তা কথাটা সত্যিই।
বিধবা হবার পর কাসা আর কাঁচের বাসন ত্যাগ করে পাথর ধরবেন ভেবেছিলেন সুলক্ষণা, পাথর ধোপে টিকল না। বিয়ের সময় দানে পাওয়া সেই ভাল ভাল রুলোর বাসনের সে বার করে নিলেন। বললেন, এই পর্যন্ত সিন্দুকের জায়গা জোড়া করে তুলেই রেখে এসেছি, যাঁর জিনিস তিনি তো কোনদিন ভোগ করতে পারেননি। আমিই করে যাই শেষবেলায়।
জানলা দিয়ে দেখা যেত সেই বাসনের শেল্টা। চৈতালীর বাবা মেয়েকে বলত, কী রকম বাহার দিয়ে রাখে দেখেছিস? যাব একদিন। কে যাওয়াবে তা অবশ্য বলত না। একথাও বলেনি যাওয়াবার ভারটা তুই নে না।
বলেনি, তবু সে ভার নিতে এসেছিল চৈতালী।
কিন্তু স্বপ্নেও ভেবেছিল কি এ রকম একটা পরিণতি হবে?
অথচ হয়েও গেল।
বইয়ে পড়া গল্পের মতই ঘটে গেল ব্যাপারটা।
.
আচ্ছা, সুলক্ষণাও কি পরীক্ষা করতে নামলেন, বইয়ে পড়া মনস্তত্ত্ব সত্যিকার মানুষের ব্যাপারে ঘটানো যায় কি না? পরীক্ষা করতে নামলেন, মানুষ সত্যিই অমৃতের সন্তান কি না?
নাকি কারণটা একেবারেই স্থূল?
শহরতলির এই পাড়াটায় এসে পর্যন্ত লোক জোটানো যে কী বিড়ম্বনা সেটা অনুভব করে করে এবং বুড়ো বংশীটার কষ্ট দেখে, এই ঝুঁকিটা কি নিয়ে ফেললেন?
সুলক্ষণার কথা সুলক্ষণাই জানেন। ওঁর খোলা মেলা আবরণের অন্তরালে যে চাপা একটি সত্তা আছে, সে নিতান্তই কঠিন প্রকৃতির। তাই সুলক্ষণার মনের কথা সঠিক বোঝা শক্ত।
তবে সকালবেলা চায়ের টেবিলে ছেলেমেয়ের কাছে শেষোক্ত কারণটাই পেশ করলেন তিনি। বললেন, দেখিই না। সত্যিই তো তেমন কারে পড়লে রাস্তা থেকে একটা অজানা অচেনা জোয়ান লোককেও ডেকে কাজ করাতে হয়, বাড়িতে জায়গা দিতে হয়। এ তো কম বয়সী একটা মেয়ে মাত্র। সুদক্ষিণার চাইতে দুতিন বছরের বড় হয়তো ঢের।
কিন্তু শুনে প্রথমটা ওরা—
আচ্ছা একেবারে প্রথম থেকেই তবে বলা যাক।
.
একেবারে সকালবেলা সুলক্ষণাকে দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ সেটা তাঁর পুজো করার সময়। প্রথম দেখা মেলে চায়ের টেবিলে। টেবিলে আজ সবাই। অপর্ণাও!
এসে বসতেই কৌশিক বলে ওঠে, তারপর মা, তোমার কালকের অ্যাডভেঞ্চার কতদূর গড়াল? অপরাধীর জীবনকাহিনী লিপিবদ্ধ করে নিলে নাকি? যেভাবে নির্জনে ওকে নিয়ে গিয়ে গুছিয়ে বসলে।
সুলক্ষণা পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে হেসে বললেন, ভুল হয়ে গেছে। খাতাকলম যদি দিয়ে যেতিস একটা।
সত্যি মা, তুমি অপূর্ব।
শুধু অপূর্ব সুদক্ষিণা বলে ওঠে, একেবারে অভূতপূর্ব। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম সকালবেলা তোমাকে রক্তাক্তকলেবরে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পাব।
সুলক্ষণা হঠাৎ হেসে উঠলেন, ওই ধারণাটুকু মনে গেঁথে নাকডাকিয়ে ঘুমোলি তো সারারাত্তির?
তা কি করব? তুমি যেভাবে আমাদের বিতাড়িত করলে। সে যাহোক, তারপর মহিলাটি বিদায় গ্রহণ করলেন কখন? মানে, কতক্ষণ তুমি
কথার মাঝখানেই বলেন সুলক্ষণা, গেল কই? যায় নি তো! রয়েছে!
যায় নি তো!
রয়েছে!
রয়েছে মানে কি?
চার-চারটে মানুষই একযোগে চমকে উঠল। আর অপর্ণা কাদো কাদো গলায় বলে উঠল, এখনো আছে? দরজায় তালা লাগিয়ে রেখেছেন তো?
অবিরত ভুগে ভুগে অপর্ণার স্নায়ুগুলো এমন শিথিল হয়ে গেছে যে, এতটুকু ভাবের বেগও বইবার ক্ষমতা নেই তাদের! ভয় বিস্ময় ব্যাকুলতা উৎকণ্ঠা উদ্বেগ কোন কিছুর ছোঁয়া লাগলেই চোখে জল এসে যায়।
তাই রাত্রের সেই চোরাঙ্গনাকে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে কি না প্রশ্ন করতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে ওঠে সে।
সুলক্ষণা যেন দেখেননি সেই অশ্রুবাষ্প, তাই নেহাৎ সহজ ভাবে বলেন, ওমা, তালা লাগিয়ে রাখব কি! তাকে যে আমি কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।
কাজে লাগিয়ে!
ছেলেমেয়ের সঙ্গে একটা পরিহাস করছেন সুলক্ষণা?
বিশ্বাসযোগ্য?
তাই আবার ওরা একযোগে একই কথা বলে ওঠে, কাজে লাগিয়েছ?
হ্যাঁ রে। যে কষ্ট যাচ্ছে বংশীটার। লোক তো এ পাড়ায় দুর্লভ রত্ন! তাই ওটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দিলাম কাজে লাগিয়ে। সেই তো আজ রাঁধছে। বংশী তো বাজারে গেছে!
মা!
কৌশিক বলে ওঠে, ভাবছি তুমি পাগল হয়ে গেছ, না আমরা পাগল হয়ে গেছি?
সুলক্ষণা কিছু বলার আগে সুদক্ষিণা বলে, না তার চেয়েও বেশী কিছু ঘটেছে। পাগলামিরও একটা সীমা থাকে, ও নিশ্চয় কিছু তুকতাক করেছে।
হ্যাঁ, মায়ের সঙ্গে এ ধরনের কথা চালায় ওরা। সে প্রশ্রয় আছে।
সুলক্ষণা এসব বিষয় গায়ে মাখেন না। বলেন, তিলকে তাল করছিস তোরা। কারে পড়লে তো রাস্তা থেকে একটা
এতক্ষণ পরে গম্ভীরপ্রকৃতি বড়ছেলে একটা কথা বলল। বলল, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না মা, হঠাৎ এরকম একটা ডিসিশান নিলে কেন তুমি?
নিলাম কেন?
কৌস্তুভের প্রশ্নে একটু যেন সিরিয়াস হলেন সুলক্ষণা। বললেন, ভাবলাম দেখি না রিস্ক নিয়ে। অভাবে পড়ে কুসঙ্গে পড়ে কত হাজার হাজার মানুষই তো নষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি, একটা মানুষকেও বাঁচানো যায় কিনা, বদ-অভ্যাস তাকে একেবারে শেষ করে ফেলেছে কিনা।
আলোচনায় হঠাৎ ছেদ পড়ল।
সিঁড়ির সামনে একটা সাদা শাড়ীর কোণ দুলে উঠল, একটু বাসন-পত্রের শব্দ হল।
ও, এনেছিস?
সুলক্ষণা বলেন, চিড়ে ভাজতে দিয়ে এসেছিলাম চায়ের সঙ্গে খাবি বলে তোরা। কই আয় না এদিকে, দিয়ে যা!
সামান্য বোধহয় ইতস্ততের ভূমিকা অভিনয় করল মেয়েটা, তারপরই বেশ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এসে পাত্রটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে গেল।