সুদক্ষিণা মায়ের এই অপরিচিত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, সত্যিই অবাক লাগছে।
আমিও অবাক হচ্ছি, ক্ষে।
হঠাৎ সুদক্ষিণা অন্য এক চাল চালে। বলে, তোমার ছেলেদের ব্যাপারে তাহলে সব জোর ফুরিয়ে ফেললে? এই মেয়েটা বোধহয় ফাউয়ের খাতায়?
সুলক্ষণা কথাটা শোনেন, বোঝেন। তারপর বলেন, আমি কারও জন্যে কিছু করতে পারি, এ ভরসা আর নেই রে ক্ষে। আমার ছুটি নেবার মন হয়েছে।
মা, বৌদিকেও যে তুমি এত বেশী
সুলক্ষণা বাধা দিয়ে বলেন, মা হওয়া যে কত জ্বালা, সে তুই এখন কী করে বুঝবি ক্ষেণু?
ওই চিরকেলে পুরনো কথাটা তোমার মুখে শোনার আশা করিনি মা।
সুলক্ষণা এবার একটু হাসেন।
বলেন, মানুষ জীবটাই যে চিরকেলে পুরনো, ক্ষেণু! কালের প্রলেপে হয়তো তার রঙ বদলায়, পালিশ ঝলসায়, কিন্তু ভেতরের কাঠামোয় যখন হাত পড়ে, তখনই ধরা পড়ে তার পুরনোত্ব। তোর কথায় তাই আমি লজ্জা পেলাম না ক্ষে।
কিন্তু মা, ছোড়দারও তো মা তুমি? তাকে ত্যাগ করতে তোমার কষ্ট হবে না।
ত্যাগ? বলিস কি ক্ষেণু? ষাট ষাট! এ তো শুধু দূরে থাকা, সরে গিয়ে থাকা। সুখের দিনে, ঔজ্জ্বল্যের দিনে, সাফল্যের দিনে মাকে না হলেও চলে যায় ক্ষেণু, সে জীবনে মা শুধু একটা ডাক মাত্র, একটা সম্পর্কের বন্ধন মাত্র, আশ্রয় নয়। তাই মা চিরদিন থাকে তার দুঃখী সন্তানের দিকে, অভাগা অনুজ্জ্বল, ব্যর্থ সন্তানের দিকে।
ক্ষেণু তর্কের সুরে বলে, আর কোনো মায়ের যদি সব ছেলেমেয়েগুলোই সুখী সফল হয়, মা কি তবে তখন আমাকে আর কারও দরকার নেই–বলে গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে যাবে?
সুলক্ষণা হেসে ফেলেন।
বলেন, তা নয় ক্ষেণু। তখন শুধু মা ছুটি পাবে।
সুদক্ষিণা মায়ের মুখে যে সঙ্কল্পের ছায়া দেখতে পেয়েছে, তাতে আর ভরসা নেই। তবু সাহস করে বলে, যদি চৈতালীকে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি ছোড়দা তাকে আনে, তাকে নিয়ে তুমি সংসার করবে না?
না ক্ষেণু, সংসার করার সাধ আমার বড় বৌমা ঘুচিয়ে দিয়েছে। পাপ যেখানে যে কোন কারণেই আসুক, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সেই প্রায়শ্চিত্তটাই রইল এখন আমার ভাগে।
মা, তবে তুমি চৈতালী চৈতালী করে অমন অস্থির হয়েছিলে কেন?
সুলক্ষণা হাসেন, ওই একটা ব্যাপারই মানুষের আয়ত্তের বাইরে, ক্ষেণু। ভেবে চিন্তে সঙ্কল্প স্থির করে কেউ অস্থির হয় না। যাক তবু তো বুঝলি, তোদের মা কাঠ পাথরে তৈরি নয়, নেহাই রক্ত মাংসের মানুষ?
ক্ষেণু আস্তে মাথা নাড়ে।
না, ঠিক বুঝলাম না। বরং মনে হচ্ছে কাঠেরও নয়, পাথরেরও নয়, স্রেফ স্টিলের।
.
ক্ষেণু চলে গেলে সুলক্ষণা চুপ করে বসে রইলেন। ভাবলেন, ওরা কোনদিনই আমাকে বুঝল না সে অভিমান ছিল আমার, কিন্তু এখন সে অভিমান ঘুচেছে। নিজেই কি আমি নিজেকে বুঝতাম? আর ওদেরই কি বুঝতে পারি?
.
না, কেউ কাউকে সহজে বুঝতে পারে না। বুঝতে চায় না বলেই হয়তো পারে না।
তাই চৈতালী বুঝতে পারছে না কৌশিককে?
তার মুখের ওপর হেসে উঠছে?
নাকি আত্মহত্যার এই পদ্ধতিটাই বেছে নিয়েছে চৈতালী? গায়ে আগুন ধরিয়ে নয়, আগুন নিজের মধ্যে জ্বেলে!
চৈতালী এত নিষ্ঠুর হল কবে?
চৈতালীর কথাগুলো কৌশিককে কতটা আঘাত হানছে বুঝতে পারছে না বলেই কি? নাকি ইচ্ছে করেই নিষ্ঠুর হচ্ছে চৈতালী? তাই লহরে লহরে হেসে হেসে বলছে, থানায়? হাসপাতালে? বল কি? খোঁজবার আর জায়গা পাওনি? কিন্তু কেন বল তো এখনো এত খোঁজাখুঁজি? পুলিশে দেবে বলে? সোনা চুরির দায়ে ওয়ারেন্ট এনেছ?
কৌশিক সেই অস্বাভাবিক হাসির পর্দার নীচেকার অস্বাভাবিক পাণ্ডুর কৃশ মুখটার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ ঠিক বলেছ চৈতালী, সোনা চোরকে কে ছেড়ে দেয়?
তাই নাকি? ও বরেন, ঘরের মধ্যে কি করছ? বেরিয়ে এসে দেখো। আমার সেই মনিব বাড়ির দাদাবাবু
ভয়ঙ্কর হাসির দাপটেই বুঝি চৈতালীর গলা বুজে আসে।
.
কিন্তু বরেন কেন?
বরেন কোথা থেকে এল এখানে?
চৈতালীর সঙ্গে বরেনের সম্পর্ক কী?
না, সত্যিকার সম্পর্ক তো কিছুই নেই। আর পূর্বজন্মে চৈতালীর সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, সে তো শুধু বিরক্তির। শুধু তিক্ততার।
তবু এক ছাদের নীচে আছে দুজনে।
হয়তো এটা বিধাতার কৌতুকের একটা জোরালো নিদর্শন। মানুষ যাকে সংক্ষেপে বলে, অদৃষ্টের পরিহাস। সেই অদৃষ্টের পরিহাসেই চৈতালী সুলক্ষণার আশ্রয় ত্যাগ করে এসে জলে ডুবল না, আগুনে পুড়ল না, রেল লাইনে মাথা পাততে গেল না। বরেনের কাছে আশ্রয় চাইল!
.
শচীন মজুমদারের যখন শেষ হল, বরেন তখন নিতাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একদিন এসে উঠেছিল দমদমের এই উদ্বাস্তু কলোনিতে। অনেক চেষ্টায় এ ঠিকানা সংগ্রহ করেছিল চৈতালী। গিয়ে পৌঁছতেও অনেক কষ্ট পেয়েছিল। তাই প্রথম দর্শনেই বলে উঠেছিল, সব আগে, কোন কথা বলার আগে এক গ্লাস জল দাও দিকি। খুব ঠাণ্ডা! নাকি জল-পাত্তরই নেই? রাস্তার কলে জল খাও?
বরেন তাড়াতাড়ি করে ঘরের ভেতর থেকে একটা পাটা মোটা কাঁচের গ্লাসে করে এক গ্লাস জল এনে নীরবে এগিয়ে দিয়েছিল। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি, কোন আকুলতা দেখায় নি, কৌতূহল ব্যক্ত করেনি।
চৈতালী গ্লাসটাকে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিয়ে ঠিক আছে বলে এক নিঃশ্বাসে জলটা নিঃশেষ করে গ্লাসটা বরেনের হাতে ফিরিয়ে দেয়, তারপর বলে ওঠে, কই বসতে বললে না?