, আপাতত ভবার্ণব পার হবার তরণীটি ওর ভালই জুটল দেখা যাচ্ছে। বেশ সুলক্ষণাক্রান্ত। এখন সুবাতাসের দাক্ষিণ্য পেলেই– বলে সুদক্ষিণার দিকে একটি নিরীহ কটাক্ষপাত করে।

সুদক্ষিণা গম্ভীর ভাবে বলে, আমি তোমাদের সাতেও নেই, পাঁচেও নেই।

তা নেই বটে। তুই শুধু প্যাঁচে আছিস। বলে হাসতে হাসতে উঠে যায় কৌশিক।

আর এই সব ঘাত-প্রতিঘাত, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সহানুভূতি সমালোচনা সব কিছুর মধ্যে এক অলিখিত দলিলে স্থিরীকৃত হয়ে যায় চৈতালীর এখানের বাসটা পাকাই হল।

না হবেই বা কি করে।

একবেলাতেই যে কাজে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সে। তা ছাড়া একটানা বংশীর হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে জিভ আর জঠর যে কতটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল সকলের, তা যেন বংশীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্পষ্ট ধরা পড়ল।

বংশী তুই একটু চোখে চোখে রাখিস…

দুপুরের দিকে বাইরের দরজাটা চাবি দিলে ভাল হয়, রুপোর বাসনগুলো কিছুদিন তুলে ফেললে হত না? এই ধরনের ক্ষীণ দুএকটা মন্তব্য দুএকবার উচ্চারিত হল।….

অথচ সকলেই মনে মনে ধরে নিল, ওগুলো প্রতিপালিত হবে না। মনে হল, এগুলো যেন। বাহুল্যই বলা হচ্ছে।

আশ্চর্য!

এই মেয়েটা মাঝরাত্তিরে চুরি করতে বেরিয়েছিল!

.

ইনজেকশনের পর কিছুক্ষণ অপর্ণার কাছে থেকে সুস্থ করে না গেলে বেরোবার উপায় নেই কৌস্তুভের। পাখার রেগুলেটারকে শেষ প্রান্তে ঠেলে দিলেও বইখাতা নেড়ে বাতাস করতে হয়, বার বার নাড়ি দেখতে হয়। শাকবর্ণ মুখের স্বাভাবিক ফ্যাকাশে রঙটা ফিরতেও বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে।

সাত রাজ্য খুঁজে সুন্দরী বৌ এনেছিলেন সুলক্ষণা। সে সৌন্দর্যের অবশিষ্টাংশ আজ শুধু করুণাই জাগায়।

সাদা ফরসা রঙটা এখন ফ্যাকাশে বিবর্ণ খড়ির মত। কপালের মাপ অনেকখানি বেড়ে গেছে, সামনের চুল উঠে গিয়ে আর পাতলা হয়ে গিয়ে। গালের হাড় উঁচু, চোয়ালের হাড় কোণাচে, চোখের দৃষ্টিতে শুধু এক অপরিসীম ক্লান্তির ছাপ।

পানের মত নিটোল মুখে গভীর কালো দুটি চোখ আঁকা সরস্বতী প্রতিমার মত বৌটি সুলক্ষণার এখন শুধু স্মৃতিচিহ্ন হয়ে দেয়ালে ঝুলছে। বিয়ের সময় অনেক আহ্লাদ করে বরকনের। রঙিন ফটো তুলিয়েছিলেন সুলক্ষণার স্বামী।

এই সব কথা মনে পড়লে সদা আনন্দময়ী সুলক্ষণার মনও বুঝি বেদনায় ভরে ওঠে।

.

অপর্ণার চোখে অসীম ক্লান্তি।

ক্লান্তি নেই কৌস্তুভের।

বিধাতার নিষ্ঠুরতা থেকে ও যেন ছিনিয়ে রাখবেই অপর্ণাকে। টিকিয়ে রাখবে এই পৃথিবীতে।

সুলক্ষণা ইনজেকশনের সময় ছিলেন, তারপর নেমে গিয়েছিলেন ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে।

আবার এলেন।

বললেন, তোর তো বেলা হয়ে যাচ্ছে খোকা, চান করবি, খাবি। আমি একটু না হয় বসছি বৌমার কাছে, তুই যা।

অপর্ণা ক্ষীণ কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলে, না না, আমি একাই থাকতে পারব।

কৌস্তুভও বলে, তুমি এখন আবার! কেন, ক্ষেণু নেই?

না, ওর তো আজ গানের ক্লাস। ব্যস্ত হচ্ছিস কেন, যা তুই।

ব্যস্ত কৌস্তুভ হচ্ছিল এতক্ষণ মনে মনে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ব্যস্ততা দেখানো চলে না, তাহলে অপর্ণা আহত হবে। অভিমানের জোর নেই, শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ে।

মার বিবেচনায় স্বস্তি পেয়ে নেমে গেল সে। এবং যথারীতি চান করে এসে টেবিলের ধারে বসে শান্ত গম্ভীর গলায় ডাক দিল, বংশী!

কিন্তু বংশী এল না।

এল চৈতালী।

.

কোস্তুভ কৌশিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত।

মেয়ে দেখলেই অস্বস্তি অনুভব করে ও। সকালবেলা কৌশিক যখন চৈতালীকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছিল, কৌস্তুভ অস্বস্তিতে ঘেমে উঠছিল।

তাই চৈতালীকে ভাত দিতে আসতে দেখে ওর ক্ষিদেই উপে গেল। চৈতালী কিন্তু নির্বিকার। এল, কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে টেবিলে রাখল, ভাত বেড়ে আনল, পরিপাটি করে পাশে বাটি সাজিয়ে দিল, নুন লেবু সব দিয়ে আস্তে সরে গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়াল।

অস্বস্তির মাঝখানেও অবাক হয়ে গেল কৌস্তুভ!

সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়, আনকোরা নতুন হাতে এত সুন্দরভাবে কাজ হওয়া সম্ভব? আর এতগুলো রান্না হয়ে ওঠা?

শুধু বংশী কেন, বামুনঠাকুরদের আমলেও দেখেছে কৌস্তুভ। রান্না হয়ে না ওঠার জন্যে সুলক্ষণা অনুযোগ করতেন, গরম ডাল ভাত ঠাণ্ডা করবার জন্যে হানটান করছেন, এইটাই কৌস্তুভ বহুদিন থেকে দেখতে অভ্যস্ত। সুলক্ষণার স্বামীর আমল থেকেই। ভদ্রলোক স্ত্রীকে রান্না ভঁড়ার ঘরে বেশীক্ষণ থাকতে দিতে আদৌ ভালবাসতেন না। কাজেই সারা সকাল সুলক্ষণাকে তার কাছেই ঘুরতে হত, এদিকটা দেখা হত না।

আজও তো কই দেখেননি মা, ভাবল কৌস্তুভ। আর সঙ্গে সঙ্গেই ভাবল, অথচ এ এত সুন্দর করে।

আচ্ছা কাল তো মেয়েটাকে এত পরিষ্কার দেখতে লাগছিল না। কাজকর্ম করলে মেয়েদের চেহারা বদলে যায় নাকি?

আর কিছু লাগবে?

না না। আবার কি।

কৌস্তুভ ব্যস্ত হয়ে জলের গ্লাসে হাত ডুবিয়ে উঠে পড়ল।

চৈতালী হঠাৎ খুব স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ভাত তো সবই দেখছি পড়ে রইল। আমার হাতের রান্না বলে ঘেন্নায় খেতে পারলেন না বুঝি!

না না, ইস সে কি! আমি কোনদিনই এত–জিগ্যেস কোরো মাকে পালিয়ে গেল কৌস্তুভ।

আর চৈতালী নিষ্পলকে তাকিয়ে রইল সেই ফেলে ছড়িয়ে খাওয়া ভাতের থালাটার দিকে। এদের কাছে ভাতের কোন দাম নেই।

অবশ্য চৈতালীরাও চিরদিনের দুঃখী নয়! কৈশোরটা মাসীর বাড়িতে কষ্টে কাটলেও, বাপের কাছে নানারকম দেখেছে।

তার ছিল দশ দশা।

কখনো হাতী, কখনো মশা।

কিন্তু এখন?

দীনহীন একটা দাঁতব্য হাসপাতালে পড়ে আছে বাবা, ইনজেকশনের ওষুধ জুটছে না। অথচ এদের যে বৌ চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, তার জন্যে বড় ডাক্তার এল, ইনজেকশন পড়ল।

নিজের মনে ভয়ানক একটা দুঃখ অনুভব করল চৈতালী।

সকাল থেকে কাজ দেখিয়ে দেবার উৎসাহে এবং মনের মত মাছ তরকারির উপচার নিয়ে রাঁধতে বসতে পাওয়ার আনন্দে যেন স্থান কাল পাত্র বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল চৈতালী। হঠাৎ এখন বাবার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সমস্ত শরীরের মধ্যে মস্ত একটা আলোড়ন উঠে চোখে জল এল।

.

সুদক্ষিণা কলেজ থেকে ফেরার পর সুলক্ষণা একটা ঠিকানা লেখা কাগজ এনে ওর সামনে ধরে বললেন, জায়গাটা জানিস ক্ষে?

সুদক্ষিণা তাতে চোখটা বুলিয়ে নিয়ে বলে, বাঃ এ তো দেখছি একটা হাসপাতাল! আমি কি করে জানব?

কী মুশকিল, তুই জানবিই এমন কথা তো বলিনি রে বাপু। জানিস কি না তাই বলছি। জায়গাটার আন্দাজ হচ্ছে?

মনে হচ্ছে তো বড়বাজারের দিকে কেন কি হবে সেখানে?

না, হবে না কিছু সুলক্ষণা বলেন, তুই যখন পারবিই না। ভাবছিলাম মেয়েটাকে একটু সঙ্গে করে নিয়ে যেতিস–

সুদক্ষিণা চমকে ওঠে, বলে, কেন, কি হল ওর? হাসপাতালে কেন?

ভাবনা ধরে যায় তার।

একদিনেই আস্বাদ পেয়েছে সংসারের শৃঙ্খলার, কাজের কর্মের, ভাল রান্নার। তাই একেবারে ঘৃণিত অসহ্যকেই দামী মনে হচ্ছে। কিন্তু এখন আবার কি হল তার?

সুলক্ষণা খুলে বলেন।

ওর কিছু না, ওর বাবার।

হাসপাতালে আছে ওর বাপ, ও শুধু ঠিকানাটা জানে, যায়নি একদিনের জন্যে। নিয়ে যায়নি কেউ। নিয়ে যাবার লোকই ছিল না

সুদক্ষিণা নাক কুঁচকে হেসে বলে, এখন বুঝি হয়েছে ভাবছে?

ও হয়তো কিছুই ভাবেনি, আমি ওর প্রাণটার দিকে তাকিয়ে দেখছি–

তা আমি তো ওদিকে জীবনেও একা যাইনি। তা ছাড়া আবার হাসপাতাল-ফাসপাতাল!

থাক তবে।

বলে চলে গেলেন সুলক্ষণা।

.

কিন্তু ছেড়ে দিলেন কি?

না। গৃহীত সংকল্প ত্যাগ করা সুলক্ষণার প্রকৃতি নয়।

কৌশিকের কাছে গেলেন।

কৌশিক দুহাত জোড় করে হাসে, মা, তুমি কি মহিমাময়ী মা! নিত্য তোমার পদধূলি সেবন করলে যদি কিছু হয় আমাদের। সেই অজ্ঞাত অপরিচিত মহাচোর ভদ্রলোকটির জন্যে তুমি তোমার ছেলেকে দিয়ে কমলা আপেল বিস্কুট মিছরি পাঠাবে? পাঠাবে ওষুধের টাকা? তদুপরি তোমার এই নিরীহ বালকের মাথায় চাপাবে সেই মহান ব্যক্তির কন্যাটিকে?

সুলক্ষণা বলেন, বুঝলাম তোর অসুবিধে হবে। কিন্তু দেখ, মেয়েটার জন্যে কষ্ট হচ্ছে। সারাদিন কাঁদছে।

আহা তা অত কৈফিয়তের কি আছে? আমি বলছি অসুবিধে হবে? হুকুম করবে চলে যাব, ব্যস! তবে

কি তবে?

মহিলাটিকে একটু বারণ করে দিয়ে, আমার সঙ্গে যেতে যেতে পথে যেন ফাঁস ফাস না করেন।

.

সুলক্ষণা ছেলের এই অনুরোধের কোন জবাব দেননি, হেসে সরে গিয়েছিলেন সেখান থেকে।

সুলক্ষণা ছেলেকে বলেছিলেন পথ থেকে ফল কিনে দিতে।

ফলের বহর দেখে লজ্জায় কুণ্ঠায় এতটুকু হয়ে গেল চৈতালী। এ কি! চৈতালীর বাপের জন্য এত!

এরা সত্যিই এমন মহানুভব, না পুরো পরিবারটাই পাগল?

এত কি হবে?

না বলে পারল না চৈতালী।

কৌশিক গম্ভীর মুখ করে বলে, কখন কত লাগে ধারণা আছে আপনার?

আপনি!

চৈতালীকে ওই সুকান্তি ভদ্রছেলেটি আপনি বলছে! মরমে মরে গিয়েও কি এদের ভদ্রতার ঋণ পরিশোধ হবে?

হবে না।

তবু চৈতালী নম্র গলায় বলে, আমাকে আপনি বলবেন না! মাসীমা আমায় দয়া করে

দেখ আপনি না বললাম না বললাম, ওই দয়া-টয়া বললেই ট্যাক্সি থেকে নেমে সটান বাসে চড়ে বাড়ি ফিরে যাব।

ওর কথার ধরনে হেসে ফেলে চৈতালী। তারপর আস্তে নিঃশ্বাস ফেলে বলে, বড় হয়ে পর্যন্ত খালি বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি জানোয়ারই দেখেছি, পৃথিবীতে যে দেবতাও আছে, তা দেখিনি কোনদিন।

সুলক্ষণা ওদের পাঠিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে ভাবছিলেন, আমার পরীক্ষাটা কি বড্ড বেশী দুঃসাহসিক হচ্ছে? আমি কি বিপদ ডেকে আনব? কৌশিককে অসংগত অনুরোধের চাপ দিয়ে বিব্রত করলাম? আমি কি

বংশী এসে দাঁড়াল।

বলল, মা, আমি তো বুন্ধু, চাকর নফর, কিন্তু একটা কথা না বলে তো পারছি না।

সুলক্ষণা হেসে ফেলে বললেন, না বলে যখন পারছিসই না, তখন বলেই ফেল?

চোট্টা মেয়েটাকে তো মাথার মণি করলে, কিন্তু ওর মতিগতি সুবিধের নয়।

সুলক্ষণা ভুরু কোঁচকালেন।

এটাই প্রশ্ন।

বংশী বেশ জোরালো স্বরে বলে, তোমার ওই রুপোর গেলাসটা, যেটা নিয়ে কাল হাতেনাতে ধরা পড়েছিল, সেটার ওপর ওর ছোঁকছোঁকানি যায়নি। তখন দেখি মাজা গেলাসটা হাতে নিয়ে একেবারে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন জগতের সকল চিন্তা ওই গেলাসটায়। নেহাত আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি রেখে দিল। তা কি আর বলে, জিগ্যেস করতে বলল, গেলাসে কার নাম লেখা?

সুলক্ষণা শান্ত গলায় বলেন, এতে হলটা কি? হয়তো নামটাই পড়ছিল।

তোমার যেমন সারল্য মন, তেমনিই তো বলবে। জানি, দোষ ধরবে না। আমার রাগ ধরে গেল। বললাম, কার নাম কি বিত্তান্ত, অত কথায় তোর দরকার কি? মা দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে–

বংশী!

সুলক্ষণার তীব্র স্বরে বংশী থমকে থেমে যায়।

সুলক্ষণা দাঁড়িয়ে উঠে সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, আর কোনদিন যেন এ ধরনের কথা না শুনি। আর ওভাবে তুই টুই করে খারাপ ভাবে কথা বলবি না ওর সঙ্গে। ক্ষেণুকে যেভাবে মেনে চলিস, সেই ভাবেই মেনে চলবি ওকে।

রায় দিয়ে চলে যান সুলক্ষণা।

আর রোষে ক্ষোভে ধিক্কারে বংশী সংকল্প করে কালই দেশে চলে যাব। ওই চোর মেয়েটা একবেলা একটু ভাল রান্না বেঁধেছে, তাই এত আদর তার? আর বংশী যে- ঠিক আছে যাব যাব। এই তিন সত্যি।

.

কিন্তু তিন সত্যি কি রক্ষা হল বংশীর?

বসে তো ছিল অনেকক্ষণ গুম হয়ে, তার পর?

চৈতালী আর কৌশিকের ফিরতে দেরি দেখে সুলক্ষণা যখন বংশীকেই ডেকে বললেন, কই ওরা তো এখনো এল না দেখছি, ওদিকে বৌমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। দুধটা ততক্ষণ জ্বাল দেবার ব্যবস্থা কর বংশী।

তখন বংশী ছিটকে এসে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, মা হয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে বসে আছ কী করে মা? একবার খেয়াল করছ না–ব্যাপারটা কি ঘটেছে?

সুলক্ষণাও চিন্তান্বিত ছিলেন। কিন্তু তা প্রকাশ না করে বলেন, কেন বল্ তো? কী হল?

কী হল? ছেলেটাকে ইচ্ছে করে ডাকিনীর খপরে ধরে দিয়ে কোন্ বদমাইশ গুণ্ডার আড্ডায় পাঠিয়ে দিলে কে জানে, কী তার কপালে ঘটছে কে জানে! আর বলছ যে, কী? আজন্ম কলকাতায় আছ, জানো না কতরকমের বদমাইশি আছে সংসারে। বুঝতে পারলে না সব বানানো গপো। ওই হাসপাতালের ছুতো করে কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলল কে জানে। হাসপাতালে গেল কি না বড়বাজারে! যেখানে যত রাজ্যের গুণ্ডাপট্টি। অতবড় মেডিকেল কলেজ গেল, তাতে কুলোল না ওর বাপের? ছলনা, ছলনা, আমি বলছি সব ছলনা।

.

সুলক্ষণা ভেতরে ভাঙলেও বাইরে মচকান না, বলেন, থাম বংশী, পাগলের মত বকিসনি। এ স। গাড়ি পাওয়া অত সোজা নাকি?

কিন্তু ভেতরে কি সত্যি ভাঙলেন?

তার বিধাতার কাছে কি দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন না, ঠাকুর মুখ রেখো!

আর ঠিক সেই সময়

সুদক্ষিণ, ছুটে এল, মা, বৌদি ভয় পেয়ে কীরকম করছে!

ভয় পেয়ে কী রকম করাটা বৌদির নিত্য-নৈমিত্তিক। এবং ভয়টার কারণ প্রায়শই এত তুচ্ছ যে, রাগ করতেও বেন্না করে। তবু কৌস্তুভ বাড়িতে না থাকলে যেতেই হয়, ছুটে গেলেন।

দেখলেন অপর্ণা ঘামছে চোখ বুজে শুয়ে।

কী হয়েছে?

জানি না, সুদক্ষিণা বলে, কে ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে ছোড়দাকে গুণ্ডারা খুন করেছে

আঃ, কী আশ্চর্য! এ ওই নির্বুদ্ধির ঢেঁকি বংশীটার কাজ। সুলক্ষণা ব্যস্ত হলেন, বৌমা! বৌমা!

অপর্ণা চোখ খুলে কান্নাভরা গলায় বলে ঠাকুরপোকে কেন যেতে দিলেন মা?

সুলক্ষণা তাঁর ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে বলেন, দিয়েছি তার কি?

মনে হচ্ছে কোন বিপদ হয়েছে!

সুলক্ষণা দৃঢ় স্বরে বলেন, আমি না পাঠালেই কি ও বাড়ি বসে থাকতে বৌমা? নাকি ও নিজে বেরোলে বিপদ আসতে পারত না?

এবার সুদক্ষিণা বলে, বিপদ আসা আর বিপদের মুখে পাঠানো তফাত নয় কি মা?

তা আমার হাত থেকে বিপদ আসাই যদি ওর ভাগ্যে থাকে, সেও তো আমি রদ করতে পারব না ক্ষে।

ওই! হল! সেই তোমার ভাগ্য। তা হলে তো মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বলে কিছু থাকা উচিত নয়। কিন্তু যাই বল মা, ভাগ্য-টাগ্য যদি মানো তত তোমার তুকতাকও মানা উচিত! মেয়েটা নির্ঘাত তোমায় তুক করেছে। নইলে ভাল করে ভেবে দেখ, কি অন্ধ তুমি হয়ে গেছ? খুব দি ভাল মেয়ে হয়, চোর-ডাকাত কিছু যদি নাও হয়, বাড়ির রাঁধুনীর বাবা-মা হাসপাতালে থাকলে কে কবে বাড়ির ছেলেকে পাঠায় দেখতে

সুলক্ষণা স্থির স্বরে বলেন, আসল জায়গাটায় ভুল করেই সব গুলিয়ে ফেলছিস ক্ষে। বাড়ির রাঁধুনী না ভেবে বাড়ির মেয়ে ভাবলেই আমার অঙ্কটা বুঝতে পারবি।

বাড়ির মেয়ে!

সুদক্ষিণা অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, তাই বল। বাড়ির একমাত্র মেয়ে বলে মনে বড় অহংকার ছিল, সেটা গেল। এবার বোধ করি ওঁকে দিদি বলে ডাকবার হুকুম আসবে?

সুলক্ষণা ঈষৎ হেসে বলেন, সে হুকুম আমার কাছ থেকে না এসে, তোর নিজের ভেতর থেকেও আসতে পারে ক্ষে।

আমি তোমাদের মতন অত মহৎ নয়।…এই যে দাদা এসে গেছ। মার কাণ্ড জানো? ছোড়দাকে পাঠিয়েছেন চৈতালীর সঙ্গে, তার বাবা না কাকা কে হাসপাতালে আছে তাকে। দেখাতে। এখনো ফেরেনি তারা।

কৌস্তুভ একবারমাত্র মা বোন দুজনের মুখভাব অবলোকন করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তাই নাকি? আর পরক্ষণে তার থেকে চতুগুণ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে ওঠে, কিন্তু অপর্ণার কি হল? আবার হঠাৎ

সুলক্ষণা ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

.

আচ্ছা, মেয়েটা কোথায় গেল বল্ দেখি?

নিতাই তার প্রিয় সাগরেদ বরেনকে জিগ্যেস করে, একেবারে হাওয়া হয়ে গেল কি করে?

বরেন নাক কুঁচকে বলে, বুঝতে পারছ না দাদা? তলে তলে প্রণয়ী জুটিয়ে রেখেছিল, যেই বাপ চোখের আড়াল হয়েছে, সেই

না না, নিতাই প্রতিবাদ করে ওঠে, সে প্যাটার্নের মেয়ে নয়। দেখতিস না মেজাজ? যেন রায়বাঘিনী। ওসব মেয়ে–

বরেনের বোধ করি কোনখানে একটু জ্বালা আছে, তাই তিক্তস্বরে বলে, বাঘিনী বলে কি আর প্রেমে কসুর হয়? গরু গাধাদের দিকে হেনস্থার দৃষ্টিতে তাকাতে পারে, কিন্তু জগতে বাঘও তো আছে।

.

নিতাইয়ের চৈতালী সম্পর্কে ঠিক এ রায়টা মনঃপূত হয় না। মেয়েটাকে তো দেখছে সেই ছোটবেলা থেকে। তা ছাড়া সেদিনই শচীনের হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ নিয়ে যে কোদল হয়ে গেছে নিতাইয়ের সঙ্গে চৈতালীর, এই হারিয়ে যাওয়াটা তারই প্রতিক্রিয়া কিনা ভেবে খুব একটা স্বস্তি নেই তার। কে জানে বাবা, গঙ্গায় ডুবেটুবে মরতে গেল না কি? যা তেজী মেয়ে! সেদিন তো মনে হচ্ছিল ভস্ম করে ফেলে বুঝি নিতাইকে।

কিন্তু নিতাই তো তা বলে ওই একফোঁটা মেয়েটার কাছে বেকুব বনে গিয়ে টাকার বাক্স খুলতে বসবে না। চোরাই আফিঙের যে ব্যবসাটি ছিল তাদের, তার সব কিছু ঝামেলা নিতাই নিজে পোয়াত না? শচীনটা কতটুকু কী করেছে? সব কি নিতাই শচীনকেই জানাত? যতটুকু ওকে দিয়ে করানো যায় তাই করিয়েছে। এসব কাজে দুচারজনকে না নামালেও তো সুবিধে হয় না। মনের মতন বৌটা দুম করে মরে যাওয়ায় লোকটা তো জীবনে হতাশ হয়ে নেলাক্ষ্যাপা হতে বসেছিল; সেই স্কুলের সহপাঠিত্বের পরিচয় ঝালিয়ে নিতাই ওকে আয়ত্তে এনে মানুষ করে তুলেছিল।

তখন তো জানতই না নিতাই, ওর বৌটা একটা মেয়ের জন্ম দিয়ে তবে নিজে মরেছে। শুনলো অনেক দিন পরে, শচীন বলল ওর একটা মেয়ে আছে, সে মাসীর কাছে মানুষ হচ্ছে।

তা সে মেয়েকে কি শচীন নিজের কাছে আনতে চেয়েছিল কোনদিন? না চায়নি। নিতাই-ই প্ররোচনা দিয়ে দিয়ে তাকে এখানে আনিয়েছে।

মেয়ে শুনে উল্লসিত হয়েছিল নিতাই।

এ সব ব্যবসায় একটা এক্সপার্ট মেয়ে ভয়ানক কাজে লাগে। কালে ভবিষ্যতে সেই মেয়েই দলনেত্রী হয়ে উঠে একশো পুরুষের কান কাটে।

নিতাই আশা করেছিল শচীনের মেয়েটাকে তেমনি এক্সপার্ট করে তুলবে। তাই ছোট থেকেই আনতে বলেছিল ওকে। বলেছিল, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে টাশ টাশ কিন্তু সেই মাসী মাগী না কে, সে মেয়েটাকে দশ বারো বছরেরটি না করে ছাড়ল না। আদৌ ছাড়ত না, যদি না নিজে বিধবা হয়ে অথই জলে পড়ত।

তা সেই, যা বলেছিল নিতাই, তাই হল। এক্সপার্ট যে হল না ছুঁড়ি তা নয়, কিন্তু ওই। টাশ টাশ!

নিতাইকে তো দুচক্ষের বিষ দেখেছে বরাবর। আর শচীনও ওদিকে খুব হুঁশিয়ার ছিল। মেয়েকে আগলে আগলে ফিরত।

কিন্তু এখন?

এখন কোত্থান থেকে আগলাবি আগলা? সময়ে যদি একটা বেথা দিতিস তাও বা হত। এই তত বরেন, মেয়েটার ওপর ওর যথেষ্ট লোভ ছিল, জাতে ও বামুন, দিতে পারত অনায়াসে। তা নয়। মেয়ে ওঁর দামী।

এখন? দামী মেয়ে এই তো ভেসে গেল।

বরেনের কথায় নিতাই গা ঝাড়া দিয়ে বলে, ওসব কথা যাক, এখন করা যাবে কি তাই ব? এদিকে তো এই বিপদ ঘটে গেল, ওদিকে মেয়ে হাওয়া

বরেন বিরক্ত স্বরে বলে, হাওয়া হোক, ঝড় হোক, আমাদের কি নিতাইদা? যার সঙ্গে চক্ষুলজ্জা সেই যখন

কিন্তু আমাদের, ইয়ে আমাদের আর একবার হাসপাতালে না যাওয়া কি ঠিক হল? লাশটা–

বরেন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে, ক্ষেপেছ দাদা! খাল কেটে কুমির আনতে চাও? লাশ নিতে গেলে, জেরার চোটে তোমাকে একেবারে ফাঁস করে ছাড়বে না? এ বাবা যাদের মড়া তারা বুঝবে। অজ্ঞাত পরিচয় লিখে গাদায় জ্বালিয়ে দেবে। চুকে যাবে ল্যাঠা।

চুকে তো যাবে নিতাই চিন্তিত স্বরে বলে, যদি রায়বাঘিনী হঠাৎ এসে পড়ে বাপের খোঁজ চায়?

চাইবে, পাবে না। বরেন মুখ বাঁকিয়ে বলে, যে যা চায়, সে তা পেলে তো জগতে কোনও সমস্যাই থাকত না।

তাহলে বলছিস, চেপে বসে থাকব নিশ্চিন্দি হয়ে?

নিশ্চয়।

.

ঠিক সেই সময় কৌশিকদের বাড়িতেও এই রকম আলোচনাই চলছে।

সুদক্ষিণা প্রশ্ন করেছে তাহলে দাদা চুপ করে বসে থাকবে?

কৌস্তুভ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কিছু করে উঠতে পারেনি।

পারবে কি করে, অপর্ণার সামনে বেশী উদ্বেগ প্রকাশও বারণ। ছুটোছুটি করতে উঠলে, বিপদ আবার কোন্ দিক থেকে আসবে কে বলতে পারে?

সুলক্ষণা নিজের ঘরে বসে আছেন।

সুদক্ষিণা পাশের কাদের বাড়ি থেকে কোথায় যেন ফোন করে এসেছে।

এমনি একটা সময়ে ঘড়ির কাঁটাটা বোধ করি সাড়ে নটার ঘর ছাড়িয়ে দশটার দিকে এগোতে সুরু করেছে, হঠাৎ বংশী ছুটে এসে খবর দিল এসেছে!

.

এসেছে?

অপর্ণা একবার উঠে বসেই শুয়ে পড়ে বলল, পাখাটা একটু জোরে– তারপর বলল, একা? না দুজন?

সুদক্ষিণা দ্রুত নীচে নেমে যাচ্ছিল, সুলক্ষণা ডেকে থামালেন। বললেন, বেশী কিছু বকাবকি করতে যাসনে।

বকাবকি করতে যাব না? সুদক্ষিণা ফিরে দাঁড়াল, এক প্লেট সন্দেশ নিয়ে সামনে ধরব তাহলে? এই বলছ?

হ্যাঁ তাই বলছি হাসলেন একটু সুলক্ষণা।

সুলক্ষণা বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা কোন দিক থেকে আর কি কারণে এই মূর্তি নিয়েছে। মূল কারণ তো আবার তিনি নিজেই। চট করে কিছু বলে বসা ঠিক নয় এ বোধ রয়েছে। তাই সুদক্ষিণাকে বিশ্বাস করলেন না। নিজেই হাল ধরতে গেলেন।

আর নীচে নেমেই প্রথমে চোখে পড়ল চৈতালীর বিগত কালকের মতই বিবর্ণ নিষ্প্রভ অবনতমস্তক মূর্তিটা।

বিচলিত হয়ে গেলেন সুলক্ষণা, কিছু একটা বলতে গেলেন, এগিয়ে এল কৌশিক। খুব নীচু গলায় বলল, ওর বাবা কেমন আছেন জিগ্যেস কোর না মা।

জিগ্যেস করব না!

না। কারণ জিগ্যেস করবার কিছু নেই।

জিগ্যেস করবার কিছু নেই?

মানে বুঝতে দেরি হল না সুলক্ষণার। আস্তে বললেন, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

নানা ঝামেলায়! জীবনে জানি না এসব জায়গায় কি করতে হয়, না হয়। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করে–

সুলক্ষণা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, নে কাপড়-চোপড় একটু ছেড়ে নে তোরা, হাতমুখ ধো। রাত হয়েছে, খেতে বোস।

সুলক্ষণা ভাবলেন, খুব সহজ কথার মধ্য দিয়ে, আর অন্যমনস্কতার ভানের মধ্য দিয়ে, ব্যাপারটাকে হালকা করে নেবেন। গুরুত্ব কমিয়ে দেবেন।

কিন্তু চৈতালী?

চৈতালী কি তাই করবে?

চৈতালী কি অন্যমনস্ক হবে? হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসবে?

কৃচ্ছ্র সাধনের পদ্ধতি সে জানে না, কিন্তু মা-বাপ মারা গেলে যে অশৌচ পালনের কৃচ্ছু সাধন করতে হয়, তা সে জানে। আর করতেই যদি হয় তো, আঠারো আনাই হোক না? সেই পদ্ধতিই ধরে সে। কিছু না খাওয়ার পদ্ধতি।

.

বাতাসের মোড় ঘুড়ে গেল।

চৈতালীর পিতৃবিয়োগ, সমস্ত সংসারের কাছ থেকে একটু বিশেষ স্নেহ এনে দিল চৈতালীর জন্যে! তার অশৌচ পালনের কৃচ্ছসাধন সমস্ত সংসারের থেকে একটা যেন শ্রদ্ধা এনে দিল!

আর এই স্নেহ আর শ্রদ্ধার পরিপ্রেক্ষিতে চৈতালী যেন মূল্যবান হয়ে উঠল।

সুদক্ষিণা বললে, এই বংশী, খবরদার ওকে কিছু বলবি না।

বংশী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, আমি আবার কবে কি বললাম কাকে? বংশী যে চাকর, সেই চাকর।

ওসব কথা কেন? কিছু বলবি না, তাই বলে রাখছি। আর

কৌশিক বলে, মা, ও বেচারীকে এখন আর কিছুদিন কাজটাজ নাই করতে দিলে?

সুলক্ষণা ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলেন, বাপমরা অশৌচ ওর এখন, করবেই বা কি? করছেই বা কি?

না, তাই বলছি।

কৌস্তুভ এসে বলে, অপর্ণা বলছিল এ সময় ওকে

সুলক্ষণা ভুরু কুঁচকে বলেন, কাকে?

মানে তোমাদের এই মেয়েটার কথা হচ্ছিল। বলছিল, এ সময় ওর আত্মীয়-টাত্মীয়দের কাছে গেলেই ভাল হত।

তাহলে কোথায় ওর আত্মীয়রা আছে খুঁজে বার করো।

বলে চলে গেলেন সুলক্ষণা।

.

হ্যাঁ, বাতাসের মোড় ঘুরে গেছে বাড়ির। কাদাবালি মাখা যে পাথরকুচিটুকু সুলক্ষণা নিজে কাদা থেকে তুলে ধুলো-বালি ধুয়ে আঁচলে মুছে লোকচক্ষে ধরে আত্মসন্তোষ লাভ করেছিলেন, লোকে যদি সে বস্তুকে মূল্যবান বলে বুঝে নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, সোনা বাঁধিয়ে আঙটি বানাতে চায়, সুলক্ষণার ভাল লাগবে কেন?

সুলক্ষণার আর ওকে ঘষে-মেজে উজ্জ্বল করে তোেলবার অবকাশ থাকল কই? কোথায় থাকল বড়মুখ করে বলতে পারার অবকাশ, দেখলি তো আমার হিসেব ঠিক কি না? বুঝলি তো আমি কাঁচ কি হীরে চিনতে পারি কি না।

তাই চৈতালীর ওপর একান্ত স্নেহ থাকলেও ওদেরটা বাড়াবাড়ি ঠেকছে। সেদিন ওরা সুলক্ষণার বুদ্ধিকে বিদ্রূপ করেছিল, আজ সুলক্ষণা ওদের সুবুদ্ধিতে বিরক্ত হচ্ছেন!

কিন্তু সে কথা ওদের বোঝার ক্ষমতা নেই।

তাই সুদক্ষিণা চৈতালীকে দোতলায় নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লেগেছে, কতদূর লেখাপড়া করেছে চৈতালী, গল্পের বই পড়তে পারে কিনা। যদি পারে তো পড়ক না বসে বসে, কত তো গল্পের বই রয়েছে সুদক্ষিণার ঘরে। ওর ছেলেবেলার বইগুলোও আছে। বড়দের বেশী শক্ত বই না পড়তে পারে তো ওইগুলোই পড়ক। কত মজার মজার গল্প, দেশ-বিদেশের গল্প, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প

চৈতালীর বাবা মারা গেছে!

এই খবরটাই সুদক্ষিণাকে দ্রব করে দিয়েছে। আহা, হোক চোর-ঘঁচোড় বিচ্ছিরি বাবা, তবু বাবা তো! সুদক্ষিণা তো জানে, বাবা মারা গেলে কী কষ্ট হয়।

সুদক্ষিণার তো তবু মা আছেন।

মায়ের মত মা!

আর ও বেচারী জীবনে কখনো মাকে চোখেই দেখেনি।

তবে?

সহানুভূতি না এসে পারা যায়?

ভাল না বেসে পারা যায়?

এ সহানুভূতি, এ ভালবাসা চৈতালীর ওপরও কাজ করছে বৈকি। দূরীভূত করছে তার নিজেকে সরিয়ে রাখবার প্রচেষ্টাকে আর কাঠিণ্যকে।

সুলক্ষণার স্নেহ তাকে আশ্রয় দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, কিন্তু অনেকখানিটা জায়গা দিতে পারেনি, দিতে পারেনি নিজেকে নিশ্চিন্তে মেলে ধরবার মত অনেকটা পরিসর। যেন সুলক্ষণার একান্ত নিজস্ব বস্তু ছিল ও সুলক্ষণার হাতের খুঁটি। এই খুঁটিটি নিয়ে সুলক্ষণা ওঁর ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলার ছক্ পেতে বসেছেন।

সুলক্ষণার ইচ্ছা আর নির্দেশে নিয়ন্ত্রিত হয়ে চৈতালী নামক খুঁটিটি সুলক্ষণাকে জয়ের গৌরব এনে দেবে।

তাই সুলক্ষণার স্নেহগণ্ডির পরিসরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সেই দায়ের ভার বহন করছিল চৈতালী, সুদক্ষিণা আর কৌশিক সেই স্বল্পপরিসর ঠাই থেকে টেনে বার করে আনছে দায়হীন খোলা হাওয়ার দেশে।

তবু ভেসে যায় না চৈতালী।

সুলক্ষণাকেই আঁকড়ে থাকে।

শুধু মনের মধ্যে এক বিচিত্র আলোর খেলা চলে।

সুদক্ষিণা বলে, দেখ, বয়েস হিসেবে তোমাকে দিদি টিদি গোছের কিছু একটা বললে ভাল দেখাত, কিন্তু সে সব আমার কেমন আসে না। তাই নাম ধরেই ডাকি। কিছু মনে কর না তো?

চৈতালী কৃতার্থতায় রঙিন হয়ে ওঠে।

বলে, কী যে বলেন।

কৌশিক বলে, দেখ ক্ষে, অত ঘটা করে ক্ষমা চাওয়ার ফার্সটা না করে ওর এই সব আপনি আজ্ঞে গুলো বন্ধ করলে পারতিস। অন্তত সেটাই ভাল দেখাত। বয়সে খুব মারাত্মক একটা ডিফারেন্স আছে বলে তো মনে হয় না।

সুদক্ষিণা একটু লাল হয়ে উঠে বলে, জানি না তো বাপু। দেখে একটু বড় মনে হয়, তাই বলছি। তোমার বয়েস কত গো চৈতালী?

চৈতালী আস্তে বলে, একুশ।

তবে? সুদক্ষিণা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আমার তো সবে কুড়ি সুরু হয়েছে।

মেয়েরা তো কখনো ঠিক বয়েস বলে না– কৌশিক মন্তব্য করে।

মেয়েদের সম্পর্কে এত জ্ঞান সঞ্চয় করলি কী করে ছোড়দা? সুদক্ষিণা বলে, তবে এখনো একটু কাঁচা আছিস। এ জ্ঞানটুকু জন্মায়নি ঠিক বলে না বলে, বয়েস বাড়িয়ে বলে। চৈতালী–

আহা ওর কথা কে বলছে? আমি বলছি তোর কথা–

আমার কথা? বড্ড তোর সাহস বেড়েছে দেখছি ছোড়দা, আমায় রাগাতে আসছিস। আমি বয়েস কমাচ্ছি?

অসম্ভব কি?

ওঃ তাই তো! আমার বয়েস জানিস না তুই?

দেবতা জানে না, তো আমি কোন্ ছার!

বেশ, বেশ, আমি বলছি আমার বয়েস দশ! হল তো?

ভাইবোনের এই কৌতুক কলহে হেসে ফেলে চৈতালী আর বোধ-করি স্থানকাল-পাত্র বিস্মৃত হয়েই বলে ওঠে, মেয়েদের বয়েস লুকোনো নিয়ে আমার মেসোমশাই যা মজার একটা গল্প বলতেন। বিলেতের গল্প অবিশ্যি। ওখানের একজন ধনীলোক কাজে অবসর নেবার পর গ্রামে বাস করতে গেলেন। থাকতে থাকতে তার ইচ্ছে হল, গ্রামে বিখ্যাত হবার জন্যে কিছু একটা করবেন। ভেবে চিন্তে তাই ঘোষণা করলেন, গ্রামে যদি কোন একশো বছরের বুড়ি থাকে, তাকে তিনি তাঁর বাকী জীবন মাসে পঁচিশ পাউন্ড করে পেনসন দেবেন।

দেখা গেল, ঘোষণা শুনে সেই পেনসনের দাবীদার হয়ে কেউ এল না।

তিনি ধরে নিলেন গ্রামে একশো বছরের বুড়ি নেই। তখন আবার ঘোষণা করলেন গ্রামের আশী বছরের বুড়িরা ওই পেনসন পাবে।

দেখা গেল তাতেও একজনও সাড়া দিল না। ধনী ভদ্রলোক ক্ষুব্ধ হয়ে ভাবলেন, গ্রামের মহিলারা সকলেই কি অল্পজীবী?

অতঃপর তিনি বললেন, ষাট বছর বয়সের মহিলা মাত্রেই তার ওই পেনসনটা পেতে পারবেন। এমন আশ্চর্য তাতেও গ্রাম নীরব। উনি চটে মটে বললেন, ব্যাপার কি? এখানে কি পাইকারি হারে বয়স্থা মহিলারা খুন হন? নচেৎ এ রকমটা হবে কেন?

রেগে গিয়ে ভদ্রলোক চল্লিশ বছরের মহিলাদের ওপর পেন ধার্য করলেন, এবং তাতেও সেই পুরনো ফলই পেলেন। এবারে ভদ্রলোক আর রাগও করলেন না। আর হতাশও হলেন না। খুব কৌতুক অনুভব করলেন। সেই কৌতুকের বশবর্তী হয়ে বললেন, পঁচিশ বছরের মেয়েদের এই পেনটা দেবেন তিনি।

এইটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দলে দলে মহিলা আসতে সুরু করলেন তাঁর বাড়িতে। পঁয়ত্রিশ থেকে পঁচানব্বই পর্যন্ত। ভদ্রলোক তো দিশেহারা।

ঝোঁকের মাথায় গল্পটা বলে ফেলে ভারী কুণ্ঠিত হয়ে পড়লো চৈতালী। এসে পর্যন্ত একসঙ্গে এর সিকি কথাও কোনদিন বলেনি। তা ছাড়া তার কি এখন মজার গল্প বলার সময়? কী না জানি ভাবল এরা।

এরা কিন্তু কিছুই ভাবল না। বরং হেসে উঠল এবং কৌশিক সপ্রশংস হাসি-হাসি মুখে প্রশ্ন করল, কার কাছে শুনেছিলে এ গল্প?

আমার মেসোমশাই।

বলে আরও জড়সড় হয়ে পড়ে চৈতালী। তার যে একটা অতীত ছিল, এবং সেখানে তার আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি ছিল, একথা কি প্রকাশ করবার? অন্তত এদের কাছে প্রকাশ করবার? সেই অতীতকে নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলবার সংকল্পই তো করেছে সে, বাপের মৃতদেহের সামনে।

কিন্তু এরা এতসব বোঝে না।

বরং এরা অবাকই হয়, আর বোধকরি কিছুটা লজ্জিতও।

ইস্, সুদক্ষিণা আবার জিগ্যেস করেছিল বাংলা বই পড়তে পারে কি না, অন্তত ছোটদের বই-টই।

কৌশিকও আগে ভাবেনি, এমন গুছিয়ে সুন্দরভাবে গল্প বলার মত বুদ্ধি ওর থাকতে পারে। এমন এক উৎকট পরিবেশের মধ্যে দেখা গিয়েছিল মেয়েটাকে!

সন্দেহ নেই, সত্যিই ভাল ভদ্রঘরের মেয়ে, কোন একটা দৈব-দুর্বিপাকে পড়েই

কী সেই দুর্বিপাক?

প্রলোভনে ভুলে কুলত্যাগ?

গুণ্ডার অত্যাচার?

দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় গৃহচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ে

কিন্তু তাই বা কেমন করে হবে? বাপ ছিল তো! বাপের কাছেই ছিল এযাবৎ। বাপের পদবী বলেছিল মজুমদার। অর্থাৎ জাত ভালই। কী তবে ওর ইতিহাস?

যে ইতিহাস এমন একটা মার্জিত বুদ্ধি সভ্য মেয়েকে ছিঁচকে চুরিতে নামায়!

কেমন করে উদ্ধার করা যায় সে-ইতিহাস।

ওর পক্ষে কি বলা সম্ভব?

আর ওকে জিগ্যেস করাই কি কৌশিকের পক্ষে সঙ্গত?

তবে যেটা জিগ্যেস করা সম্ভব, সেটা করে।

তোমার সেই মেসোমশাই বুঝি মারা গেছেন?

হ্যাঁ। আমার যখন এগারো বছর বয়েস।

ও! তোমায় বুঝি খুব ভালবাসতেন তিনি?

খুব! কত যে গল্প বলতেন! আর কত বিষয় যে শিক্ষা দিতেন সেই সব গল্পের মধ্যে দিয়ে।

বলেই পাংশুবর্ণ হয়ে ওঠে চৈতালী।

শিক্ষা!

শিক্ষা কথাটা মুখে আনছে সে!

যদি কৌশিক হেসে ওঠে?

যদি বলে ওঠে, তা বটে। খুব ভাল শিক্ষাই তিনি দিয়েছিলেন।

কিন্তু এরা তা করবে না।

এরা ইতর নয়।

তাই সুদক্ষিণা বলে ওঠে, যাই বল মেসোমশাই পিসেমশাই থাকা খুব ভালো। বেশ আদর হয়, তাই না?

আর কৌশিক বলে, উনিই বোধ হয় পড়াতেন?

চৈতালী মাথা নীচু করে বলে, যতদিন ওঁর কাছে থেকেছি। অবিশ্যি স্কুলের পড়া পড়াতে বিশেষ ইয়ে করতেন না, গল্প কবিতা এই সবের মধ্যে দিয়ে

গল্প কবিতা!

ও বাবা! আবার স্কুলেও পড়েছে!

কর্পোরেশান স্কুলেই খুব সম্ভব। সুদক্ষিণা সেটা জেনে নেবার কৌতূহল সংবরণ করতে পারে না, বলে, কোন্ স্কুলে পড়তে?

ভিক্টোরিয়া। ওটাই তবু বাড়ির কাছে ছিল—

ভিক্টোরিয়া! সেরেছে। তাহলে তো5, সুদক্ষিণা যেন বিচলিত হয়ে ওঠে।

কোন্ ক্লাস পর্যন্ত এটা জিগ্যেস করবে কিনা ভাবতে ভাবতেই উত্তরটা পেয়ে যায়। চৈতালী নিজেই বলে। স্বগতোক্তির মতই বলে ওঠে, কদিনই বা পড়তে পেলাম। ক্লাস সিক্সে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই তো

আহা, সুদক্ষিণা আপন মনে বলে, আর পড়া হল না? কেউ পড়তে পেল না– ভাবতে এত খারাপ লাগে।

চৈতালী মৃদু স্বরে বলে, না, তারপরও পড়েছিলাম দুতিন বছর, বাবার কাছে আসার পর, সে একটা বাজে স্কুল

সেই বাজে স্কুলের সামান্য মাইনেও যে বাবা ঠিকমত দেয়নি বলে স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে দিয়েছিল, সে কথা আর বলে না চৈতালী। তা ছাড়া নিজের সেই বদভ্যাস! স্কুলের অন্য মেয়েদের জিনিস বাড়িতে আনা। ছি ছি!

বাবার কাছে আসার পরের ইতিহাস তো সবই বাজে বিশ্রী। চোর হয়ে উঠেছিল চৈতালী তখন।

ভাবলে অবাক লাগে, কী মুখরা, কী রণচণ্ডী ছিল সে! নিজের সেই মূর্তিটাকে বুঝি এখন আর চৈতালী চিনতে পারছে না।

তার বাবার বন্ধুদের আড্ডার সেই রসদ যোগানদার মেয়েটা কি সত্যিই চৈতালী?

২. ছবিগুলো চোখের সামনে

ছবিগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠছে, চলে যাচ্ছে, ছুটোছুটি করছে।…

সেখানে নিতাইকাকা আছে, বাবা আছে, বরেন আছে, আর আছে কতকগুলো জঘন্য নোংরা গুণ্ডা শ্রেণীর লোক। তাদের মধ্যে পাঞ্জাবী আছে, বেহারী আছে, মুসলমান আছে, বর্মী আছে, চীনে আছে, আরও কত রকম যেন জাতের লোক আছে, তারা তাড়ি খাচ্ছে, তাস খেলছে। মাতাল হয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে, আবার কী সব ষড়যন্ত্র করছে ওরই মধ্যে।

প্রথম প্রথম বুঝতে পারত না চৈতালী, পরে বড় হয়ে বুঝেছে, ওরা সব লুকিয়ে আফিং কোকেনের ব্যবসা করে। ওর মধ্যে আবার একজন একবার সোনা নিয়ে ব্যবসাও ধরেছিল। ধরা পড়ল, শেষে জেলে গেল।

তবে এই সব লোকের সামনে চৈতালীকে বার করত না কোনদিন বাবা। প্রাণ গেলেও না।

নিতাইকাকা বলত, আহা-হা তাতে কি? তোমার মেয়ে সবারই মেয়ের মত চা নিয়ে গেল, খাবার পরিবেশন করল–এতে দোষ কি?

বাবা বাঘের মত গজরে উঠে বলত, না!

পরিবেশন করত বরেন।

বরেন আসত বাড়ির মধ্যে।

মানে তখন, যখনও বাড়ী বলে বস্তুটা ছিল বাবার। শ্যামপুকুর বাই লেনের সেই নোনাধরা ইট বার করা বাড়িটাও রাখতে পারেনি বাবা, বেচে দিয়েছিল। তারপর থেকে নানাস্থানী।

কিন্তু তখন বাড়িটা ছিল।

এঁদোপড়া রান্নাঘরটায় প্রকাণ্ড একটা উনুন জ্বেলে বিরাট হাঁড়িতে মাংস আর ভাত রাঁধতে হত এক একদিন। বরেন ভেতরে এসে নিয়ে নিয়ে যেত।

বরেনের চেহারাটা মনে পড়তেই ঠোঁট কামড়ালে চৈতালী। ঠিক যেন রাস্তার একটা ঘেয়ো কুকুর। তেমনি মানঅপমানহীন, তেমনি লোভী।

কতই বা বয়েস তখন চৈতালীর?

পনেরো, ষোলো। তখন থেকেই কী বিরক্তই করত চৈতালীকে।

জোর নয়, দাবী নয়, উৎপাত অত্যাচার নয়, শুধু গা ঘিনঘিনে কাঙালপনা। একদিন চৈতালী একখানা লোহার খুন্তি উনুনের আগুনে লাল টকটকে করে তাতিয়ে বরেনের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেছিল, দেখ, আর কোনদিন যদি এই সব কথা বলতে আসো, জেনো তোমার কপালে এই আছে। কাউকে বলে দিয়ে শাস্তি করাতে যাব না আমি, নিজের হাতেই শাস্তির ব্যবস্থা করব।

সেদিন থেকে গুম হয়ে গিয়েছিল বরেন, আর বেশী কথা বলত না। নীরবে রান্নাঘরে আসত যেত।

.

কিন্তু বাবার মনের ইচ্ছে জানত চৈতালী। বাবা ওই লক্ষ্মীছাড়া বরেনটাকেই মনে মনে জামাইয়ের আসনে বসিয়ে রেখেছিল। ভেবেছিল একবার একটু বেশী পয়সা পিটে নিয়ে এসব কাজ ছেড়ে দেবে, শ্বশুর জামাই দুজনে মিলে একটা সত্যিকার সৎ কারবার ফঁদবে। বাকী জীবনটা নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে কাটাবে।

হঠাৎ চোখ উপচে জল এল চৈতালীর।

বাবাকে সে শ্রদ্ধা করত না, ভক্তি করত না, কিন্তু ভালবাসত। ভাল না বেসে কি করবে?

বাবা ভিন্ন আপনার লোক তার রইল কোথায়?

মেসো মারা যেতেই নাকি দেখা গিয়েছিল অগাধ দেনা তার। নিঃসন্তান মাসী যথাসর্বস্ব বেচে দিয়ে কাশী-বাসিনী হবার উপক্রম করছেন, সেই সময় বাবা গিয়ে পড়ল মেয়ে মেয়ে করে। মাসী চোখের জল মুছতে মুছতে ছেড়ে দিলেন। বাবা মেয়ে মেয়ে করেছিল অবশ্য নিতাইয়ের প্ররোচনায়। নিতাই বলেছিল একটা কমবয়সী মেয়ে দলে থাকলে ব্যবসার পক্ষে খুব জুতের। তাকে দিয়ে মাল পাচার করা যায়, কেউ সন্দেহ করতে পারে না। স্কুলের বই খাতা ব্যাগের মধ্যে দিয়ে

তা করেছিল সে কাজ চৈতালী অনেকবার, কিন্তু ওই বদ লোকগুলোর হাতে তাকে ছেড়ে দেয়নি বাবা। নিতাইয়ের পরামর্শে নিয়ে এলেও তার পিতৃচেতনা মেয়েকে অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছে। মেয়েটাকে বড্ড বেশী ভালও বেসে ফেলেছিল। তবে প্রথম প্রথম চৈতালীকে বাগে আনতে খুব বেগ পেতে হয়েছে বৈকি শচীন মজুমদারকে। মাসীর বাড়ির তুলনায় বাবার বাড়িটাকে নরক মনে হত চৈতালীর। প্রতি মুহূর্তে সেই মনে হওয়াটা ধরা পড়ে যেত। বাবা সেটা বুঝত না তা নয়।

বুঝত আর রেগে রেগে বলত, মাসী মেসো উপকারের মধ্যে এইটি দেখছি করেছেন, মেয়েকে আমার রাজনন্দিনী বানিয়ে রেখে গেছেন।

তা চৈতালী কথায় কম যেত না। চৈতালীও বলে উঠতো, বড় অন্যায় করেছে। মা-মরা মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে হাড়ির হাল করে মানুষ করলেই খুব ভাল হত, কেমন?

তা যেমন অবস্থা তেমন ব্যবস্থাই ভাল। রাজার হাল করে আপনি তো কাটিয়ে গেলেন কর্তা, শেষরক্ষা হল? পরিবারের গলায় দেনার পাহাড়টি ঝুলিয়ে তো মরলেন।

সত্যিই তাই করে গেছেন ভদ্রলোক। অথচ খোদমেজাজি বেপরোয়া, সৌখিন আর দরাজ বুক সেই মানুষটাকে দেনা করে বাবুয়ানা করে গেছেন বলে নিন্দে করতেও বাধে।

চৈতালীর চুপ করে থাকার সুযোগে বাবা বলত, আমিও একদিন ভদ্রলোক ছিলাম রে চৈতি, তোর ওই ফ্যাসানি মেশোর সঙ্গে এক শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যখন একসঙ্গে বসে নেমতন্ন খেয়েছি, ওর থেকে আমাকে ভাল দেখাত, বুঝলি? এখন তুই দেখছিস বাবার হাড়ের ওপর চামড়া নেই। গরীব ছিলাম বটে, কিন্তু এমন ছোটলোক ছিলাম না, সেটা শুনে রাখ।

বাবার চেহারা যে একদা ভালই ছিল সেটা চৈতালীও দেখেছে বৈকি, মানুষটাকে দিয়ে নয়, ছবির মধ্যে। মাসীর ঘরের দেয়ালে একটা বর-কনের ছবি দেখেছে বরাবর। ছোটমাসী মেয়েটাকে চিনিয়ে দিয়েছিল, তোর মা তোর বাবা।

সেই বরবেশী বাবাকে কি ভালই লাগত চৈতালীর!

কিন্তু বাবা যখন তাকে নিতে গেল? বাবার চেহারা দেখে সে আড়ষ্ট হয়ে গেল। রোগা পাকসিটে, অর্ধেক চুল পাকা, পেশীর রেখায় শ্রীহীন মুখ, আর পোড়া পোড়া তামাটে রঙ। সেই লোকটাকে দেখে তার স্রেফ একটা ঘোটলোকই মনে হয়েছিল।

তা বাবার কথার উত্তরে ঝঙ্কার দিয়ে উঠত চৈতালী, শুনে তো রাখছি, বলি ছোটলোক হতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?

কে?

শচীন যেন আকাশে বার্তা পাঠাচ্ছে এইভাবে ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠত, কে? এই তোমারই গর্ভধারিণী!

মা? আমার মা?

আলবাৎ! কেন, মরতে কে বলেছিল তাকে সাতসকালে? বড় ডাক্তার ডাকবার ক্ষমতা যার না থাকে, তার পরিবার বাঁচবে না? মরে গিয়ে দগ্ধে রেখে যাবে?

তা মা কি রাগ করে আত্মহত্যা করেছিলেন বাবা?

না করুক। বলি মরল তো ভাল চিকিৎসার অভাবে। আমি যদি বড় বড় ডাক্তার ডাকতে পারতাম, দামী দামী ওষুধ খাওয়াতে পারতাম, সাধ্যি ছিল ওর দুম করে মরে যাবার? যাক, আমিও সেই চিতে ছুঁয়ে দিব্যি করলাম, শালার বড়লোক হতেই হবে, যেত তেন প্রকারেণ।

আবার এক এক সময় ভারী মনমরা হয়ে যেত বেচারা শচীন মজুমদার। হয়তো এমনি, হয়তো বা ভাগ-বখরা নিয়ে দলের লোকদের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেলে। তখন মেয়েকে কাছে ডেকে বলত, দেখ চৈতি, এ শালার ব্যবসা-বাণিজ্য আর নয়। তোর একটা বিয়ে দিয়ে জামাই ব্যাটার সঙ্গে মিলে একটা সৎ কারবার ফাঁদব।

চৈতালী বলত, কিন্তু সৎ হবার ক্ষমতা তোমার আর আছে বাবা?

শচীন মজুমদার বলত, মাঝে মাঝে সে ভয়ও করে চৈতি, আবার ভাবি ওই হারামজাদা পাজীগুলোর সঙ্গ ত্যাগ করতে পারলে

হ্যাঁ পারলে, তবে পারবে না।

বলে মুখ ঝামটে চলে যেত চৈতালী।

আর ভাবত মা যদি না অকালে মরত তার, তাহলে মাসীর বাড়ির মত সংসার তাদেরও হত। তার মা, মাসীর মত রোজ বিকেলে স্টোভ জ্বেলে খাবার করতে বসত, আর চৈতালীকে ডেকে ডেকে বলত, আয় কাজ শেখ। সিঙ্গাড়াগুলো গড়ে দে। হয়তো হেসে হেসে বলত কচুরি বেলতে না শিখলে বিয়ে হয় না, বুঝলি?

সেই এগারো বছর বয়সেই তো কত কাজ শিখে ফেলেছিল চৈতালী। ঘর সাজানো, টেবিল গোছানো, আলনায় কাপড়-চোপড় ঠিকমত করে ঝোলানো, সব শেখাতেন মাসী।

ফুলগাছের টব ছিল ছাদে, বেল মল্লিকা গোলাপের, মাসীর সঙ্গে জল দিতে উঠত, আর মাসীকে বলতো, আচ্ছা মা, ছাতে কেন শিউলি গাছ পোঁতো না?—

হ্যাঁ মাসীকেই মা বলে ডাকত চৈতালী।

মাসী বলত, মা ডাক শিখিয়েছি, কিন্তু মা তোর ছিল রে, আমাদের সকলের ছোট্ট বোনটা। তাকে মুছে ফেলতে চাই না। তোর ওই ছবির মাকে তুই প্রণাম করবি, ভালবাসবি, ভক্তি করবি, বুঝলি?

চৈতালী বলত, ধ্যেৎ! নেই, দেখতে পাই না, তাকে আবার ভক্তি ভালবাসা। না দেখলে বুঝি ভালবাসা যায়?

মাসী বলত, যায়! যাবে না কেন! ভগবানকেও তো আমরা দেখতে পাই না, তাবলে

মেসোমশাই শুনতে পেলে হৈ চৈ করে উঠতেন, হয়েছে, মাথা-খাওয়া শুরু হয়েছে। দেখ ভগবান জিনিসটা একটু দুষ্পচ্য, ওটা এ বয়সে হজম হয় না। ওটা আর ওকে এক্ষুনি গুলে খাওয়াতে বোসো না। মেলোমশায়ের কথাগুলো কী সুন্দরই ছিল! এমন কি মাসীর বাড়িতে যারা বেড়াতে আসত, তারাও যেন সব সুন্দর চমৎকার চকচকে ঝকঝকে।

আর তার এই বাবার বাড়িতে?

ভাবলেই চোখে জল আসত চৈতালীর।

আজ আবার সেই বাড়ির জন্যেই চোখে জল আসছে।

বাবা মরে গেল তার।

আর কোনদিন ভাল হবার দিন পেল না বাবা, দিন পেল না সৎ কারবার ফঁদবার।

.

অবশ্য সেই সৎ আর ভাল সম্বন্ধে তখন মোহ খুব একটা আর ছিল না চৈতালীর। চুরি জোচ্চুরি লোক ঠকানো, এগুলোকে সে প্রায় বাহাদুরীর পর্যায়ে ফেলত, এবং জগতে যে ভাল লোক বলতে কেউই নেই, সবাই চোর, এ ধারণা ক্রমশই বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল তার।

বাবার মন্ত্রে দীক্ষা হচ্ছিল চৈতালীর, তবে বাবার রুচিতে তার রুচির মিল ছিল না। বরেনকে বাবা জামাই করবার বাসনায় আছে মনে করলেই বাবার ওপর রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যেত, এবং বরেনকে বঁটা মারতে ইচ্ছে করত।

তবু কৌশিকের মত আলোয় গড়া মানুষও যে পৃথিবীতে আছে, তা তো তখন স্বপ্নেও জানত না চৈতালী।

জানত না সুলক্ষণার মত এমন মা থাকে জগতে।

সুদক্ষিণাকে ভয় করেছিল প্রথমটা।

সে ভয় ভেঙে যাচ্ছে।

ভয় ভাঙছে, কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য আসছে কি? দৈবাৎ অসতর্কে ভুলে গিয়ে হয়তো একটু সহজভাবে কথা কয়ে উঠল, পরক্ষণেই কুঁকড়ে যায় মন, মনে হয় আমি ওদের সঙ্গে সমান হয়ে কথা বলছি?

ওরা কী, আর আমি কী!

আমি কি ওদের কাছে বসবারও যোগ্য?

সুলক্ষণা মহীয়সী, সুলক্ষণা করুণাময়ী, তাই চৈতালী এই স্বর্গে প্রবেশের অধিকার পেয়েছে।

না হলে কি হত!

ভাবতে গিয়ে শিউরে ওঠে চৈতালী।

শচীন মজুমদার নামক লোকটা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির ছাপ মেরে হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরে চালান হওয়ায় পর চৈতালী মজুমদার নামক মেয়েটাকে কি সেই বাঘ ভাল্লুকের দল আস্ত রাখত?

কিন্তু

আর একটা কথা স্মরণ করলেই সমস্ত মনটা তার কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসে।

কথা নয়, দৃশ্য।

প্রথম দিনকার সেই দৃশ্য।

একটা গেলাস চুরি করতে এসে ধরা পড়েছে চৈতালী!

চাকর বংশী তাকে জাপটে ধরে রেখেছে। ছি ছি ছি!

ভাবলে তখুনি মরে যেতে ইচ্ছা হয়। এরা আশ্চর্য মহানুভব, তাই সে দৃশ্যের কথা ভুলে গেছে। কিন্তু চৈতালী? সে কেমন করে ভুলবে?

তা ছাড়া

অপর্ণা!

অপর্ণা কি ভুলতে দেবে?

অপর্ণার চোখে তো আজও সেই প্রথম দর্শনের দৃষ্টি।

সেই ঘৃণা বিস্ময় আতঙ্ক!

দীর্ঘ পল্লবাচ্ছাদিত বিস্ফারিত দুই চোখে তেমনি করেই চেয়ে থাকে অপর্ণা চৈতালীর দিকে।

কথা বলে না।

না, দু একদিন কথা বলেছিল। বলেছিল, আমার বাপের বাড়িতে নতুন কোনও ঝি চাকরকে ঢোকাবার সময় প্রথমেই তার ঠিকানা জেনে নেওয়া হয়।

তারপর তার আগের জীবনের ইতিহাস জেনে নেওয়া হয়। মা বলেন, কে জানে বাবা চোর হবে কি ডাকাত হবে, খুনে হলেও হতে পারে। রান্নায় যদি বিষই মিশিয়ে দেয়। যাকে জানি না, শুনি না, তাকে বিশ্বাস কি?

চৈতালীর মুখ লাল হয়ে উঠেছিল।

চৈতালী তবু মৃদু স্বরেই বলেছিল, তা তো ঠিক। তবে বিশ্বাস যাকে নেই, সে যে তার নাম পরিচয় অতীত ইতিহাস সব ঠিক বলবে, তাতেই বা বিশ্বাস কি?

অপর্ণা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, সেই তো! আমার বাবা বলতেন, আগুন সাপ আর চোর, এই তিন নিয়ে ঘর করা যায় না। হয় ঘর যাবে, নয় প্রাণ যাবে।

নিজের জবানে সব কথা গুছিয়ে বলতে পারে না অপর্ণা, বাপ-মায়ের জবানীতে বলে।

অপর্ণার কাছ থেকে সরে সরে বেড়ায় চৈতালী। দুধ দিতে, খাবার দিতে, একটি একটি করে গরম লুচি ভেজে ঘরে দিয়ে আসতে অপর্ণার কাছে আসতেই হয় বটে, সাধ্যপক্ষে কথা বলে না। বোবা পুতুলের মত যায় আসে, কাজ করে।

কি জানি যদি অপর্ণা তার মার নিয়মে চৈতালীর অতীত ইতিহাস জানতে চায়!

সে যে বড় ভয়ানক।

কিন্তু সুলক্ষণাকে তো সেদিন সব বলেছিল চৈতালী, সুলক্ষণা কি সে কথা কাউকে বলেননি?

চৈতালী ভেবেছে।

ভেবে ভেবে অনুমান করেছে, সুলক্ষণা সে সব কথা নিজের মধ্যেই আবদ্ধ রেখেছেন।

আশ্চর্য, আর কোনদিন একটিও কথা জিগ্যেস করলেন না সুলক্ষণা। যেন ভুলে গেছেন, চৈতালী এ বাড়ির লোক নয়। ভুলে গেছেন, চৈতালী এই সেদিনও এ বাড়িতে ছিল না।

যদি না ভুলতেন

যদি চৈতালীর জীবনের প্রতিটি দিনের ঘটনা জানতে চাইতেন?

চৈতালী কি তাহলে বলতে পারত পৈতৃক বাড়ি বিক্রী করে ফেলার পর হতভাগা শচীন মজুমদার একটা তরুণী অনূঢ়া মেয়ের হাত ধরে কত ঘাটের জল খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত মাঠকোঠায় এসে পৌঁছেছিল! সে ইতিবৃত্ত কি বর্ণনা করার?

মেয়েকে শচীন কখনো পরিচয় দিয়েছে ভাইঝি বলে, কখনো ভাগ্নী বলে, কখনো বলেছে বন্ধুর মেয়ে। চৈতালী রেগে উঠে প্রশ্ন করলে বলেছে, আহা বুঝছিস না, আমার মত হতভাগার মেয়ে তুই, এটা লোককে বলতে চাই না!

অথচ এই বোকামীর জন্য একবার একটা ভাল আশ্রয় ছাড়তে হয়েছিল তাদের।

বাড়িওলি-গিন্নী চৈতালীকে সুনজরে দেখেছিলেন, তার কী একটা অসুখের সময় চৈতালী সেবা করেছে, তার সংসারের রান্না করে দিয়েছে। ওর পরিপাটি কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি, কিন্তু একদিন বাধল বিপত্তি।

হঠাৎ গিন্নী একদিন ডেকে প্রশ্ন করলেন, হ্যাগা বাছা, শচীনবাবু তো বলে তুমি নাকি তার ভাগ্নী, তবে তুমি বাবা বাবা কর কেন ওকে?

চৈতালী জোর দিয়ে বলে ফেলেছিল, উনি ভুল বলেছেন, উনি আমার বাবা।

ভদ্রমহিলা রেগে গেলেন।

রেগে আগুন হয়ে বললেন, এমন কথা তো বাপের জন্মে শুনিনি। ভুল করে মেয়েকে বলবে ভাগী!

কথাটা শচীনের কানে গেল।

গেল তো গেল, শচীন যখন একটু রঙে রয়েছে। শুনতে পেয়ে বলে উঠল, বেশ করব বলব, আলবৎ বলব। আমার মেয়েকে আমি যা খুশী বলব, উনি জবাবদিহি চাইবার কে?

কে তা দেখিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।

আশ্ৰয়টা গেল। অমন ভাল আশ্রয়।

ভালমন্দ কত আশ্রয়ই গেল তারপর। এখন শচীন মজুমদার সেরা আশ্রয় পেয়ে গেছে, এরপরে আর বাসা খুঁজে বেড়াতে হবে না তাকে।

আর শচীন মজুমদারের মেয়ে?

তার কপালে তো স্বর্গবাস লেখা ছিল। সেই স্বর্গে এসে পৌঁছেছে সে। কিন্তু কদিনের জন্যে?

কে জানে?

অপর্ণার চোখ যেন তীব্র শাসন করে বোঝাতে চেষ্টা করে,–এ তোমার অনধিকার প্রবেশ।

সুলক্ষণা সুদক্ষিণার মত উচ্চমনা যদি হত অপর্ণা! তা নয় সে।

শুধু দেহটাই তার অসুস্থ নয়, মনটাও অসুস্থ।

সুদক্ষিণা গল্প করেছে

বিয়ের সময় কি সুন্দর চেহারা ছিল বৌদির! কী হাসিখুসি মুখ! কোথা থেকে যে এক বিশ্রী রোগ এল–

চৈতালী ভেবে পায়নি দেহে রোগ এল বলে মনেও রোগ আসবে কেন।

ভেবে পায়নি বলেই সুদক্ষিণার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।

সুদক্ষিণা বলেছে, বৌদির কথায় কখনো কিছু মনে করো না ভাই। উনি একটু ওই রকমের। ছোড়দা বলে–

সব কথায় ছোড়দার কথা আনে সুদক্ষিণা। কারণ ছোড়দার সঙ্গেই যত গল্প সুদক্ষিণার।

সেদিন চৈতালীকে একটা বই হাতে দিয়ে বসিয়ে ছুটে যায় তিনতলার ঘরে। হাঁপিয়ে বসে পড়ে বলে, দেখ ছোড়দা, আমাদের মোটেই উচিত নয় ওকে বংশীর অ্যাসিস্টেন্ট করে রেখে দেওয়া! আসলে ও সত্যিই ভদ্র ঘরের মেয়ে, শুধু বাবার দোষে

কিন্তু বাপের ওপর কি ভালবাসা! বাবাঃ!

খুবই স্বাভাবিক। আর যখন কেউ নেই।

সুদক্ষিণা একটু চুপ করে থেকে বলে, কিন্তু দেখ ছোড়দা, একটা কথা আমি ভাবছি

ওরে বাবা তুই আবার ভাবছিস? শুনি কি ভাবনা?

কথাটা গুছিয়ে গাছিয়ে বলে সুদক্ষিণা।

বলে, ওই অশৌচ না কি, ওটা মিটে গেলেই তো মা আবার চৈতালীকে রান্নাঘরে ভরতি করে দেবেন, যার জন্যে সেই অদ্ভুত অবস্থায় ওকে ঘরে তুলে নিয়েছেন মা পথ থেকে।

কিন্তু সেটা কি ন্যায়ধর্ম এবং মানবিকতা হবে? চৈতালী যখন একটা সত্যিকার আস্ত ভদ্রমেয়েওর মধ্যে বস্তু রয়েছে, সে বস্তুকে মূল্য দিয়ে ওকে উঁচু কোঠায় তুলে নেওয়া যায়। ওকে একটা সত্যিকার মানুষে পরিণত করা যায়।

যেটা করা যায়, সেটা না করা কি অমানবিকতা নয়? নিজেদের সুবিধের জন্যে রাঁধুনী করে রেখে দেওয়া হবে ওকে!

.

তা এ কথাটা যে একা সুদক্ষিণাই ভেবেছে তা তো নয়।

কৌশিকও ভেবেছে বৈকি।

সেদিন অতগুলো ঘণ্টা চৈতালীর সঙ্গে নানা বিপাকের মধ্যে ঘুরে বেড়িয়ে এবং সদ্য পিতৃশোকাতুর মেয়েটার সঙ্গে একত্রে অতটা রাস্তা এক গাড়িতে আসায়, অনেকটা পরিচয় ঘটেছে। তারপর আরোই ঘটছে।

সে পরিচয় অনেকটা ভাবিয়ে তুলেছে কৌশিককে, অনেক প্রশ্ন এসেছে মনের মধ্যে। আর বার বার মনে হয়েছে, এখন তো দুচার দিন, তারপর?

তারপর তো সেই বংশীর শাগরেদী!

সেটা কি ঠিক হবে?

কিন্তু বলবে কে?

তুই বল, বলল সুদক্ষিণা।

কৌশিক বলে, আমায় আবার কেন জড়াচ্ছ বাবা এর মধ্যে? তোমার বান্ধবী হয়েছে, তুমি বলগে না তোমার মাকে।

সুদক্ষিণা হঠাৎ একটু চোরা হাসি হেসে বলে ওঠে, কে বলতে পারে, ভবিষ্যতে তোরই বান্ধবী হয়ে উঠবে কিনা।

কৌশিক হেসে উঠে বলে, তা তো নিশ্চয়, ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু আপাতত যখন হয়ে ওঠেনি, তখন আর–আমি কেন বাবা?

জীবে দয়া হিসেবে।

তুই পারবি না?

পারব না কেন? তবে তুই বললেই বেশী কাজ হবে।

বেশ।

এও ওদের এক হিসেবের ভুল।

মেয়ের কাছ থেকে না শুনে ছেলের কাছ থেকে শুনে বেশী প্রভাবিত হবেন সুলক্ষণা, এমন মনে করবার হেতু নেই।

সুলক্ষণা ওঁর ওই ক্ষ্যাপা ছেলেটার দিকেও গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।

তারপর বললেন, রান্নাবান্না করতে দেব না? তাহলে এই অখণ্ড সময়টা নিয়ে কি করবে ও?

লেখাপড়া করবে। কৌশিক নিশ্চিন্ত দৃঢ়তায় বলে, লেখাপড়ার থেকে ভাল জিনিস আর কী আছে?

কিন্তু তাতে আমার কী লাভ হল?

তোমার লাভ? তোমার কী লাভ হল তাই ভাবছ? সে কী গো মা! এই রকম তুচ্ছ একটা লাভ-লোকসানের কথা তুমি ভাবতে পারলে? তুমি?

সুলক্ষণা মনে মনে একটু নরম হলেন।

দেখলেন এটা সেই তার চিরকালের ছেলেটা। এর ওপর অন্য সন্দেহ করা অবিচার। তবু হাসলেন না।

বললেন, তা কোনদিন কি বলেছি, আমি কোনমতে স্বর্গ হতে টসকে, পড়েছি এ মর্ত্যভূমে বিধাতার হাত ফসকে। সংসারী মানুষ, সংসারের লাভ-লোকসান দেখব না?

না, দেখবে না।

আর ওকে যখন রাখলাম, তখন যে বড্ড ঠাট্টা করেছিলি?

কৌশিক হেসে উঠে বলে, সেই কথা দেখছি মনে করে রেখেছ? ঠাট্টায় বিচলিত হবার লোক তো তুমি নও বাপু! হল কি তোমার? লিভারের কাজ ভাল হচ্ছে না বুঝি?

যা পালা, ইয়ার ছেলে!

সুলক্ষণা একটু তাড়া দিলেন, তারপর বললেন, কিন্তু মনস্তত্ত্বের অনেক তত্ত্ব আছে, বুঝলি? কাজ একটা না দিলে ওরই বা ভাল লাগবে কেন? নিজেকে দরকারী মনে হবে কেন? সব সময় যদি মনে পড়ে, আমি এদের দয়ার ওপর আছি, তাহলে স্বস্তি পাবে কেন?

তা কৌশিক তো পাগলই।

তাই পাগলের মতই একটা কথা বলে বসে।

তা আমিও তো তোমাদের সংসারের কোন কাজে লাগি না। নিজেই তো বল, সংসারের একটা কুটোও ভাঙতে পারে না। কিন্তু কই স্বস্তির কিছু অভাব তো নেই আমার? সর্বদা তো মনে পড়ে না, আমি সুলক্ষণা দেবীর দয়ার ওপর পড়ে আছি।

এবার না হেসে পারেন না সুলক্ষণা। হেসে ফেলেন। হাসতে হাসতে বলেন, তোর যেমন কথা! তুই আর ও?

আহা একেবারে এক রকম না হলেও, কৌশিক মার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তুমি তো ওর ভার নিয়েছ? ওর মা হতে স্বীকার পেয়েছ?

সুলক্ষণা আরও হেসে ওঠেন, মা নয়, মাসী।

সে তো তোমার হিংসুটে ছেলেমেয়ে দুটোর ভয়ে।

ও বলেছে বুঝি তোকে? খুব গপপো করেছিস ওর সঙ্গে, কেমন?

কৌশিক বলে, করেছি বৈকি। একটা মানুষ, যোবা নয়, কালা নয়, তার সঙ্গে সাক্ষণ এক বাড়িতে থাকছি, কথা কইব না?

তা তোর দিক থেকে তো তুই খুব উদারতা মানবিকতা হৃদ্যতা আরও এ ও তা দেখাচ্ছিস, কিন্তু ক্ষেণু? ক্ষেণু তো ওকে দেখতেই পারে না। ওকে না খাঁটিয়ে শুধু যদি আদর করে মানুষ করে তুলতে থাকি, ক্ষেণু রেগে আগুন হবে না?

কৌশিক একটু চুপ করে থেকে গম্ভীরভাবে বলে, তাহলে বুঝতেই হবে মেয়ে মানুষ করবার ক্যাপাসিটি তোমার নেই। নিজের মেয়েটাকে মেয়েমানুষ করেই রেখে দিয়েছ। হিংসুটি খলকুটি গাঁইয়া মেয়ে।

তারপর হেসে উঠে বলে, আসলে এ বার্তা ক্ষেরই প্রেরিত। আমি দূত মাত্র।

ক্ষেণুর!

হ্যাঁ। ওই আমাকে সাধলো, ছোড়দা মাকে ভেজাগে যা। আহা মেয়েটা একটু সুযোগ পেলেই মানুষ হতে পারে, ওকে ওই বংশীদার অ্যাসিস্টেন্ট করে রাখা কি ঠিক?

মেয়ের এই আনুকূল্যে সুলক্ষণা অবাক হলেন। সুলক্ষণা হয়তো খুশীও হলেন। নিজের মনের মধ্যে যে বাসনার উদ্ভব হয়েছিল, যে বোধ দেখা দিয়েছিল, তার জন্যে আর লড়াই করতে হবে না ভেবে শান্তি পেলেন, তবু মনের মধ্যে সেই কাঁটাটি খচখচ করতে লাগল।

আমারটি ওরা নিয়ে নিল!

যেটি একান্ত নিজস্ব ছিল, সেটি সকলের হয়ে গেল!

বললেন, আর তোদের দাদা বৌদি?

কৌশিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ওনারা তো মহৎ ব্যক্তি! ওঁদের জন্যে ভাবনা কি?

কথাটা সত্যি। ওরা হিংসুটে নয়।

অতএব নির্ভাবনায় চৈতালী নামক ভাগ্যহত প্রাণীটিকে ভাগ্যের দরজার কাছে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে। ওর সমস্ত ঘাটতি কেবলমাত্র দয়ার বাটখারা চাপিয়ে চাপিয়ে সমান করে নেওয়া চলে।

ভাবা চলে, ওকে কোন স্কুলে ভরতি করে দেওয়া হবে, না বাড়িতে মাস্টার রেখে পড়ানো হবে! নাকি এরাই ভাইবোনে একটা বেওয়ারিশ ছাত্রীর ওপর হাত পাকাবে?

.

কিন্তু ও পক্ষও তো নিরেট দেওয়াল নয়!

ও পক্ষেও বুদ্ধির ঘরে জানলা দরজা আছে।

সে বেঁকে বসল।

যেদিন গঙ্গার ঘাটে নিয়ে গিয়ে চৈতালীকে শুদ্ধ করিয়ে নিয়ে এলেন সুলক্ষণা, সেদিন সুলক্ষণাকে সে প্রশ্ন করল, এবার সব কাজ করতে পাবো তো মাসীমা?

সুলক্ষণা বললেন, এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? শরীর মন ভাল নেই, থাক না

শরীর তো খুবই ভাল আছে মাসীমা! আপনার যত্নে তো এই কদিনে ডবল মোটা হয়ে গেলাম।

হ্যাঁ গেলি! তা যাক মনটা একটু সুস্থির থোক না।

কাজ না করলে মন আরও অস্থির হয়ে ওঠে মাসীমা।

তা বইটই তো পড়ছিস।

সে কী সারাক্ষণ?

সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, তা সারাক্ষণই চালা। ক্ষেণু কুশী তো আমার ওপর কড়া নিষেধ জারি করে দিয়েছে, যাতে তোকে ওই সব হাবিজাবি কাজে না ভরতি করি আবার। করলে ওরা আমায় ফাঁসি দেবে!

চৈতালী এ পরিহাসে হাসে না।

শঙ্কিত চোখে বলে, কেন মাসীমা?

কেন আর? লেখাপড়া শিখে মানুষ হবি। বংশীর শাগরেদী করবি না–

চৈতালী মুখ তুলে বলে, কাজ না করতে পেলে আমি টিকতে পারব না মাসীমা! আর–আর যদি মানুষ হওয়ার কথা বলেন? আমার মধ্যে যদি কিছুও মনুষ্যত্ব থাকে, আপনাদের হাওয়াতেই মানুষ হয়ে যাব। লেখাপড়া কি আর কাজকর্ম করলে হয় না?

তা সেই কথা বোঝাস তোর দাদা-দিদিকে।

বলে চলে যান সুলক্ষণা।

দিদিই বলেন ক্ষেণুর সম্পর্কে।

বয়সে ছোট হলেও।

ওটুকু শ্রেণী বিচার রয়েছে এখনও তার মনের মধ্যে।

.

অপর্ণা কদিন একটু ভাল আছে।

উঠে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

অতএব এখন এদের উৎসবের দিন।

এখন সুদক্ষিণা বলতে পারে, অনেকদিন সিনেমা দেখা হয়নি মা!

কৌশিক বলতে পারে, মা ভাবছি সামনের ছুটিতে দুদিন কোথাও ঘুরে আসি।

কৌস্তুভ বলতে পারে, রেডিওটা বন্ধ পড়ে থেকে থেকে ইয়ে হয়ে গেল, খুলব অপর্ণা? গান শুনবে?

আর স্বয়ং অপর্ণার বলতে ইচ্ছে হয়, আমায় কিছু করতে দিন না মা! বেশ তো ভাল আছি।

সুলক্ষণাকে সস্নেহ ভর্ৎসনায় নিবৃত্ত করতে হয় অপর্ণার সেই সহজ হয়ে যাবার ইচ্ছেটাকে।

তবু বাড়িতে আনন্দের হাওয়া বয়।

.

আপাতত সেই হাওয়া বইছিল বাড়িতে।

সুদক্ষিণা বলল, চল্ ছোড়দা, সিনেমা দেখে আসি।

কেন? কৌশিক স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে, আর একটু ফ্যাশান শিখতে? কি করে আঁচলটা আরও কায়দা করে বাতাসে ওড়ানো যায়, কি করে মুখে আরও বেশী করে চুনকালি মাখা যায়–

থাম্ থাম্। যথেষ্ট সেকেলেপনা হয়েছে। রাস্থ কথা। টিকিট কেটে আনগে যা।

কৌশিক ইতস্তত করে বলে, কটা টিকিট?

কটা? কটা আবার? আর কে যাবে?

মানে বলছি, সে তো জানি–মা যান না, বৌদির কথা বাদ, কিন্তু ধর চৈতালীকে তো অফার করতে পারিস তুই।

চৈতালীকে? হুঁ! সে তার অন্নপূর্ণার আসন ত্যাগ করলে তো! সেই রান্নাঘরে পড়ে আছে। দেখলি তো সেদিন? কম বোঝানো বোঝালাম? সেই এককথা, কাজ না করলে বাঁচব না। যারা কাজ না করতে পেলে মারা যায়, এই সুখের পৃথিবীর আমোদ আহ্লাদ তাদের জন্যে নয়, বুঝলি? তারা ওই ঘানিই ঘোরাবে। আমি ওকে মানুষ করে তোলবার আশা ছেড়ে দিয়েছি।

তবে যে সেদিন বললি, পড়াশোনায় খুব চাড় আছে

তা আছে। সেটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু রান্নাঘর ভাড়ারঘরের অধিকার ত্যাগ করে নয়। ষোল আনা বজায় রেখে

তবে থাক। যে যার নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করবে। তবে ভাবছিলাম মনটন খারাপ, কিছু তো করা হয় না। ও বেশ বেঁধে চলেছে, আর আমরা বেশ খেয়ে চলেছি, ব্যস!

সুদক্ষিণা বলে, বলে দেখব?

দেখ! হয়তো বৃথা পণ্ডশ্রম। যাইহোক মাকে কিন্তু বলিস আগে।

সুলক্ষণা তখন বৌয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন।

.

সুদক্ষিণা এসে ভূমিকা করল, মা, সন্ধ্যেবেলার রান্নাটা বংশী চালিয়ে নিতে পারবে না আজ?

সুলক্ষণা অবাক হলেন।

অপর্ণা অবাক হয়ে তাকাল।

সুদক্ষিণা আবার বলল, কি, পারবে না?

পারবে না কেন? কিন্তু কারণটা কি? চৈতালী কি শরীর খারাপ টারাপ কিছু বলেছে?

না, না, শরীর খারাপ হতে যাবে কেন? ভাবছিলাম, সিনেমা যাই। তা ও বেচারী তো কোথাও যেতে টেতে পায় না–রাতদিন বাড়ির মধ্যে থাকে, ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না– থেমে গেল সুদক্ষিণা। থতমত খেল।

অপর্ণার ফ্যাকাশে মুখ শাকমূর্তি হয়ে গেছে।

সুলক্ষণা অস্বস্তি অনুভব করলেন।

কত বছর যেন হয়ে গেল, অপর্ণা বাড়ির বাইরে যায়নি, জগতের কোন আমোদ আহ্লাদের ভাগ গ্রহণ করতে পায়নি।

সুদক্ষিণাও বোধ করি বৌদির মুখ দেখে অপ্রতিভ হল। এমন দিনও তো ছিল অপর্ণার, যখন নিজে সে সেজেগুজে পরীর মত হয়ে এসে বলত, ক্ষেণু, সিনেমা যাবে?

সুদক্ষিণা বলত, বাবা সামনে পরীক্ষা

আরে দূর! জীবনভোর তো পরীক্ষা দেবে। পৃথিবীকে ভোগ করে নিতে হয়।

সুলক্ষণা বলতেন, পড়ো মেয়ে, এত নিত্যি নিত্যি সিনেমা থিয়েটার দেখা কেন বৌমা? তোমরা যাচ্ছ যাও!

অপর্ণা বলত, ওকে ফেলে যেতে ভাল লাগে না মা!

.

সে সব কদিনের ব্যাপার? সে সব কবেকার ঘটনা? কদিন পৃথিবীকে ভোগ করে নিতে পেরেছিল অপর্ণা?

কিন্তু আজ সুদক্ষিণার ভূমিকা প্রধান।

সুদক্ষিণাকে আজ আর নিয়ে যেতে হয় না, সে নিজেই নিয়ে যাবার মালিক। তাই সেও আজ বলছে ওকে ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না।

কিন্তু সেই ওটা অপর্ণা নয়। সে আর একজন। ধুলো মাটি থেকে কুড়িয়ে তুলে ঠাকুরঘরে স্থাপনা করা হয়েছে যাকে। সে যে বাইরে কোথাও যেতে পায় না, সারাদিন বাড়ির মধ্যে পড়ে থাকে, এই কষ্টকর অবস্থাটা অনুভব করে কাতর হচ্ছে সুদক্ষিণা!

এতে যদি শুধু অপর্ণার সাদা ফ্যাকাশে রঙটা বাসী শাকের মত হয়ে যায়, আর কিছু হয় না, সেটা অপর্ণার অসীম ক্ষমতার পরিচয়। দেহে যার রক্ত নেই, তার পক্ষে এতটা ক্ষমতা আশ্চর্য বৈকি।

সেই আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে অপর্ণা শুধু তাকিয়ে রইল।

সুদক্ষিণা অপ্রতিভ হয়েছে।

বৌদির সামনে কথাটা বলতে আসা শোভন হয়নি বুঝতে পেরেছে, কিন্তু হাতের ঢিল মুখের কথা! এখন কথা অসমাপ্ত রেখে চলে যাওয়া আরও লজ্জা!

তাই আস্তে আস্তে বলে সুদক্ষিণা, বেচারীর বাপ মারা গেল সেদিন।

এইটুকু তবু হাতে ছিল।

এইতেই মুখরক্ষা!

সুলক্ষণা বৌয়ের মুখের দিকে অলক্ষ্যে একবার তাকিয়ে নিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলেন, চালিয়ে নিতে বংশী না পারে তা নয়, তবে চৈতালীই ছাড়তে চায় না। যার হাতে জিনিস, সে যদি না ছাড়ে, আর একজন ধরবে কি করে?

অপর্ণা হঠাৎ শাশুড়ীর হাত থেকে চুলটা ছাড়িয়ে নেয়। দাঁড়িয়ে উঠে বলে, আমি রান্না করব এবেলা!

একথা শুনে হেসে উঠল সুদক্ষিণা।

নিশ্চিন্ত ব্যাধ!

জানে না বাণটা কোথায় গিয়ে বিঁধল।

জানে না তাই হেসে ওঠে। লহরে লহরে হাসে।

যাক বাবা সমস্যাটা মিটল। বংশীকেই বা দরকার কি? তাহলে তো আজ

এইমাত্র যে অপর্ণার মুখের চেহারা বদলে গিয়েছিল, সে কথা ভুলে যায় সুদক্ষিণা, তাই হেসেই ওঠে সে।

হেসে হেসেই কথা শেষ করে, ভালমন্দ কিছু দেখছি আজ খাওয়া যাবে।

সুদক্ষিণা এত নির্বোধ হল কেন?

প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে শঙ্কিত হন সুলক্ষণা।

ঈষৎ কঠিন স্বরে বলেন, পাগলামি করিসনে ক্ষেণু! নিজেরা যাচ্ছিস যা।

ক্ষেণু এই হঠাৎ সুর বদলে চকিত হয়। বোধকরি সচেতন হয়। বৌদির বদলে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আস্তে সরে যায়। ভাবে, দূর ছাই! আমাদের আবার হাসিঠাট্টা! যা একখানি বৌ হয়েছেন বাড়িতে!

করুণার বদলে রাগ আসে সুদক্ষিণার, সেই ফ্যাকাশে-মুখ মানুষটার ওপর। ভাবে, যাই। ছোড়দাকে জানাইগে মাতৃ-আজ্ঞা। ছোড়দা হয়তো বলবে, থাকগে গিয়ে কাজ নেই।

তা বলতে পারে।

হঠাৎ এই বিরক্তির মধ্যেও সুদক্ষিণার মুখে একটা আলগা হাসি ফুটে ওঠে।

ছোড়দাটা যা পাগলা। হয়তো

.

আর একখানা মুখেও তখন ফুটে উঠেছে এইরকম একটু আলগা হাসি।

সে মুখ এ বাড়ির রাঁধুনীর।

দ্রুতহাতে কুটনো কুটে নিচ্ছিল সে, এখন হাতটা নিশ্চল। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

সামনেই একটা বেতের মোড়া পড়েছিল, সেটাকে টেনে নিয়ে জুত করে বসেছে কৌশিক। বলছে, তা নিজেকে এত দরকারী করে তোলার প্রয়োজনই বা কি? না হয় লোকে ভাবলই, মেয়েটা কোন কর্মের নয়। হলটা কি তাতে? আমাকে তো সবাই কোন কর্মের নয় বলে খরচের। খাতায় লিখে রেখেছে, কই আমি তো কোন অপরাধ বোধ করি না। অস্বস্তিও পাই না।

চৈতালীর মুখে ওই হাসিটা ফুটে উঠেছে।

এত অদ্ভুত কথা বলেন আপনি!

কথাটা অদ্ভুত কিছুই নয়। তুমিই অদ্ভুত। আজ পর্যন্ত তো দেখিনি, কোন মেয়ে সিনেমা দেখতে আপত্তি করে।

চৈতালী কি ভুলে যায়, ও কে?

তাই কৌশিকের সঙ্গে কৌতুক করে বসে? দুই চোখ নাচিয়ে হেসে উঠে বলে, কোন মেয়ে করে না। অনেক মেয়ে আপনি দেখেছেন বুঝি?

দেখছিই তো হরদম। কিন্তু তোমার মত এমন দেখলাম না। খাও দাও ঘুরে বেড়াও, সুখে স্বচ্ছন্দে থাক–তা নয়। বেশ তবে কাজকর্ম করো, হেসেখেলে কাটাও, তা নয়। অদ্ভুত!

.

চৈতালী কৌশিকের এই কথার ধরনে না হেসে পারে না। হাসে। কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর স্বরে বলে, আমি কি সাধারণ আর সবাইয়ের মত?

বেশ, না হয় অসাধারণই। কিন্তু এই সাধারণদের সঙ্গে একটুআধটু মিশলে মাহাত্ম্য কিছু ক্ষুণ্ণ হবে না।

আমি যদি আপনাদের সঙ্গে মিশতে যাই, আপনাদের মাথা হেঁট হবে না?

আমাদের মাথা কি এতই হালকা যে, এই সামান্য ভারে হেঁট হয়ে যাবে?

কিন্তু আমি যে কী, তা তো আমি নিজে জানি। কোন লজ্জায় কবে–

কৌশিক এবার গম্ভীর হয়।

সত্যিকার গম্ভীর।

বলে, জীবনের প্রারম্ভে মানুষ যা জানে, সেটাই শেষ জানা হতে পারে না। নতুন করে জানতে শিখতে হয়, নতুন করে নিজেকে গড়তে হয়। কেউ যদি কোন অগৌরবের মধ্যে জন্মায়, সেটা তার নিজের হাত নয়, কেউ যদি জ্ঞান বুদ্ধি জন্মাবার আগে ভুল নির্দেশে চলে কাঁটাঝোপে গিয়ে পড়ে, সেটাই তার পথ নয়। প্রতিদিনের জন্মানোর মধ্যে দিয়ে গৌরব সৃষ্টি করতে হয়, প্রতিদিনের চেষ্টার মধ্যে দিয়ে ভাল পথ নির্ণয় করতে হয়। আর সেটা শুধু নিজের ওপর শ্রদ্ধা থাকলে। নিজের ওপর শ্রদ্ধা না থাকলে–কে? কে ওখানে?

চমকে উঠে পড়ল কৌশিক।

বলল, সিঁড়ির তলার দরজা দিয়ে এসে কে চট করে ওপরে উঠে গেল মনে হল না?

কি জানি, দেখিনি তো।

দেখনি? কিন্তু আমি যেন দেখলাম, সাদা কাপড়ের মত কি যেন একটা

তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল কৌশিক।

.

কিন্তু সত্যিই কি দেখেনি চৈতালী?

দেখেছে।

শুধু আজ নয়, রোজই দেখে। যখন তখন দেখে। দেখে আর কণ্টকিত হয়। অবাক হয়। ভয়ে বেশীক্ষণ ভাবতেও পারে না।

তাই হিসেব মেলাতেও পারে না।

কোন প্রকারেই পারে না।

অথচ আগ্রহাতুর মুগ্ধ একজোড়া চোখের দৃষ্টি যেন শরীরী হয়ে সর্বাঙ্গে লেগে থাকে, আটকে থাকে, একা ঘরে বসেও মনে হয় মুছে ফেলা যাচ্ছে না তাকে।

সেই দৃষ্টি দুজনের ওপর স্থির হয়েছিল এতক্ষণ নিভৃত কোন অন্তরাল থেকে। বুঝতে পেরেছে চৈতালী।

.

বৌয়ের চুল বেঁধে দিয়ে এসে বসেছিলেন সুলক্ষণা। ওকে দেখতে পেলেন তিনি। বললেন, কি খুঁজছিস রে কৌশিক, এঘর-ওঘর করে?

চোর!

চোর খুঁজছিস?

হ্যাঁ, মনে হল কে যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। একটু সাদার আভাস

উঠে এল তো খোকা!

খোকা!

তাই তো দেখলাম।

কিন্তু? না না, দাদা কেন অমন ঝট করে চলে আসবে? আমরা রয়েছি ওখানে।

সুলক্ষণা হেসে ফেলে বললেন, তাহলে দেখ খুঁজে, কোথায় চোর! এক চোর নিয়েই তো–

চোর ফোবিয়া! কৌ

স্তুভ শান্ত গলায় বলে, এ রকম হয় মানুষের।

হয়? কৌশিক বলে, তোমাদের কথার কোন মানে হয় না। তুমিই তাহলে ওরকম চট করে উঠে এসেছ?

কৌস্তুভ গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে হ্যাঁঙারে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে বলে, বললাম তো আমি যেমন ভাবে রোজ আসি, ঠিক সেই ভাবেই এসেছি।

হ্যাঁ, ঠিক এই কথাই প্রথমে বলেছে কৌস্তুভ। বলেছে, কেন, তাড়াতাড়ি আসতে যাব কেন? যেমন আসি–

কৌশিক বলেছে, তুমি তো সিঁড়ি ওঠ গুনে গুনে—

কথাটা সত্যি।

কৌশিকের মত কৌস্তুভ কোনদিনই দুটো সিঁড়ি একসঙ্গে টপকে ওঠে না।

কৌশিকের রাগে রাগ করেনি কৌস্তুভ। হাসেওনি। শুধু বলেছে, তাই-ই এসেছি।

তাহলে চোর সোজা ছাতে উঠেছে—

কৌস্তুভ বলেছে চোর ফোবিয়া।

কিন্তু চোর শুনে যার ভয় পাবার কথা, সে ভয় পায় না। শুধু ওদের দুই ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, লোকটাকে কী রকম মনে হল ঠাকুরপো? মেয়ে না পুরুষ?

কি জানি বাবা! সিঁড়ির ঠিক বাঁকটায় ওঠার সময় একটা পাঞ্জাবির কোণের মত

কী মজা! কী মজা! হঠাৎ হাততালি দিয়ে ওঠে অপর্ণা। নেহাৎ ছেলেমানুষের মত বলে, তাহলে যে করে তোক খুঁজে বার করে ফেল ঠাকুরপো। চোরে চোরে বিয়ে দিয়ে দিই। বাড়িতে যখন এত চোরের আমদানি!

কচি খুকীর মত হাসি কথা আর হাততালি।

কৌশিক অবজ্ঞার হাসি হাসে।

.

একদা যখন অপর্ণার বিয়ে হয়েছিল, এক গা গহনা আর সরস্বতী প্রতিমার মত রূপ নিয়ে ঝলমলিয়ে এসে ঢুকেছিল অপর্ণা এ সংসারে, তখন কৌশিকের কিশোর চিত্ত একেবারে মুগ্ধ হয়ে সেই ঔজ্জ্বল্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল। বৌদির কাছ থেকে নড়তে ইচ্ছে করত না তখন কৌশিকের।

কিন্তু সে ঔজ্জ্বল্য আজ হারিয়ে গেছে।

রক্তমাংসের মানুষটা কাগজের পুতুল হয়ে গেছে, আর বিচ্ছিরি রকমের বোকা হয়ে গেছে। ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠা কৌশিকের তাই বৌদিকে নিতান্ত নাবালিকা বলে করুণা হয়। ওর নিতান্ত ছেলেমানুষের মত কথা শুনে হাসি পায়।

তাই অবজ্ঞার হাসি হাসল কৌশিক।

কিন্তু কৌশিকের বড় ভাই?

তার মুখটা লাল হয়ে উঠল কেন? বোধ করি অপমানেই। কৌশিকের এই হাসি তত তার চোখে পড়েছে।

অপর্ণা বলল, তোমরা সিনেমা যাচ্ছ শুনলাম।

যাচ্ছিলাম তো। কৌশিক বলে, মার ওই পুষ্যি বোনঝিটিকেও অফার করেছিলাম। কিন্তু সময় নেই তার। কাজের অসুবিধা হয়ে যাবে। মানুষ যে কী করে এত কাজ-পাগলা হতে পারে! বংশী তো প্রায় বেকার হয়ে গেছে আজকাল। সেদিন দেখি, ও বাসন মাজছে। বকতে গেলাম বংশীকে, বংশী উলটে আমাকেই বকে দিল। বলল, শুনবে না, আমার হাত থেকে কাজ কেড়ে নিয়ে নিয়ে সব কাজ করবে। আমি কি করব? আর সত্যি এতও পারে! সব কাজ শেষ করে ফেলে ছাতে উঠে যায়, চাল ডাল বড়ি আচার রোদ্দুরে দিতে।

অপর্ণা বোকার মত বলে, ছাতে? তোমার ঘরের সামনেই তো ছাত? দেখা হয় না তোমার সঙ্গে?

কৌস্তুভ অগ্রাহ্যভরে বলে, গরীব দুঃখীর মেয়ে, খেটে খাওয়াই অভ্যাস–আশ্চয্যি হবার কি আছে?

.

না, তা হয় তো নেই।

কিন্তু আশ্চয্যি হতে হচ্ছে এখন কৌশিককে অপর্ণার উত্তেজনায়।

তোমরা সিনেমা যাও, আমি আজ রাঁধব।

ঘোষণা করে অপর্ণা উত্তেজিত মুখে! রক্ত ফুরিয়ে যাওয়া শরীর আরক্ত করে তুলতে পারে না মুখটাকে, শুধু ঘাম গড়িয়ে পড়ে রগের পাশ দিয়ে।

তুমি রাঁধবে!

কৌশিকও সুদক্ষিণার মতই ভুল করে।

হা হা করে হেসে ওঠে।

কেন? আমি রাঁধতে জানি না? খাওনি কখনো তোমরা আমার হাতে?

আহা খেয়েছি বৈকি। কিন্তু সে সব তো প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা। এখন তোমার হাতের রান্না খাওয়া মানে তো হত্যাপরাধ। হঠাৎ এ খেয়াল?

অপর্ণা আঁচলটা টেনে গায়ে ঘুরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ গলায় বলে, কেন, একদিন ইচ্ছে হতে পারে না? যাও, তোমরা ওকে নিয়ে যাও। আমি রাঁধবই।

কৌস্তুভ গম্ভীর ভাবে বলে, পাগলামি কোর না অপর্ণা, শুয়ে পড়ো। বেশী হাসি-ঠাট্টাও তোমার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর তা জানো তো! শোও, শোও।

না, শোব না।

.

শান্ত অপর্ণা হঠাৎ জেদী হয়ে উঠেছে।

বুঝলাম অপর্ণা অবুঝ হয়ে উঠেছে।

আমি যাচ্ছি।

আঃ অপর্ণা! কি ছেলেমানুষী হচ্ছে?

না, আমি যাব। আমি কাজ করবো।

কৌস্তুভ ধরে ফেলে।

কৌশিককে ইশারা করে পাখাটা বাড়িয়ে দিতে।

অপর্ণাকে শুইয়ে দেয়।

অবশ্য শুইয়ে দেবার দরকার বিশেষ ছিল না। নিজেই শুয়ে পড়েছে সে ঘেমে ঠাণ্ডা হয়ে!

দেখ দিকি, ছি ছি! কী যে পাগলামি করো!

কৌস্তুভ স্ত্রীর হাতের ওপর আস্তে আস্তে হাত বোলায়। নীল নীল শিরা-ওঠা সাদা প্যাকাটির মত হাত।

এই হাতে একগোছা করে চুড়ি পরে থাকে অপর্ণা। হাতের ওই শীর্ণতার দৈন্য যেন আরও বেশী স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাতে।

কৌশিক বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

ভাবে, দাদা যদি মাঝে মাঝে বকত বৌদিকে, তাহলে হয়তো ভদ্রমহিলার কিছুটা উপকারই হত। ভাবে, ওকে একবার সহজ মানুষের মত ছেড়ে দিলে কী হয়? এখানে না থোক, কোথাও চেঞ্জে নিয়ে গিয়ে। হয়তো ওকে সর্বদা ওই তুমি মারা গেলে, মারা গেলে ভাবটা মনে করিয়ে দেওয়াই ওকে মৃত্যুর দিকে খানিকটা এগিয়ে দেওয়া।

কিন্তু কৌশিকের বুদ্ধি নিচ্ছে কে?

মা আর ছেলেতে মিলে–

না, সিনেমা আর যাওয়া হয় না সেদিন সুদক্ষিণার। তার বদলে কৌশিককে যেতে হয়। ডাক্তারকে ডাকতে।

অনবরত ঘেমে ঘেমে ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছিল অপর্ণা।

ডাক্তার আসে। তাই পুরো ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আর পৌঁছয় না।

বয়েস বেশী নয় ডাক্তারের, কিন্তু বিচক্ষণ। ওর বিচক্ষণতার জোরেই তো এযাবৎ টিকে আছে কৌস্তুভ রায়ের স্ত্রী অপর্ণা রায়।

.

উৎসবের দিন ফুরোয়।

আবার সেই বিষণ্ণ আবহাওয়া।

অপর্ণার ওঠা বারণ।

কৌস্তুভের রোজ অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, সুলক্ষণাকে রোজ দুতিনবার স্নান করতে হচ্ছে।

সুলক্ষণা?

তা সুলক্ষণা ছাড়া আর কে?

নার্স রাখা কি সম্ভব?

বারো মাস তিরিশ দিনের জন্যে?

কিন্তু চৈতালীর কথা মনে পড়ছে না সুলক্ষণার?

বিনি পয়সায় যে খেতে পাচ্ছে, পরতে পাচ্ছে, থাকতে পাচ্ছে!

সুলক্ষণার মনে পড়ে না।

মনে পড়ে চৈতালীর নিজেরই।

যখন খেতে বসেছে কৌস্তুভ, সুলক্ষণা কাছে বসে।

সুলক্ষণা বলেন, কী যে বলিস। তুই আর কত করবি?

আরও অনেক করা যায় মাসীমা। আমার যা কাজ, সে তো তক্ষুনি ফুরিয়ে যায়। সারাদিনই মনে হয় বসে আছি।

তা হোক। রুগীর সেবা কি সোজা নাকি?

সোজা নয় বলেই তো বলছি মাসীমা! শক্ত কাজেই আনন্দ আমার। আমি বৌদির সেবার ভার নেব। দাদা, আপনি বলুন মাকে।

আপনি বলুন!

দাদা!

কৌস্তুভ চমকে ওঠে। বলে, আমি? কী বলবো আমি?

কী আর! মাকে বোঝাবেন। আমার ওপর যাতে বৌদির ভারটা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্দি হতে পারেন!

সে কি, সে কি? তাই কি সম্ভব?

কেন? অসম্ভব কিসে?

চৈতালী দৃঢ়স্বরে বলে, বৌদি আমার হাতের সেবা নেবেন না?

কৌস্তুভ আবারও হয়তো সে কি সে কি বলতে যাচ্ছিল, সুলক্ষণা হঠাৎ তাকে অপ্রতিভ করে দিয়ে বলে ওঠেন, না নেওয়াই সম্ভব।

আচ্ছা, নেন কি না নেন, আমি বুঝব।

না না, কৌস্তুভ বলে, সে হয় না।

কেন হয় না, তা তো বলছেন না।

সে, ও ইয়ে মানে লজ্জা পাবে।

লজ্জা পাবেন? কেন? আমি যদি বাইরের নার্স হতাম?

সে আলাদা কথা রে চৈতালী– সুলক্ষণা বলেন, ওসব খেয়াল ছাড়।

চৈতালী দৃঢ়স্বরে বলে, মোটেই ছাড়ব না। আপনাকে আর এত খাটতে দেব না। লজ্জা তো আমারও আছে। বেশ তো, মাইনে করা লোককে যদি লজ্জা না হয় তো মাইনেই দেবেন আমাকে। বলেছেন তো প্রথমে।

কথাটা মিথ্যা নয়।

হাতখরচ করিস বলে কিছু টাকা প্রথম দিকে দিতে চেয়েছিলেন সুলক্ষণা, নিতে চায়নি চৈতালী। হাতজোড় করে প্রত্যাখ্যান করেছে। বলেছে, হাতে হাতে তো সবই পাচ্ছি মা, আশার অতিরিক্ত, দরকারের অতিরিক্ত পাচ্ছি। তবে আবার টাকা নিয়ে কি করব আমি?

বাঃ, তোর যদি কিছু ইচ্ছে হয়—

তোমার কাছে চেয়ে নেব মা। চাইলে দেবে না?

.

সামনে মাসী, আড়ালে মা।

নিভৃত সেবার সময়।

যখন দুপুরে ছেলেমেয়ে বাইরে থাকে সুলক্ষণার, বৌ ঘুমোয়, তখন চৈতালী গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় সুলক্ষণার, চুলের জট ছাড়িয়ে দেয়। সুলক্ষণার ঘর গুছিয়ে দেয়, বিছানা রোদে দেয়।

প্রথম প্রথম অস্বস্তি বোধ করতেন সুলক্ষণা, অনভ্যস্ত চিত্ত কারও কাছে সেবা নিতে সঙ্কুচিত হত, কিন্তু এই নম্র অথচ প্ৰবলা মেয়েটার কাছে হার মানতে হয়েছে সুলক্ষণাকে।

এখন ভাল লাগে।

একটা মানুষ কেবলমাত্র আমার জন্যে নিজেকে দিচ্ছে, দিতে পেরে কৃতার্থ হচ্ছে, এ অনুভূতি, বড় সুখের। তাই ওর হাতে সঁপে দিয়েছেন নিজেকে।

তাই আড়ালে এই সম্বোধনের লুকোচুরি।

আড়ালে মা, তুমি, সামনে মাসীমা, আপনি।

মা বলে ডাকতে পায়নি কখনো।

এই আকাঙ্ক্ষা সেই অভাবের।

সুলক্ষণা বলেন মাঝে মাঝে, আর অত কষ্ট কেন বাপু? মা-ই বলিস। আর কিছু বলবে না ওরা।

চৈতালী মাথা নীচু করে হেসে বলেছে, না, এই বেশ। এই মজা! আমি যে তোমার চোর মেয়ে! তাই লুকোচুরি!

সুলক্ষণা বলেন, হ্যাঁ সত্যি, সে কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু চোর মেয়ে নয়, চোরের মেয়ে! তাই আমার মত আস্ত একটা মানুষকেই চুরি করে বসে আছিস।

.

এরপর আর মাইনের কথা ওঠেনি।

আজ উঠল।

চৈতালী নিজেই ওঠাল।

সুলক্ষণা বললেন, মাইনে নিবি তো?

নিতেই হবে! চৈতালী কৌস্তুভের আনত মুখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়স্বরে বলে, না নিলে যখন বৌদি আমার হাতের সেবা নেবেন না!

পরাস্ত হলেন সুলক্ষণা।

এত কথা সুদক্ষিণা জানে না।

কৌশিক তো নয়ই।

সুদক্ষিণাই জানতে পেরে জানাল কৌশিককে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ছোড়দা শুনেছিস, চৈতালীকে দিয়ে বৌদির সব কিছু করানো হচ্ছে।

সব কিছু মানে?

সব কিছু মানে সব কিছু। বিছানায় পড়ে থাকার পিরিয়ডে এখন বেডপ্যান পর্যন্ত

ধেৎ!

ধেৎ মানে? নিজের চোখে দেখে এলাম।

মা কি বললেন?

মাকে জিগ্যেস করিনি। দেখেই তাজ্জব হয়ে তোর কাছে ছুটে এসেছি। সত্যি ছি ছি, না হয় একটা বেওয়ারিশ মেয়ে পাওয়া গিয়েছে, তাই বলে এই সমস্ত কাজ

সুদক্ষিণার নিজের মত বয়সের একটা মেয়েকে এ কাজ করতে দেখে ভারী বিচলিত বোধ করছে সুদক্ষিণা।

মা করেন, কিছু মনে আসে না।

মা যেন সব কিছুর ঊর্ধ্বে।

কৌশিক ওর পিঠটা ঠুকে দিয়ে বলে, উত্তেজিত হয়ো না ভগ্নী, এটা ওকে দিয়ে কেউ জোর করে করায় নি। সুযোগও নেয়নি। এ ওর স্বখাত সলিল। নিশ্চয় নিজেই ব্যাকুলতা করেছে, বেডপ্যানটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করেছে মার সঙ্গে

তুই কি করে বুঝলি?

বুদ্ধির দ্বারা। তোর ঘটে একফোঁটা বুদ্ধি থাকলে তুইও বুঝতিস।

আমি কিন্তু মাকে বলব

কেন মিথ্যে মাথা গরম করছিস?

যা হচ্ছে হতে দে

হ্যাঁ, ওই কথাই বলে কৌশিক।

ওই বলেই বোনকে প্রবোধ দেয়।

কিন্তু নিজে?

নিজে জেরার পথ ধরে।

সুবিধেও হয়ে যায়।

দুপুরবেলা কৌশিক যে বাড়ি আছে, জানত না চৈতালী।

নিত্যি যেমন দুপুরে বালতিখানেক কাপড়-চোপড় সাবান কেচে ছাতে মেলে দিতে আসে, তেমনি এসেছিল। নিত্যি যেমন কাজ সেরে নীচে নেমে যাবার সময় কৌশিকের ঘরটায় একবার ঢুকে একটু বসে, একটু গুছিয়ে রেখে চলে যায়, তেমনিই ঢুকেছিল, সেদিন ঢুকেই থতমত খেল।

কিন্তু চট করে চলে যাওয়াও বিপদ। হয়তো বা সন্দেহজনকও। তাই প্রশ্ন করতে হল, এ কী, আপনি এখন ঘরে যে?

কৌশিক ইজিচেয়ারে শুয়ে পা দোলাচ্ছিল, উঠে বসল।

গম্ভীর ভাবে বলল, আমিও প্রশ্ন করতে পারি, এ কী তুমি এখন এ ঘরে যে?

চৈতালী চারদিকে চেয়ে দেখে।

রোদে ঝাঁ ঝাঁ স্তব্ধ দুপুর, ছাতের একধারের একখানা মাত্র ঘর, তিনদিকের রোদ পেয়ে যেন ভাজা ভাজা হচ্ছে। অথচ কৌশিক নির্বিকার চিত্তে বসে আছে মাথার ওপরকার পাখাটা পর্যন্ত না খুলে।

প্রথমেই পাখাটা খুলে দেয় চৈতালী।

যতটা ঠেলে দেওয়া যায় পয়েন্টটা দেয়।

হয়তো কিছু একটা করে আড়ষ্টতা কাটাবার জন্যেই এই কাজটা করা। হয়তো বা করে ওই আত্মভোলা ছেলেটার ওপর মমতার বশেই।

খুলে দিয়ে নিত্য অভ্যাসমত টেবিলের অগোছালো বইগুলো গোছাতে গোছাতে বলে, আমি তো এ সময় রোজই আসি।

কৌশিক আরও গম্ভীরের ভান করে।

বলে, কেন? এ ঘরে কী কাজ? কি জন্যে আসো?

চৈতালী ফিরে দাঁড়ায়।

হঠাৎ অন্য এক চোখে চায়, অন্য এক সুরে কথা বলে ওঠে, যদি বলি চুরি করতে আসি!

.

এই স্তব্ধ দুপুরের পটভূমিকায়, যখন দূরে কোথায় যেন একটা ঘুঘু পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই, তখন এই অন্য চাওয়া, অন্য সুর কৌশিককে বুঝি একটু কাঁপিয়ে দেয়, একটু বুঝি অস্বস্তিতেও ফেলে, তবু সামলে নিতে জানে সে।

তাই হেসে উঠে বলে, দ্যাটস্ রাইট। তাই আমি কিছুদিন থেকে কোন কিছু যেন খুঁজে পাচ্ছি না। সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।

কী কী হারিয়েছে?

লিস্ট করে রাখিনি। তবে মনে হচ্ছে যে বেশ অনেক।

দুই হাত বিস্তারিত করে মাপটা দেখায় কৌশিক।

চৈতালী তেমনি এক সুরে বলে, লিস্ট করে রাখবেন, পুলিসে ডায়েরী করার সময় কাজে লাগবে।

তাই রাখব ভাবছি।

আমি কিছু ভাবছেন না?

আর কি?

ভাবছেন না–এই জন্যেই বলে, স্বভাব যায় না মলে! এত পাচ্ছে চোরটা, তবু মাঝদুপুরে চুপি চুপি এসে আমার ঘর খুলে চুরি করতে আসে!

তাও ভাবছি হয়তো কৌশিকও যেন আর এক চোখে চায়।

নাকি চায় না?

ও শুধু চৈতালীর চোখের ভ্রম!

কৌশিকের চোখের দৃষ্টি কোনদিন শরীরী হয়ে এসে আক্রমণ করে না। আগুনের তাপের মত জ্বালা ধরায় না। মুছলেও মুছতে চায় না, এমন ভাবে গায়ে লেগে থাকে না।

ওর চোখ আলোর মত।

আয়নার মত।

দীঘির জলের মত।

কৌশিক বলে, সে অপরাধের বিচার হবে।

কোথায়?

এই এখানেই। এটাই কোর্ট। আর এই মান্যগণ্য ব্যক্তিটিই জজ!

আমার কাজ আছে। নীচে যাচ্ছি।

নো নো, আগে বিচারটা হয়ে যাক।

এভাবে দুপুরবেলা বসে বসে আপনার সঙ্গে গল্প করলে লোকে কি বলবে?

কী আবার বলবে? কৌশিক ভুরু কুঁচকে বলে, এটা গল্প নয়, কাজের কথা হচ্ছে। বলছি–এটা কী হচ্ছে?

কোনটা?

এই একাধারে রাঁধুনী চাকরানী খোবানী ঝাড়দারনী মেথরানী, সব কিছুর পার্ট প্লে করে চলা! মানে হয় এর?

চৈতালী হেসে ওঠে, নাম করে করে বললেই অনেক। আমার তো কিছুই কষ্ট হয় না। গায়েই লাগে না।

বাহাদুরি নেবার জন্যে অনেকে পিঠে হাতি তোলে, তাতেও তাদের গায়ে লাগে না।

বাহাদুরি নেবার জন্যে?

তবে আবার কি?

যদি বলি আমার ভাল লাগে?

তামা-তুলসী-গঙ্গাজল হাতে করে এসে বললেও বিশ্বাস করব না।

কেন, কেউ কি কাজ করতে ভালবাসে না?

বাসে। বাসতে পারে। কিন্তু শ্রীমতী অপর্ণা রায়ের সেবার ভার কেউ ভালবেসে কাঁধে তুলে নেয়, এ আমাকে কেটে ফেললেও বিশ্বাস করব না।

আর মার বুঝি কষ্ট হয় না?

ক্ষুব্ধস্বরে বলে ওঠে চৈতালী।

মা!

মাসীমা, মাসীমা! আপনাদের মা। তাকেই তো ওই সব কিছু

সেটা মার অভ্যাস হয়ে গেছে।

আমারও হবে।

কৌশিকের তরল কণ্ঠে একটু বুঝি গভীরতার স্পর্শ লাগে। সে ম্লান হেসে বলে, তা হয়তো হবে। কিন্তু মার হল, নিজের ছেলের রুগ্ন বৌ। মার কথা আলাদা। কিন্তু তুমি করবে কোন্ প্রেরণায়? দৈনিক কমণ চালের ভাত খাও যে সেই ভাতের দাম আর উসুল হচ্ছে না!

চৈতালী চোখ তুলে বলে, শুধু ভাতের দাম? সেই ঋণ শোধ করছি আমি?

কৌশিক হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।

ওই নির্ভীক স্পষ্ট চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে এক পলক। তারপর স্তব্ধতা ভেঙে বলে, ভাতের ছাড়া আর যদি কোন ঋণ থাকে, সে কি শোধ দেবার?

আমি যাই!

যাবে। তার আগে শোনো, এভাবে পাগলের মত আত্মপীড়নের কোন মানে হয় না।

যদি বলি আত্মপীড়ন নয়, আত্মনিবেদন!

কৌশিক আর একবার স্তব্ধ হয়।

তারপর বলে, অপর্ণা রায়ের কাছে অন্তত সে নিবেদন না করলেও চলে।

বিশেষ করে কারও কাছেই নয়। ধরুন শুধু এই সংসারের কাছেই।

তোমার হিসেবের সঙ্গে আমার হিসেব মেলে না– কৌশিক বলে, বংশীকে বসিয়ে রেখে? তার কাজগুলো পর্যন্ত করার প্রয়োজনীয়তা কিছুতেই স্বীকার করানো যাবে না আমাকে।

চৈতালী টেবিলের ওপরটা আঁচল দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে মুখ না ফিরিয়ে বলে, বসে থাকলেই আমার হাত-পায়ের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হতে থাকে, হয়তো চোরের রক্ত বলেই–

চৈতালী!

চৈতালী চুপ।

চৈতালী, শোনো। এইটুকু শুধু বলে রাখি, এ সংসারে তোমার পোেস্ট কেবলমাত্র দয়ার আশ্রয়ের আশ্রিতার নয়।

এত ভয় দেখাবেন না!

ভয়?

হ্যাঁ, ভয়! ভয়ানক ভয়! আমার এই নতুন জীবনটুকু মুছে যাবার ভয়, এই আশ্রয়ের বাসাটি ভেঙে যাবার ভয়। মার মুখোমুখি দাঁড়ানোর ভয়

হঠাৎ সমস্ত শরীরে একটা মোচড় দিয়ে ছুটে নীচে নেমে যায় চৈতালী।

আর কৌশিক ভাবে, মানুষ কি নিজেই নিজের কর্তা? নিজের ওপর কি কন্ট্রোল রাখতে পারে মানুষ?

এই মুহূর্তে যে সব কথা হয়ে গেল এখানে, তার সম্পর্কে কি এক বিন্দুও ধারণা ছিল কৌশিকের? ও কি ভেবেছিল এই সব কথা বলবে? শুধু আলটু-বালটু কতকগুলো কাজ করার জন্যে বকবে বলেই তো দাঁড় করিয়েছিল চৈতালীকে।

তারপর ভাবল, বিচলিত হচ্ছি কেন?

তা ছাড়া আর কী-ই বা বলেছি? কথার পিঠে কথা পড়ে যে ধারায় চলে গেছে, সেই ধারায় কথাকে ঠেলে দিয়েছি বৈ তো না। ওতে ভাববার কিছু নেই।

ভাবল ভাববার নেই, তবু ভাবতে লাগল।

প্রথম থেকে পর পর কী কথা হল ভাবতে লাগল।

ভাবতে লাগল প্রতিদিন দুপুরে এ ঘরে আসে চৈতালী, আশ্চর্য!

অনেক কিছু ভাবার পর হঠাৎ সচেতন হয়ে ভাবতে চেষ্টা করল, চৈতালী এ বাড়িতে ঢুকেছিল বাসন চুরি করতে!

ভাবতে পারল না।

বার বার খেই হারিয়ে গেল সেদিনের কথা, ঝাপসা হয়ে গেল সে-দিনের ছবি।

.

ফুলের মত সুরভিত, পালকের মত হালকা অথচ ভয়ানক একটা ভয় পাওয়ার মত দুরুদুরু মন নিয়ে ছাত থেকে নেমে এসেছিল চৈতালী। এসেই থমকে গেল। অপর্ণার ঘরে সুলক্ষণা।

ব্যস্ত হয়ে একখানা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করছেন বৌকে।

চৈতালী এসে দাঁড়াতেই ঈষৎ কঠিন সুরে বলেন, ভার যদি নিতে পারবি না তো সাহস করেছিলি কেন?

মূক চৈতালী অপর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে তার চোখ বোজা, চোখের কোণে জল।

ডেকে ডেকে নাকি পায়নি তোকে! ছিলি কোথায়?

ছাতে।

ছাতে? আবার আজ গুচ্ছির সাবান কেচেছিস বুঝি?

চৈতালী মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আর বন্ধ চোখ আস্তে খুলে, অপরিসীম ক্লান্ত সুরে অপর্ণা বলে, ঠাকুরপোর আজ ছুটি না?

সুলক্ষণার ঘরের পাশে একটা ঘর আছে, ছোট্ট এক ফালি, ট্রাঙ্ক বাক্স রাখবার, কাপড় ছাড়বার। সুলক্ষণার সুবিধের কথা ভেবেই যখন বাড়ি তৈরী হয়েছিল, তখন সুলক্ষণাই এ বাড়ির প্রধান ছিলেন। তখন কিসে সুলক্ষণার সুবিধে হবে, সেটাই চিন্তা ছিল সংসারের সমস্ত সদস্য কটির। তখন অপর্ণা শুধু বৌ!

শান্ত নম্র মিষ্ট হাস্যমুখী বৌমা মাত্র।

তার জন্যে ভাল শাড়ী দামী গহনা ছাড়া আর কিছু ভাবা হত না।

কিন্তু কখন কোন্ ফাঁকে অপর্ণাই কেন্দ্রে এসে গেছে। সুলক্ষণা সরে গেছেন কেন্দ্র থেকে। এখন শুধু অপর্ণার সুবিধে ভাবা হয়। শুধু সুলক্ষণার ঘরের পাশের এই ফালি ঘরটা ওঁর সেই সব দিনের সাক্ষ্য দেয়। সে বলে, এক সময় ওঁর সুবিধের জন্যে অনেক ভাবা হত।

কিন্তু সুলক্ষণাই সেই স্মৃতিটুকু মুছে ফেলেছেন। সেই ঘরটার দখল ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে চৈতালীকে জায়গা দিয়েছেন। এটা এখন চৈতালীর ঘর।

নিজের ঘর।

সেই ঘরে এসে জানলার কাছে দাঁড়াল চৈতালী।

এ জানলা রাস্তার ওপর নয়, বাড়িরই পাশের গলির ধারে।

তবু দাঁড়াল।

ভাবল, আমি কি চলে যাব?

তারপর দেখল কখন যেন চারটে বেজে গেছে, উনুনে আগুন দিয়েছে বংশী। নেমে এল আস্তে আস্তে।

.

কিন্তু আগুন কি শুধু উনুনেই?

মানুষের হাতের তালুতেও আগুন থাকে না কি? আঙুলের ডগায়?

সেই উত্তপ্ত আগুন-ভরা হাতে যদি কেউ কারও কবজি চেপে ধরে, জ্বলে যায় না সেখানটা? ফোঁসকা পড়ে যায় না?

হাতটা ছাড়িয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টায় ঘেমে উঠে হাতের অধিকারিণী রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ছাড়ুন!

না ছাড়ব না! আগে কথা দাও, অপর্ণার ঘরে আর যাবে না তুমি?

কেন?

সে প্রশ্ন থাক না।

বিনা যুক্তিতে শুনব কেন কোন কথা?

ওকে সেবা করতে যাবারই বা কী দরকার তোমার?

ধরুন টাকার জন্যে। বিনি মাইনের কাজ করছি আপনাদের বাড়ি, ভাবলাম বড়লোকের স্ত্রীর নার্সিং করে যদি ভাল মাইনে পাওয়া যায়?

বিশ্বাস করি না।

অবিশ্বাসের কী আছে, আমি গরীব, আমি চোর।

তবু বিশ্বাস করব না।

হাত ছাড়ুন!

না।

যদি চেঁচাই?

পারবে না।

কী করে জানলেন?

জানি। এ আশ্রয় ভেঙে যাবার ভয়ে সব সয়ে চুপ করে থাকবে তুমি!

যদি মাকে বলে দিই?

পারবে না। কারণ জানো মা বিশ্বাস করবেন না। আমি জানতে চাই, তুমি কেন হঠাৎ অপর্ণার সেবা করবার জন্যে ব্যাকুল হলে?

যদি বলি, ওই ঘরের আশ্রয়টাই নিরাপদ মনে হয়েছিল!

কী? কী বললে?

হ্যাঁ, তাই! ভেবেছিলাম কান যে কথা বিশ্বাস করবে না, সে কথা প্রমাণিত করার একমাত্র উপায় চোখ! অহরহ ওই চোখের পাহারায় থাকতে পেলে–

চুপ, চুপ করো।

আমি বলতে চাইনি।

কুশীর সঙ্গে তোমার কিসের এত গল্প?

জিগ্যেস করে উত্তর আদায় করবেন?

না, জিগ্যেস করব না। জিগ্যেস না করেই বুঝতে পেরেছি। জানো, একথা যদি মার কানে ওঠে—

জানি উঠবে না। ওঠাতে পারবেন না। আপনি বেশ ভাল রকমই জানেন, তাতে আমার এ বাড়ির আশ্রয় যেতে পারে। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর তত পেলেন, এবার হাত ছাড়ুন! কবজিটা ভেঙে যাবে।

অপর্ণার ঘরে আর ঢুকবে না নিশ্চয়?

কথা দিতে পারছি না।

তোমার কাছে হাতজোড় করছি।

ওই তো কাগজের পুতুল, ওকে আপনার এত ভয় কেন?

ভয় কেন? আশ্চর্য! এটা একটা প্রশ্ন? শোনো, তুমি এসে পর্যন্ত সমস্ত সংসার জটিল হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে আরও কিছু যেন আসছে। ভয়ানক কোন বিপদ..ভীষণ কোন ঝড়…

তবে আমাকে চলে যেতে দিন।

না না! তা হয় না। শুধু তোমায় মিনতি করছি—

আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে, কি জবাব দেব?

জবাব আমি দেব। বলব, অপর্ণা পছন্দ করে না, অপর্ণা বিরক্ত হয়।

কিন্তু সেটা তো বানানো কথা! উনি তো খুব পছন্দ করছিলেন আমাকে। ডেকে সাড়া না পেলেই বরং বিরক্ত হন। যদি ডাকেন? তাহলে?

জানি না, তাহলে কি! কিন্তু আমি বলছি, খুব একটা ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিয়েছ তুমি। এ পথে বিপদ আসতে পারে, মৃত্যু আসতে পারে। খুব সাবধান!

অথচ আপনি সাবধান হলে সবই সহজ হয়ে যায়।

আমি? আমি কি সাবধান হই না? হচ্ছি না? কিন্তু রক্তমাংসের তৈরী মানুষ আর কত বেশী সাবধান হতে পারে বলতে পারো?

.

জানলার ধারে গিয়ে হাতটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল চৈতালী।

না, ফোসকা পড়েনি, শুধু রক্ত জমে গিয়ে কালশিটে পড়ে গেছে, শুধু আগুনের ফুলকির মত যেন একটা দাহ উঠছে ভেতর থেকে।

কি হল? হাতে কি হল?

ক্ষেণু এসে হাতের বইগুলো দুদ্দাড় করে নামাল।

আর হঠাৎ রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল চৈতালীর। সবাই সুখী থাকতে পারে, সবাই নিশ্চিন্ত। শুধু পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা, সমস্ত ভয় জমানো আছে চৈতালীর জন্যে।

শুধু একটি ভদ্র আশ্রয়, শুধু একটু মাতৃস্নেহ, শুধু একখানি সংসারের পরিবেশ, এই তো রাজার ঐশ্বর্য হয়েছিল চৈতালীর, এতেই তো সে ধন্য হয়ে গিয়েছিল, সেই পাওয়াটুকু নিয়েই সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিতে পারত, কিন্তু চৈতালীর ভাগ্যের শনি সেটুকুকে তিষ্ঠোতে দিল না। আনলো ঘূর্ণিঝড়!

সে ঝড় একদিকে যেমন সারাজীবনের দুঃসহ গুমোট কাটিয়ে দিয়ে আনল উদার আকাশের • খোলা হাওয়া, তেমনি আনল ধুলো বালি শুকনো পাতা। সে বালি চোখে ঝাঁপটা মারছে, সমস্ত আলো থেকে আড়াল করে ধরছে।

কই কি হল বললে না? হাত পোড়ালে বুঝি?

রাগকে লাগামে কষে আটকাতে হবে।

চৈতালী কেমন একরকম হেসে বলে, হ্যাঁ।

তা তো পুড়বেই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজ নিজের ঘাড়ে তুলে নিতে গেলেই কাটে, ঘেঁড়ে, পোড়ে। ওষুধ লাগিয়েছ কিছু?

নাঃ! লাগাতে কিছু হবে না।

না না, অবহেলা করা ঠিক নয়। তিল থেকেই তাল হয়– সুদক্ষিণা বলে ওঠে, যাক আজকের কী খাবার বল? খিদেয় তো নিজেকেই নিজে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে।

.

চৈতালীর মনে পড়ে, ছোলার ডাল সেদ্ধ করে বেটে রেখেছিল আজ, ডালপুরী করে দেবে বলে। নিরামিষ খাবার করলে সুলক্ষণারও খাওয়া হয়, তাই রোজ বিকেলেই দেশী খাবার বানায় চৈতালী।

সুলক্ষণা বলেন, ছিলি তো একটা বাউণ্ডুলে বাপের কাছে, এত সব শিখলি কোথায়?

চৈতালী হাসে। বলে, এমনি।

কিন্তু এমনি নয়, কিছুদিন তার বাবা একটা খাবারের দোকানের ভেতরদিকের একটা ঘরের ভাড়াটে ছিল। সে ঘরের সামনেই সর্বদা দোকানের যাবতীয় রসদ প্রস্তুত হত।

বড় বড় তেলজবজবে বারকোশে রাশি রাশি ময়দা, বড় বড় গামলায় শিঙাড়ার পুর, বড় বড় পরাতে কচুরির ভাজি, ডালপুরীর পুর, সব বসানো থাকত ওদের ঘরের সামনের ঘরটায়।

খাবারওলা বলেছিল ওর কারিগরদের একজন দেশে গেছে, চৈতালীরা বাপ-বেটিতে যদি

তা সেই সময় অনেক কাজ শিখে ফেলেছে চৈতালী। কিন্তু সে কথা বলা যায় না। বলতেই হয়, কি জানি, এমনি!

সুদক্ষিণাকে বলল চৈতালী, তুমি যাও ওপরে, হাত মুখ ধুয়ে আসতে আসতে হয়ে যাবে।

তার মানে হয়নি!

তা তো হয়নি। চৈতালীর অনেক খানিকটা সময় যে হরণ করে নিয়ে গেল এক দস্যু।

আর শুধুই কি সময় হরণ করল?

হয়ে যাবে!

সুদক্ষিণা বলে, আহা থাক না তবে বাবা। ওই হাত-টাত পুড়িয়েছ! আগে তো রোজ এসে। টোস্ট খেতাম, তাই খাওয়া যাবে। চল চল, বরং একটা মজার কথা আছে–

মজার কথা?

হ্যাঁ ভারী মজার! ছোড়দা এলেই বলব ভাবছিলাম।

বাড়িতেই তো আছেন এখন ছোড়দা!

বাড়িতে? এ সময়? এত সুমতি? তাহলে তো আজ একটু সিনেমাতেও যাওয়া যায়। সেদিন তত বৌদি মার্ডার কেস করে ছাড়ল।

ছোড়দা, ছোড়দা! ডাকতে ডাকতে দুমদাম করে ওপরে উঠে গেল সুদক্ষিণা।

.

এ শব্দ অপর্ণার বুকে গিয়ে হামানদিস্তার ঘা দিল।

অপর্ণা ক্ষীণ গলায় বলল, দরজাটা বন্ধ করে দেবে? তবু একটু

কৌস্তুভ উঠে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আসে।

অপর্ণা বলে, অত দূরে বসছ কেন?

দূরে কোথা? এই তো কাছে।

বিছানায় উঠে এসে বসে কৌস্তুভ।

অপর্ণা একটু নিঃশ্বাস ফেলে বলে, জীবনে আমার বড় ঘেন্না ধরে গেছে।

কৌস্তুভ আস্তে ওর গায়ে হাত রেখে কাতর গলায় বলে, এসব কথা বললে আমি কত কষ্ট পাই বোঝো না কেন অপু?

না, তাই বলছি। যদি সেকাল হত, বেশ সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী একটি মেয়ে দেখে আর একটা বিয়ে দিয়ে দিতাম তোমার।

কৌস্তুভ ওর গালের হাড়ে একটু টোকার মত দিয়ে বলে, সেকালে জন্মাইনি বলে আপসোস হচ্ছে আমার।

অপর্ণা একটু চুপ করে থেকে বলে, মার ওই পুষ্যি মেয়েটার খুব স্বাস্থ্য।

অপর্ণার দেহের মধ্যে নতুন রক্ত আর তৈরী হয় না বলেই কি স্মৃতিশক্তি অত কমে গেছে অপর্ণার? .

একশোবার শুনেও চৈতালী নামটা মুখস্থ করতে পারে না? বলে, মার পুষ্যি মেয়ে!

কৌস্তুভ চকিত হয়ে বলে, কে? কার কথা হচ্ছে?

ওই যে তোমাদের বাড়ির রাঁধুনী। যখন এসেছিল কী রোগা, কী নোগা! আর এই কমাসেই দেখ চেহারা। গা দিয়ে তেল পিছলে পড়ছে। একটা জোয়ান মেয়ের চেহারা যেমন হওয়া উচিত, ঠিক তেমনি।

কথা বলে আর স্বামীর মুখের দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে থাকে অপর্ণা!

কী দেখছ?

তোমায়।

কখনো দেখনি বুঝি?

কই আর দেখলাম!

থাক, আর দেখতে হবে না। ওষুধটা খেয়ে ফেল।

ওষুধটা ঢালতে ঢালতে ভাবে কৌস্তুভ, রক্তশূন্যতা শুনে শুনে কান পচে গেল। এত রক্ত শুষেও কোন উন্নতি হচ্ছে না।

আশ্চর্য!

ওষুধ খেতে চায় না অপর্ণা, ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রতিবার খাওয়াতে হয়।

সে পর্ব মিটলে, অপর্ণা আস্তে থেমে থেমে বলে, ওকে একবার ডাক না?

কাকে? শঙ্কিত চোখে চায় কৌস্তুভ।

ওই যে ওই চৈতালীকে।

না, নামটা বিস্মৃত হয়নি তাহলে।

কৌস্তুভ শান্ত গলায় বলে, ওকে কেন?

বিছানাটা একটু ঝেড়ে দেবে

কী আশ্চর্য! এটুকুর জন্যে লোক ডাকতে হবে? আমি দিচ্ছি

না, আরো কাজ আছে। ডাক না।

কৌস্তুভ উঠে দাঁড়ায়। টেবিলে রাখা ওষুধের শিশিগুলোর দিকে তাকায় একবার। তাকায় দেরাজের ওপর আর আর্শির সামনে। সর্বত্রই শিশি। শুধু শিশিই নয়, নানারকম শিশি কৌটো টিউব।

সেইগুলোর দিকে তাকিয়ে যেন নাম পড়ে নিতে চায় কৌস্তুভ। যেন ওই নামগুলোর মধ্যে ওর ভয়ানক দরকারী একটা কিছু লুকোনো আছে।

তারপর বেরিয়ে ডাকে, বংশী!

বংশীকে কেন?

ও ডেকে দেবে।

কেন? তুমি ডাকতে পার না? ডাক না?

আমার ডাকার কী দরকার?

বাঃ, রোজ ভাত খাও ওর কাছে

বেশী কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। একটু চুপ কর। দরকারী কথা ছাড়া আর কিছু বলা বারণ, মনে নেই?

৩. বংশী এসে দাঁড়ায়

বংশী এসে দাঁড়ায়।

কৌস্তুভ বলে, তোর বৌদিদি কী যেন বলবে!

অপর্ণা চোখ বোজে।

অপর্ণার রক্তহীন গালে যেন হালকা সিঁদুরের ছোপ পড়ে।

বংশী বার দুই বৌদি বৌদি ডেকে একটু ইতস্তত করে বলে, ঘুমোচ্ছেন!

কৌস্তুভ আশ্চর্য হয়

। অন্তত বংশী দেখে, বড়দা খুব আশ্চর্য হয়ে গেছে।

বলে, এই তো জেগে ছিল।

দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ বংশী, তারপর সরে পড়ে।

আর অনেকক্ষণ ধরে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে হয় অপর্ণাকে।

.

মজার কথাটা সুদক্ষিণার কৌশিককে নিয়েই।

ক্লাসের একটি মেয়ে কতদিন ধরে বলছিল, তার মা নাকি সুদক্ষিণাকে দেখতে চেয়েছেন, তাই গিয়েছিল সুদক্ষিণা। আর তিনি সুদক্ষিণাকে হাতে পেয়ে–হি হি করে হাসে সুদক্ষিণা, বুঝলি ছোড়দা, আমাকে পেয়ে সে এক মজার প্রস্তাব!

হেসেই অস্থির, কৌশিক ওর মাথায় একটা বইয়ের কোণ ঠুকে দিয়ে বলে, প্রস্তাবটা কি তাই তো শুনলাম না। তোর বিয়ের নাকি? এমন একটি নিধিকে দেখেই বুঝি ছেলের বৌ করে নিতে ইচ্ছে করছে?

হি হি হি, প্রায় তাই, কাছাকাছি এনেছ। ছেলের বৌ নয়, মেয়ের বর। দেখা নিধির দিকে ফিরেও একবার দেখল না, না দেখা নিধির জন্যেই কাতর। পুঙ্খানুপুঙ্খ জিগ্যেস করল আমাকে তোর কথা।

আমার কথা? আমার কথা মানে? আমার আবার কী কথা?

আহা, এই তুমি রাগী না হাসিখুশী? মেজাজী না হেলাফেলা? ঝালের ভক্ত না মিষ্টির ভক্ত?

এই সব জিগ্যেস করল?

করল তো।

আর তুই তার উত্তর দিলি বসে বসে?

দিলাম তো!

গোল্লায় যা।

খাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকল চৈতালী। বলল, এ কি দিদি, হাত মুখ ধোওনি?

ধোবো! মজার কথাটা শুনে যাও, এই এই

কী?

ছোড়দার না, একটা হিল্লে হয়ে যাচ্ছে। আমার ক্লাসের একটা মেয়ের মা

.

এ বাড়ির সব কটা প্রাণীর মধ্যে সুদক্ষিণাই সুখী। সে সব কিছুর মধ্যে অত তলাতে যায় না।

নিজেকে নিয়েই মশগুল।

তা ছাড়া হয়তো বা বোধটাও একটু কম। চৈতালীকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে সে ছোড়দাকে, তাই বলে সেটা নিয়ে যে সত্যি মাথা ঘামানো যেতে পারে, এ তার বুদ্ধির বাইরে।

তাই কথার মাঝখানে হঠাৎ চৈতালীকে চলে যেতে দেখে ও একটু চমকালো।

শুধু তো চলে যাওয়া নয়, মুখের চেহারাখানাও খুব খারাপ ঠেকল। ছোড়দার দিকে তাকাল।

ভুরু কুঁচকে বলল, ছোড়দা!

আজ্ঞা হোক!

ঠাট্টা ছাড়। ও মুখটাকে অমন করে চলে গেল কেন?

সেটা ওর মুখকেই জিগ্যেস করলে ভাল হয়।

না। তোর চোখ থেকেই উত্তর চাইছি।

তাহলে চোখের ভাষা পড়তে শেখ। ওটা জিগ্যেস করে হয় না।

হুঁ!… তাহলে তলে তলে সত্যিই এটি ঘটাচ্ছ?

ঘটাচ্ছি না। ঘটছে।

কিন্তু ছোড়দা, ব্যাপারটা কি ভাল হচ্ছে?

জগতে কি যেটা ভাল, শুধু সেটাই ঘটে?

কিন্তু না না ছোড়দা, ভয়ানক অস্বস্তি হচ্ছে।

হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এ নিয়ে মাথাটা বেশী নাই বা ঘামালি?

তা না ঘামালে? পরিণতিটা ভাবতে হবে তো?

সমস্ত ব্যাপারেরই একটা ছকে বাঁধা সুষ্ঠু পরিণতি হবে, এমন ভাববার দরকার কি? কালের হাতে ছেড়ে দিয়েও দেখতে হয় কিছু কিছু। অনেক নদীই মরুপথে ধারা হারায়।

হুঁ, ব্যাপারটা যতটুকু ভাবছিলাম তার থেকেও ঘোরালো মনে হচ্ছে।

হেতু?

তোর মুখে দার্শনিক উক্তি!

ছেড়ে দে ওসব কথা। একটা অনুরোধ করি তোকে, ওকে কিছু বলতে যাস না।

ওকে বলব না, মাকে বলব।

ক্ষেণু! বেশী পাকামি করতে যাস না, বলবার দরকার বুঝি, আমিই বলব। তোকে উকিল ধরতে যাব না।

তুই বলবি? পারবি?

কেন পারব না? দরকার বোধ করলে সবই পারা যায়।

তা সে দরকারটা এখন বোধ করছিস না?

না।

.

না, সে দরকার এখন বোধ করছে না কৌশিক, করবে না।

সে হালকা স্বভাবের হতে পারে, হালকা বুদ্ধি নয়। চারাগাছকে মহীরুহ ভাবতে বসছে না সে।

হয়তো কৌশিক এদের এই গতানুগতিক সমাজবোধকে খুব একটা মূল্য দেয় না, কিন্তু অকারণ তাল ঠুকতেও সে চায় না।

তা ছাড়া চৈতালী?

তার কুণ্ঠিত সংকুচিত জীবনকে আগে বিকাশের পথ দেখিয়ে দেওয়া উচিত। তারপর সে জীবনের সার্থকতার প্রশ্ন।

.

তবু চোখে চোখ পড়লেই চোখের ভাষা মুখর হয়ে ওঠে।

একজোড়া ত্রস্ত সেখ বলতে চায়, এ তুমি কি করছ?

আর একজোড়া অভয় হাসি হেসে বলে, তাতে কি? জগতে কি এ রকম ঘটে না?

একজোড়া বলে, লোকে আমায় কি বলবে?

আর একজোড়া বলে, বলুক না। তুমি তো একা নও। আমিও তো রয়েছি

কিন্তু মুখের ভাষা কৌশিকের এখনো তেমনি। খেতে বসেই হাঁকডাক করে, রান্না যে আজকাল মুখে করা যাচ্ছে না, সে বিষয়ে যথেচ্ছ মন্তব্য প্রকাশ করে, আবার চেয়ে খায়। তাকেই যে বিশেষ করে অবহেলা করা হচ্ছে এই ছুতো তুলে সুলক্ষণাকে ডেকে নালিশ জানায়, সালিশ মানে, আর মায়ের অসাক্ষাতে হেসে বলে, কেমন জব্দ!

কিন্তু এই সহজ ভঙ্গীটাই যে সন্দেহজনক, সে বোধ কি আছে কৌশিকের?

নেই।

জগতের সমস্ত নবীনের মত সেও প্রবীণকে অবোধ ভাবে। সমস্ত যৌবন অতিক্রম করে, জগতের সর্ববিধ রূপ রস রহস্য, রঙ্গের রহস্য ভেদ করে আর আস্বাদন করে করে তবে যে ওরা প্রবীণ হয়েছে, সে কথা খেয়ালে আনে না। খেয়ালে আনে না–তোদের মুখের রঙের আভাস মাত্র দেখলেই ওরা ধরে ফেলে, কোথায় চলছে কতটা রঙের খেলা।

সুলক্ষণা বিধবা, সুলক্ষণা বুড়ী হয়ে গেছেন, অতএব সুলক্ষণা এ রহস্য বুঝতে পারছেন না। এটাই হিসেব।

কিন্তু সুলক্ষণা বুঝছেন।

তাই সুলক্ষণা শঙ্কিত হচ্ছেন।

আর গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন।

সুলক্ষণার কণ্ঠে আর যেন তেমন প্রশ্রয়ের সুর নেই। নিজের নিভৃতে ভাবতে থাকেন সুলক্ষণা, কৌশিকের কথা তো আগে ভাবিনি আমি।

ওকে যে আমি অনেক উঁচু জগতের মানুষ বলে জানতাম! আমি ওর সহৃদয়তাটুকুকে ভরসা করেছিলাম, ওর মমতাকে তো ভয় করিনি।

ওটাও কি তাহলে একেবারে সাধারণ?

আমি যে তাহলে হেরে গেলাম।

ঘি আর আগুনের সেই চিরপ্রচলিত কুৎসিত প্রবাদটার কাছেই মাথা নোয়াতে হল আমাকে?

.

দুপুরবেলা যখন চৈতালী এসে পায়ের কাছে বসে, পা গুটিয়ে নেন সুলক্ষণা। বলেন, থাক, তুই সরে যা। ঘুম পাচ্ছে আমার।

চৈতালী ভয় পায়।

আগের মত আর নিয়ে চুল নিয়ে জবরদস্তি করে না। আস্তে সরে যায়, নিজের জন্যে নির্দিষ্ট সেই ছোট ঘরটায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। তারপর অনেকক্ষণ হয়ে যায়।

এক সময় নিঃশ্বাস ফেলে বইখাতা নিয়ে বসে।

সুদক্ষিণা বলেছে, বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তারপর তোমাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাবে।

চৈতালী এসব কথায় ম্লান হয়ে যায়।

বলে, এসব কি দরকার দিদি? এই তো আমি বেশ আছি।

বেশ আছছ? রাতদিন শুধু ভাত রাঁধছে, কাপড় কাঁচছে, ঘর মুছছে, বাসন ধুচ্ছ, গুল পাকাচ্ছ, মোচা কুচোচ্ছো, আর কোনও কিছু নেই, এ একটা জীবন! একে বলে বেশ থাকা?

আর কীই বা থাকে দিদি আমাদের মত মেয়েদের?

থাকে লক্ষ্য। থাকে উদ্দেশ্য। তোমার কি আছে?

স্রোতের কুটোর কি কোন লক্ষ্য থাকে? কোন উদ্দেশ্য থাকে?

তা স্রোতের কুটো হয়েই থাকবে নাকি চিরকাল?

ক্ষতি কি?

আমার ক্ষতিবোধ আসে। নিশ্চিন্ত চিত্তে একটা জীবনের অপচয় চোখের ওপর দেখতে ইচ্ছে করে না।

আমি তো মনে করি না অপচয়। তোমাদের বাড়িতে এই আশ্রয়টুকু পেয়ে আমি তো নিজেকে ধন্যই মনে করি।

কর সেটা তোমার মনের গুণ। কিন্তু আমি মনে করি না, আমাদের সংসারে দাসত্ব করে খুব একটা ধন্য হচ্ছ তুমি।… ওই সব হাবিজাবি কাজগুলো কমিয়ে এই জ্ঞানরাজ্যের সীমানায় এসে দাঁড়াও একটু, দেখবে তোমার এখনকার হিসেব সব অর্থহীন হয়ে যাবে।

.

সেই জ্ঞানরাজ্যের চাবিকাঠিটি হাতে তুলে দিতে চাইছে ওরা। চৈতালী কি অবহেলা করবে তাকে?

বইগুলো নিয়ে বসে।

মনে হয়, বাবা যদি মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি বসিয়ে না রাখতেন, আমিও হয়তো দিদির মত

সুলক্ষণা কোন একসময় হয়তো উঠে পড়েন। পাশ থেকে দেখতে পান, চৈতালী বইখাতা নিয়ে বসে আছে চুপচাপ! শুকনো, ম্লান মুখ।

স্বাস্থ্য খুবই ভাল হয়েছে ওর এখন, কিন্তু যখন একা থাকে, মুখটা বড় ম্লান দেখায়। যন্ত্রণার কপাল মেয়েটার। জীবনের মোটা যন্ত্রণার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্ম আর এক যন্ত্রণা কুরে খেতে বসেছে ওকে।

ভারী মমতা হয় তখন।

মনে হয়, আমি কেন ওর ওপর বিরক্ত হচ্ছি, ওর তো বয়েস কম, এই তো ভালবাসবার সময়। ওর সামনে যদি, ওর এই ঠিক ভালবাসায় বিকশিত হয়ে ওঠবার বয়সে, কৌশিকের মত ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়, কি করে নিজেকে রুখবে ও?

না, ওকে আমি দোষ দিতে পারি না।

ও তো মেয়েমানুষ।

মেয়েমানুষ যে ভালবাসায় ধন্য হয়ে যাবার জন্যই জন্মায়।

সুলক্ষণার এই মতবাদ শুনলে হয়তো লোকে হেসে উঠবে। বলবে, এ যুগে অন্তত তোমার ওই পচা থিয়োরি অচল। এ যুগের বহুমুখী প্রতিভাধর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখ। কত দিকে নিজেকে বিকশিত করে তুলছে তারা, স্বয়ংসম্পূর্ণতার দৃষ্টান্ত নিয়ে।

পুরুষের ভালবাসা তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বস্তু।

বলবে।

বলুক কিন্তু তা হয় না।

প্রকৃতির নিয়ম উলটোয় না।

একটি পুরুষের ভালবাসা ভিন্ন কোনও মেয়েই সম্পূর্ণ নয়। অনুসন্ধান করো, দেখবে তার আপাত একক জীবনের অন্তরালে স্পন্দিত হচ্ছে একটি প্রেম–আকাশের কোলে ধ্রুবতারার মত, নাট্যপ্রবাহের পেছনে আবহ সঙ্গীতের মত।

সেই প্রেম তার সমস্ত জীবন ব্যেপে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখে কল্যাণের দূরত্ব বজায় রেখে। রাখে গোচরে অগোচরে, জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে।

সে প্রেম সমাজবিরোধী কাজ করে তার জীবনের মানসীকে ধুলোয় টেনে নামায় না, শুধু হৃদয়ের উপস্থিতি দিয়ে ভরিয়ে রেখে দেয়।

নিঃস্বার্থ?

নিঃস্বার্থ প্রেম হয় না বলবে?

কিন্তু নিঃস্বার্থ কোথায়? সেই তার মানসী প্রিয়ার সুন্দর হয়ে ওঠা, মহৎ হয়ে ওঠা, উজ্জ্বল হয়ে ওঠাই তো তার স্বার্থ।

যে মেয়ে সত্যি একক, সত্যি নিঃসঙ্গ, সে কৃতী হতে পারে, উজ্জ্বল হয় না। সাফল্য অর্জন করতে পারে, সার্থক হয় না। সে তার অনেক জ্ঞানবুদ্ধি কর্মদক্ষতা, অনেক প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি প্রাধান্য, অনেক যশ অর্থ সম্মানের বোঝা নিয়েও শুকিয়ে যায়, বুড়িয়ে যায়, নিষ্প্রভ হয়ে যায়।

মেয়েদের জীবনে মূল জীবনীরস ভালবাসা। সমাজ তাই ভয় পায়। তাই সদাসর্বদা শাসনের তর্জনী তুলে বসে থাকে, তাই অহরহ নিক্তি ধরে বিচার করে দেয়, কোনটা বৈধ, কোনটা অবৈধ, কোনটা শ্রেয়, কোনটা অশ্রেয়, কিসে কল্যাণ, কিসে অকল্যাণ।

না করে উপায় নেই। নইলে বাঁধ ভাঙবে মেয়েরা, কূল ছাপাবে। বাঁশীর ডাককে উপেক্ষা করবার শক্তি খুঁজে পাবে না।

.

এত সব ভাবেন সুলক্ষণা। বুদ্ধি দিয়ে, বিচার দিয়ে।

কিন্তু চোখের সামনে ওই হাসি ঠাট্টা কৌতুক কলগান কিছুতেই যেন ভাল লাগে না।

চৈতালীকে মেয়ের আসনে বসাতে পেরেছিলেন এক মুহূর্তে, তার অতখানি ত্রুটির বোঝা সত্ত্বেও পেরেছিলেন। কিন্তু বৌয়ের আসনে বসাবার কথা ভাবতেই পারছেন না। সমস্ত মনটা যেন সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে।

তাই বারবার ভাবতে চেষ্টা করছেন সুলক্ষণা–আমার বড়ছেলের বৌকে এনেছিলাম আমি সেরা কুলীনের ঘর থেকে, সমাজের উঁচু চূড়ো থেকে!

.

হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। একেবারে উঁচু চুড়ো থেকেই অপর্ণাকে এনেছিলেন এঁরা।

তাই নীচু হবার উপায় হল না অপর্ণার। নীচু হতে পারছে না বলেই জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অসতী মেয়ের কাহিনী শুনলে শিউরে উঠতে হয় ওকে, কুমারী মেয়ের কলঙ্ক কথা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়, তাই আঙুর আপেল বেদানা ছানা ডিম দুধ মাছ মাংসের সমারোহের মধ্যে ডুবে থেকেও শরীরে ওর রক্ত হয় না। আর অনেক উঁচু থেকে এসেছে বলেই বোধ করি এই নীচু তলার মানুষদের বিশ্বাস করতে পারে না সুলক্ষণার বড়বৌ।

চেষ্টা করেছিল।

বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন চেষ্টা করেছিল। সাধনা করেছিল উজ্জ্বল হয়ে ওঠবার, পারল না। ব্যর্থ হল। বিছানা নিল।

তবু উঁচুঘরের কথাই ভাবেন সুলক্ষণা।

হাড়ে মজ্জায় যে সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে আছে, তাকে তিনি উড়িয়ে দিতে পারেন না। মেয়ে আর বৌকে সমান কোঠায় ফেলতে পারেন না।

.

সুদক্ষিণা কিন্তু মার থেকে উদার।

সুদক্ষিণা সমাজ-সংস্কারমুক্ত বলে নয়, সুদক্ষিণা আধুনিকা বলেও নয়, সুদক্ষিণার মনটা সহানুভূতিপ্রবণ বলেই। ও ভাবে মরুকগে বাবা, হলেই বা। ছোড়দা যখন ঘেন্না করছে না, তখন দোষ কি? তোমাদের পুরাকালের শান্তরেও তো আছে বাবা স্ত্রীরত্নং দুঙ্কুলাদপি!

চৈতালী কি রত্ন?

তা যে মেয়ে যাকে ভালবাসল, প্রধানত সেই তো তার কাছে রত্ন হয়ে উঠল। তা ছাড়া কেনই বা রত্ন নয়?

কী পরিবেশে মানুষ হয়েছে ও!

তবু কী পরিচ্ছন্ন, কী সভ্য সুন্দর!

ওর মাত্রাবোধকে সমীহ করে সুদক্ষিণা।

সুলক্ষণার অভাবিত প্রশ্রয়ের আশ্রয় পেয়েও দিশেহারা হয়নি ও। সুলক্ষণার অতখানি দামী ছেলের কাছে দামী হয়ে উঠেও আত্মহারা হয়নি। অতবড় পাওয়াকে নিজের মধ্যে সংহত রেখে, সেই বাটনা বাটা, কুটনো কোটা, রান্না করা, কাপড় কাঁচার মধ্যেই নিজেকে অমন করে সমাহিত রাখা কি সহজ ক্ষমতার পরিচয়!

সুদক্ষিণাকে যদি হঠাৎ কোনও রাজপুত্র এসে বরমাল্য দেয়?

সুদক্ষিণা কি মাটি দিয়ে হাঁটবে?

এই প্রশ্ন নিয়ে সুদক্ষিণা চৈতালীকে সমীহর চোখে দেখে। ওদের দুজনের ভালবাসাকে তাই স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হয় না।

কিন্তু কৌশিকের মন এখনো প্রশ্নহীন নয়।

কৌশিক ভাবছে এটা কি সত্যি?

নাকি সেই তুচ্ছ বস্তুটা?

একটা তরুণী মেয়ের প্রতি পুরুষের যে সহজাত মোহ, সেই-টা? অথবা করুণা?

ওর সঙ্গে আমার যে অসাম্য, সে কি আমি করুণা দিয়ে অনেকখানি ভরাট করে তুলে ভুল করতে বসেছি?

সুদক্ষিণা বলে, এই ছোড়দা, কবে বলবি মাকে?

ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? সবুরে মেওয়া ফলে।

ওদিকে আর এক খেলা চলছে, খোঁজ রাখিস?

কি?

বড়গিন্নীর সারাক্ষণ চৈতালীকে না হলে চলছে না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমার রাগারাগিতে সেই একটা নার্স রাখা হয়েছিল কদিন, দেখেছিলি তো?

দেখে থাকব! ওই জাতীয় একটা জীবকে কদিন যেন ঘুরতে দেখেছিলাম মনে হচ্ছে—

বিদেয় করে দিয়েছে সেটাকে। ওষুধ খাওয়াতে এসেছিল, হাত কামড়ে দিয়েছে তার

ফাইন! সুপারফাইন! দেখা যাচ্ছে কামড় দেওয়া ব্যাপারটা ছোটলোকের একচেটে নয়, স্রেফ মেয়েলোকদের একচেটে।

চৈতালীর এবাড়িতে আসার প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে গেল সুদক্ষিণার। ছোড়দার মুখের দিকে চেয়ে হাসল একটু।

তারপর বলল, সে যাক। সে নার্স তো পত্রপাঠমাত্র পদত্যাগপত্র! বৌদি এখন চৈতালীকে সর্বদা চাইছে, বলছে, সংসারের কাজের জন্যে অন্য লোক রাখো তোমরা–

কিন্তু অহেতুক এই রাহুর প্রেমের হেতু?

জিগ্যেসের সঙ্গে সঙ্গেই নিজের একটা প্রশ্নের উত্তর পায় কৌশিক। কদিন ধরেই দেখছে, চৈতালী যেন দুর্লভ হয়ে উঠেছে, দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না তার। এমন কি মাঝে মাঝে বেঁধে বেড়ে রেখে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, ভাত বেড়ে দিচ্ছে বংশী।

মনে ভেবেছিল, হয়তো এ চৈতালীর নতুন জন্মানো লজ্জা, হয়তো বা নিজেকে গুটিয়ে রাখবার, সরিয়ে রাখবার দুরূহ সাধনা, আর নয়তো বা হা, একথাও ভেবেছিল কৌশিক, নয়তো বা কৌশিককে যাচাই। দুর্লভকে লাভ করবার জন্যে চেষ্টা করে বেড়ায় কিনা কৌশিক, তারই পরীক্ষা!

আজ বুঝল, ওসব কিছু না।

হরিণী ব্যাধের জালে আটক।

কিন্তু আটকের মানে পেল না। ইদানীং বৌদির ঘরে সে কদাচ ঢোকে। নেহাত মরণ বাঁচন শুনলেই তবে। তাই দেখেনি, ওখানে চৈতালীর অবস্থাটা কি।

তাই বলল, হেতু?

সুদক্ষিণা অবশ্য বেশী আলোকপাত করতে পারল না। সব প্রশ্নের যেটা শেষ উত্তর, সেটাই বলে দিল দু হাত উলটে, ঈশ্বর জানেন।

যাক তাহলে সময়মত সেই লোকটাকে একবার শুধিয়ে এলেই হবে।

আহা রে.. তবে শোন্

কী? আমার মনে হয়, বৌদি তোদের সন্দেহ করে।

সন্দেহ করে?

হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়।

তা এসব অধমাধম তুচ্ছ ব্যক্তিদের সন্দেহ করে ওঁর কী লাভ?

বাড়ির বড়গিন্নী, বোধহয় বাড়ির পবিত্রতা বজায় রাখবার দায়টা নিজের বলে গ্রহণ করেছেন। অথবা ভাবছেন, বিশ্বে শুধু নড়িবেক মোর ল্যাজটুকু! এ সংসারের তাবৎ আগ্রহ ঔৎসুক্য আর ভালবাসার ওপর ওঁর একচেটে অধিকার। আর কোথাও কিছু ঘটলেই ওনার নৈবেদ্যে কম পড়ে যায়।

হুঁ, মনস্তত্ত্বজ্ঞানটা যে বেশ জবর হয়ে উঠছে দেখছি।

না রে ছোড়দা সত্যি, আগে এত বুঝতে পারতাম না, সর্বদা ভয় পেতাম ওই বুঝি কি হয় বলে, এখন যেন অরুচি ধরে গেছে। ওর স্বার্থপরতা, আর দাদার কী বলব, কী আর বলব, স্ত্রৈণতাই, ঘেন্না ধরিয়ে দিয়েছে একেবারে। বুঝলাম যে রুগ্ন বৌ, তা বলে ন্যায্য অন্যায্য বলে কিছু থাকবে না? এটুকু বুদ্ধি থাকবে না যে ও ওই রোগ ভাঙিয়েই

এই থাম!

.

এই থাম!

সাবধান করে দেবার সময় এসেছে।

চৈতালী এসে দাঁড়িয়েছে।

দিদি!

কী গো?

এখন কি কেউ বেরোবেন?

কেউ মানে তো ছোড়দা। ওকেই জিগ্যেস করে দেখ।

চৈতালী মৃদুস্বরে বলে, জিগ্যেস করবার আর কী আছে। বলছিলাম যে থার্মোমিটারটা তো ভেঙে গেছে, আর একটা এনে রাখতে

ভেঙে গেছে। শুধু থার্মোমিটারটা? না আর কিছু?

চৈতালী চোখ তুলে বলে, না, আর কি ভাঙবে!

তা বটে, ভাঙতে হলে হাড়। তা অত বোধ করি ক্ষমতা নেই তোমার পেসেন্টের। বড় জোর চামড়াটা একটু ছিঁড়েখুঁড়ে

চুপ করুন।

চৈতালী চলে গেল। দ্রুতপায়ে।

অপর্ণা আস্তে আস্তে ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

.

বৌদি আজকাল ক্রমশই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে

নিঃশ্বাস ফেলে বলে সুদক্ষিণা।

কৌশিকও একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর আস্তে বলে, অথচ ওঁকে বাঁচানো যেত।

যেত?

যেত। যদি ওঁকে নিয়ে এমন শবসাধনার মহোৎসব করা না হত। যদি খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া হত ওঁর।

খাঁচার দরজা খোলা পেলে কী করত ও শুনি?

খাঁচায় বন্ধ পাখীরা যা করে। উড়ে যেত।

না, তা যেত না সুদক্ষিণা বলে, পারত না! ওর কাছে ওই নিয়মিত ছাতু ছোলারও যে রীতিমত মূল্য আছে। আকাশের স্বপ্ন দেখেছে ও, কিন্তু ছাতুর ভাড়টা আঁকড়ে ধরে আছে।

আছে, তাই আছে।

নৈবেদ্যের ত্রুটি সহ্য করবে, এমন ক্ষমতা নেই অপর্ণার। অথচ অপর্ণা খাঁচার শিকে ডানা ঝাঁপটায়।

কিন্তু সেই ঝাপট যার গায়ে লাগে, সে এক অদ্ভুত সহিষ্ণুতার অবতার। একবার বলে ওঠে না, আঃ!

বলে ওঠে না, এই চুপ!

.

সুলক্ষণার আজকাল আবার একটু কাজ বেড়েছে।

বংশীর অসুখ, চৈতালী বেশীর ভাগ অপর্ণার ঘরে। নেমে এসে ভাঁড়ারে বসে ময়দা মাখছিলেন তিনি, চৈতালী এসে দাঁড়াল। এসেছিল অপর্ণার জন্যে জারক লেবু নিতে, ভুলে গেল, থমকে দাঁড়াল।

বলল, মা!

মা বলে অনেক দিন ডাকেনি। এমন নিভৃতির সুযোগই ঘটেনি অনেক দিন। চিরকঠিন সুলক্ষণার হঠাৎ চোখের কোণে জল এসে গেল এই ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর দিতে পারলেন না।

চৈতালী কাছে বসে পড়ল, রুদ্ধকণ্ঠে বলল, মা, আমার হয়তো এবার চলে যাওয়া উচিত।

.

সুলক্ষণার অভিমান, এটা একটা আশ্চর্য বস্তু! ওঁর মেয়ে-ছেলেরা কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ, তবু সেই আশ্চর্য বস্তুটা চোখে দেখতে পেল চৈতালী।

সুলক্ষণা বললেন, কেন, চলেই বা যাবি কেন? তুই তো এখন বড় গাছে নৌকো বেঁধেছিস!

চৈতালী একটুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর দাঁড়িয়ে উঠে আস্তে বলল, মা, বৌদি একটু জারক লেবু চাইছেন।

সুলক্ষণা এ মুহূর্তে একথা প্রত্যাশা করেননি। চকিত হলেন। মুখে চোখ তুললেন, দেখলেন ভয়হীন বেদনাহীন ব্যাকুলতাহীন অদ্ভুত এক নির্লিপ্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চৈতালী। আগুন লাগা ঘরের সামনে বুঝি এমনি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ।

সুলক্ষণা শঙ্কিত হলেন।

সত্যি চলে যাবে না তো মেয়েটা? বনের পাখী ভালবাসায় বশ হয়ে আটকে পড়েছিল। সুলক্ষণা যদি সে ভালবাসা তুলে নেন, যদি হাতের ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দেন, উড়ে যাওয়া তার পক্ষে বিচিত্র কি?

কিন্তু?

কিন্তু আরও এক কঠিন শেকলে তো বাঁধা পড়ে গেছিস রে বাপু! সে শেকল ছিঁড়তে পারবি?

সুলক্ষণার মনে হল ওর মুখে শেকল ছিঁড়ে বাইরে এসে দাঁড়ানোর ছাপ। চোখে জল নেই, মুখে রেখা নেই, শুধু একটা শূন্যতা।

বিচলিত হলেন একটু।

বললেন, বোস!

তারপর বললেন, চলে যাবি বলে তো খুব শাসাচ্ছিস, পারবি চলে যেতে?

চৈতালী শূন্যে দৃষ্টি তুলে বলল, তা সত্যি সহজে পারব না, কষ্ট হবে ঠিকই।

তা চলে যাবার কি হল হঠাৎ?

মা! তুমি তো সবই বুঝতে পারো।

সুলক্ষণার চোখেও একটা গভীর শূন্যতার ছায়া ঘনিয়ে এল। খুব আস্তে বললেন, যেন নিজেকেই তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি সবই বুঝতে পারি। বুঝতে পারছি। কিন্তু হেরে তুই পালিয়ে যাবি কেন?

আমি কি একটা মানুষ মা? তাই হার-জিতের কথা? তুমি দয়া করে রেখেছিলে, কৃতার্থ হয়ে ছিলাম, এখন দেখছি তোমার সুখের সংসারে অশান্তি আনলাম আমি, শান্ত ঘরে ঝড়। তবে? শুধু নিজের স্বার্থের মুখ চেয়ে লড়াই করে জিততে যাব?

.

সুলক্ষণা অবাক হলেন।

চৈতালী যে এত ভাবতে পারে, সে ভাবনাকে এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারে এ যেন তার কাছে অভাবনীয় ঠেকল।

হঠাৎ মনে হল, যে মেয়েটাকে এই কত দিন যেন আগে এই ঘরে টেনে এনে হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, তোর নাম কি বল? এ যেন সে মেয়েটা নয়।

তার মুখের আদল চুরি করে আর একজন কে বসে আছে তার কাছে। একে চেনেন না সুলক্ষণা।

এই অচেনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা অসতর্ক কথা বলে বসলেন সুলক্ষণা।

বললেন, তা জিততেই হবে। স্বার্থ তো শুধু আর এখন একা তোর নয়। আমার ছেলেটা যে তোর স্বার্থে মাথা মুড়িয়ে বসে আছে।

মা!

সুক্ষণা ওর লুটিয়ে-পড়া মাথাটার ওপর একটা হাত রেখে বলেন, আমি সব জানি চৈতালী! শুধু–মিথ্যে বলব না, মনকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। বাধছিল। কিন্তু ভেবে দেখছি, মিথ্যে সংস্কারই যদি সব সিংহাসন দখল করে থাকবে, তাহলে বুদ্ধি বিবেচনা, মায়া মমতা, এরা কোথায় ঠাই পাবে?

মা!

হ্যাঁ মা? আর কোনদিন মাসীমা নয়।

মা! আমায় মাপ করো। ছেড়ে দাও। তোমার মাথা হেট হবে, এমন কাজ করবার সাধ্য আমার নেই।

সুলক্ষণা শান্ত হাসি হেসে বলেন, আমার মাথাটা কিসে হেঁট হবে, আর কিসে উঁচু হবে, সে বিধান কি তোর কাছে নিতে যাব আমি? এ তো শুধু তোর কথা নয়, এ যে আমার কুশীরও কথা! আমার নিজের সন্তানের কাছেই যদি আমি আমার স্নেহ নিয়ে, উদারতা নিয়ে, ক্ষমা নিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারলাম, বাইরের পাঁচজনের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মূল্যটা কী? সে তো মেঘের প্রাসাদ! যে কোনও সময় বাতাসে উড়ে যাবে, আকাশে মিলিয়ে যাবে।

মা, আমি কি করে মুখ দেখাব তোমার কাছে? আমি যে এ ভাবতেই পারছি না?

সুলক্ষণা এবার একটু হালকা হলেন।

একটু হাসলেন।

বললেন, আমার উদোমাদা বোকা ছেলেটার সঙ্গে দিব্যি তো আমার আড়ালে প্রেম করতে পারছিলি? এখন বিয়ের বেলায় আর ভাবতে পারছিস না! মুখ দেখাতে লজ্জা করছে!

হাতের তালুতে আগুন থাকে, হাতের তালুতে উত্তাপও থাকে। আঙুলের ডগায় থাকে সেই উষ্ণতা, যে উষ্ণতা থাকে শীতের সকালের প্রথম রোদে, বৃষ্টির সন্ধ্যায় ঘরের আরামে।

তাই আর ছাড়ুন বলতে ইচ্ছে হয় না।

শুধু সেই হাত ধরা হাতটায় মুখটা রাখতে ইচ্ছে করে।

চৈতালী!

উ!

চৈতালী!

বল।

খুব অদ্ভুত লাগছে না তোমার?

আমার জীবনের কোনটা অদ্ভুত নয়?

তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, কি করে বুঝতে পারলেন বল তো? কি করে এ সিদ্ধান্তে এলেন?

মা মা বলে!

ঠিক বলেছ চৈতালী! এতক্ষণে ধাঁধাটার উত্তর পেয়ে গেলাম! ভাবছিলাম, মা কি রাগ করে?… মা কি নির্লিপ্ত হয়ে?… মা কি অভিমানে?… এখন বুঝতে পারছি, মা সব বুঝতে পেরেছেন, মা বলে। এ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন মা বলে!

কিন্তু আমার বড় ভয় করছে।

জানি তোমার ভয় করবে। কিন্তু অভয় তো তোমার হাতের কাছেই চৈতালী! তাকে তুমি একটুও কেয়ার করছ না কেন? একবার যদি বলতে পারো, সব তুমি বুঝবে, তাহলেই দেখো ভয় সহজে কেটে যাবে।

কি জানি! যেন মনে হচ্ছে, চিরকাল বুঝি এই ছাতের ঘরের দরজার চৌকাঠটা ডিঙোলেই আমার বুক কাঁপবে, পা অবশ হতে চাইবে।

সর্বনাশ! তাহলে তো দেখছি ঘর বদলাতে হবে।

এই! বাঃ! তাই বললাম বুঝি? না গো না, এখানটা আমার স্বর্গ!

তুমি বলছ ভয় করছে, আমি ভাবছি বাবাঃ বাঁচা গেল। তখন আর দুটো কথার পর তিনটে কথা কইতে গেলেই বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটবে না?

আহা ইস্! তোমারও যেন

আমারও যেন মানে? হতো না নাকি ভেবেছ? নেহাত পৌরুষের মর্যাদাটুকু বজায় রাখতে মুখে বেপরোয়ার ভাব দেখাতে হত!

উঃ কী ওস্তাদ!

ওস্তাদ না হলে চোরকে বাটপাড়ি করে নিতে পারি?

এই, ভাল হবে না বলছি! খালি খালি চোর চোর বলা চলবে না—

একশো বার চলবে! এই তো বলছি–চোর চোর চোর!

.

চোর চোর চোর!

অপর্ণার রক্তহীন মস্তিষ্কে যেন বোলতা ঘুরছে,চোর চোর! সেই চোর মেয়েটা! মায়ের রুপোর গেলাসটা চুরি করতে গিয়ে হাতে-নাতে যে ধরা পড়েছিল। তবু মা ওকে ঘরের অন্দরে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এখন ও মার সোনার কৌটো চুরি করছে!

আমি যদি ভাল থাকতাম।… চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল অপর্ণার। স্নায়ুশিরা রক্তহীন, তবু চোখের ওই জলটা ফুটন্ত লোনা। ওই জলটা ওর রগের পাশটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।

আমি যদি ভাল থাকতাম, ওকে মেরে ফেলতাম আমি! ছাত থেকে ঠেলে ফেলে দিতাম! গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিতাম!…

আমি অক্ষম।

তাই ও আমার সামনে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর অটুট স্বাস্থ্য নিয়ে, ওর নিটোল গড়ন নিয়ে। যেদিন এল, সেদিন ও আমারই মত রোগা ছিল। আমার স্বামীর টাকায় ভাত খেয়ে খেয়ে অতখানি হয়ে উঠেছে ও। অতখানি পুষ্টি, অতখানি লাবণ্য আদায় করে নিয়েছে।

আর এখন

.

বৌদি–আপনার গা মোছর সময় হয়েছে।

চৈতালী এসে দাঁড়াল গামলা তোয়ালে স্পঞ্জ নিয়ে।

হাতের কাছে এমন কিছু নেই যে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারা যায় ওকে। তাই কিছু না পেয়ে শুধু ঝিমঝিমিয়ে ঘেমে উঠল অপর্ণা।

আর এদিকে অনেকক্ষণ খাটতে হল চৈতালীকে সেই ঘাম মুছিয়ে কিঞ্চিৎ সুস্থ করে তুলতে।

তারপর, সুস্থতার পর অপর্ণা সেই সেবার হাতটা ঠেলে দিয়ে বলল, মুছব না। ইচ্ছে নেই।

কাল মোছা হয়নি।

না হোক, অপর্ণা তার সরু সরু কাঠির মত আঙুল কটা বাড়িয়ে চেপে ধরল ওর হাত। শীর্ণ মুখে একটা বিকৃত হাসি হেসে বলল, কাল রাত্তিরে তুই কতক্ষণ ছিলি এঘরে?

রাত্তিরে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর!

আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পর আর আমি থাকতে যাব কেন বৌদি? মশারি গুঁজে দিয়ে

থাকতে যাবি কেন? মশারি গুঁজে দিয়ে? আমি কিছু বুঝি না ভেবেছিস?

হাতটা আর ধরে থাকতে পারে না, ছেড়ে যায়।

বৌদি পাগলামি করবেন না। দেখুন তো কী অবস্থা হচ্ছে শরীরের! এই সব আবোলতাবোল ভেবে মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছেন কেন?

.

বুকের তোলপাড় থামতে সময় লাগে অপর্ণার। আবার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। খামচে ধরে ওর শাড়ীর আঁচলটা।

মিথ্যে কষ্ট! মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছি আমি? আমি কি দেখতে পাই না, দিন রাত্রি, চব্বিশ ঘণ্টা তোর ওই দেহটাকে ও চোখ দিয়ে গিলে খায়!

আঃ বৌদি!

ধর্মের নামে শপথ করে বল, একথা সত্যি নয়? বল্ তোর মরা বাবার নাম করে, একথা মিথ্যে! কি, মুখ হেঁট হয়ে গেল তো? জানি জানি, সব জানি। ঘুমের আমার দরকার নেই, তবু আমায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রেখে

আপনি যদি এসব কথা ফের বলেন, আমি আর আসব না এঘরে।

তা আসবি কেন? তোর তো একজন নয়! আমার বোকাহাবা শাশুড়ীটার দুটো ছেলেকেই তো গ্রাস করছিস তুই! দুটোকেই তো

চুপ করে যায় অপর্ণা।

বৌদি! বৌদি!

ধরে নাড়া দেয় চৈতালী। বাইরে গিয়ে ডাকে, ক্ষেণু, শীগগির একবার এসো তো!

.

ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?

কৌশিক অনেক চেষ্টায় একবার আটক করে। বলে, ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?

কী আর! বৌদি হঠাৎ মূর্ছা গিয়েছিলেন–

অকারণ?

ওঁর মূৰ্ছা যাওয়ার কারণ থাকে নাকি?

থাকে না। দৃশ্যত থাকে না, কিন্তু অলক্ষ্য লোকে কিছু থাকে। দাদার ব্যবহারে যদি ওঁর অভিযোগের কোন পথ থাকত, যদি অবহেলার অপরাধে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারতেন দাদাকে, তা হলে হয়ত এত মূৰ্ছা যেতেন না বৌদি। ভেতরের বাষ্পেচ্ছাসটা কিছু প্রশমিত হত। কিন্তু দাদা ব্যক্তিটি এমন পারফেক্ট ভদ্রলোক যে–

তোমার তো সাহসের অভাব নেই। একদিন দাদাকে নির্জনে ধরে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দাও না।

বোঝাতে গেলে আকাশ থেকে পড়বে।

ওটা বাড়িয়ে বলছ। খুব খারাপ লোক নাকি?

কৌশিক এবার গম্ভীর হয়।

বলে, না, লোক খারাপ বললে অবিচার করা হয়, খারাপ হচ্ছে ওনার ভাগ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের মত খারাপকে খারাপ বলে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে, উনি সেটাকেই পরম সুখ বলে মেনে নেওয়ার ভান করতে বসেই অবস্থা জটিল করে তুলছেন। বৌদিকে যদি এতটা এমন না করতেন, সত্যি দুঃখের কান্না কেঁদে হালকা হয়ে বাঁচত বৌদি। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তাই কান্নার পাথরের ভার বয়ে বয়ে কখনো আগুন জ্বালছে, কখনো হয়তো মুছা যাচ্ছে।

চৈতালী মৃদু গম্ভীর হয়ে হেসে বলে, আগুন জ্বালাবারই বা ক্ষমতা কই? দেখে মায়া হয়। আমার কি মনে হয় জানো?

কি?

যদি ধৃষ্টতা বলে না ধরো তো বলি—

গৌরচন্দ্রিকা রাখো, সময় কম!

মনে হয় ওঁর কোন অতীত ইতিহাস আছে।

না না। আগে এমন ছিল না। স্বাস্থ্যভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেহ বাতিক ঢুকিয়ে মনটাকে ছারখার করে ফেলল।

সারবার কী কোন আর আশাই নেই?

আছে! মানে ছিল হয়তো। কিন্তু কোথায় সে সম্ভাবনা? অবিশ্যি সেটা আমার অনুমান। মনে হয় সত্যিকার একটু ভালবাসা পেলে ও হয়তো সেরে উঠত। কিন্তু পুতুলকে সত্যি ভালবাসা দিতে পারে, এমন মানুষ কোথায় পাওয়া যায় বল? আগে ছিল মোমের পুতুল, এখন হয়েছে কাগজের পুতুল। অথচ আবার একটা দিক বেশ তৈরি। ছলনা ধরতে পারে!

সত্যিকারের ভালবাসবার মত লোক কোথাও জোগাড় কর না?

হয় না! এদিকে আবার গোসাঁই বংশের মেয়ে, ঐহিক পারত্রিক সর্ববিধ বিশুদ্ধতা রাখাই ওঁর জীবনের লক্ষ্য। সরলতা আর কুটিলতার এক আশ্চর্য সমন্বয় ওই মহিলাটি। কিন্তু থাক, অনেকক্ষণ পরচর্চা করা গেছে।

তা গেছে। এ সব কথা বলতে ভয় করে। তবু দাদা আর তুমি, দুজনে এক মায়ের ছেলে ভাবতে অবাক লাগে

হঁ, তা লাগতেই পারে। একজন সুমহান হিমাচল, অন্যজন ক্ষুদ্র উইঢিবি, একজন বিশাল সমুদ্র, অন্যজন তুচ্ছ গোম্পদ, একজন বিরাট বটবৃক্ষ, অন্যজন হতভাগ্য তৃণদল, একজন

হয়েছে হয়েছে, থাক। সব বুঝতে পেরেছি। উঃ!

কি, এখন পস্তাচ্ছো তো? ভাবছো এই বাজে বাক্যবাগীশটাকে নিয়ে

আঃ থামো! অত বোলা না, আমার ভয় করে, আমার বিশ্বাস হয় না।

বিশ্বাস হয় না? উইটিবিকে গোষ্পদকে তৃণদলকে তোমার বিশ্বাস হয় না?

চৈতালী শান্ত চোখ তুলে বলে, না, ভাগ্যকে আমার বিশ্বাস হয় না!

এত ভয় কেন?

.

ভয় কেন?

চৈতালী শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কেমন করে বোঝাবে ভয় কেন! এখনো যে ওর মন বলছে এত কেন দিতে আসছ ভগবান? এমন অদ্ভুত অসম্ভব দান তো চাইনি আমি। শুধু একটু নিশ্চিন্ত আশ্রয়, শুধু একটু স্নেহছায়া, শুধু একটুকু সান্নিধ্য, একটুকু চোখের সুখ, এই পেয়েই ধন্য থাকতাম আমি, কাটিয়ে দিতে পারতাম সারাজীবন। তোমার এই প্রচণ্ড দয়ার ভার কি বইতে পারব আমি? জীবনের প্রারম্ভ থেকে কিছু না পেয়ে পেয়ে, পাওয়াটাই যে ভয়ের হয়ে গেছে। তোমার এই অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টির খেলায় আমি কি জিততে পারব? বুঝি হেরে যাব!

.

এই বাড়িরই অন্য এক ঘরে আরও একজন তখন ঠিক ওই কথাই ভাবছিল, আমি তা হলে হেরে যাব! সব দিকেই হার হবে আমার! শাশুড়ী আমায় ভালবাসার ভান করেন, জানি সব মিথ্যে, ওই আঁস্তাকুড়ের জীবটাকে আমার থেকে অনেক বেশী ভালবাসেন তিনি। এরপর ওই রাক্ষুসীই এ বাড়ির সর্বেসর্বা হবে, আমার সামনে, আমার চোখের ওপর সংসারের সব আদর দখল করে নেবে। কৌশিকের সঙ্গে আমার ছোেট বোনটার সম্বন্ধ করাবো ভেবেছিলাম, সে আশায় ছাই পড়ল। সুপর্ণা এ বাড়ির বৌ হয়ে এলে আমার সব কিছু বজায় থাকত। আর

অনেকটা চোখের জল উপচে আসায় অনেকক্ষণ গেল সামলাতে। তারপর ভাবল অপর্ণা, ওই লক্ষ্মীছাড়া বিচ্ছিরি মেয়েটা কি ভাসুর বলে মানবে? ওকেও গ্রাস করবে! যেমন এখন করছে। অথচ কেউ ওর দোষ দেখতে পাবে না। মাকে ও তুক করেছে, বাকীগুলোকে তো বশীকরণ মন্তর দিয়েছে। কে বলতে পারে, ও কো-ঘরের মেয়ে!

আমি তবে কী করব গো? কী করব! হে ভগবান, আমায় তুমি সারিয়ে দিতে পার না! দিতে পার না অগাধ স্বাস্থ্য, প্রচুর শক্তি? ইচ্ছে করলে কী না পার তুমি! তোমার ভাঁড়ারে কত ঐশ্বর্য, তবু এত কৃপণ কেন গো তুমি, এত নিষ্ঠুর কেন?

.

কৌস্তুভ কোনদিন মাকে কোন প্রশ্ন করে না, আজ এসেছে প্রশ্ন করতে।

মা, এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তটাই তুমি তাহলে পাকা রাখলে?

সুলক্ষণা তাঁর বড় ছেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে মৃদু হেসে বলেন, পাকা বাবার জন্যেই তো সিদ্ধান্ত রে খোকা!

কুশী পাগল হতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে তুমিও পাগল হবে, এটা খুব আশ্চর্য লাগছে!

জগতে প্রতিদিনই কত রকমেব আশ্চর্য ঘটনাই তো ঘটছে খোকা!

এটা বোধকরি সব কিছুকে হার মানাবে। তোমার ভাবী পুত্রবধূর ইতিহাস বোধ হয় ভুলে গেছ!

ভুলবো কেন রে? সেই মানুষটা কি আছে আর?

তোমরাই বল স্বভাব যায় না মলে–

ব্যতিক্রমও থাকে। তাছাড়া কোনটা স্বভাব, কোল্টা অভাব, সেটাও বুঝতে চেষ্টা করতে হয় বৈকি। পরিবেশ মানুষকে যে কী ভাবে কী করায়–

কৌস্তুভ ঈষৎ উত্তেজিতভাবে বলে, মনে হচ্ছে অপর্ণাকে নিয়ে আমাকে এরপর অন্যত্র থাকতে হবে

ওমা! সুলক্ষণাও অবাক হন এবার, বৌমার সঙ্গে যোগাযোগ কোন্‌খানে? সংঘর্ষই বা কোথায়?

আমরা ভুলতে পারি, কিন্তু ও তো ভুলতে পারে না ও গোস্বামী বাড়ির মেয়ে।

সুলক্ষণা উত্তেজিত হন না, সুলক্ষণা গম্ভীর হন, কিন্তু ওর হাতে খেতে, সেবা যত্ন নিতে, আমার গোসাই বেয়াইয়ের মেয়ে তো কই আপত্তি করেনি খোকা?

খাওয়া আর ইয়ে–মানে ঘরের বৌ করে

সুলক্ষণা এক মুহূর্ত নির্নিমেষ চোখে তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই বড় হয়েছিস, তোর পরামর্শ নেওয়া অবশ্য আমার উচিত। বল্ তবে, ওকে কি চলে যেতে বলব?

চলে যেতে? চলে যেতে বলেছি আমি?

কৌস্তুভ আর একটু লাল হয়।

তবে? সুলক্ষণা শান্ত নির্বিকার গলায় বলেন, তা ছাড়া? কী তবে করবে ও এরপর?

কেন যেমন আছে-আছে, তেমন থাকা যায় না?

যেমন আছে? মানে তোদর সংসারের রাঁধুনী হয়ে? তা হয়তো যায়, তবে কি জানিস খোকা, মানুষ জিনিসটা তো অঙ্কের সংখ্যা নয় যে তাকে ঠিকমত সাজিয়ে নির্ভুল কষে ফেলা যাবে। মানুষের মধ্যে মন বলে একটা বস্তু আছে।

বেশ, আমার আর কিছু বলার নেই। তবে জেনো, ক্ষের বিয়ের জন্যে অসুবিধেয় পড়তে হবে।

.

কৌস্তুভ ক্ষেণুর বিয়ের কথা বলে। যে কৌস্তুভ জীবনে কখনো এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে না।

সুলক্ষণা বলেন, বুঝতে পারছি খোকা, আজ তুই নেহাৎ মরীয়া হয়েই লড়তে এসেছিস, নইলে এত কথা তুই কবে বলেছিস ব? এত কথা জানলিই বা কী করে? কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস বাবা, অনিবার্য বলে একটা শব্দ আছে। সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ মানুষের হাতের বাইরে।

কৌস্তুভের মা ঠিকই বুঝেছেন, মরীয়া হয়েই এসেছে কৌস্তুভ, কারণ অপর্ণা বলেছে চৈতালীর বিষয়ে একটা হেস্তনেস্ত না হলে, অর্থাৎ তার এ বাড়ির বৌ হওয়াটা রদ না হলে অপর্ণা মরবে। কেঁদে কেঁদে হার্ট খারাপ করে মরবে, উপবাস ধর্মঘট করে মরবে, ঘুমের ওষুধ বেশী করে খেয়ে মরবে, যা হয় কিছু করবেই। অর্থাৎ ওর হাতে মৃত্যুর যা যা উপায় আছে, একে একে প্রয়োগ করবে। একটাও কি লাগবে না?

অগত্যাই তবে কৌস্তুভকে মায়ের কাছে আসতে হয় দরবার করতে। কিন্তু সুলক্ষণ ওর কথাকে উড়িয়ে দিলেন। বললেন অনিবার্যকে মেনে নিতে হয়।

তাহলে?

তবু লড়ল, কৌস্তুভ।

বলল অনিবার্যকেই যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে তো মানুষের করণীয় বলে কিছু থাকে না মা। রোগে চিকিৎসা, অসহনীয় অবস্থাকে সহনীয় করার চেষ্টা, সবই দেখছি তাহলে অনাবশ্যক?

সুলক্ষণা এক মুহূর্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই আজ বড় বেশী উত্তেজিত হয়েছিস বাবা, এখন তর্ক করতে বসলে পরে কষ্ট পাবি। তবে আমার কি মনে হয় জানিস, প্রত্যেকেরই এক একটা নিজস্ব এলাকা থাকে, তার বাইরে যেতে চেষ্টা করলেই অনেক ঝঞ্জাট, অনেক দুঃখ। কুশীর ব্যাপারটা বৌমার এলাকায় নয়, এটাই বৌমাকে বুঝিয়ে বলিস।

সুলক্ষণা চলে যান।

কৌস্তুভের মনে হয় এই মাত্র যেন তার চির স্নেহময়ী মা তাকে একটা চাবুক মেরে চলে গেলেন।

কৌস্তুভের সমস্ত সদ্বিবেচনাই যে বৌয়ের তাড়না অথবা প্রেরণা মাত্র, এইটাই তবে জেনে গেলেন সুলক্ষণা!

.

কিন্তু সত্যিই কি তাই?

কৌস্তুভের নিজের ভেতর কি কোনও প্রেরণা নেই? নেই কোন কিছুর তাড়না?

থাক।

যা কিছুই থাক, যত অসহনীয়, যত তীব্র, যত ক্ষোভ দুঃখ হতাশা, তবু ফিরে যেতে হবে সেইখানে। যেখানে এক অবুঝ স্বার্থপর নির্বোধ কুটিল মন নিজের এলাকার বাইরে বেরিয়ে অকারণ জ্বালায় আছড়ে মরছে।

কৌস্তুভের উদ্ধার নেই সেখান থেকে।

অদৃশ্যলোক থেকে অদৃষ্ট দেবতা তাকিয়ে দেখে

সেই নীল শির-ওঠা চুল উঠে-যাওয়া চওড়া কপাল, সাদা খড়ির মত রঙ।

সেই তার ওপর একখানি স্বাস্থ্যবান পুরুষের হাতের থাবা। আস্তে সন্তর্পণে এই কপালের ওপর হাত বুলোচ্ছে সেই পুরুষ।

ওই চামড়ার নীচে অদৃশ্য যে ললাটলিপি লেখা আছে তাকে কি মুছে দিতে চাইছে ওই হাত?

.

তোমার হাতের সেই চুড়িগুলো কি হল?

ভারী লাগে, খুলে রেখেছি।

হাতটা কিরকম যেন দেখাচ্ছে।

আর হাত! হাতটাই আর বইতে পারছি না।

না না, পোরা। এই একটা মাত্র চুড়িতে হাতটা যেন তোমার বলে মনেই হচ্ছে না। কোথায় রেখেছ?

আমি আর কোথায় রাখব?

অসীম ক্লান্তিভরা কাতর চোখের দৃষ্টি তুলে অর্পণা আস্তে বলে, ওকে রেখে দিতে বলেছি।

ওকে! কাকে?

ওই যে চৈতালীকে!

ও আবার কোথায় রাখল?

কি জানি! ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে অপর্ণার।…শিশুর মত বিশ্বস্ত মুখটা শান্ত, সরলতায় শিথিল হয়ে আসে, রেখেছে কোথাও।

.

এই একটা সুযোগ।

এই উপলক্ষ্যে নিজেকে নিয়ে গিয়ে উপস্থাপিত করা যায়।

এখন সুলক্ষণা পুজোয় বসেছেন।

সকালের পুজো নয় যে সংসারের ডাকে তাড়াতাড়ি উঠবেন, এ সন্ধ্যেপুজো। এ সময়ে কোন ডাক নেই সুলক্ষণার জীবনে, তাই যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকেন সুলক্ষণা পুজোর ঘরে।

সুলক্ষণার বড়ছেলে জানে একথা।

না, অন্য কিছু নয়।

শুধু অর্পণার ব্যবহারের জন্য একটু ক্ষমা চাওয়া চৈতালীর কাছে। শুধু বলা, আমি ওর জন্যে লজ্জিত। চোখের ওপর দেখতে পায় তো।

অদ্ভুত একটি অসহায়তা আর কোমলতায় ঢাকা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সেই নির্যাতন, বসে বসে সহ্য করা কী কঠিন।

গতকালের দৃশ্যটাই এখন শুধু চোখের ওপর দেখতে পায় কৌস্তুভ।

বিছানা ছেড়ে উঠে ইজিচেয়ারে বসেছিল অর্পণা, ন্যাকড়ার ফালির মত লটপটে হাত দুখানা দুপাশে ঝুলিয়ে। তখন তো সেই ঝকঝকে চুড়ির গোছাটা রয়েছে হাতে। তাই আরও সরু আর শিথিল দেখাচ্ছিল হাত দুটো।

চৈতালী বিছানা ঝাড়ছিল।

অপর্ণার বিছানা, কৌস্তুভের বিছানা। ঘরের দু দেয়ালের দু পাশে দুটো খাট।

অপর্ণা ডাকল, চৈতালী!

ও বলল, বলুন!

এর আগে ডানলোপিলোর গদিতে শুয়েছ কখন?

চৈতালী থমকে তাকাল।

বলল, আগে পরে ও কোনদিন চোখেও দেখিনি বৌদি।

অপর্ণা ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি হাসল।

কী যে বল চৈতালী! কাল রাতে যে আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমোইনি, সেটা বোধহয় টের পাওনি!

আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না বৌদি।

এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে কষ্ট হচ্ছিল অপর্ণার, তাই খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে বলল, আমিও তো কিছুতেই বুঝতে পারি না চৈতালী, রাতে যে তোমাকে আমার দরকার হয় না, তবু তুমি এ ঘরে শুতে আস কেন?

কৌস্তুভ বলে উঠেছিল, সেই মুহূর্তে চুপ করে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়েছিল বলেই বলেছিল, অপর্ণা, কী সব বলছ যা!

অপর্ণা চোখটা একবার খুলে আর একবার বুজে বলেছিল, যা তা বলছি? তা হবে।  ফিসফিস কথায় ঘুম ভেঙে গেল, চুপ করে পড়ে পড়ে শুনলাম কত হাসি, কত কথা, বললাম ভগবান আমায় যদি মশারি তুলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াবার ক্ষমতা দিতেন!… দেখতাম কোন্ রাক্ষুসী আমার স্বামীকে

ফেন্ট হয়ে পড়েছিল অপর্ণা তক্ষুণি।

চৈতালীর সঙ্গে কৌস্তুভকেও লাগতে হয়েছিল তার চৈতন্য সম্পাদনের সাধনায়।

আর বার বার মনে হয়েছিল কৌস্তুভের, অজ্ঞান হয়ে গিয়েও যে অপর্ণার চোখটা সম্পূর্ণ বুজে যায় না, সেটা কি লক্ষ্য করেছে চৈতালী?

কৌস্তুভ কি বলে দেবে ওকে, অপর্ণার চোখ দুটো বড্ড বেশী বড় বলেই ওই রকম দেখায়।

বলেই অবশ্য।

জ্ঞান হবার আগেই ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল চৈতালী।

.

তারপর এই।

কিন্তু পৃথিবীতে কি এতও প্রতিবন্ধক!

সুদক্ষিণা বসে আছে ওর কাছে।

এত কিসের হাসি গল্প ওদের?

বার দুই ফিরে এল কৌস্তুভ। তারপর দেখল, সুদক্ষিণা নিজের ঘরে বসে পড়ছে। একা।

নীচে রান্নাঘরে অন্ধকার। বংশীও দেশে গেছে কদিন।

ও তাহলে কোথায় গেল? কোথায় আছে এখন?

দোতলায় নয়, একতলায় নয়, বারান্দায় নয়, সিঁড়িতে নয়, তাহলে?

তিনতলায় কৌশিকের ঘর থেকে ছুরির ফলার মত তীব্র তীক্ষ্ণ একটা আলোর রেখা বারান্দার ওপর এসে পড়েছে।

সেদিকে তাকিয়ে ছুরির ফলার মত জ্বলতে থাকে একজোড়া চোখ। এই তবু জ্বলন্ত চোখের ধার নিয়েও দূর থেকে তাকিয়ে বিন্দুমাত্র দেখা যায় না।

তবে? কাছে যাওয়া ছাড়া উপায়?

একজন বিছানায় পা ঝুলিয়ে, একজন চেয়ারে।

যে চেয়ারে, তার মুখের ওপর জোর পাওয়ারের বিদ্যুৎবাতির সমস্ত আলোটা এসে পড়েছে। পড়েছে শরীরের সমস্ত রেখায় রেখায়। কোলের ওপর পড়ে থাকা শ্যামাভ হাত দুখানা পাথরে গড়া পুতুলের হাতের মত নিটোল মসৃণ। একগাছা করে সরু বালা যেন নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছে সেই মণিবন্ধ দুটি।

ও যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল সে তো কতদিন হয়ে গেল! তখন ওর মুখের উঁচু রেখাগুলোর ওপর আলো পড়েছিল, আর ওর হাত দুটো চোখেই পড়েনি।

ওর মুখটা এখন ভরাট আর উজ্জ্বল।

কী বলছে ও? হেসে হেসে?

আর কী বলছে তার উত্তরে বখে-যাওয়া কৌশিকটা? বলছে, হ্যাঁ ঠিক তো। সার্থকনামা মহিলা। চৈতালী ঘূর্ণিই বটে। বাবাঃ একেবারে তচনচ্ কাণ্ড!

কার দোষ শুনি?

দোষ? এর মধ্যে দোষটা কোথা? সবটাই তো গুণ।

গুণ মানে?

মানে গুণতুক, জানো না সে-সব? জানো, ক্ষেণু তাই বলেছিল গোড়ায়। বলেছিল, মেয়েটা নিশ্চয় গুণতুক কিছু জানে ছোড়দা। নইলে মা খামোকা ওকে এত ভজলেন মানে কি? এখন বুঝছি ক্ষেণু কত দূরদর্শী!

আর নিজে? নিজে তো প্রথম দিনেই…

প্রথম দিনের কথা আর তুলো না—

হেসে উঠলো চৈতালী।

যে হাসি কৌস্তুভ কোনদিন চোখেও দেখেনি।

হাসি দেখতে না পেলেও কৌস্তুভ প্রতিনিয়ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর কাজ করা দেখেছে, দেখেছে কত অনায়াস অবলীলায় সংসারের সমস্ত গুরুভার নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে সমাধা করে চলেছে। ও। কত শান্ত হয়ে অপর্ণার সেবা করছে। ঘামে না, হাঁপায় না, বসে পড়ে না, নিশ্বাস ফেলে না।

দেখেছে অলক্ষ্য দৃষ্টিতে, ওর নিটোল হাতের ওঠা পড়া, মসৃণ ঘাড়ের কমনীয়তা। শুধু ওর হাসি দেখেনি কোনদিন। দেখেনি হাসলে ওর ঠোঁটটা কত লাবণ্যময় হয়ে ওঠে।

.

ওই হাসি আর ওই লাবণ্যের কাছে কি এগিয়ে আসছে কৌশিক? কৌস্তুভর উচ্ছন্ন যাওয়া ছোট ভাইটা!

কৌস্তুভ দেখবে তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? ছি ছি!

তবে?

নেমে যাবে?

চোখ কান বুজে ছুটে?

না না। চলে যাবার সময়টাও দেবে না বুঝি ওরা।

তবে ঘরেই ঢুকে পড়া ভাল।

দরজার কাছে অন্তত! খুব দরকারী কথার জন্যে ঢোকা যাবে নাই বা কেন?

ঘরে আর কেউ আছে, এ যেন দেখতে পাচ্ছে না কৌস্তুভ। গম্ভীর ভারী গলায় প্রশ্ন করছে, অপর্ণার চুড়িগুলো কোথায় রেখেছ?

চুড়ি!

চমকে উঠল চৈতালী। ছিটকে বেরিয়ে এল চেয়ারটাকে প্রায় ঠেলে দিয়ে। বোবা গলায় বলল, চুড়ি!

হ্যাঁ, ও তখন যেগুলো খুলে রাখতে দিয়েছিল তোমায়!… আচ্ছা থাক, এখন সময় না থাকে পরে দিও।

.

তুমি রাখনি? তোমায় দিইনি আমি?

সর্বশরীর ঘেমে উঠেছে অপর্ণার, নাড়ী বসে গেছে মনে হচ্ছে। বলছে, ভগবান!

সুলক্ষণা একখানা হাতপাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে করতে বলেন, বৌমা, উতলা হয়ো না। একটু ভাবতে চেষ্টা করো, তুমি নিজেই হয়তো

আমি? আমি? তাহলে আমার বালিশের তলা খুঁজে দেখুন।

.

কথাটা সত্যি।

বালিশের তলা ছাড়া আর দৌড় কোথা অপর্ণার? ভারী লাগছে বলে যদি খুলেই রাখে অন্যমনস্ক হয়ে, ওইখানেই রাখবে।

আর কে ঘরে ঢোকে?

কৌস্তুভ।

সুলক্ষণা।

কদাচিৎ সুদক্ষিণা।

সুদক্ষিণাকে দেখলেই বিরক্ত হয় আজকাল অপর্ণা, চোখ এড়ায় না সুদক্ষিণার।

হয়তো যারাই পৃথিবীর আলো বাতাসের উপস্বত্ব ভোগ করে বেড়াচ্ছে, তাদের সকলের ওপরই বিরক্ত অপর্ণা।

অথচ এই কিছুদিন আগেও এ রকম ছিল না সে। তখন শুধুই ঘামত, তখন শুধুই অপরিসীম ক্লান্তিভরা চোখ দুটো তুলে অপ্রতিভের হাসি হাসত।

আর যখন একটু ভাল থাকত, তখন বলত, আমায় কিছু কাজ করতে দিন না মা!

.

সেই সেদিন থেকে অদ্ভুত রকমের বদলে গেছে অপর্ণা। যেদিন থেকে চৈতালীকে বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সুলক্ষণা।

সেদিন অপর্ণা শুধু অবাক হয়ে বলেছিল, ওই চোরটা? শুধু কাজের জন্যে?

সুলক্ষণা বলেছিলেন, কিসের জন্যে কি, সব কি আর বোঝানো যায় বৌমা! ধর শুধু কাজেরই জন্যে, সে দরকারও তো অস্বীকার করা যায় না? আমি আর কতকাল তোমাদের সংসার দেখতে পারব! সংসারের জন্যে লোকজন দরকার, তোমার জন্যেও একটি লোকের দরকার।

.

হ্যাঁ, এই ধরনের কথাই বলেছিলেন সুলক্ষণা। তারপর থেকেই যেন দ্রুত বদলে যাচ্ছে অপর্ণা, আরও বদলে গেছে চৈতালীকে নিজের ঘরে ডেকে এনে। আর ক্রমশই কাহিল হয়ে যাচ্ছে।

এখন আর ওর দৌড় বালিশের তলার বেশী নয়। খোঁজা হল সেখানে। অপর্ণাকে আস্তে বসিয়ে তোশকের তলা, গদির তলা পর্যন্ত। দেখা হল খাটের তলা, যদি গড়িয়ে গিয়ে থাকে।

সুলক্ষণা এতক্ষণ অপর্ণাকে বলছিলেন, এবার চৈতালীকে বললেন, ভাল করে ভেবে দেখ দিকি। তাড়াতাড়িতে কোথাও রেখেছিস কিনা–।

চৈতালী সুলক্ষণার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে বলল, ভাল করে ভেবে দেখেছি, মাসীমা।

কিন্তু যাবে কোথায় বল্ বংশীর কথা মুখে আনাও পাপ, তবু বংশীও তো নেই দু-তিন দিন। ঈশ্বর সত্যিই মঙ্গল করেছেন যে ও নেই এখন।

.

ঈশ্বর মঙ্গল করেছেন।

বংশীকে বাঁচিয়েছেন!

ভাবল চৈতালী। এই কথাই তাহলে বলতে চাইছেন সুলক্ষণা।

এ ঘরের দরজায় বাড়ির সবকটা প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে।

সুদক্ষিণা এসেছে সুলক্ষণার তীক্ষ্ণ প্রশ্ন শুনে, কৌশিক চৈতালীর সেই বোবা গলায় উচ্চারিত চুড়ি শুনে।

কিন্তু নেমে আসার আগে পর্যন্ত অবেনি, এ রকম একটা নাটকের অভিনয় দেখতে পাবে।

তাহলে গেল কোথায়!

এ কথা সুলক্ষণা উচ্চারণ করলেন, অনুচ্চারিত রইল অন্য আর একজনের মনে। কিন্তু উচ্চারণের সময়ই বা কোথায়? এদিকে যে আর এক বিপদ। অপর্ণার চোখ চাওয়ানো যাচ্ছে না। বাতাস দিয়ে নয়, চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে নয়। নাড়ীর গতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।

অতএব কৌশিককে এখন ছুটতেই হবে ডাক্তারকে একটা খবর দিতে।

কৌস্তুভ তো নাড়ী ধরে বসে আছে।

আর সুদক্ষিণা বাতাস করতে করতে ভাবছে, বৌদির গায়ে যদি আর সকলের মত রক্ত থাকত, তাহলে অনেক, অনেকদিন আগে মারা যেত বৌদি। রক্ত নেই বলেই যম ওকে অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে যায়।

ওরা মৃত্যুর পদধ্বনি গুনছে! আর সুলক্ষণা লোকলজ্জা ভুলে তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন অপর্ণার ঘরের বাক্স আলমারি দেরাজ শেলফ ড্রেসিং টেবল! বড়লোক বাবার বাড়ি থেকে অনেক দামী দামী আসবাব পেয়েছিল অপর্ণা। তার চাবি নিয়ে সেই সব খুলে সুলক্ষণ দেখলেন।

নেই।

নেই! কোথাও নেই।

অপর্ণা তো আর তার চুড়িগুলো স্যাকরাবাড়িতে বেচে দিয়ে আসে নি।

তবে তোদের ঘরেই খোঁজা হোক– সুলক্ষণা সুদক্ষিণার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, আর কোথায় খুঁজতে যাব ব?

খোঁজো!

সুদক্ষিণা নিজের ঘরের বইপত্র বিছানা বাক্স তুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে।

বলে, দেখ বাবা, দেখে নাও। কপালে এও ছিল! যত সব পাগলামি।

কিন্তু এতক্ষণে কৌস্তুভ একটা কথা বলে, চুড়িগুলো চুরি যাওয়াটা তো পাগলামি নয়?

এ কথার উত্তর দেবে কে?

চুড়িগুলো যে সকাল পর্যন্তও জলজ্যান্ত প্রত্যক্ষ ছিল।

আমার ঘরটা দেখা হয় নি।

চৈতালী বলে ভাবশূন্য মুখে।

আর সেই সময়, ডাক্তার যখন সবে এসে দাঁড়িয়েছেন, ওষুধ দেন নি, তখন রোগী হঠাৎ চোখ মেলে ভাঙা ভাঙা ক্ষীণ গলায় বলে ওঠে, রাখলে কি ঘরে রাখবে তুমি?

ডাক্তারের সমস্ত মুখস্থ।

সপ্তাহে তিনদিন আসতে হয় তাঁকে। দরকার বোধ করলে আরও। যেমন আজ। যথারীতি পরীক্ষা করে বলেন, ঠিক আছে। সামান্য একটু বেশী উইক লাগছে। হজমের গোলমালে হতে পারে। পুরিয়াটা দিয়ে দেবেন একবার।

আর রাত্রে? কৌস্তুভ বলে, ঘুম না এলে?

নেহাত না এলে বড়িটা দেবেন। না দিলেই ভাল হয়। না দিতেই চেষ্টা করবেন। পালসটা একটু–কিছু না, ঠিকই আছে। ওই যা বললাম, খুব দরকার বিবেচনা করলে

দরকার বিবেচনা করলে।

ভাবলো কৌস্তুভ।

দরকার কাকে বলে?

.

বলা যায় না। সুদক্ষিণা বলে, অপরাধের বীজ রক্তে থাকে। এমনও হয় হয়তো সারাজীবন বড় বড় লোভ ত্যাগ করে শেষ জীবনে সামান্যর জন্যে

আছে। এরকম দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি আছে সুলক্ষণার জানার জগতে। সুলক্ষণা মুহূর্তের লোভের কাহিনী জানেন, রক্তের ঋণ শোধের কথা জানেন, সোনার জন্যে আদি অন্তের পৃথিবীতে কত কুশ্রীতা, কত নির্লজ্জতা, কত নিষ্ঠুরতা আর নির্বুদ্ধিতার ঘটনা ঘটছে, তার খবর বার্তা জানেন।

কিন্তু চৈতালী?

কিন্তু নয় কেন? কৌস্তুভ আস্তে আস্তে বলে, জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। নেহাত নিরীহ একটা লোকও মানুষ খুন করতে পারে, নেহাত সাধু একটা লোকও চুরি করতে পারে। আর এর তো চমৎকার একটা হিস্ট্রিই রয়েছে। যাদের রক্তে চুরির নেশা থাকে, তারা অজ্ঞাতসারেও চুরি করতে পারে। তা ছাড়া তোমার কাছের এই কিছুদিন ছাড়া ওর আগের জীবনের কিছুই তো জানো না তুমি? কে বলতে পারে, দলের লোকের প্ল্যান অনুযায়ীই

খোকা চুপ কর–বলে উঠে আসেন সুলক্ষণা।

চৈতালীকে যে ঘরটা দিয়েছিলেন, সেই ঘরটায় আসেন। সারা ঘরে সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে চৈতালী।

সুলক্ষণা আস্তে বলেন, আচ্ছা, তোর কি মনে হয় বল্ দেখি চৈতালী?

চৈতালী মুখ তুলে বুঝি একটু হেসেই বলে, মনে যা হয়, তা কি বলতে আছে মাসীমা?

কিন্তু আমি যে ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।

আমার ভাগ্য!

এবার যেন সুলক্ষণার চোখে একটা রুক্ষতা দেখা দেয়। যা এতক্ষণের মধ্যে দেখা যায়নি। সেই সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত সুলক্ষণার চোখে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে, উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, অস্বস্তি দেখা দিয়েছে, চিন্তা দেখা দিয়েছে, কিন্তু রুক্ষতা এক মুহূর্তও দেখা দেয়নি।

এখনই দেখা গেল।

বললেন, ভাগ্য বলে চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না বাছা, গেল কোথায় সেটা তো দেখতে হবে?

দেখুন!

একটুকরো আগুনের মত কথাটা এসে লাগে সুলক্ষণার ওপর, দেখবার যা যা পদ্ধতি আছে, প্রয়োগ করুন সে সব।

আগুনের সঙ্গে হাসি ঝলসাল একটু।

সুলক্ষণার মনে হয়, এ যেন তাঁর নিত্য দেখা চেনা মেয়েটা নয়। সেই একদিনের দেখা অচেনা মেয়েটা।

যে বলেছিল, পুলিসে দিতে ইচ্ছে হয় পুলিসে দিন, চাকর দিয়ে মারাতে ইচ্ছে হয় মারুন, নামের কী দরকার?

সুলক্ষণা জ্বলে ওঠেন।

সুলক্ষণার উঁচু মাথাটা চিরতরে হেঁট হয়ে গেছে আজ, সুলক্ষণার বড় সাধের হিসেব তালগোল পাকিয়ে গেছে।

এখন সেই তালগোল পাকানো হিসেবের ওপর এসে এসে ভিড় করছে সেই সব শোনা আর জানা কাহিনী।

কাদের বিশ বছরের পুরনো চাকর চার আনা ওজনের সোনার লোভে মনিবের ছেলেকে খুন করেছিল, কার নিজের ভাইপো শুধু সিন্দুকের চাবিটা হাতাবার জন্যে কাকার গলা কেটেছিল। কোথাকার মঠের সাধু আজীবন কৃচ্ছসাধনের মহৎ পথ বেয়ে চলে এসে বৃদ্ধকালে বিগ্রহের গহনা চুরির অপরাধে বিতাড়িত হয়েছিলেন আর কোন্ পরম নিষ্ঠাবতী বালবিধবা সারা যৌবনকাল নির্জলা একাদশী করে আর কঠোর নিয়মে কাটিয়ে এসে, প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে কলঙ্কের কালি মুখে মেখে কুলত্যাগ করেছিল, সেই সব এখন ভাবতে হচ্ছে সুলক্ষণাকে।

রোধ করতে পারছেন না এই চিন্তার ঢেউ।

সে ঢেউ সুলক্ষণাকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে, শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে।

সেই দমবন্ধ অবস্থায় সুলক্ষণা কিছুতেই আর মনে করতে পারছেন না, মানুষ অমৃতের সন্তান।

এখন বরং ভাবছেন, ভগবান খুব রক্ষা করেছেন। নেহাত সুলক্ষণাকে হাত ধরে ফিরিয়ে আনা যাবে না বলেই এতবড় একটা ধাক্কা দিয়ে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।

কত বড় একটা ভুলই ঘটতে বসছিল।

কত বড় বিপদ।

আর কৌশিক?

প্রথমটায় সে তো ব্যাপারটার গুরুত্বই দেয়নি! ভেবেছিল বৌদির এটি একটি নতুন অবদান।

গহনা হারানোর ছুতোয় বুঝি আর এক নতুন কান্নার পথ আবিষ্কার!

কিন্তু সে ধারণার ওপর বিরাট একটা ধাক্কা এসে লাগল।

দেখতে পেল, চৈতালীকে আবার সবাই যেন তার পুরনো ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাকিয়ে দেখছে।

ভয়ানক একটা যন্ত্রণা বোধ করল কৌশিক, ওই অবনতমুখীর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কর্তব্যের ডাক, মায়া মমতা আকুলতা সব কিছুর অনেক উর্ধ্বে। ছুটতে হল তখন ডাক্তারবাড়ি।

আর ডাক্তারকে নিয়ে যখন ফিরল, তখন চৈতালী অদ্ভুত রকমের বদলে গেছে। যেন ওর সমস্ত সত্তাকে ঘিরে একটা পাথরের পাঁচিল বানিয়ে ফেলেছে চৈতালী। তার ওপিঠে আর কারুর প্রবেশাধিকার রইল না বুঝি।

ডাক্তারের বাণী শ্রবণ করে যখন ছিটকে এদিকে এল, দেখল চৈতালীর সেই ছোট্ট ঘরটার দরজায় সুদক্ষিণা কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে, আর ঘরের মিথ্যা মালিক একটি একটি করে জিনিস খুলে ছড়িয়ে মেলে ধরছে তার সামনে!

কৌশিক রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করেছিল, কী হচ্ছে এসব ক্ষেণু?

চৈতালী মুখ তুলে মৃদু হেসে বলেছিল, সার্চ!

সুদক্ষিণা বোধ করি ছোড়দার সামনে লজ্জা পেয়েছিল, তাই বিরক্ত স্বরে বলে উঠেছিল, সব ঘরই তো খোঁজা হচ্ছে, তোমার ঘরও হল, এতে এত ব্যঙ্গ করবার কিছু নেই। আমার ঘরও তো তছনছ করলাম, কই অপমান তো বোধ করলাম না?

চৈতালী বলল, তোমার মহত্ত্ব!

সুদক্ষিণা রাগ করে সরে গেল।

কৌশিক কেমন এক নিরুত্তাপ দৃষ্টি মেলে বলে, চৈতালী! এই বিচ্ছিরি সমস্যাটা কি সংসারে এলেই চলত না? না এলেই ভাল হত না কি?

চৈতালী একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিল, কত জিনিসই তো না এলে ভাল হত। তবু সেই ভালটা আর হয় কই? আমিই তো তার প্রমাণ।

কিন্তু চৈতালী–

কী আশ্চর্য! আচ্ছা মানুষ তো আপনি? বাড়ির রাঁধুনী, তাও আবার চোর, তার ঘরে আপনি কেন?

কৌশিক থতমত খেয়েছিল।

তবু হেসেও ছিল।

বলেছিল, হয়তো ঘরের ঘরণীর মনে সাড়া জাগাতে!

ছিঃ!

কিন্তু সেই ছিঃটা উলটে ফিরে এল চৈতালীর কাছে। শেষ পর্যন্ত কৌশিক বলে উঠল, ছি ছি।

না, চোর বলে নয়। ওর রূঢ়তায়, ওর কঠোরতায়। অথচ কৌশিকের সঙ্গে এই রূঢ়তা কি সত্যিই কোন কারণ ছিল? কৌশিক তো সন্দেহ করতে আসে নি? কৌশিক শুধু প্রশ্ন করতে এসেছিল, সবাই সন্দেহ করছে কেন?

ঘটনা সংস্থাপনটা হল কী ভাবে?

চৈতালী ভুল বুঝল!

না, চৈতালী কৌশিককে ভুল বোঝে নি।

চৈতালী তার আগের ভুল বুঝতে পেরে সাবধান হল। চৈতালী বুঝতে পারল, ভয়ানক একটা ফাটলের ওপর মাটি চাপা দিয়ে প্রাসাদ গাঁথতে বসা ভুল। চৈতালী বুঝতে পারল, যে গাছের শিকড় নেই, সে গাছের আয়ু অনিশ্চিত।

অপর্ণার হারানো গহনা কোনখান থেকে না কোনখান থেকে পাওয়া যাবেই।

কিন্তু চৈতালীর ওপর থেকে হারানো বিশ্বাস কি আর ফিরে পাবেন সুলক্ষণা? ফিরে পাবে কৌশিক?

আর যদি সেই গহনাটা না পাওয়া যায়? যদি কৌস্তুভ ঘুমন্ত স্ত্রীর গা থেকে খুলে নিয়ে গিয়ে বেচে এসে থাকে? (যেটা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোন সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না চৈতালী তার বোবা প্রশ্নের।)

তাহলে?

সেই গভীর বিদারণ রেখার ওপর দিয়েই চিরদিন পথ চলতে হবে চৈতালীকে।

যেটা অসম্ভব।

যেটা অবাস্তব।

.

তবু আবার এল কৌশিক।

বলল, চৈতালী, এমনও তো হতে পারে, এতক্ষণ ধরে ঠাট্টা করছিলে তুমি। বৌদির জিনিসটা লুকিয়ে রেখে মজা দেখছ।… এমনও হতে পারে, আমাদের পরীক্ষা করছ তুমি। আমরা তোমায় কতটুকু বিশ্বাস করি, তার পরীক্ষা!

চৈতালী হেসে উঠল।

বলল, আর এমনই কী হতে পারে না, লোভের জিনিস সামনে আসে নি বলেই রক্তের গুণ জেগে ওঠে নি, ঘুমিয়ে ছিল। সামনে আসতেই

কৌশিক ক্ষুব্ধস্বরে বলে ওঠে, ওকথা আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।

চৈতালী আবার হেসে ওঠে, কেন কর না? প্রকৃতির নিয়ম উলটে যাবে নাকি তোমার বোকা বিশ্বাসের জন্যে? শোন নি, বাঘের ছানাকে দুধভাত খাইয়ে রাখলে সে পালক প্রভুর হাত চাটে, কিন্তু দৈবাৎ একদিন রক্তের আস্বাদ পেলে, সেই প্রভুরই ঘাড় ভাঙে।

ঠিক এই কথাই সুলক্ষণা বলেন।

শুনেছি পোষা বাঘ হঠাৎ একবার রক্তের আস্বাদ পেলে

কৌশিককেই বলেন।

কৌশিক উদ্ধত গলায় বলে দেয়, বৌদিকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না।

সুলক্ষণা গম্ভীর গলায় বলেন, হয়তো আমিও করি না। কিন্তু বৌদি তার গহনা নিয়ে গিয়ে আর কোনখানে লুকিয়ে এসেছে, সেটাও তো বিশ্বাস করার কথা নয়?

বেপরোয়া কৌশিক বলে ওঠে, কে বলতে পারে, দাদাই করেছে কিনা!

সুলক্ষণা হঠাৎ তীব্র কটু গলায় বলেন, তাহলে তুমিই বা নয় কেন?…

হঠাৎ রাগ চড়ে গেছে তার। হয়তো নিজের আশাভঙ্গে, কিংবা ছেলের ব্যাকুলতায়।

মা, তুমি কি সত্যিই তাহলে স্বীকার করছ, মানুষ চিনতে তুমি ঠকেছিলে?

সুলক্ষণা ছেলের যন্ত্রণাহত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, কোথাও কোনখানে ঠকিনি, বা কোনদিন ঠকব না, এত বুদ্ধির অহঙ্কার আমার নেই কুশী।

.

তারপর আর ঘুরে বেড়াতে পারে নি কৌশিক। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। আর সারাক্ষণ আশা করছিল দরজার কাছে একটি পদধ্বনি এসে থামবে।

কিন্তু থামল না।

মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ আগে কোথাও থেমে গেছে সেই পায়ের শব্দ। চিরদিনের মত।

 ৪. অনেক রাত্রে

অনেক রাত্রে কে জানে কি জন্যে নীচে নেমেছিল কৌস্তুভ। ভাড়ারঘরে এখনো আলো জ্বলছে!

বংশী নেই, এত রাত্তিরে কে কী করছে!

ঘরে এসে দেখল, চৈতালী কুটনো কুটছে বসে বসে।

এই এত রাত্তির অবধি এই সব করছে চৈতালী?

অথচ আজই ওকে কতখানি অপমান করা হয়েছে।

কৌস্তুভ আস্তে বলে, এখন এ সব কেন?

চৈতালী ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস মেখে বলে, করে রাখছি। সকালে উঠে মাসীমাকে যাতে বেশী অসুবিধেয় পড়তে না হয়!

বংশী কবে আসবে?

কি জানি!

আজ তোমার ওপর যা অত্যাচার হয়ে গেল!

চৈতালী বঁটি ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে কঠিন রুক্ষ গলায় বলে বসে, তবু তো আশ মেটে নি বলে মনে হচ্ছে। তাই বুঝি আরও যা যা বাকী আছে–

এ রকম বলছ কেন?

বলছি কেন? আপনি জানেন না এত রাত্রে এভাবে দুটো মানুষকে একত্রে দেখলে, লোকে তার কি অর্থ করে?

আমি তো চলে যাচ্ছি। আমি শুধু একটা কথা তোমায় বলতে এসেছিলাম—

জানি কি বলতে এসেছেন।

জানো?

হ্যাঁ। বলতে এসেছেন আমি যেন এখান থেকে রাগ করে চলে না যাই।

চৈতালী!

আপনার ছোট ভাই ঠিক এই সুরে ডাকে আমায়।

কৌস্তুভ আরক্ত মুখে বলে ওঠে, অপমানের শোধ নিলে? যাক, হয়তো এ আমার পাওনাই ছিল। তবু বলছি, হা ওই কথাই বলতে এসেছিলাম, রাগ করে চলে যেও না।

চৈতালী খুব ঠাণ্ডা মৃদু গলায় বলে, না, রাগ করে চলে যাব কেন?

.

-না, রাগ করে নয়—

কাগজের টুকরোটা মুঠোয় চেপে ধরে সুলক্ষণা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সাদা দেয়ালের দিকে।

তারপর দেখলেন, সকালের জন্যে পরিপাটি রান্নার গোছ সাজানো। দেখলেন নিজের কোকালের পুরনো সরু যে দুগাছি বালা পরতে দিয়েছিলেন চৈতালীকে, সেই বালা দুগাছি বাসনের তাকে পড়ে আছে!

কাগজের টুকরোটায় চাপা দেওয়া ছিল যে চাবির থোলোটা, সেটা সুলক্ষণার হাত লেগেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

কাগজটা আর একবার চোখের সামনে তুলে ধরলেন–লেখা রয়েছে–না, রাগ করে নয়, লজ্জায়! চোরের মেয়েকে আদর করে ঘরে জায়গা দিয়েছিলে, এখন তোমাদের সংসারের কত সোনা চুরি করে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমার লোকসান, আমার সারা জীবনের সম্বল।

কী এ?

স্বীকারোক্তি? এ কোন্ সোনা?

অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সুলক্ষণা ভাঙা গলায় ডেকে উঠলেন, ক্ষেণু!

ক্ষেণু এল।

বলল, মা?

সুলক্ষণা কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, চলে গেছে।

সুদক্ষিণা বোবা চোখ মেলে তাকাল, চলে গেছে!

.

চলে গেছে!

হ্যাঁ, চলে গেছে।

কে জানে কখন!

কে জানে কোথায়!

তার সেই চিরকালের খড়কুটোর বাসা তো ভেঙে গেছে, উড়ে গেছে নিশ্চিহ্ন হয়ে!

আবার কোথায় কোত্থানে জুটবে নতুন বাসা?

আর কি কেউ অজানা অচেনা একটা যুবতী মেয়েকে বলে বসবে, আমার কাছে থাকবি?

তা হয়তো বা বলবে।

এই শহরে পাপের বাসার তো অভাব নেই। প্রলোভনের হাতছানি দিয়ে কেউ হয়তো ডেকে নিয়ে যাবে। আর আদি অন্তকাল থেকে মেয়েমানুষের জন্যে অধঃপাতের যে একটাই পথ নির্দিষ্ট আছে, সেই পথের নিশানা চিনিয়ে দেবে।

সুলক্ষণা হেরে গেলেন।

সুলক্ষণা তো প্রমাণ করে দেখাতে পারলেন না, মানুষ অমৃতের সন্তান।

কিন্তু কে বলতে পারে, অমৃতের অধিকার পেল না বলে অভিমানে মৃত্যুটাকেই হাতে তুলে নিল চৈতালী।

এই শহরতলির আশেপাশে রেললাইনের তো অভাব নেই? মরণ ফাঁদ পেতে তো পড়ে আছে মাইলের পর মাইল।

সেখানেও সুবিধে না হয়, আছে খানা ডোবা পুকুর।

বাঁচবার ঘরের দেওয়াল পাথরে গাঁথা, তার দরজা খুঁজে পাওয়া কঠিন। মরবার রাস্তা খোলা চওড়া মসৃণ। তার কোথাও কোনখানে আগল নেই।

চৈতালী হয়তো সেই আগলহীন রাস্তাটাই বেছে নিয়েছে। এপথে মিলে যাবে তার সারাজীবনের পরাধীনতার মুক্তি, সমস্ত নিরুপায়তার মুক্তি।

আমি আমার এ কথা বোঝবার এই একটাই পথ।

.

কিন্তু চৈতালী এমন একটা কী প্রাণী যে তাকে নিয়ে আরও অনেক ভাবা হবে?

কে দিচ্ছে সে অবসর?

সংসার, সমাজ, না তার ভাগ্য?

কেউ দেবে না।

সংসার যদি বা একটা নিশ্বাস ফেলে একবার অন্তত অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকায়, যদি ভাবে এ ভুলটা তো না করতেও পারতাম আমরা।

চৈতালীর কুগ্রহে গড়া ভাগ্য সে নিঃশ্বাস ছিনিয়ে নেবে আর একজনের জন্যে। সে নিঃশ্বাসকে হাহাকারে পরিণত করে তুলবে সেই ভাগ্যমন্তের সন্ধানে।

চৈতালী হয়তো মরে গেছে ভেবে কতক্ষণ ভাবনাবিলাস করবে সংসার, সংসারের সবচেয়ে দামী লোকটাই যদি সত্যি মরে গিয়ে টেক্কা দেয় তার ওপর?

রাত্তিরে ওরা সকলেই যথানিয়মে খেয়ে শুয়েছিল। কে জানে কে ওই রাত্রির আকাশটার দিকে তাকিয়ে বসেছিল, আর কে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন ছিল।

অপর্ণাকেই শুধু ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল ঘুমের ওষুধ খাইয়ে। খুব হয়তো দরকার বুঝেছিল অপর্ণার স্ত্রৈণ স্বামী। স্ত্রীর এতটুকু অসুবিধে দেখলেই যে দিশেহারা হয়ে ওঠে।

তা ঘুমন্ত আর জাগন্ত যাই হোক, সব প্রাণীগুলোই তো নিথর হয়ে ছিল। রাত্রির স্তব্ধতা। ক্লেদাক্ত হয়ে ওঠে নি, অপবিত্র হয়ে ওঠে নি, রূঢ় আলোকপাতে, চঞ্চল পদপাতে।

রাত্রির কমনীয়তা একটুও কুৎসিত হয়ে ওঠে নি কারও ভয়ার্ত স্বরে।

.

কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

শেষরাত্রির স্তব্ধতা ক্লেদাক্ত হয়ে উঠল। শেষরাত্রির কমনীয়তা কুৎসিত হয়ে উঠল।…

সমস্ত ঘরের আলো জ্বলে উঠল রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে। সমস্ত বাড়িটা মুখর হয়ে উঠল চঞ্চল পদপাতে।

প্রথম ধাক্কা পড়ল সুলক্ষণার দরজায়।

সুলক্ষণা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন নির্লিপ্ততায় শুনলেন সে শব্দ, কিন্তু আচ্ছন্নতা কতক্ষণ থাকে? ঘন ঘন ধাক্কা এসে পড়ে দরজার ওপর, ঘুমের ওপর, স্তিমিত উদাসীনতার ওপর।

মা, ওকে দেখবে এসো!

সুলক্ষণা অবিন্যস্ত আঁচল লুটোতে লুটোতে বেরিয়ে এলেন, দালানের আলোটা জ্বেলে দিলেন, তারপর ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, খোকা!

সুদক্ষিণা বেরিয়ে এল ওঘর থেকে।

তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, দাদা?

কৌশিক তিনতলা থেকে নেমে এল। চিৎকার করল না, শুধু দৃঢ় গলায় বলল, কখন?

কৌস্তুভ বলল, জানি না।

.

অপর্ণা আর ঘামবে না।

কোনদিনও না।

অপর্ণার চোখ দিয়ে আর জল গড়াবে না।

একবিন্দুও না।

অপর্ণার বুকের ওঠাপড়াটা আর মৃত্যুর সংকেতে সকলকে দিশেহারা করে তুলবে না। তবে কৌস্তুভ আর ব্যস্ত হয়ে ওঘরে গিয়ে বসবে কেন? দরকার নেই। তাই ঘরের বাইরে এসে বসে ছিল কৌস্তুভ মাথার চুলগুলো মুঠোয় চেপে।

আর কারও কথার উত্তর দেবার ছিল না।

ভাইয়ের কথার উত্তর দিল কৌস্তুভ। বলল, কি জানি! টের পাই নি। ঘুমের মধ্যে কখন—

সুলক্ষণা ঘরে ঢুকে গেছেন।

বসে আছেন।

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।

তাকিয়ে আছেন সদ্য মৃতার সাদা খড়ির মত মুখটার নীল হয়ে যাওয়া রঙের দিকে নয়, তাকিয়ে আছেন দেয়ালে ঝোলানো ওদের বিয়ের সময়কার সেই রঙিন ছবিটার দিকে!

ওই ছবিটার মধ্যে এত কী পাচ্ছেন সুলক্ষণা যে, দেখে দেখে আর শেষ করতে পারছেন না?

সুদক্ষিণা এক জায়গায় বসে থাকতে পারছে না। ও ঘরে ঢুকছে, বেরিয়ে আসছে। বসছে, দাঁড়াচ্ছে।

সুলক্ষণা একবার ক্লান্ত গলায় বললেন, এখানে বসতে না পারিস, বাইরে গিয়ে বসগে যা।

বসতে পারছি না– বলল সুদক্ষিণা।

তারপর বলল, আশ্চর্য! এতবার এত সমারোহ হল, কিছু হল না! আর সত্যি যখন একেবারে চলে গেল, তখন–চুপি চুপি চোরের মত

সুলক্ষণা বুঝি একটু হেসে বললেন, মৃত্যু রাজা, মৃত্যু চোর! ও কখনো ঘোড়ায় চেপে দেউড়ি দিয়ে আসে, কখনো নিঃশব্দ পায়ে পেছনের দেয়ালে সিঁদ কাটে!

.

তারপর আস্তে আস্তে ভোর হল, সকাল হল।

আর সকালের এই স্পষ্ট সাদা আলো যেন এতক্ষণে এদের বাস্তব জগতের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিল।

জানিয়ে দিল, অকারণ দেওয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার সময় আর নেই। জানিয়ে দিল মৃত্যু শুধু স্তব্ধ সুন্দর নয়, মৃত্যু সশব্দ কর্কশ।

সাদা গোলাপে ঢাকা শবদেহ সামনে নিয়ে শুধু বসে থাকার শান্ত ইচ্ছা হাস্যকর পাগলামি।

এই দেহ, এই খাট, এই সাজানো ঘর এখুনি তছনছ করে ফেলতে হবে। হৃদয়সম্পর্কহীন কতকগুলো লোক জড় করে এনে সাহায্য নিতে হবে তাদের, তারপর বিধানের পুঁথি খুলে বসে হিসেব করতে হবে, এরপর কী করণীয়।

অপর্ণা আর ঘামবে না।

অপর্ণার নাড়ি আর দ্রুত স্পন্দিত হবে না, অপর্ণার হৃদ্যন্ত্র থেমে যাব যাব বলে আর ভয় দেখাবে না, তবু ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। বহুদিন যাবৎ এ সংসারের নিত অতিথি তিনি। এবার সময় হয়েছে শেষ কর্তব্য সাধনের।

ডাক্তার এলেন।

আর ঠিক সেই তখন, যখন ডাক্তারের জুতোর শব্দ সিঁড়িতে শোনা যাচ্ছে, কৌশিক অপর্ণার ঘরে এসে ঢুকল। চুপ করে তাকিয়ে দেখল এক মিনিট, টেবিলের কাছে চলে এল, ঘুমের ওষুধের শিশিটা তুলে ধরল। নামিয়ে রাখল আরও একরাশি শিশি বোতল কৌটোর দঙ্গলের মধ্যে।

ফিরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। আস্তে একটু হাসির মত করে বলল, আপনার কাজ কমে গেল এবার!

যে মৃত্যু প্রতিক্ষণ উঁকি দিয়েছে, যে প্রতিদিন দুএকবার করে দেখে গেছে বন্ধ তালাটা কতখানি মজবুত, মোচড় দিয়ে গেছে খানিকটা করে ভেঙে পড়ে কি না দেখতে, সে মৃত্যুকে আবার যাচাই করবার কি আছে?

ডাক্তার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন একবার, বুকপকেট থেকে কলমটা বার করলেন।

ছাড়পত্র চাই।

প্রাণটা ছেড়ে যাবার পরও দেহটার জন্যে ছাড়পত্রের দরকার। ওটা যত্ন করে সঙ্গে নিতে হবে।

.

ডাক্তার চলে গেলেন। এবার সমারোহের দরজা খুলে দেওয়া হল। লোকে ভরে গেল বাড়ি। নীল হয়ে যাওয়া কপাল সাদা চন্দনের ছাপে ঢেকে গেল। ওর সেই সাদা খড়ির মত কপালটাই আবার ফুটে উঠল যেন।

অপর্ণার বিয়ের সময়ের অধিবাসের শাড়িটা বার করে দিলেন সুলক্ষণা, যেটা পরিয়ে ওই রঙিন ফটোখানা একদিন তুলিয়েছিলেন অপর্ণার শ্বশুর।

এবাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন একদিন, আজ তার যত্ন করে খুঁজে আনা বৌ চলে গেল।

সুলক্ষণা শেষবারের মত কপালে একটা হাত রেখে ধীর কণ্ঠে বললেন, যিনি খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসেছিলেন, তোমায়, তাকে এবার খুঁজে বার করগে তুমি।

কৌশিক মার পিঠে একটা হাত ঠেকিয়ে বলল, সব মৃত্যুই কি একই জায়গায় পৌঁছয় মা?

সুদক্ষিণা কথাটা শুনতে পেল।

ভাবল, একথা বলল কেন ছোড়দা? চৈতালীর কথা মনে পড়ল না ওর।

.

তারপর। অনেক দুর্ভোগের পর

অনেক রাত্রে বাড়ির সব আলো যখন নিভে গেছে, ছাতের দালানের সিঁড়ির, শুধু মৃতের ঘরের আলো নেবানো বারণ বলে কিসের যেন একটা ক্ষীণ আলো জ্বলছে, তখন সুলক্ষণা সে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

এসে তিনি দেখলেন, তাঁর বড় ছেলে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে।

এই স্তব্ধতার ছবি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুলক্ষণা, তারপর সাবধানে কাছে এসে ডাকলেন, খোকা!

ফিরে দাঁড়াল কৌস্তুভ।

এত অস্পষ্ট আলোয় ওর মুখ দেখতে পেলেন না সুলক্ষণা। নরম গলায় বললেন, ঘুম। আসছে না থোকা?

না।

খুব বেশী সহজ হবার জন্যেই বোধ করি বড় বেশী সাধারণ গলায় কথা বলল কৌস্তুভ।

বলল, না। সারাদিন অনেক ঝঞ্জাট গেল। মাথাটা বড্ড ধরে গেছে।

তারপর বলল, মা জানলার কাছে এসো!

কি? জানলার কাছে কি?

সুলক্ষণা যেন ভয় পেলেন।

কৌস্তুভ ভয় পেল না। কৌস্তুভ যেন হাসল। বলল, নীচের কার্নিসের দিকে তাকিয়ে দেখ।

সুলক্ষণা জানলার কাছে এলেন।

জানলার গরাদের খাঁজে মুখটাকে রাখলেন। লোহার এই শিকগুলৈ বাধা। তা হোক, তবু দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না! কার্নিসটা চওড়া।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সুলক্ষণা সেই নীচের দিকে। ওঁর মনে হল ওখানে যেন অনেকগুলো আগুনের ফুলকি জ্বলছে।

আমি জানতাম! আমি জানতাম! যেন মনের মধ্যে উচ্চারণ করছেন সুলক্ষণা, এই রকমই একটা কিছু যে হবে আগেই ভেবেছিলাম আমি!

মনের মধ্যে উচ্চারণ করলেন যেন।

তবু এই সদ্য মৃত্যুর ছমছমানি ভরা, একেবারে নিস্তব্ধ ঘরের পটভূমিকায় সেই উচ্চারণ শুনতে পেল কৌস্তুভ।

বাতাসের মত শব্দে বলল, যদি দেখতে না পেতাম!

সুলক্ষণা নিশ্বাস ফেলে বললেন, যদি শুধু আমিই দেখতে পেতাম! তারপর বললেন, কখন?

কাল কাল রাত্তিরে!

সুলক্ষণা বিড়বিড় করে বললেন, তাহলে আমার সব ধারণা ঠিক!

কৌস্তুভ জানলা থেকে সরে এল। বিছানায় বসে পড়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিক। আমি জানতাম, তুমি বুঝতে পারবে। তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। কিন্তু মা, জানো? কৌস্তুভের গলার স্বরটা যেন ছায়ার মত শোনালোজানো, আজ আবার তাকিয়ে দেখতে দেখতে অদ্ভুত একটা মায়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এইটুকুর বেশী ক্ষমতা যার ছিল না, তাকে একটা মানুষই বা ভাবলাম কেন আমি!

সুলক্ষণা অন্ধকারে আন্দাজে ছেলের গায়ে একটা হাত রাখলেন। বললেন, তুইও তো মানুষ খোকা! রক্তমাংসের মানুষ!

.

কিন্তু অনেকক্ষণ পরে ঘরে কথার সাড়া আনলেন সুলক্ষণা।

কিন্তু ওরা ওঠবার আগে, ওরা জাগবার আগে ওর তো একটা ব্যবস্থা করতে হয় খোকা!

না মা! ওদের কাছে স্বীকার করব আমি, প্রকাশ করব। ওরা কেন মিছামিছি একজনকে দোষী ভেবে

সুলক্ষণা দৃঢ়স্বরে বললেন, তা হয় না খোকা!

কিন্তু কেন হয় না মা?

হয় না বলেই হয় না বাবা!

কিন্তু মা, জীবন বড়, না মৃত্যু বড়?

সুলক্ষণা বললেন, বড় ছোট বিচার করা শক্ত খোকা, শুধু জানি, মৃত্যু সম্মানের, মৃত্যু শ্রদ্ধার।

.

বংশী আসেনি, আর কেউ নেই, এখন সুদক্ষিণাকেই সকাল বেলা চা ঢালতে হবে।

আর বসে পড়ে বলা যাবে না, কই কোথায়?

ক্লান্ত মন আর ক্লান্ত ভঙ্গী নিয়ে চা ঢালতে ঢালতে সুদক্ষিণা আস্তে বলে, যখন বৌদির ঘরে কেউ থাকবে না, তখন তোকে একবার ওঘরে নিয়ে যাব ছোড়দা, একটা ভয়ঙ্কর জিনিস দেখাব।

কৌশিক চোখ তুলে বলে, জানি!

জানিস? জানিস তুই?

জানতাম! জানলাম!

কখন! কখন জানলি তুই?

এক সময়।

মাকে বলেছিস?

রুদ্ধ কণ্ঠ সুদক্ষিণার, রুদ্ধশ্বাস।

কৌশিক ম্লান হেসে বলে, পাগল হয়েছিস!

বলবি না? শুধু শুধু একটা মেয়েকে

কত লোকই তো শুধু শুধু কত কষ্ট পায় ক্ষে, কত লাঞ্ছনা সহ্য করে, ওটা তো পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কথা নয়। কিন্তু যে পৃথিবীর আওতা ছাড়িয়ে চলে গেছে, তাকে কেন আর?

তাই বলে তুই নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবি?

হয়তো এখন আর চেষ্টা করার কোন মানেও নেই। খুব মর্মান্তিক ধিক্কারের মুহূর্তে মানুষ চরম পথটাই বেছে নেয়।

তুই তক্ষুণি কেন বেরোলি না ছোড়দা, ও চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে।

কৌশিক ম্লান হেসে বলে, কখন সময় পেলাম বল? সবটাই তো আকস্মিক ঘটে যাচ্ছে। যেখানে বাড়ির বৌয়ের মৃত্যুর সমারোহ, সেখানে বাড়ির রাঁধুনীর

ছিঃ ছোড়দা!

কৌশিক মিনিট খানেক চুপ করে থেকে আস্তে বলে, কিন্তু ক্ষেণু, ওর ঘর সার্চ করতেও আমাদের বাধেনি!

এই ঘর সার্চের ব্যাপারে সুদক্ষিণার ভূমিকা রয়েছে, তাই সুদক্ষিণা আরক্ত মুখে বলে, সে আমি ওকে সন্দেহ করে নয় মোটেই। মা দাদার ওপর রাগ করে।

তা জানি। শুধু ভাবছি ও সে কথা বুঝতে পেরেছিল কিনা। অভিমানে একদম পাথর হয়ে গিয়েছিল তখন।

হওয়াই স্বাভাবিক। আশ্চর্য, সেদিন আমরা সব জায়গা দেখলাম, অথচ ওই–ওই জানলার নীচেটা–

আমি দেখেছিলাম—

দেখেছিলি? তুই দেখেছিলি? কখন?

যখন আসামী কাঠগড়ায়—

ছোড়দা!

সুদক্ষিণা আর্তস্বরে প্রায় চীৎকার করে ওঠে, তবে? তবে কেন তুই… তখন তো বৌদি মারা যায়নি!

না, তা যায়নি। কিন্তু কৌশিক একটু হাসে, সত্য উদঘাটনের প্রতিক্রিয়ায় যদি মারা যায়, এই ভয়ে জানলা থেকে উদাসীন মুখ নিয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু আশ্চর্য দেখ, শেষরক্ষা হল না। বৌদিকেও বাঁচানো গেল না।

ঘুমের ওষুধ এত বেশী বেশী আনা থাকত ছোড়দা?

খুব বেশীর দরকার হয়নি রে ক্ষেণু!

সুদক্ষিণা এই দুদিনেই অনেক বড় হয়ে গেছে। সুদক্ষিণার মুখে সেই পরিণতির ছাপ।

অথচ দেখ ছোড়দা, কারও কোথাও শাস্তি হল না! ডাক্তারও তাকিয়ে দেখল না।

হয়তো ডাক্তারেরও ধৈর্যের শেষ হয়ে গিয়েছিল।

থাক! ডাক্তারের আবার ধৈর্য অধৈর্য! দিব্যি একখানি কামধেনু পেয়েছিল।

ছিঃ ক্ষেণু, মানুষ সম্বন্ধে ও রকম শ্রদ্ধাহীন কথা বলিস না। টাকাই শেষ কথা, এমন মানুষ খুব বেশী নেই।

না থাকলেই মঙ্গল– সুদক্ষিণা ঠোঁট উল্টোয়।

কৌশিক আস্তে বলে, দেখ ক্ষেণু, ঘটনার চেহারা দেখে মানুষকে বিচার করলে বড় ভুল করা হয়। নিজেদের তো কেউই আমরা ভয়ানক একটা পাষণ্ড ভাবি নি, তবু দেখ যদি চৈতালীর দিক থেকে

ওদের কথা শেষ হয় না।

ওদের কথার মাঝখানে কৌস্তুভ এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, কেউই যে আমরা নিজেকে পাষণ্ড ভাবি না, এ কথাটাও তোর ভুল কুশী!

দাদা!

দুজনেই বলে উঠল ওরা।

সুদক্ষিণা তারপর বলল, খাওয়া দাওয়া না করে কোথায় গিয়েছিলে? এতখানি বেলা হয়ে গেল, মা খাননি।

মা খাননি, এমন কথাতেও বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করল না কৌস্তুভ। সেই ভাবেই বলল, মেয়েটাকে কি এমন করে অনায়াসেই হারিয়ে যেতে দেওয়া হবে ক্ষে?

কে, কে, কার কথা বলছ তুমি? ক্ষেণু চেঁচিয়ে ওঠে, দাদা! কথাটা কি ভূতের মুখে রামনামের মত হল না? দুজনে মিলে তোমরা ষড়যন্ত্র করে তাকে।

সুদক্ষিণা চুপ করে গেল।

মনে পড়ে গেল সেই দুজনের একজন আজ নেই। তার সম্বন্ধে বাকসংযমের প্রয়োজন। সে জিতে গেছে, সে ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করেও সংসারের বিচারের দৃষ্টির উর্ধ্বে উঠে গেছে।

কৌশিক চেঁচাল না।

কৌশিক নিথর হয়ে তাকিয়ে রইল তার দাদার পাথরের মত মুখের দিকে।

কৌস্তুভ বোনের সহসা রুদ্ধবাক উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত চোখে বলে, ধরলাম দুজনে মিলেই। কিন্তু–এও তো সত্যি, ভুল মানুষেই করে। আবার ভুল সংশোধনও মানুষেরই কাজ–

সুদক্ষিণার ব্যঙ্গ তীব্র হয়ে ওঠে, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বলে, এটা কী দাদা? অনুতাপ, না মহত্ত্ব?

ক্ষেণু! এবার কৌশিকের কণ্ঠে শব্দ ফোটে। সে শব্দে নিষেধের সুর।

সুদক্ষিণা কিন্তু এই নিষেধে কান দেয় না। সেই তীব্রতার সঙ্গেই বলে, কেন বারণ করছ ছোড়দা? মুখোশ এঁটে যে চিরদিন সংসারকে ভোলানো যায় না, সেটাও প্রকাশ করার দরকার আছে বৈকি। বৌদিকে যে তুমি একদিনের জন্যেও ভালবাসতে পারনি দাদা, সেটা তোমার চেয়ে আর বেশী কে জানে? তবু তুমি আদর্শ স্বামী সেজে রাতদিন তাকে ঠকিয়েছ। সেই ছলনার মুখোশখানা নেড়ে আহা আহা করে তার মুখ বন্ধ করে রেখেছ। বিদ্রোহ করবার তিলার্ধ সুযোগ দাওনি তাকে। হয়তো সে সুযোগ দিলে তার নার্ভগুলো এত বিকৃত হয়ে উঠত না। আর সেই বিকৃতির বোঝা নিয়ে এমন হাস্যাস্পদও হয়ে উঠত না। তিল তিল করে শুধু যত্নের অত্যাচারে মেরেছ তাকে তুমি, আর শেষ পর্যন্ত।

আবার সহসা থেমে যায় সুদক্ষিণা। মনে পড়ে যে কথা, যে ভয়ঙ্কর কথা, এখনো অনুক্ত আছে, সেটা উদঘাটন করে বসা চরম নিবুদ্ধিতা।

নিরাবরণ নিষ্ঠুর সত্যটা সমস্ত সংসারকে যেন দাঁত খিঁচিয়ে উঠবে।

কিন্তু কৌস্তুভ সেই চরম নির্বুদ্ধিতাটাই করে বসে।

কৌস্তুভ বোনের এই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে যেন মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, হ্যাঁ শেষ পর্যন্ত। কিন্তু পরে মনে হল এতটা না করলেও চলতো। কতটুকুই বা ক্ষমতা ছিল ওর? জানলা পর্যন্ত পৌঁছতেই

সুদক্ষিণা স্থির স্বরে বলে, জানলা পর্যন্ত পৌঁছবার ক্ষমতা তো ওর ছিল না দাদা!

ঠিকই বলেছিস ক্ষে, সে ক্ষমতা ছিল না ওর। তবু গিয়েছিল। দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একেই হয়তো মরীয়া অবস্থা বলে। ঈর্ষার জ্বালায়–

কিন্তু কেন এই ঈর্ষা, কেন এই বিদ্বেষ বলতে পার দাদা?

সব কথাই কি বলা যায় ফেণু? না সব কথা বলার যোগ্য হয়? তবে ঈর্ষাই তো অক্ষমের সম্বল! তাই তোদের অনুরোধ করি, অক্ষম বলে অবোধ বলে তাকে তোরা একটু দয়া করিস। আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাব ঠিক করেছি, হয়তো সেই অবকাশে সংসারের সব জটিলতা সরল হয়ে যাবে, হয়তো সংসার তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ পাবে। হয়তো মার দুটো ছেলেই ব্যর্থ হয়ে যাবে না। কিন্তু এটা জেনে রাখিস ক্ষে, চেষ্টা করলেই কাউকে ভালবাসা যায় না। আর ইচ্ছে করলেই ভালবাসা ফিরিয়ে আনা যায় না। শুধু সে ভালবাসাকে মোহমুক্ত, নির্মল করে তোলার সাধনাই হচ্ছে মানুষের কর্তব্য।

.

দাদাকে আমরা ভুল বিচার করেছি

ক্ষেণু আস্তে বলে।

কৌশিকও সেইভাবে বলে, প্রতি পদেই তো আমরা ভুল বিচার করি ক্ষে, প্রত্যেকটি লোককেই ভুল বুঝি। আমাদের বিচারের দৃষ্টিটা যদি আর্শির মত স্বচ্ছ হত, তা হলে তো সংসারে কোনও সমস্যাই থাকত না।

দাদা হয়তো বৌদিকে সুখী করতেই চেষ্টা করত। হয়তো ঠকাবে ভেবে মুখোশ আঁটেনি, হয়তো দাদা নিজেও বুঝত না।

.

ওদের কথার মাঝখানে ছেদ পড়ল।

সুলক্ষণা দ্রুত ছুটে এসেছেন একখানা বাঙলা খবরের কাগজ হাতে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ কণ্ঠ সুলক্ষণার, কুশী, কুশী, মেয়েটা বুঝি সেই সর্বনাশই করল রে–

সুলক্ষণার এত বছরের ঘরকরা রাজরাণীর মত বৌ বিষে নীল হয়ে নিথর বনে গেল, তবু উত্তেজিত হননি সুলক্ষণা, বিচলিত হননি। বিচলিত হচ্ছেন যে ঘুঁটেকুড়নীটাকে রাজরাণী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন মাত্র, তার মৃত্যুর আশঙ্কায়!

আশ্চর্য বৈকি।

মাকে এমন কখনো দেখেনি সুলক্ষণার ছেলেমেয়েরা। বাবার মৃত্যুসময়েও না।

তখন সুলক্ষণা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।

এখন সুলক্ষণা কাতর হচ্ছেন।

সুলক্ষণা আছড়ে পড়ছেন।

মেয়েটাকে আমিই মেরে ফেললাম ক্ষেণু!

কৌশিক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।

.

কি? কি হল কি? কাগজে কি?

ঝুঁকে পড়ল সুদক্ষিণা

কাগজে কি দেখেছেন সুলক্ষণা, দেখালেন মেলে ধরে। তিনদিন আগের খবর।

গত সোমবার সকালে বাঁশধানী অঞ্চলে একটি পুকুর হইতে একজন তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তরুণীর পরনে সরু কালপাড় ফিকে নীল রঙের শাড়ী ও শাদা ব্লাউজ। দেহে কোথাও অলঙ্কারের চিহ্ন নাই। তরুণীটিকে কুমারী বলিয়া মনে হয়। পুলিশ ইহাকে একটি আত্মহত্যার ঘটনা অনুমান করিতেছে।

ও কি ওই রকম শাড়ী ব্লাউস পরেছিল সেদিন?

ক্ষেণু প্রায় ডুকরে ওঠে, কই কোনদিন তো

সুলক্ষণা আস্তে বলেন, না কোনদিন পরেনি, শুধু যেদিন প্রথম এসেছিল, ওর নিজের সেই শাড়ী পরে চলে গেছে। যাবার সময় আমার দেওয়া কিছুই নিয়ে যায়নি ক্ষেণু! আমার ভালবাসাটাও আমার পুরনো শাড়ীগুলোর মত ফেলে দিয়ে চলে গেছে।

সুলক্ষণা উদ্বেল হয়ে উঠেছেন।

সুলক্ষণা সেখানে যাবেন।

সুদক্ষিণাও।

কুশী এখনি চল। দেখ পুলিশ তাকে জ্বালিয়ে দিল কিনা। একবার দেখব গিয়ে এত বড় অভিমানে মুখটা তার কেমন হয়ে গেছে

কৌশিক এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবারে সে আস্তে বলে, মা তুমি নাইবা গেলে? আমি যাই–

নারে কুশী, আমি তাকে একবার দেখব।

মা তুমি গেলে সেই মৃত্যুর সমস্ত দায়িত্ব তোমার ওপর পড়বে। যে তোমার কাছ থেকে এমন হঠাৎ চলে গিয়ে।

কৌশিক থেমে যায়।

তারপর একটু থেমে খুব মৃদু গলায় বলে, পুলিশের ব্যাপার তো জানো? হয়তো অকারণ কতকগুলো কদর্যতা টেনে এনে ভয়ানক একটা অপমানে ফেলবে তোমাকে। হয়তো বলবে

এখন বসে বসে তুই ঝামেলা ঝাটের ভাবনা করছিস কুশী, সুলক্ষণা ধিক্কার দিয়ে ওঠেন, সেটাই বড় হল তোর কাছে?

কৌশিক মার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায়।

দৃঢ় গলায় বলে, ঝামেলা ঝঞ্জাট নয় মা, তোমার সম্মান। আমার কাছে তার চাইতে কোন কিছুই বড় হতে পারে না।

.

কিন্তু চিরদিনের বুঝমান সুলক্ষণা বুঝি অবুধ হয়েছেন। তাই কৌশিক তাকে কোন যুক্তিতেই রুখতে পারে না। তিনি যাবেনই। দেখবেন সেই অভিমানিনীর মুখ! যদি কৌশিক নিয়ে না যায়, তিনি বড় ছেলের কাছে গিয়েই দরবার করবেন।

বলবেন খোকা, তোকে তো কখনো কিছু কাজের ভার দিই না, আজ

.

না, সুলক্ষণার বড়ছেলে মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রয়োগ করেনি, নিষেধ করেনি ঝঞ্ঝাট আর ঝামেলার ভয়ে। শুধু বলেছিল, বৃথা যাবে মা। সে নয়।

.

সেই কথারই উত্তর দিলেন সুলক্ষণা, সেই অনেক কষ্টের পারাবার পার হয়ে বাড়ি ফিরে। কিন্তু চুপি চুপি যেন নিজের কানে কানে বললেন, এ নয় বলেই কি আমি খোকার কথা মানব? না, সে আমার বড় অভিমানী। আমি জানি এখানে নয়, কিন্তু অন্য কোনখানে…।

.

সুলক্ষণার ব্যাকুল স্নেহ কি ভুলপথে হাতড়ে মরতে চাইছে? সুলক্ষণার ধীর স্থির বড় ছেলেই কি ঠিক বুঝেছে? সে যে বলেছিল, যেতে চাও চল, নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি বলছি, সে হতেই পারে না। তার মধ্যে আগুন আছে, শক্তি আছে, সেই শক্তি মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হতে আসেনি, সেই আগুন ওই পানাপুকুরের জলে নিভে যেতে যায় নি।

কিন্তু সুলক্ষণা বিশ্বাস করবেন না সে কথা। সুলক্ষণা খবরের কাগজ তন্ন তন্ন করে দেখবেন, কোথায় কোনখানে মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে।

সুলক্ষণা তরুণী অথবা যুবতী শুনলেই সেখানে ছুটবেন। আসুক বিপদ, আসুক বিরক্তিকর প্রশ্ন, কিছুতেই যেন সুলক্ষণা হার মানবেন না।

কিন্তু দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে যে! এতদিন পরে কি চৈতালী রেলে কাটা পড়তে যাবে? জলে ডুবতে যাবে?

কৌশিক বলে, মা, এ কী পাগলামী করছ তুমি?

সুলক্ষণা বলেন, বল, পাগলই বল আমাকে।

সুদক্ষিণা বলে, মা, এত ভালই যদি বাসতে তাকে, তবে কেন সেদিন।

সুলক্ষণা নিঃশ্বাস ফেলেন।

বলেন, ভেবেছিলাম ও আমায় বুঝবে। ভেবেছিলাম ও আমায় মায়া করবে। ও নিষ্ঠুর, ও তা করল না!

.

আর কৌস্তুভ?

সে কি কিছু বলে না?

না, সে কিছু বলে না। সে দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তি পেয়েছে, তাই বেড়াতে চলে গেছে। কিন্তু শুধুই কি বেড়াতে?

দাদার শূন্য ঘরটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে কৌশিক, দাদা কি শুধু মুক্তির আস্বাদ ভোগ করতেই বেরিয়ে পড়েছে, কাজে ছুটি নিয়ে?

কে জানে!

কৌস্তুভের মনের ভেতরের কথা কোনদিনই বোঝা যায় না।

.

তবু একদিন বোঝা গেল।

কৌস্তুভের চিঠি সেকথা বুঝিয়ে দিল। কোথায় বেড়াতে গেছে কৌস্তুভ, সে কথা এরা জানে না। কৌস্তুভ যে চিঠি দিয়েছে, তাতে নিজের ঠিকানা জানায় নি। হঠাৎ একদিন অন্য একটা ঠিকানা দিয়েছে। একটা চিঠির সঙ্গে। দমদমের কোন একটি উদ্বাস্তু কলোনির ঠিকানা।

কৌশিককে লেখা এই চিঠিতে ঠিকানা পাঠাবার কোন কারণ উল্লেখ নেই।

তবু বুঝতে পারে কৌশিক।

দাদাকে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে।

কিন্তু কী সংবাদ নিহিত আছে এই পরিচয়হীন একটা তুচ্ছ ঠিকানার মধ্যে? এতদিন ধরে সুলক্ষণা যা ভেবে এসেছেন তাই কি?

অনেক পথ অতিক্রম করে খুঁজে খুঁজে পৌঁছে আবার কি একখানা মৃত্যুনীল মুখ দেখতে হবে কৌশিককে? নাকি কোনো মৃত্যুপথ যাত্রিণীকে? না এ ঠিকানা শুধু সন্ধানবার্তা?

আশা এক আনা, আশঙ্কা পনেরো আনা। সেই আশা আর আশঙ্কা, বোঝা আর না বোঝার দ্বন্দ্বে কম্পিতহৃদয় নিয়ে একাই বেরোয় কৌশিক।

সুলক্ষণা বলেছিলেন, আমি যাইরে?

কৌশিক কেমন একরকম করে তাকিয়ে বলেছিল, যদি তুমি সহ্য করতে না পার?

আমি পারব না, তুই পারবি?

আমার সম্পর্কে ধারণা একটু বদলাও মা!

তোর কি মনে হচ্ছে বল তো কুশী?

সর্ববিধ মনে হওয়া থেকে মনকে আমি একেবারে মুক্ত করে ফেলেছি মা।

সুদক্ষিণা বলে, আমি তা পারিনি। আমি ওর মত অত মুক্তজীব নই মা। আমার মনে হচ্ছে, এ ওরই ঠিকানা। ও আছে। দাদা খুঁজেছিল, দাদা ওর সন্ধান পেয়েছে।

সুলক্ষণা কথা বললেন না, নিঃশ্বাস ফেললেন। আর কৌশিক চলে গেলে সহসা মেয়েকে ডেকে বলে উঠলেন, যদি তোর কথাই সত্যি হয় ক্ষে, কুশী কী করবে সে তো বলে দেওয়া হল না!

সুদক্ষিণা আস্তে বলে, এ তো তুমি আমি বলে দিয়ে করাবার জিনিস নয় মা, ওর মন যা বলবে, তাই করবে ও।

ও যদি শুধু নিজের মনের নির্দেশটাই না দেখে? যদি আর কারও মনের কথা ভাবতে বসে?

তা যদি হয় মা, সুদক্ষিণা বলে, বুঝতে হবে ওর মন এখনো কঁচা আছে। নিজেকে বোঝে।

কিন্তু আমরা কেউই কি আমাদের বুঝি ক্ষে?

.

এতদিন পারেননি, এতদিন একবারও এ ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেননি।

আজ সুলক্ষণা চৈতালীর সেই পুরনো ঘরটায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন আলনায় কয়েকখানা শাড়ী ঝুলে আছে।

ধূলিধূসর বিবর্ণ মলিন।

যে শাড়ীগুলো সুলক্ষণা নিজের আলমারি থেকে একখানি একখানি করে বার করে দিয়েছিলেন। সেই অবধি আর কেউ হাত দেয়নি এগুলোয়।

হঠাৎ মনের ভাবনাটা উচ্চারণ করে ফেললেন সুলক্ষণা, তুমিও আর কোনদিন হাত দেবে না! এবার তুমি যদি আমো, আপন অধিকার নিয়ে রাজ-সমারোহে আসবে। আমার ঘরের কোণের দিকের ছোট্ট এই এক ফালি ঘরের দিকে আর তাকিয়েও দেখবে না তুমি। তাকিয়ে দেখবে না আমার দেওয়া জিনিসের দিকে। যা তুমি ফেলে চলে গেছ, যার দিকে আমি এখনো পর্যন্ত তাকাতে পারি না।

চৈতালী এসে এসবের দিকে কী অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবে, সেটাই ভাবতে লাগলেন সুলক্ষণা।

ধুলোভরা কয়েকটা শাড়ী, আলনার কোণে ঝুলে থাকা দুটো রঙিন ব্লাউজ, ব্র্যাকেটে রাখা একখানা চিরুনি, আর একটা তেলের শিশি, এই তো! এই তুচ্ছ বস্তুগুলোর জন্যে এমন জ্বালাভরা হাহাকার অনুভব করছেন কেন সুলক্ষণা?

.

ছত্র সেই চিঠিটা পড়বার পর যে হাহাকার উঠেছিল সুলক্ষণার মনে, নতুন করে আবার যেন সেই হাহাকার অনুভব করলেন সুলক্ষণা।

অথবা তার চাইতেও বেশি।

সেদিন শুধুই মর্মান্তিক একটা বেদনা ছিল, আজ তার সঙ্গে যেন একটা দাহ। কিসের এই দাহ? কী এত চিন্তা?

চৈতালী ফের আর তার পুরনো জায়গাটায় এসে দাঁড়াবে না, সেই ফাঁকা হয়ে যাওয়া ফাঁকটা ভরাট করে তুলবে না, এই চিন্তা? সে চিন্তাটা কি এতও তীব্র হল যে চিরতরে হারিয়ে ফেলা জিনিসটাকে ফিরে পাওয়ার আশা দেখেও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারছেন না সুলক্ষণা!

নাকি এখনো বিশ্বাসে আসতে পারছেন না তিনি, চৈতালী আছে! চৈতালী ফিরে আসবে।

সে কথা জানেন সুলক্ষণা আর তার ভগবান। কিন্তু একটু পরেই উঠে পড়লেন তিনি। কৌশিক না আসতেই, কোন খবর না পেতেই সুদক্ষিণাকে ডেকে তিনি বললেন, ক্ষেণু, ধর আমি যদি তোদের দাদাকে নিয়ে আর কোথাও গিয়ে থাকি, তুই এ সংসার চালিয়ে নিতে পারবি না?

সুদক্ষিণা ভুরু কুঁচকে বলে, তার মানে?

মানে কিছু না। কুশী সংসার পাতলে, আমার বোধ হয় অন্য কোথাও গিয়ে থাকাই উচিত।

বটে নাকি? ক্ষেণু ক্ষুব্ধ গলায় বলে ওঠে।

তা হলে তো তোমার কুশীর সংসার না করাই উচিত। হঠাৎ এমন অদ্ভুত চিন্তা তোমার মাথায় এল কেন বল তো?

সুলক্ষণা, চিরদিনের দৃঢ় আর স্থিরচিত্ত সুলক্ষণা, তিনি কি তাহলে অস্থির হয়ে গেলেন? দুর্বল হয়ে গেলেন? তাই কেমন যেন অসহায়ের মত তিনি বললেন, খোকার কথাটা তো আমায় ভাবতে হবে ক্ষেণু!

ভাবতে বারণ করছে কে? ভাবো না যত পার। কিন্তু সংসার ত্যাগ করতে যাবে কেন? খোকাকেই বা সংসারছাড়া করবার দরকার কি?

আমার মনে হচ্ছে ক্ষেণু, সংসার সে আপনিই ছাড়বে।

দেখব কে তাকে ছাড়তে দেয়।

কিন্তু ক্ষেণু, সুলক্ষণা হতাশভাবে বলেন, বৌমার সেই চোখ দুটোকে কি এ সংসার থেকে উপড়ে ফেলতে পারব? পারব না। সেই চোখ প্রতিনিয়ত আমাকে ভর্ৎসনা করবে। আমাকে ছুঁচ দিয়ে বিধবে

মা, তুমি তো এমন দুর্বল ছিলে না?

হয়তত ছিলাম না। কিন্তু কেবলই বুঝি মনে হচ্ছে ভেতরের সব জোর ফুরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোথায় যেন মস্ত বড় একটা অপরাধ করেছি।

সুদক্ষিণা মায়ের এই অপরিচিত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, সত্যিই অবাক লাগছে।

আমিও অবাক হচ্ছি, ক্ষে।

হঠাৎ সুদক্ষিণা অন্য এক চাল চালে। বলে, তোমার ছেলেদের ব্যাপারে তাহলে সব জোর ফুরিয়ে ফেললে? এই মেয়েটা বোধহয় ফাউয়ের খাতায়?

সুলক্ষণা কথাটা শোনেন, বোঝেন। তারপর বলেন, আমি কারও জন্যে কিছু করতে পারি, এ ভরসা আর নেই রে ক্ষে। আমার ছুটি নেবার মন হয়েছে।

মা, বৌদিকেও যে তুমি এত বেশী

সুলক্ষণা বাধা দিয়ে বলেন, মা হওয়া যে কত জ্বালা, সে তুই এখন কী করে বুঝবি ক্ষেণু?

ওই চিরকেলে পুরনো কথাটা তোমার মুখে শোনার আশা করিনি মা।

সুলক্ষণা এবার একটু হাসেন।

বলেন, মানুষ জীবটাই যে চিরকেলে পুরনো, ক্ষেণু! কালের প্রলেপে হয়তো তার রঙ বদলায়, পালিশ ঝলসায়, কিন্তু ভেতরের কাঠামোয় যখন হাত পড়ে, তখনই ধরা পড়ে তার পুরনোত্ব। তোর কথায় তাই আমি লজ্জা পেলাম না ক্ষে।

কিন্তু মা, ছোড়দারও তো মা তুমি? তাকে ত্যাগ করতে তোমার কষ্ট হবে না।

ত্যাগ? বলিস কি ক্ষেণু? ষাট ষাট! এ তো শুধু দূরে থাকা, সরে গিয়ে থাকা। সুখের দিনে, ঔজ্জ্বল্যের দিনে, সাফল্যের দিনে মাকে না হলেও চলে যায় ক্ষেণু, সে জীবনে মা শুধু একটা ডাক মাত্র, একটা সম্পর্কের বন্ধন মাত্র, আশ্রয় নয়। তাই মা চিরদিন থাকে তার দুঃখী সন্তানের দিকে, অভাগা অনুজ্জ্বল, ব্যর্থ সন্তানের দিকে।

ক্ষেণু তর্কের সুরে বলে, আর কোনো মায়ের যদি সব ছেলেমেয়েগুলোই সুখী সফল হয়, মা কি তবে তখন আমাকে আর কারও দরকার নেই–বলে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে যাবে?

সুলক্ষণা হেসে ফেলেন।

বলেন, তা নয় ক্ষেণু। তখন শুধু মা ছুটি পাবে।

সুদক্ষিণা মায়ের মুখে যে সঙ্কল্পের ছায়া দেখতে পেয়েছে, তাতে আর ভরসা নেই। তবু সাহস করে বলে, যদি চৈতালীকে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি ছোড়দা তাকে আনে, তাকে নিয়ে তুমি সংসার করবে না?

না ক্ষেণু, সংসার করার সাধ আমার বড় বৌমা ঘুচিয়ে দিয়েছে। পাপ যেখানে যে কোন কারণেই আসুক, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সেই প্রায়শ্চিত্তটাই রইল এখন আমার ভাগে।

মা, তবে তুমি চৈতালী চৈতালী করে অমন অস্থির হয়েছিলে কেন?

সুলক্ষণা হাসেন, ওই একটা ব্যাপারই মানুষের আয়ত্তের বাইরে, ক্ষেণু। ভেবে চিন্তে সঙ্কল্প স্থির করে কেউ অস্থির হয় না। যাক তবু তো বুঝলি, তোদের মা কাঠ পাথরে তৈরি নয়, নেহাই রক্ত মাংসের মানুষ?

ক্ষেণু আস্তে মাথা নাড়ে।

না, ঠিক বুঝলাম না। বরং মনে হচ্ছে কাঠেরও নয়, পাথরেরও নয়, স্রেফ স্টিলের।

.

ক্ষেণু চলে গেলে সুলক্ষণা চুপ করে বসে রইলেন। ভাবলেন, ওরা কোনদিনই আমাকে বুঝল না সে অভিমান ছিল আমার, কিন্তু এখন সে অভিমান ঘুচেছে। নিজেই কি আমি নিজেকে বুঝতাম? আর ওদেরই কি বুঝতে পারি?

.

না, কেউ কাউকে সহজে বুঝতে পারে না। বুঝতে চায় না বলেই হয়তো পারে না।

তাই চৈতালী বুঝতে পারছে না কৌশিককে?

তার মুখের ওপর হেসে উঠছে?

নাকি আত্মহত্যার এই পদ্ধতিটাই বেছে নিয়েছে চৈতালী? গায়ে আগুন ধরিয়ে নয়, আগুন নিজের মধ্যে জ্বেলে!

চৈতালী এত নিষ্ঠুর হল কবে?

চৈতালীর কথাগুলো কৌশিককে কতটা আঘাত হানছে বুঝতে পারছে না বলেই কি? নাকি ইচ্ছে করেই নিষ্ঠুর হচ্ছে চৈতালী? তাই লহরে লহরে হেসে হেসে বলছে, থানায়? হাসপাতালে? বল কি? খোঁজবার আর জায়গা পাওনি? কিন্তু কেন বল তো এখনো এত খোঁজাখুঁজি? পুলিশে দেবে বলে? সোনা চুরির দায়ে ওয়ারেন্ট এনেছ?

কৌশিক সেই অস্বাভাবিক হাসির পর্দার নীচেকার অস্বাভাবিক পাণ্ডুর কৃশ মুখটার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ ঠিক বলেছ চৈতালী, সোনা চোরকে কে ছেড়ে দেয়?

তাই নাকি? ও বরেন, ঘরের মধ্যে কি করছ? বেরিয়ে এসে দেখো। আমার সেই মনিব বাড়ির দাদাবাবু

ভয়ঙ্কর হাসির দাপটেই বুঝি চৈতালীর গলা বুজে আসে।

.

কিন্তু বরেন কেন?

বরেন কোথা থেকে এল এখানে?

চৈতালীর সঙ্গে বরেনের সম্পর্ক কী?

না, সত্যিকার সম্পর্ক তো কিছুই নেই। আর পূর্বজন্মে চৈতালীর সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, সে তো শুধু বিরক্তির। শুধু তিক্ততার।

তবু এক ছাদের নীচে আছে দুজনে।

হয়তো এটা বিধাতার কৌতুকের একটা জোরালো নিদর্শন। মানুষ যাকে সংক্ষেপে বলে, অদৃষ্টের পরিহাস। সেই অদৃষ্টের পরিহাসেই চৈতালী সুলক্ষণার আশ্রয় ত্যাগ করে এসে জলে ডুবল না, আগুনে পুড়ল না, রেল লাইনে মাথা পাততে গেল না। বরেনের কাছে আশ্রয় চাইল!

.

শচীন মজুমদারের যখন শেষ হল, বরেন তখন নিতাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একদিন এসে উঠেছিল দমদমের এই উদ্বাস্তু কলোনিতে। অনেক চেষ্টায় এ ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল চৈতালী। গিয়ে পৌঁছতেও অনেক কষ্ট পেয়েছিল। তাই প্রথম দর্শনেই বলে উঠেছিল, সব আগে, কোন কথা বলার আগে এক গ্লাস জল দাও দিকি। খুব ঠাণ্ডা! নাকি জল-পাত্তরই নেই? রাস্তার কলে জল খাও?

বরেন তাড়াতাড়ি করে ঘরের ভেতর থেকে একটা পাটা মোটা কাঁচের গ্লাসে করে এক গ্লাস জল এনে নীরবে এগিয়ে দিয়েছিল। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি, কোন আকুলতা দেখায় নি, কৌতূহল ব্যক্ত করেনি।

চৈতালী গ্লাসটাকে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে ঠিক আছে বলে এক নিঃশ্বাসে জলটা নিঃশেষ করে গ্লাসটা বরেনের হাতে ফিরিয়ে দেয়, তারপর বলে ওঠে, কই বসতে বললে না?

বরেন অনেক আত্মস্থ হয়ে গেছে, অনেক স্থির ধীর। তাই শান্ত গলায় বলেছিল, বসবার যদি হয়, বসবেই জানি। আর যদি না বসবার হয়, বলে লাভ নেই তাও জানি।

হু, বুদ্ধিটা তো বেশ পরিষ্কার পরিষ্কার লাগছে, তাহলে দাও একটা কিছু, বসে পড়ি। কিন্তু অবহিত থেকো, বসতে পেলেই শুতে চাইব, খেতে চাইব।

বরেন ঘর থেকে একটা নীচু জলচৌকী এনে পেতে দিয়ে বলেছিল, সবই চাইতে পার।

হু! বলে চৌকীটায় বসে পড়ে চৈতালী এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, তারপর খাপছাড়া বলে ওঠে, বাবার খবর জানো?

বরেন মাথা কাৎ করে সম্মতি জানিয়ে বলে, হাসপাতালের বাইরে থেকে খবর নিয়ে এসেছিলাম।

এখানে চলে এলে কবে?

ওই একদিন!

চৈতালী কী আবার তার পুরনো জীবনে ফিরে যেতে চায়? তাই তার সেই পুরনো পরিবেশের সন্ধান করে?

নিতাইকাকা কোথায়?

জানি না।

তাই নাকি? তার মানে ঝগড়া? তা চেহারাটা তো দেখছি আরও লক্ষ্মীছাড়া লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছে, বিয়ে করনি? ·

বরেন চৈতালীর এই অকারণ ব্যঙ্গে জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, না।

কেন?

হয়ে ওঠেনি।

হয়ে ওঠেনি? শুধু হয়ে ওঠেনি বলে? কেন, বাঙলা দেশে কি পাত্রীর এতই আকাল পড়েছে?

.

বরেন সহসা কোন উত্তর দেয় না। শুধু নীরবে তাকিয়ে থাকে এই নিষ্ঠুর কৌতুকময়ীর দিকে। অকারণ এই আঘাত কেন?

কোথায় ছিল এতদিন এই নিষ্ঠুরা রুদ্রাণী?

হঠাৎ এই মূর্তি নিয়ে আবির্ভাবের কারণ কি?

এতদিন পরে কি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে এল ও?

হ্যাঁ হত্যাই সে বলেছিল।

বরেনের মনে আছে। নিতাই যখন বলেছিল, টাকার জোগাড় করতে পারিস তত তোর বাপের চিকিচ্ছে হবে। ডাক্তারে বলে দিয়েছে।

তখন ক্রুদ্ধ মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ঠিক আছে, এনে দেব ইনজেকশনের দাম। কিন্তু বাবা যদি না বাঁচে, তোমাদেরও আর এই ধরাধামে টিকে থাকতে হবে না।

নিতাই ক্যাবলা হাসি হেসেছিল, বাঃ, আমরা কী চোরদায়ে ধরা পড়লাম? আমাদের কী দোষ?

রুদ্রাণী গর্জে উঠেছিল, জান না তোমাদের কী দোষ? কে খুন করেছে আমার বাবাকে? দিনে দিনে তিলে তিলে তোমরাই করেছ খুন। সভ্য ভদ্র শান্ত ভাল একটা মানুষকে খুন করে ফেলে, তার জায়গায় একটা ভূতকে প্রতিষ্ঠা করেছ। তোমাদের কবলে না পড়লে, এমন করে খুন হতে হত নাকি বাবাকে?

ভরাসন্ধ্যাবেলা ঝটকা মেরে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন চৈতালী, আর তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। বরেন বলেছিল, ও সব ঝগড়া টগড়া ছল, বুঝল বাবার হয়ে গেছে, তাই মনের মানুষের সঙ্গে কেটে পড়েছে।

বিশ্বাসের সঙ্গে বলেনি বরেন, তর্কের মাথায় বলেছিল। কিন্তু মেয়েটা যে গেল কোথায়, তা ও ঠিক করতে পারেনি।

.

সেই তারপর এই আজ।

পরনে তার সেই সেদিনের সাজ, হা সেই চেহারাটা একেবারে মনে আঁকা আছে বরেনের। শুধু সেদিনের সেই রোগা পটকা মেয়েটা, আজ যেন স্বাস্থ্যের জোয়ারে ভরা গঙ্গা। মুখটা শুকনো, অথচ কেমন যেন অস্বাভাবিক প্রখর।

প্রতিশোধ নেবার উপযুক্ত হয়ে ওঠবার বাসনাতেই কী এতদিন কোনখানে বসে শক্তির সাধনা করছিল চৈতালী?

.

ঠিক এমন ভাবে ভাবতে না পারলেও এই রকমই একটা কিছু ভেবেছিল বরেন। আর নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে দেখছিল সেই মুখরার দিকে।

চৈতালী আবার বলেছিল, তা পাত্রীর যদি আকাল পড়ে থাকে তো বল আমিই একগাছা বরমাল্য গেঁথে ফেলি। কী বল! রাজী আছ? রাজী না থাকো তো তাও বলে ফেল!

বরেন রুষ্টকণ্ঠে বলেছিল, কোথায় তুমি ছিলে এতদিন তা জানি না, আবার এতদিন পরে এসে হঠাৎ এমন কাটার চাবুক মারছ কেন, তাও বুঝছি না। সবটাই তো গোলকধাঁধাঁ লাগছে।

চৈতালী হেসে উঠেছিল।

বাঃ, তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছ বরেন। ঠিক বলেছ, গোলকধাঁধাঁ! গোলক ধাঁধাঁ। ওর মধ্যে পড়েই ঘুরে মরছি আমরা। এই মনে হচ্ছে সশরীরে স্বর্গে গিয়ে উঠলাম বুঝি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি–আরে দূর! যে নরক, সেই নরক। যাক, এত কথা তুমি বুঝবে না। মোট কথা, তোমার বাসায় একটু জায়গা চাইতে এসেছি, দাও তো থাকি।

.

বরেনও বুঝি তখন গোলকধাঁধাঁর ফেরে পড়ে ভেবেছিল, স্বৰ্গই বুঝি পেলাম! নাকি অতটা মুখ নয় সে?

তবু রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিল সে, তোমার বাবা আমার হাতেই তোমাকে দেবে ভেবে রেখেছিল কিন্তু আমি পাগল নই চৈতালী! আমাকে তুমি যদি

এই দেখ! লোকটা কাঁদতে বসল। আরে বাবা, আমিও তো সেই পিতৃইচ্ছে পালন করতেই

চৈতালীও কথা শেষ করতে পারেনি সেদিন। তবু থেমে গিয়েছিল। শুধু কদিন পরে একদিন বলেছিল, বাপ-মা মারা গেলে এক বছর কাল-অশৌচ থাকে, তাই তো বরেন?

মেয়েদের বেলায় তা হয় না, সেকথা বলেনি বরেন, চুপ করে থেকেছিল।

.

তারপর চৈতালী এই কলোনির মধ্যে একটা বর্ণপরিচয়ের পাঠশালা খোলবার তোড়জোড় করেছিল। বলেছিল, এখন থেকেই তো আর তোমার অন্ন ধ্বংসাতে পারি না। যা হয় একটা কিছু করতেই হবে।

তাছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেলাইয়ের অডার আনতে সুরু করে চৈতালী। কলোনির খদ্দেরদের যার যতটুকু প্রয়োজন। তবু তা থেকে একটা পেট নিশ্চয়ই চলে যাবে। রাজভোগে না হোক, শাকভাতে তো হবে।

.

কিন্তু কেন?

কেন চৈতালীর এই নির্বাচন?

মরতে ভয় পেল কেন চৈতালী? সেটাই তো সম্ভ্রমের ছিল। বরেনের কাছে এসে আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে শ্রেয় ছিল না কি সেটা? বেঁচে থাকবার দরকার কী ছিল চৈতালীর?

হয়তো তাই ছিল।

কিন্তু মানুষের মন বড় জটিল বস্তু। হয়তো সেই মরা আর এই বাঁচার মধ্যে কোন প্রভেদ খুঁজে পায়নি চৈতালী। তাই তার চিরদুঃখী বাবার গোপন বাসনাটুকু নিজের মধ্যে সে পূর্ণ করতে চেয়েছিল।

.

অথবা তা নয়।

এ চৈতালীর নিজের ওপর প্রতিহিংসা গ্রহণ। যেন তীব্র ধিক্কারে বলে ওঠা, বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছিলি তুই! হয়েছে তো তার শাস্তি। বিধাতার লৌহদণ্ড এসে ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে তো সেই হাত!

এখন মাটিতে মুখথুবড়ে ধুলো খা! সেটাই তোর উপযুক্ত!

বরেনকে ঘেন্না করতিস তুই?

কেন?

কিসের জন্যে?

বরেনই তোর যোগ্য বর। খুঁটেকুড়নীর আবার রাজরাণী হবার শখ!

আত্মহত্যার এই অভিনব পথটাই হয়তো গ্রহণ করেছিল চৈতালী, প্রতিহিংসা চরিতার্থের অমোঘ উপায়।

বিয়ে করে যুগলে একবার ও-বাড়ি বেড়িয়ে এলে কেমন হয়? কেমন হয় সুদক্ষিণাকে দিদিমণি আর তার সেই ভাইকে দাদাবাবু বলে সম্বোধন করে পেন্নাম করতে গেলে?

আর আর–সেই তাদের আদরের আদরিণী বৌয়ের কাছে?

বখশিশ চাইবে?

বলবে নাকি, বিয়ে-থা তো করলাম বৌদিদি, একটু বখশিশ মিলবে না?

.

ঈশ্বর জানেন, চৈতালীর ঈশ্বর জানেন, কোন চিন্তায় কী করেছিল চৈতালী। তবে তার ঈশ্বর একটা রক্ষা করেছেন, কাল অশৌচের কাল এখনো তার শেষ হয়নি।

বরেন এখন শুধু তার খিদমতগারি করে চলেছে।

.

সত্যিই বরেন বেরিয়ে আসে ভেতরকার একখানা কাঁচা বেড়ার ঘরের মধ্যে থেকে। কৌশিকের দিকে একটা নীচু জলচৌকী এগিয়ে দিয়ে বলে, বসুন। বুঝতে পেরেছি আপনি কে! ভেবেছিলাম লুকিয়ে আপনাদের কাছে খবর দেব, কিন্তু ওর মরা বাপের নামে ও দিব্যি দিয়ে রেখেছে।

কৌশিক নিতান্ত হতভাগা চেহারার এই লোকটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে, আপনি?

আমি?

বরেন যেন বাইরের রোদে ভরা আকাশের কাছে নিজের পরিচয় খোঁজে। তারপর বলে, আমি–মানে, আমাকে ওর ভাই বলেই জানবেন। ওর বাবাকে আমি কাকা বলতাম।

চৈতালীকে কি ভূতে পেল?

তাই চৈতালী আবার হাসছে।

হিস্টিরিয়া রোগীর মত!

বল কি বরেন? কালাশৌচ পার হলে তোমাকে যে আমি বিয়ে করব বলেছিলাম! খামোকা তুমি আমার ভাই হয়ে বসলে? আমি কি করব গো।

চৈতালী, পাগলামী করো না!

হতভাগা বরেনও ধমক দিচ্ছে চৈতালীকে। তবে আর কি করে হাসি বজায় রাখবে চৈতালী? তবে কেন হঠাৎ পাথর হয়ে যাবে না সে?

কৌশিক আস্তে বলে, চৈতালী, অপরাধের শাস্তি থাকে জানি, কিন্তু তার মাত্রাও থাকে। মার অবস্থা যদি দেখো

চৈতালী নীরব।

চৈতালী, চল!

চৈতালী আবার কেমন একরকম বিচিত্র হাসি হেসে বলে ওঠে, তোমার তো সাহস কম নয়। কে বলতে পারে–চুড়ির পর এবার সাতনরী হার কিনা!

চৈতালী চুড়ির মালিক আর নেই!

কী-কী বললে? চৈতালী চমকে ওঠে, শিউরে ওঠে, চেঁচিয়ে ওঠে।

হ্যাঁ চৈতালী! তুমি যেদিন চলে এলে সেই রাত্রেই

কৌশিক, এ কী তুমি আমায় শাস্তি দেবার জন্যে বানিয়ে বলছ?

চৈতালী সত্যি!

আমায় মাপ কর কৌশিক। আমার নিষ্ঠুরতার জন্যে, নির্লজ্জতার জন্যে, বাঁচালতার জন্যে মাপ চাইছি আমি।

কে কার কাছে মাপ চাইবে, সে কথা থাক চৈতালী, চল, গাড়ি আছে সঙ্গে।

কৌশিক, তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি ছেলেমানুষ, হয়তো এই ঠিক হয়েছে। বিধাতার নিয়ম উল্টে দিতে চাইলে এই রকমই হয় হয়তো। যাকে যেখানে মানায় না–

মানায় না!

কৌশিক বুঝি এবার তার স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে। তাই কৌশিক হেসে উঠে বলে, মানায় না মানে? চোরকে জেলখানাতেই মানায়! বারে বারে কি তুমি চুরি করে পার পাবে? সুলক্ষণা দেবীর লোহার সিন্ধুকের সবচেয়ে দামী মালটিই চুরি করে এনেছ, ভুলে যেও না সে কথা!

কৌশিক, বেচারা বরেনকে আমি আশা দিয়েছিলাম।

বরেন কি একটা অস্ফুট প্রতিবাদ করে ওঠে।

কৌশিক মৃদু হেসে বলে, তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আমি ওঁকে শালা বলব?

শালা!

হ্যাঁ, তাই তো। নিয়মমত! তুমি তো নিয়মকানুনেরই ভক্ত।

কৌশিক তোমার এই স্বভাবই আমার কাল। এইতেই আমার মাথা খেয়েছ তুমি।

যাক বাঁচা গেল! মাথাটা খেতে পেরেছি, তার স্বীকৃতি পেলাম তাহলে! কিন্তু আর দেরী করা যাচ্ছে না চৈতালী!

কিন্তু কৌশিক বড় ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেখানে বৌদির সেই বড় বড় আর ভয়ঙ্কর দুটো চোখ

ভয় করলে চলবে না চৈতালী। জগতের সমস্ত চোখকে অস্বীকার করব, এই তো আমার পণ। যেখানে যত চোখ আছে, তাদের ভয় করতে করতে যে নিজেদের চোখের মাথা খেয়ে বসি আমরা। সত্যের চোখ, ন্যায়ের চোখ, বিচারের চোখ। যাক্ তর্ক রইল সারা জীবনের জন্যে, এখন বিনা তর্কে পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে এস দিকি!

কৌশিক, তা হয় না, চৈতালী আস্তে বলে, আজ হয় না। আমাকে ভাবতে দাও, সময় দাও–

সময় তো অনেক নিলে চৈতালী।

না কৌশিক, সময় আমি নিইনি, শুধু নিজেকে নিয়ে সরে এসেছিলাম। আবার যদি যাই, নিজেই যাব।

এটা তো তাড়িয়ে দেওয়ার কথা, ফিরিয়ে দেওয়ার কথা।

না কৌশিক, ভুল বুঝো না, শুধু ভিক্ষে চাইছি, মনটাকে একটু প্রস্তুত হতে দাও।

যদি না দিই, যদি লুঠ করে নিয়ে যাই?

বরেন এদের কথার মধ্যে যেন খাপছাড়া ভাবে বলে ওঠে, তাই নিয়ে যান, নইলে ও যা মেয়ে, আবার পালাবে, আবার লুকিয়ে পড়বে।

চৈতালী মৃদু হেসে বলে, বেশ তো, তাহলে ও আবার খুঁজে বেড়াবে। বোঝা যাবে চাহিদাটা কত জোরালো।

ঠিক আছে। কৌশিক বলে, চাহিদার জোরটাই পরীক্ষা কোরো, তবু বিশ্বাস করব তুমি নিজে থেকে যাবে।

যদি যাই তাই যাব কৌশিক। তোমার সঙ্গে সমারোহ করে গাড়ি চড়ে গেলে মার কাছে মুখ দেখাব কি করে! ভিখিরির মেয়ে, ভিখিরির মতই গিয়ে দাঁড়াব মার কাছে।

ভিখিরির মেয়ে এইটাই শুধু তোমার পরিচয়?

চৈতালী মৃদু হেসে বলে, আর যা পরিচয় থাক না আড়ালে, সে তো রইলই, স্ট্যাম্প কাগজের পাকা দলিল।

সেদিন সে কথা মাননি চৈতালী!

ভুল করেছিলাম। আজ মানলাম।

Exit mobile version