মা নয়, মা নয়, সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, মাসীমা। আমার ওই ছোট ছেলেমেয়ে দুটো বেজায় হিংসুটে, মা বলতে শুনলে হিংসেয় সারা হবে।
তারপর তিনিও ঈষৎ গাঢ় স্বরে বলেন, দেখ, আমি শুধু ভগবানের নাম স্মরণ করেই এই দুঃসাহস করতে চাইছি। হয়তো এর জন্যে সংসারে আমায় কিছু লড়তে হবে। দেখি কি হয়? তবে মনে রাখিস, তোর ভগবানও তাকে সুযোগ দিচ্ছেন। খারাপ হতে এক মিনিটও লাগে না, ভাল হতে অনেক সময় দরকার। সে সময় আমি তোকে দেব। দেখব আমার অঙ্ককষা ভুল হল, না ঠিক হল। আজ তোকে আটকাব না, যদি ইচ্ছে হয়, যদি ভয়ঙ্কর কোন কুগ্রহ তোর বাধা না হয়, আসবি আমার কাছে
চৈতালী ব্যাকুল স্বরে বলে, আমি আজ থেকেই থাকব। যাব না।
থাকবি? তা থাক তবে!
.
হ্যাঁ, থেকেই যায় চৈতালী।
দেখবে ভগবান তাকে সুযোগ দিলেন, না দুর্যোগ দিলেন। বাপ তো হাসপাতালে, নিতাই নামক সেই লোকটা, যাকে চৈতালী বাবার বন্ধু হিসাবে নিতাই কাকা বলে এবং মনে মনে জানে সে তার বাবার পরম শত্রু–সেই তার বাবাকে উচ্ছন্নে দেবার গুরু–সেই নোকটা কাল এসে বলেছে, ডাক্তার জানিয়েছে অবস্থা সংকটজনক, তবে খরচা দিলে ইনজেকশন আর রক্ত দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারে।
চৈতালী ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, তা কর সে সব?
নিতাই পরম অবহেলায় বলেছিল, কোথা থেকে? হাসপাতালে যাবার সময় কি তোর বাবা আমার হাতে একমোট টাকা দিয়ে গেছে?
চৈতালীও অবশ্য এমন কিছু নরম শান্ত মেয়ে নয়।
সেই আট-দশ বছর বয়েস থেকে বাবার ব্যবসার মাল এহাত-ওহাত চালান করে করে পোক্ত হয়েছে, আর রাতদিন বাড়িতে যে নানাবিধ লোকের আমদানী হয়েছে, তাদের আড্ডা শুনে, তর্কাতর্কি শুনে, আর তাদের জন্যে চা বানিয়ে হাতে কড়া পড়িয়েছে।
কাজে কাজেই কথাও তার কড়া কড়া।
সেই কড়া সুর আর কড়া ভাষায় প্রশ্ন করেছিল সে এযাবৎ যে চৈতালীর বাবা ব্যবসা করছিল নিতাইয়ের সঙ্গে একযোগে, সে ব্যবসার কি হল? বাবা হাসপাতালে যাবার সময় টাকার মোট না হয় না দিয়ে গেছে, ব্যবসাটাও তো তেমনি নিয়ে যায়নি। তার আয়?
তার উত্তরে নিতাই চৈতালীকে যথেচ্ছ গালাগাল দিয়ে বলেছে, সেই আয়ের উপসত্ব যদি আদায় করতে চায় চৈতালী তো আদালতের সাহায্য নিক গিয়ে। আর বাপকে যদি বাঁচাতে চায় তো, যেখান থেকে হোক টাকা জোগাড় করে এনে দিক!
প্রথমটার থেকে শেষেরটাই আগে দরকার ভেবে মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল চৈতালী। খুব একটা নতুন কিছু নয়, ছেলেবেলায় এ ধরনের কাজ অনেক করেছে। ট্রামে বাসে ট্রেনে রেস্তোরাঁয় পাড়ার লোকের বাড়িতে, সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াত বাবা, আর বলত, ওর বুকপকেট থেকে কলমটা তুলে নিতে পারিস? প্যান্টের পকেট থেকে মনি-ব্যাগটা? পারিস কাছ ঘেঁষে বসে টুক করে ঘড়িটা কেটে নিতে? দেখি তো কেমন বাহাদুর মেয়ে?
চৈতালী বলত, এ তো চুরি! বাবা, তুমি আমায় চুরি করা শেখাচ্ছ?
বাবা অনেক লম্বা লেকচার দিত। মেয়েকে বোঝাত এই দুনিয়ায় সবাই চোর। রাজা মন্ত্রী পাত্র মিত্র কোটাল কাটাল কেউ বাদ নেই, একধার থেকে সবাই চুরি করে চলেছে, শুধু চুরির রকমফের মাত্র। এ তো তবু সামান্য চুরি, সাধারণ চুরি। বড় বড় জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত বিদ্বান তারা যে তলে তলে মানুষের প্রাণ মান ধর্ম বিবেক বিশ্বাস আত্মা সব চুরি করে চলেছে।
ওষুধে ভেজালের কাহিনী শোনাত বাবা ওইটুকু মেয়েটাকে, শোনাত খাদ্যে বিষাক্ত বস্তু মিশেল দেওয়ার। যেদিকে যতদূর দৃষ্টি চলে সব কিছুর কথা তুলে বিশদ ব্যাখ্যা করত, ধর্মাধর্ম পাপপুণ্য ও সব বাজে ফকিকারি। বেঁচে থাকতে হলে টাকা চাই। আর সে টাকা ছলে বলে কৌশলে যে করে হোক–
বাবার বাক্যচ্ছটায় মুগ্ধ হয়ে যেত চৈতালী। ক্রমশ ব্যাপারটা রপ্ত হয়ে গেল, এমন কি . জিনিস দেখলে নিজেরই হাত নিসপিস করত চৈতালীর। পাড়ার লোকের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে টুক করে তুলে আনত এটা-ওটা।
স্কুলেও ভরতি করে দিয়েছিল বাবা একবার, পড়েও ছিল কিছুকাল। সেখানে সহপাঠিনীদের জিনিসপত্র চুরি করে করে পয়লট্ট করতে করতে ধরা পড়ল একদিন, স্কুল থেকে দূর করে দিল।
তদবধি বাড়িতেই।
মাঝে মাঝে বাবার সব বন্ধুদের বাড়িতে চোরাই মাল পাচার করতে পাঠানো ছাড়া আর খুব কিছু করতে বেরোতে হত না।
কিন্তু বিপদ হল বাপের মাথা ফাটায়।
নাম ভাড়িয়ে ভাঁড়িয়ে আর বাসা বদলে বদলে চালাত লোকটা। প্রথমদিকে তাই ডাক্তার হাসপাতাল এসবগুলো এড়াবার চেষ্টা করেছে। তারপর এই অবস্থা।
.
সুলক্ষণাদের এই শহরতলির বাড়িটার পেছনে দিব্যি একটা পুকুর আছে, ছাত থেকে জানালা থেকে দেখতে পাওয়া যায়। আর তার সঙ্গেই দেখতে পাওয়া যায় পুকুরের ওপারে বস্তির গা ছাড়িয়ে একটা মাঠ-কোঠা। সেখানেই সম্প্রতি বাস করছিল চৈতালীর বাবা। ওখান থেকে আসতে বড় রাস্তার প্রথম বাড়িটাই সুলক্ষণার। আসতে যেতে ওদের বাড়ির নীচের ঘরের ভেতরগুলো দেখে দেখে চৈতালীর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
চৈতালী জানত দালানের শেফে ওই যে ঝকমকে বাসনগুলো সাজানো থাকে, তার মধ্যেকার রুপোর বাসনগুলোয় গিন্নী খাওয়া-দাওয়া করেন। জানতো বৌ একটা আছে, সে দৈবাৎ নীচে নামে। জানতো দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে আছে গিন্নীর। আর জানত চাকরটা কখন কি কাজ করে।
শুধু ওদের বাড়িতে যে একদিন তাকে চুরি করতে ঢুকতে হবে, সেটাই জানত না। রুপোর বাসনগুলো শুধু লক্ষ্য করেই এসেছিল। কারণ বোঝা যেত জিনিসগুলো ভারী ভারী বনেদী। আর দামও আছে এখন ওর।