বরেন অনেক আত্মস্থ হয়ে গেছে, অনেক স্থির ধীর। তাই শান্ত গলায় বলেছিল, বসবার যদি হয়, বসবেই জানি। আর যদি না বসবার হয়, বলে লাভ নেই তাও জানি।
হু, বুদ্ধিটা তো বেশ পরিষ্কার পরিষ্কার লাগছে, তাহলে দাও একটা কিছু, বসে পড়ি। কিন্তু অবহিত থেকো, বসতে পেলেই শুতে চাইব, খেতে চাইব।
বরেন ঘর থেকে একটা নীচু জলচৌকী এনে পেতে দিয়ে বলেছিল, সবই চাইতে পার।
হু! বলে চৌকীটায় বসে পড়ে চৈতালী এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, তারপর খাপছাড়া বলে ওঠে, বাবার খবর জানো?
বরেন মাথা কাৎ করে সম্মতি জানিয়ে বলে, হাসপাতালের বাইরে থেকে খবর নিয়ে এসেছিলাম।
এখানে চলে এলে কবে?
ওই একদিন!
চৈতালী কী আবার তার পুরনো জীবনে ফিরে যেতে চায়? তাই তার সেই পুরনো পরিবেশের সন্ধান করে?
নিতাইকাকা কোথায়?
জানি না।
তাই নাকি? তার মানে ঝগড়া? তা চেহারাটা তো দেখছি আরও লক্ষ্মীছাড়া লক্ষ্মীছাড়া হয়ে গেছে, বিয়ে করনি? ·
বরেন চৈতালীর এই অকারণ ব্যঙ্গে জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, না।
কেন?
হয়ে ওঠেনি।
হয়ে ওঠেনি? শুধু হয়ে ওঠেনি বলে? কেন, বাঙলা দেশে কি পাত্রীর এতই আকাল পড়েছে?
.
বরেন সহসা কোন উত্তর দেয় না। শুধু নীরবে তাকিয়ে থাকে এই নিষ্ঠুর কৌতুকময়ীর দিকে। অকারণ এই আঘাত কেন?
কোথায় ছিল এতদিন এই নিষ্ঠুরা রুদ্রাণী?
হঠাৎ এই মূর্তি নিয়ে আবির্ভাবের কারণ কি?
এতদিন পরে কি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে এল ও?
হ্যাঁ হত্যাই সে বলেছিল।
বরেনের মনে আছে। নিতাই যখন বলেছিল, টাকার জোগাড় করতে পারিস তত তোর বাপের চিকিচ্ছে হবে। ডাক্তারে বলে দিয়েছে।
তখন ক্রুদ্ধ মেয়েটা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, ঠিক আছে, এনে দেব ইনজেকশনের দাম। কিন্তু বাবা যদি না বাঁচে, তোমাদেরও আর এই ধরাধামে টিকে থাকতে হবে না।
নিতাই ক্যাবলা হাসি হেসেছিল, বাঃ, আমরা কী চোরদায়ে ধরা পড়লাম? আমাদের কী দোষ?
রুদ্রাণী গর্জে উঠেছিল, জান না তোমাদের কী দোষ? কে খুন করেছে আমার বাবাকে? দিনে দিনে তিলে তিলে তোমরাই করেছ খুন। সভ্য ভদ্র শান্ত ভাল একটা মানুষকে খুন করে ফেলে, তার জায়গায় একটা ভূতকে প্রতিষ্ঠা করেছ। তোমাদের কবলে না পড়লে, এমন করে খুন হতে হত নাকি বাবাকে?
ভরাসন্ধ্যাবেলা ঝটকা মেরে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন চৈতালী, আর তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। বরেন বলেছিল, ও সব ঝগড়া টগড়া ছল, বুঝল বাবার হয়ে গেছে, তাই মনের মানুষের সঙ্গে কেটে পড়েছে।
বিশ্বাসের সঙ্গে বলেনি বরেন, তর্কের মাথায় বলেছিল। কিন্তু মেয়েটা যে গেল কোথায়, তা ও ঠিক করতে পারেনি।
.
সেই তারপর এই আজ।
পরনে তার সেই সেদিনের সাজ, হা সেই চেহারাটা একেবারে মনে আঁকা আছে বরেনের। শুধু সেদিনের সেই রোগা পটকা মেয়েটা, আজ যেন স্বাস্থ্যের জোয়ারে ভরা গঙ্গা। মুখটা শুকনো, অথচ কেমন যেন অস্বাভাবিক প্রখর।
প্রতিশোধ নেবার উপযুক্ত হয়ে ওঠবার বাসনাতেই কী এতদিন কোনখানে বসে শক্তির সাধনা করছিল চৈতালী?
.
ঠিক এমন ভাবে ভাবতে না পারলেও এই রকমই একটা কিছু ভেবেছিল বরেন। আর নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে দেখছিল সেই মুখরার দিকে।
চৈতালী আবার বলেছিল, তা পাত্রীর যদি আকাল পড়ে থাকে তো বল আমিই একগাছা বরমাল্য গেঁথে ফেলি। কী বল! রাজী আছ? রাজী না থাকো তো তাও বলে ফেল!
বরেন রুষ্টকণ্ঠে বলেছিল, কোথায় তুমি ছিলে এতদিন তা জানি না, আবার এতদিন পরে এসে হঠাৎ এমন কাটার চাবুক মারছ কেন, তাও বুঝছি না। সবটাই তো গোলকধাঁধাঁ লাগছে।
চৈতালী হেসে উঠেছিল।
বাঃ, তুমি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছ বরেন। ঠিক বলেছ, গোলকধাঁধাঁ! গোলক ধাঁধাঁ। ওর মধ্যে পড়েই ঘুরে মরছি আমরা। এই মনে হচ্ছে সশরীরে স্বর্গে গিয়ে উঠলাম বুঝি, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি–আরে দূর! যে নরক, সেই নরক। যাক, এত কথা তুমি বুঝবে না। মোট কথা, তোমার বাসায় একটু জায়গা চাইতে এসেছি, দাও তো থাকি।
.
বরেনও বুঝি তখন গোলকধাঁধাঁর ফেরে পড়ে ভেবেছিল, স্বৰ্গই বুঝি পেলাম! নাকি অতটা মুখ নয় সে?
তবু রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিল সে, তোমার বাবা আমার হাতেই তোমাকে দেবে ভেবে রেখেছিল কিন্তু আমি পাগল নই চৈতালী! আমাকে তুমি যদি
এই দেখ! লোকটা কাঁদতে বসল। আরে বাবা, আমিও তো সেই পিতৃইচ্ছে পালন করতেই
চৈতালীও কথা শেষ করতে পারেনি সেদিন। তবু থেমে গিয়েছিল। শুধু কদিন পরে একদিন বলেছিল, বাপ-মা মারা গেলে এক বছর কাল-অশৌচ থাকে, তাই তো বরেন?
মেয়েদের বেলায় তা হয় না, সেকথা বলেনি বরেন, চুপ করে থেকেছিল।
.
তারপর চৈতালী এই কলোনির মধ্যে একটা বর্ণপরিচয়ের পাঠশালা খোলবার তোড়জোড় করেছিল। বলেছিল, এখন থেকেই তো আর তোমার অন্ন ধ্বংসাতে পারি না। যা হয় একটা কিছু করতেই হবে।
তাছাড়া বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেলাইয়ের অডার আনতে সুরু করে চৈতালী। কলোনির খদ্দেরদের যার যতটুকু প্রয়োজন। তবু তা থেকে একটা পেট নিশ্চয়ই চলে যাবে। রাজভোগে না হোক, শাকভাতে তো হবে।
.
কিন্তু কেন?
কেন চৈতালীর এই নির্বাচন?
মরতে ভয় পেল কেন চৈতালী? সেটাই তো সম্ভ্রমের ছিল। বরেনের কাছে এসে আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে শ্রেয় ছিল না কি সেটা? বেঁচে থাকবার দরকার কী ছিল চৈতালীর?
হয়তো তাই ছিল।
কিন্তু মানুষের মন বড় জটিল বস্তু। হয়তো সেই মরা আর এই বাঁচার মধ্যে কোন প্রভেদ খুঁজে পায়নি চৈতালী। তাই তার চিরদুঃখী বাবার গোপন বাসনাটুকু নিজের মধ্যে সে পূর্ণ করতে চেয়েছিল।