এরা সবিস্ময় দৃষ্টিতে লক্ষ্য করল ওর পরনের শাড়ীটি বড় বেশী চেনা।
সুলক্ষণার শাড়ী। চওড়া বেগুনী চুড়িপাড়।
যে সব এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে আলমারির নীচের তাকে, তারই একখানা। ওই সব অপয়া শাড়ী বৌকে মেয়েকে তিনি কোনদিন পরতে দেননি। ওরাও কোনদিন ভাবেনি, মা যেগুলো আর পরতে পাবেন না সেগুলো ওরা পরবে।
কিন্তু ওই সুন্দর পাড়ের শাড়ীটার এই গতি দেখে মেয়ের গায়ে জ্বালা ধরল, বৌয়ের চোখে জল এল। ছেলেরা অবশ্য ঠিক ধরতে পারল না, শাড়ীটা কার। তবে অনুমান করল মা ফর্সা শাড়ী সাপ্লাই করে ওকে সাজিয়ে-গুছিয়ে জাতে তুলেছেন।
মেয়েটা যে দেখতে একেবারে ভদ্রলোকের বাড়ির ভালো মেয়ের মত সেটা আজও আবার নতুন করে অনুভব করল এরা।
সুলক্ষণা বললেন, ওরে, ওইখানে মরিচের গুঁড়োর শিশিটা আছে, দিয়ে যা তো!
ভাতটা খাওয়া হয় নীচের দালানে, চা-টা দোতলায়। তাই চায়ের ব্যাপারে একটু আসা যাওয়া করতেই হয়।
সুদক্ষিণা বিরক্ত হয়ে বলে, ওই দৃষ্টিসুখকর জীবটিকে বারবার আর নাই বা সামনে আনলে মা।
সুলক্ষণা মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইলেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, ছি ক্ষেণু, ছোট হসনে। মনে রাখিস ও তোদের আশ্রিত-র পর্যায়ে পড়ল। তবে টিকে যদি থাকে, মাইনেও দেব। ওর একটা দাবি জন্মাবার জন্যেই দেব।
অর্থাৎ একখানি সুসভ্যা রাঁধুনী লাভ করছ তুমি– কৌশিক বলে, রাঁধুক তাতে ক্ষতি নেই, কাউকে কামড়ে-টামড়ে দিতে না এলেই হল।
সুলক্ষণার চোখের ইশারা, কৌস্তুভের অস্বস্তি প্রকাশ, সব ব্যর্থ করে দিয়ে কথাটা সম্পূর্ণ করল কৌশিক, চৈতালীর উপস্থিতিতেই। কারণ মরিচের গুড়োর শিশি নিয়ে সে তখন ঠিক কৌশিকের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
না শোনার ভান করা যায় না।
সুলক্ষণা বলে উঠলেন, তুই যদি সব সময় ওকে ওরকম ক্ষ্যাপাস তবে তো ওর আমার কাছে থাকাই চলে না রে।
এ সুরে কাজ হল।
কৌশিক অপ্রতিভ হল। রীতিমতই হল। পেছনে ওর উপস্থিতিই একটু বিচলিত করেছিল। যতই নিন্দনীয় ইতিহাস থাক, সভ্য-ভব্য দেখতে আস্ত একটা তরুণী মেয়েকে সমীহ একটু না করে পারা যায় না। তাছাড়া, আড়ালে কথা বলারও একটা লজ্জা আছে।
কৌশিক মেয়েটার আপাদমস্তক দেখে নেয়। দেখে, সেখানে কি প্রতিক্রিয়া।
কিন্তু কই?
কিছুই তো না।
একেবারে ভাবশূন্য মুখ। গতরাত্রে চোর অবস্থায় ধরা পড়েও যে মেয়ে ফোঁস করে উঠেছিল, তার পক্ষে এটা আশ্চর্য!
কী এ?
সর্বংসহার সাধনা? সুলক্ষণা তাহলে এইটিই বুঝিয়েছেন পড়িয়েছেন ওকে, আমার ছোট ছেলেটা অতি অসভ্য, তার কথাবার্তায় কিছু মনে কোরো না তুমি।
ধ্যেৎ, বড় বিশ্রী হয়ে গেল।
তবে কি না লজ্জায় পড়ে গেছি, এটা প্রকাশ করাও আবার বেশী লজ্জা। তাই কৌশিক সেটা অপ্রকাশিত রেখে মার কথার উত্তর দেয়, নতুন করে আর ক্ষ্যাপাবার কি আছে? আমার তো ধারণা ছিল ওই কামড়-টামড়গুলো, ইয়ে, মানে–ওই আর কি ইয়েরই লক্ষণ কিন্তু তুমি যখন বারণ করছ, এ প্রসঙ্গে ইতি। বাড়িতে ডেটল কিছু বেশী করে মজুত রাখা ছাড়া
এমন ভাবে মাথা চুলকোয় কৌশিক যে মনে হয় সত্যিই বিশেষ চিন্তায় পড়েছে।
.
এই ছেলেটার জন্যেই সুলক্ষণার মন আর সংসার এত দুঃখেও সর্বদা আনন্দোজ্জ্বল। কথা দিয়েই ভরিয়ে রাখে ও চারপাশের সমস্ত শূন্যতা।
নইলে দুঃখ কম সুলক্ষণার?
নতুন বাড়িটি তৈরি করে পুরো একটা বছরও ভোগ করতে পারেননি স্বামী। নতুন পাড়ায় এসে পড়শিনীদের সঙ্গে সবেমাত্র পরিচয় হতে না হতে সুলক্ষণার বৈধব্যের লজ্জা। হ্যাঁ, লজ্জা বৈকি। শোকের চেয়ে লজ্জাই বেশী। আর লজ্জার দাঁত যে শাকের চেয়ে অনেক বেশী ধারালো।
তা ছাড়া বড়ছেলেটার ওই বরবাদ-যাওয়া জীবন। বৌয়ের সেবা করা, বৌয়ের তাওত করা ছাড়া আর কোন কিছুই রইল না কৌস্তুভের। ডাক্তার বলেছে, এ এক বিশেষ রোগ, রক্ত তৈরী হয় না ভেতরে।
অতএব, চিরদিনই রক্তশূন্যতায় ভুগবে অপর্ণা।
এর থেকে মুক্তি মানে মৃত্যু।
সে তো আরও ভয়াবহ। সে দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখাই মানবিকতা।
সুদক্ষিণার জন্যেও কত চিন্তা।
ওর বাপ থাকলে দায়িত্ব অর্ধেক হত সুলক্ষণার।
কিন্তু মায়ের মনের এই ভারগ্রস্ত অবস্থাকে কৌশিক যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়। সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে না পারুক, ও যে চেষ্টা করছে, তাতেই অনেকটা ভার লাঘব হয়।
সুলক্ষণা জানেন চৈতালীকে যতই ঠাট্টা-উপহাস করুক কৌশিক, ঘৃণা করবে না। মানুষকে ঘৃণা করার কথা ভাবতেই পারে না ও! সেই তো ভরসা সুলক্ষণার, সেই তো বুকের বল। মনের একেবারে ভেতরের ঘরের খবর নিলে দেখা যেত, কৌশিকের দরদের ভরসাতেই ওই চোর মেয়েটাকে এত সহজে বাড়িতে জায়গা দিতে সাহস করলেন সুলক্ষণা।
সুলক্ষণা দেখলেন, চৈতালী কৌশিকের মাথা চুলকোনোয় হাসি চেপে সরে গেল। সুলক্ষণাও হাসি চাপলেন।
সুদক্ষিণা মায়ের সেই ছোট হওয়ার কথায় অভিমানক্ষুব্ধ হলেও একটা কথা ভেবে হঠাৎ একটু সহৃদয়তা বোধ করল। এরকম একটা মেয়ে বাড়িতে থাকা মন্দ নয়। নেহাত ঝিও নয়, অথচ ঝিয়ের চেয়ে বেশী সম্মান দিতে হবে না, এটা বেশ। মায়ের কিছুটা ভার লাঘব হবে। কাজ কমলে মাকে বেশীক্ষণ পাওয়া যাবে।
আত্মীয়-টাত্মীয় থাকা সুবিধের নয় বাবা।
দেখেছে ওর বাবার অসুখের সময় পিসিমাকে আসতে। সুলক্ষণা একা পেরে উঠবেন না। বলেও নয়, সম্পর্কের দাবিতেই এসেছিলেন। কিন্তু তিনি আর তার দুই মেয়ের প্রয়োজনের দাবি মেটাতে মেটাতেই সুদক্ষিণার প্রাণান্ত হয়েছিল।