কে জানে!
কৌস্তুভের মনের ভেতরের কথা কোনদিনই বোঝা যায় না।
.
তবু একদিন বোঝা গেল।
কৌস্তুভের চিঠি সেকথা বুঝিয়ে দিল। কোথায় বেড়াতে গেছে কৌস্তুভ, সে কথা এরা জানে না। কৌস্তুভ যে চিঠি দিয়েছে, তাতে নিজের ঠিকানা জানায় নি। হঠাৎ একদিন অন্য একটা ঠিকানা দিয়েছে। একটা চিঠির সঙ্গে। দমদমের কোন একটি উদ্বাস্তু কলোনির ঠিকানা।
কৌশিককে লেখা এই চিঠিতে ঠিকানা পাঠাবার কোন কারণ উল্লেখ নেই।
তবু বুঝতে পারে কৌশিক।
দাদাকে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে।
কিন্তু কী সংবাদ নিহিত আছে এই পরিচয়হীন একটা তুচ্ছ ঠিকানার মধ্যে? এতদিন ধরে সুলক্ষণা যা ভেবে এসেছেন তাই কি?
অনেক পথ অতিক্রম করে খুঁজে খুঁজে পৌঁছে আবার কি একখানা মৃত্যুনীল মুখ দেখতে হবে কৌশিককে? নাকি কোনো মৃত্যুপথ যাত্রিণীকে? না এ ঠিকানা শুধু সন্ধানবার্তা?
আশা এক আনা, আশঙ্কা পনেরো আনা। সেই আশা আর আশঙ্কা, বোঝা আর না বোঝার দ্বন্দ্বে কম্পিতহৃদয় নিয়ে একাই বেরোয় কৌশিক।
সুলক্ষণা বলেছিলেন, আমি যাইরে?
কৌশিক কেমন একরকম করে তাকিয়ে বলেছিল, যদি তুমি সহ্য করতে না পার?
আমি পারব না, তুই পারবি?
আমার সম্পর্কে ধারণা একটু বদলাও মা!
তোর কি মনে হচ্ছে বল তো কুশী?
সর্ববিধ মনে হওয়া থেকে মনকে আমি একেবারে মুক্ত করে ফেলেছি মা।
সুদক্ষিণা বলে, আমি তা পারিনি। আমি ওর মত অত মুক্তজীব নই মা। আমার মনে হচ্ছে, এ ওরই ঠিকানা। ও আছে। দাদা খুঁজেছিল, দাদা ওর সন্ধান পেয়েছে।
সুলক্ষণা কথা বললেন না, নিঃশ্বাস ফেললেন। আর কৌশিক চলে গেলে সহসা মেয়েকে ডেকে বলে উঠলেন, যদি তোর কথাই সত্যি হয় ক্ষে, কুশী কী করবে সে তো বলে দেওয়া হল না!
সুদক্ষিণা আস্তে বলে, এ তো তুমি আমি বলে দিয়ে করাবার জিনিস নয় মা, ওর মন যা বলবে, তাই করবে ও।
ও যদি শুধু নিজের মনের নির্দেশটাই না দেখে? যদি আর কারও মনের কথা ভাবতে বসে?
তা যদি হয় মা, সুদক্ষিণা বলে, বুঝতে হবে ওর মন এখনো কঁচা আছে। নিজেকে বোঝে।
কিন্তু আমরা কেউই কি আমাদের বুঝি ক্ষে?
.
এতদিন পারেননি, এতদিন একবারও এ ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেননি।
আজ সুলক্ষণা চৈতালীর সেই পুরনো ঘরটায় এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন আলনায় কয়েকখানা শাড়ী ঝুলে আছে।
ধূলিধূসর বিবর্ণ মলিন।
যে শাড়ীগুলো সুলক্ষণা নিজের আলমারি থেকে একখানি একখানি করে বার করে দিয়েছিলেন। সেই অবধি আর কেউ হাত দেয়নি এগুলোয়।
হঠাৎ মনের ভাবনাটা উচ্চারণ করে ফেললেন সুলক্ষণা, তুমিও আর কোনদিন হাত দেবে না! এবার তুমি যদি আমো, আপন অধিকার নিয়ে রাজ-সমারোহে আসবে। আমার ঘরের কোণের দিকের ছোট্ট এই এক ফালি ঘরের দিকে আর তাকিয়েও দেখবে না তুমি। তাকিয়ে দেখবে না আমার দেওয়া জিনিসের দিকে। যা তুমি ফেলে চলে গেছ, যার দিকে আমি এখনো পর্যন্ত তাকাতে পারি না।
চৈতালী এসে এসবের দিকে কী অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবে, সেটাই ভাবতে লাগলেন সুলক্ষণা।
ধুলোভরা কয়েকটা শাড়ী, আলনার কোণে ঝুলে থাকা দুটো রঙিন ব্লাউজ, ব্র্যাকেটে রাখা একখানা চিরুনি, আর একটা তেলের শিশি, এই তো! এই তুচ্ছ বস্তুগুলোর জন্যে এমন জ্বালাভরা হাহাকার অনুভব করছেন কেন সুলক্ষণা?
.
ছত্র সেই চিঠিটা পড়বার পর যে হাহাকার উঠেছিল সুলক্ষণার মনে, নতুন করে আবার যেন সেই হাহাকার অনুভব করলেন সুলক্ষণা।
অথবা তার চাইতেও বেশি।
সেদিন শুধুই মর্মান্তিক একটা বেদনা ছিল, আজ তার সঙ্গে যেন একটা দাহ। কিসের এই দাহ? কী এত চিন্তা?
চৈতালী ফের আর তার পুরনো জায়গাটায় এসে দাঁড়াবে না, সেই ফাঁকা হয়ে যাওয়া ফাঁকটা ভরাট করে তুলবে না, এই চিন্তা? সে চিন্তাটা কি এতও তীব্র হল যে চিরতরে হারিয়ে ফেলা জিনিসটাকে ফিরে পাওয়ার আশা দেখেও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারছেন না সুলক্ষণা!
নাকি এখনো বিশ্বাসে আসতে পারছেন না তিনি, চৈতালী আছে! চৈতালী ফিরে আসবে।
সে কথা জানেন সুলক্ষণা আর তার ভগবান। কিন্তু একটু পরেই উঠে পড়লেন তিনি। কৌশিক না আসতেই, কোন খবর না পেতেই সুদক্ষিণাকে ডেকে তিনি বললেন, ক্ষেণু, ধর আমি যদি তোদের দাদাকে নিয়ে আর কোথাও গিয়ে থাকি, তুই এ সংসার চালিয়ে নিতে পারবি না?
সুদক্ষিণা ভুরু কুঁচকে বলে, তার মানে?
মানে কিছু না। কুশী সংসার পাতলে, আমার বোধ হয় অন্য কোথাও গিয়ে থাকাই উচিত।
বটে নাকি? ক্ষেণু ক্ষুব্ধ গলায় বলে ওঠে।
তা হলে তো তোমার কুশীর সংসার না করাই উচিত। হঠাৎ এমন অদ্ভুত চিন্তা তোমার মাথায় এল কেন বল তো?
সুলক্ষণা, চিরদিনের দৃঢ় আর স্থিরচিত্ত সুলক্ষণা, তিনি কি তাহলে অস্থির হয়ে গেলেন? দুর্বল হয়ে গেলেন? তাই কেমন যেন অসহায়ের মত তিনি বললেন, খোকার কথাটা তো আমায় ভাবতে হবে ক্ষেণু!
ভাবতে বারণ করছে কে? ভাবো না যত পার। কিন্তু সংসার ত্যাগ করতে যাবে কেন? খোকাকেই বা সংসারছাড়া করবার দরকার কি?
আমার মনে হচ্ছে ক্ষেণু, সংসার সে আপনিই ছাড়বে।
দেখব কে তাকে ছাড়তে দেয়।
কিন্তু ক্ষেণু, সুলক্ষণা হতাশভাবে বলেন, বৌমার সেই চোখ দুটোকে কি এ সংসার থেকে উপড়ে ফেলতে পারব? পারব না। সেই চোখ প্রতিনিয়ত আমাকে ভর্ৎসনা করবে। আমাকে ছুঁচ দিয়ে বিধবে
মা, তুমি তো এমন দুর্বল ছিলে না?
হয়তত ছিলাম না। কিন্তু কেবলই বুঝি মনে হচ্ছে ভেতরের সব জোর ফুরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোথায় যেন মস্ত বড় একটা অপরাধ করেছি।