.
অথবা তা নয়।
এ চৈতালীর নিজের ওপর প্রতিহিংসা গ্রহণ। যেন তীব্র ধিক্কারে বলে ওঠা, বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছিলি তুই! হয়েছে তো তার শাস্তি। বিধাতার লৌহদণ্ড এসে ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে তো সেই হাত!
এখন মাটিতে মুখথুবড়ে ধুলো খা! সেটাই তোর উপযুক্ত!
বরেনকে ঘেন্না করতিস তুই?
কেন?
কিসের জন্যে?
বরেনই তোর যোগ্য বর। খুঁটেকুড়নীর আবার রাজরাণী হবার শখ!
আত্মহত্যার এই অভিনব পথটাই হয়তো গ্রহণ করেছিল চৈতালী, প্রতিহিংসা চরিতার্থের অমোঘ উপায়।
বিয়ে করে যুগলে একবার ও-বাড়ি বেড়িয়ে এলে কেমন হয়? কেমন হয় সুদক্ষিণাকে দিদিমণি আর তার সেই ভাইকে দাদাবাবু বলে সম্বোধন করে পেন্নাম করতে গেলে?
আর আর–সেই তাদের আদরের আদরিণী বৌয়ের কাছে?
বখশিশ চাইবে?
বলবে নাকি, বিয়ে-থা তো করলাম বৌদিদি, একটু বখশিশ মিলবে না?
.
ঈশ্বর জানেন, চৈতালীর ঈশ্বর জানেন, কোন চিন্তায় কী করেছিল চৈতালী। তবে তার ঈশ্বর একটা রক্ষা করেছেন, কাল অশৌচের কাল এখনো তার শেষ হয়নি।
বরেন এখন শুধু তার খিদমতগারি করে চলেছে।
.
সত্যিই বরেন বেরিয়ে আসে ভেতরকার একখানা কাঁচা বেড়ার ঘরের মধ্যে থেকে। কৌশিকের দিকে একটা নীচু জলচৌকী এগিয়ে দিয়ে বলে, বসুন। বুঝতে পেরেছি আপনি কে! ভেবেছিলাম লুকিয়ে আপনাদের কাছে খবর দেব, কিন্তু ওর মরা বাপের নামে ও দিব্যি দিয়ে রেখেছে।
কৌশিক নিতান্ত হতভাগা চেহারার এই লোকটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে, আপনি?
আমি?
বরেন যেন বাইরের রোদে ভরা আকাশের কাছে নিজের পরিচয় খোঁজে। তারপর বলে, আমি–মানে, আমাকে ওর ভাই বলেই জানবেন। ওর বাবাকে আমি কাকা বলতাম।
চৈতালীকে কি ভূতে পেল?
তাই চৈতালী আবার হাসছে।
হিস্টিরিয়া রোগীর মত!
বল কি বরেন? কালাশৌচ পার হলে তোমাকে যে আমি বিয়ে করব বলেছিলাম! খামোকা তুমি আমার ভাই হয়ে বসলে? আমি কি করব গো।
চৈতালী, পাগলামী করো না!
হতভাগা বরেনও ধমক দিচ্ছে চৈতালীকে। তবে আর কি করে হাসি বজায় রাখবে চৈতালী? তবে কেন হঠাৎ পাথর হয়ে যাবে না সে?
কৌশিক আস্তে বলে, চৈতালী, অপরাধের শাস্তি থাকে জানি, কিন্তু তার মাত্রাও থাকে। মার অবস্থা যদি দেখো
চৈতালী নীরব।
চৈতালী, চল!
চৈতালী আবার কেমন একরকম বিচিত্র হাসি হেসে বলে ওঠে, তোমার তো সাহস কম নয়। কে বলতে পারে–চুড়ির পর এবার সাতনরী হার কিনা!
চৈতালী চুড়ির মালিক আর নেই!
কী-কী বললে? চৈতালী চমকে ওঠে, শিউরে ওঠে, চেঁচিয়ে ওঠে।
হ্যাঁ চৈতালী! তুমি যেদিন চলে এলে সেই রাত্রেই
কৌশিক, এ কী তুমি আমায় শাস্তি দেবার জন্যে বানিয়ে বলছ?
চৈতালী সত্যি!
আমায় মাপ কর কৌশিক। আমার নিষ্ঠুরতার জন্যে, নির্লজ্জতার জন্যে, বাঁচালতার জন্যে মাপ চাইছি আমি।
কে কার কাছে মাপ চাইবে, সে কথা থাক চৈতালী, চল, গাড়ি আছে সঙ্গে।
কৌশিক, তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি ছেলেমানুষ, হয়তো এই ঠিক হয়েছে। বিধাতার নিয়ম উল্টে দিতে চাইলে এই রকমই হয় হয়তো। যাকে যেখানে মানায় না–
মানায় না!
কৌশিক বুঝি এবার তার স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকপ্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে। তাই কৌশিক হেসে উঠে বলে, মানায় না মানে? চোরকে জেলখানাতেই মানায়! বারে বারে কি তুমি চুরি করে পার পাবে? সুলক্ষণা দেবীর লোহার সিন্ধুকের সবচেয়ে দামী মালটিই চুরি করে এনেছ, ভুলে যেও না সে কথা!
কৌশিক, বেচারা বরেনকে আমি আশা দিয়েছিলাম।
বরেন কি একটা অস্ফুট প্রতিবাদ করে ওঠে।
কৌশিক মৃদু হেসে বলে, তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আমি ওঁকে শালা বলব?
শালা!
হ্যাঁ, তাই তো। নিয়মমত! তুমি তো নিয়মকানুনেরই ভক্ত।
কৌশিক তোমার এই স্বভাবই আমার কাল। এইতেই আমার মাথা খেয়েছ তুমি।
যাক বাঁচা গেল! মাথাটা খেতে পেরেছি, তার স্বীকৃতি পেলাম তাহলে! কিন্তু আর দেরী করা যাচ্ছে না চৈতালী!
কিন্তু কৌশিক বড় ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেখানে বৌদির সেই বড় বড় আর ভয়ঙ্কর দুটো চোখ
ভয় করলে চলবে না চৈতালী। জগতের সমস্ত চোখকে অস্বীকার করব, এই তো আমার পণ। যেখানে যত চোখ আছে, তাদের ভয় করতে করতে যে নিজেদের চোখের মাথা খেয়ে বসি আমরা। সত্যের চোখ, ন্যায়ের চোখ, বিচারের চোখ। যাক্ তর্ক রইল সারা জীবনের জন্যে, এখন বিনা তর্কে পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলে এস দিকি!
কৌশিক, তা হয় না, চৈতালী আস্তে বলে, আজ হয় না। আমাকে ভাবতে দাও, সময় দাও–
সময় তো অনেক নিলে চৈতালী।
না কৌশিক, সময় আমি নিইনি, শুধু নিজেকে নিয়ে সরে এসেছিলাম। আবার যদি যাই, নিজেই যাব।
এটা তো তাড়িয়ে দেওয়ার কথা, ফিরিয়ে দেওয়ার কথা।
না কৌশিক, ভুল বুঝো না, শুধু ভিক্ষে চাইছি, মনটাকে একটু প্রস্তুত হতে দাও।
যদি না দিই, যদি লুঠ করে নিয়ে যাই?
বরেন এদের কথার মধ্যে যেন খাপছাড়া ভাবে বলে ওঠে, তাই নিয়ে যান, নইলে ও যা মেয়ে, আবার পালাবে, আবার লুকিয়ে পড়বে।
চৈতালী মৃদু হেসে বলে, বেশ তো, তাহলে ও আবার খুঁজে বেড়াবে। বোঝা যাবে চাহিদাটা কত জোরালো।
ঠিক আছে। কৌশিক বলে, চাহিদার জোরটাই পরীক্ষা কোরো, তবু বিশ্বাস করব তুমি নিজে থেকে যাবে।
যদি যাই তাই যাব কৌশিক। তোমার সঙ্গে সমারোহ করে গাড়ি চড়ে গেলে মার কাছে মুখ দেখাব কি করে! ভিখিরির মেয়ে, ভিখিরির মতই গিয়ে দাঁড়াব মার কাছে।