.
দাদাকে আমরা ভুল বিচার করেছি
ক্ষেণু আস্তে বলে।
কৌশিকও সেইভাবে বলে, প্রতি পদেই তো আমরা ভুল বিচার করি ক্ষে, প্রত্যেকটি লোককেই ভুল বুঝি। আমাদের বিচারের দৃষ্টিটা যদি আর্শির মত স্বচ্ছ হত, তা হলে তো সংসারে কোনও সমস্যাই থাকত না।
দাদা হয়তো বৌদিকে সুখী করতেই চেষ্টা করত। হয়তো ঠকাবে ভেবে মুখোশ আঁটেনি, হয়তো দাদা নিজেও বুঝত না।
.
ওদের কথার মাঝখানে ছেদ পড়ল।
সুলক্ষণা দ্রুত ছুটে এসেছেন একখানা বাঙলা খবরের কাগজ হাতে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ কণ্ঠ সুলক্ষণার, কুশী, কুশী, মেয়েটা বুঝি সেই সর্বনাশই করল রে–
সুলক্ষণার এত বছরের ঘরকরা রাজরাণীর মত বৌ বিষে নীল হয়ে নিথর বনে গেল, তবু উত্তেজিত হননি সুলক্ষণা, বিচলিত হননি। বিচলিত হচ্ছেন যে ঘুঁটেকুড়নীটাকে রাজরাণী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন মাত্র, তার মৃত্যুর আশঙ্কায়!
আশ্চর্য বৈকি।
মাকে এমন কখনো দেখেনি সুলক্ষণার ছেলেমেয়েরা। বাবার মৃত্যুসময়েও না।
তখন সুলক্ষণা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।
এখন সুলক্ষণা কাতর হচ্ছেন।
সুলক্ষণা আছড়ে পড়ছেন।
মেয়েটাকে আমিই মেরে ফেললাম ক্ষেণু!
কৌশিক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।
.
কি? কি হল কি? কাগজে কি?
ঝুঁকে পড়ল সুদক্ষিণা
কাগজে কি দেখেছেন সুলক্ষণা, দেখালেন মেলে ধরে। তিনদিন আগের খবর।
গত সোমবার সকালে বাঁশধানী অঞ্চলে একটি পুকুর হইতে একজন তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তরুণীর পরনে সরু কালপাড় ফিকে নীল রঙের শাড়ী ও শাদা ব্লাউজ। দেহে কোথাও অলঙ্কারের চিহ্ন নাই। তরুণীটিকে কুমারী বলিয়া মনে হয়। পুলিশ ইহাকে একটি আত্মহত্যার ঘটনা অনুমান করিতেছে।
ও কি ওই রকম শাড়ী ব্লাউস পরেছিল সেদিন?
ক্ষেণু প্রায় ডুকরে ওঠে, কই কোনদিন তো
সুলক্ষণা আস্তে বলেন, না কোনদিন পরেনি, শুধু যেদিন প্রথম এসেছিল, ওর নিজের সেই শাড়ী পরে চলে গেছে। যাবার সময় আমার দেওয়া কিছুই নিয়ে যায়নি ক্ষেণু! আমার ভালবাসাটাও আমার পুরনো শাড়ীগুলোর মত ফেলে দিয়ে চলে গেছে।
সুলক্ষণা উদ্বেল হয়ে উঠেছেন।
সুলক্ষণা সেখানে যাবেন।
সুদক্ষিণাও।
কুশী এখনি চল। দেখ পুলিশ তাকে জ্বালিয়ে দিল কিনা। একবার দেখব গিয়ে এত বড় অভিমানে মুখটা তার কেমন হয়ে গেছে
কৌশিক এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবারে সে আস্তে বলে, মা তুমি নাইবা গেলে? আমি যাই–
নারে কুশী, আমি তাকে একবার দেখব।
মা তুমি গেলে সেই মৃত্যুর সমস্ত দায়িত্ব তোমার ওপর পড়বে। যে তোমার কাছ থেকে এমন হঠাৎ চলে গিয়ে।
কৌশিক থেমে যায়।
তারপর একটু থেমে খুব মৃদু গলায় বলে, পুলিশের ব্যাপার তো জানো? হয়তো অকারণ কতকগুলো কদর্যতা টেনে এনে ভয়ানক একটা অপমানে ফেলবে তোমাকে। হয়তো বলবে
এখন বসে বসে তুই ঝামেলা ঝাটের ভাবনা করছিস কুশী, সুলক্ষণা ধিক্কার দিয়ে ওঠেন, সেটাই বড় হল তোর কাছে?
কৌশিক মার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায়।
দৃঢ় গলায় বলে, ঝামেলা ঝঞ্জাট নয় মা, তোমার সম্মান। আমার কাছে তার চাইতে কোন কিছুই বড় হতে পারে না।
.
কিন্তু চিরদিনের বুঝমান সুলক্ষণা বুঝি অবুধ হয়েছেন। তাই কৌশিক তাকে কোন যুক্তিতেই রুখতে পারে না। তিনি যাবেনই। দেখবেন সেই অভিমানিনীর মুখ! যদি কৌশিক নিয়ে না যায়, তিনি বড় ছেলের কাছে গিয়েই দরবার করবেন।
বলবেন খোকা, তোকে তো কখনো কিছু কাজের ভার দিই না, আজ
.
না, সুলক্ষণার বড়ছেলে মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রয়োগ করেনি, নিষেধ করেনি ঝঞ্ঝাট আর ঝামেলার ভয়ে। শুধু বলেছিল, বৃথা যাবে মা। সে নয়।
.
সেই কথারই উত্তর দিলেন সুলক্ষণা, সেই অনেক কষ্টের পারাবার পার হয়ে বাড়ি ফিরে। কিন্তু চুপি চুপি যেন নিজের কানে কানে বললেন, এ নয় বলেই কি আমি খোকার কথা মানব? না, সে আমার বড় অভিমানী। আমি জানি এখানে নয়, কিন্তু অন্য কোনখানে…।
.
সুলক্ষণার ব্যাকুল স্নেহ কি ভুলপথে হাতড়ে মরতে চাইছে? সুলক্ষণার ধীর স্থির বড় ছেলেই কি ঠিক বুঝেছে? সে যে বলেছিল, যেতে চাও চল, নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমি বলছি, সে হতেই পারে না। তার মধ্যে আগুন আছে, শক্তি আছে, সেই শক্তি মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হতে আসেনি, সেই আগুন ওই পানাপুকুরের জলে নিভে যেতে যায় নি।
কিন্তু সুলক্ষণা বিশ্বাস করবেন না সে কথা। সুলক্ষণা খবরের কাগজ তন্ন তন্ন করে দেখবেন, কোথায় কোনখানে মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে।
সুলক্ষণা তরুণী অথবা যুবতী শুনলেই সেখানে ছুটবেন। আসুক বিপদ, আসুক বিরক্তিকর প্রশ্ন, কিছুতেই যেন সুলক্ষণা হার মানবেন না।
কিন্তু দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে যে! এতদিন পরে কি চৈতালী রেলে কাটা পড়তে যাবে? জলে ডুবতে যাবে?
কৌশিক বলে, মা, এ কী পাগলামী করছ তুমি?
সুলক্ষণা বলেন, বল, পাগলই বল আমাকে।
সুদক্ষিণা বলে, মা, এত ভালই যদি বাসতে তাকে, তবে কেন সেদিন।
সুলক্ষণা নিঃশ্বাস ফেলেন।
বলেন, ভেবেছিলাম ও আমায় বুঝবে। ভেবেছিলাম ও আমায় মায়া করবে। ও নিষ্ঠুর, ও তা করল না!
.
আর কৌস্তুভ?
সে কি কিছু বলে না?
না, সে কিছু বলে না। সে দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তি পেয়েছে, তাই বেড়াতে চলে গেছে। কিন্তু শুধুই কি বেড়াতে?
দাদার শূন্য ঘরটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে কৌশিক, দাদা কি শুধু মুক্তির আস্বাদ ভোগ করতেই বেরিয়ে পড়েছে, কাজে ছুটি নিয়ে?