বংশী তো ভারী! বুড়ো একটা! আর একটু হাঁপিয়ে নিয়ে অপর্ণা বলে, যদি কোথাও ছোরা লুকনো থাকে? যদি বাইরে ওর দল থাকে? ভেবে ভয়ে আমার বুকের মধ্যে কি রকম যেন করছে।
কৌস্তুভ ওর ভয় নিরাকরণের জন্যে নীচে নেমে যায় না, বুকে হাত বুলিয়ে বুকেরই চিকিৎসা করতে থাকে।
.
সুদক্ষিণা বসে থেকে থেকে খানিক পরে বিরক্ত হয়ে উঠে এসে তিনতলায় গিয়ে বলে, ছোড়দা ঘুমোলি?
নাক ডাকাচ্ছি।
মার এই অসমসাহসিকতার অর্থ কি বলতে পারিস?
কে জানে বাবা! পূর্বকালের কোন সইয়ের কি গঙ্গাজলের মেয়ে কিনা তাই বা কে জানে? দেখে মনে হল অনেক দিনের অদেখা বোনঝি পেলেন বুঝি একটি!
থাম! ঘটনাস্থলে যাই চল্। …
পাগল হয়েছিস? এই তিনতলায় উঠে এসে আরামে শুয়ে পড়ে, আবার?
তা তো বলবিই তুই, কুম্ভকর্ণের অবতার! যদি ওর সঙ্গে ছোরা-টোরা কিছু থাকে?
থাকে শ্রীমতী সুলক্ষণা দেবীর বুকে বিদ্ধ করে পালিয়ে যাবে। আমরা তিনটি অনাথ শিশু মাতৃহীন হব, কাগজে এই লোমহর্ষক হত্যাকাহিনী ছাপা হবে
আঃ ছোড়দা! ন্যাকামি করিস না, চল বলছি।
ইচ্ছে হয় তুই যা না! আমি গিয়ে শেষে বংশীর মতন কামড় খাই আর কি!
আর আমি মার বারণ না শুনে আবার নীচে নামলে ওই বিচ্ছিরীটার সামনে মার কাছে ধমক খাই যদি? তুই সঙ্গে থাকলে তবু একটু বুকের বল–
কৌশিক বালিশটা উলটে-পালটে ঘাড়ের তলায় জুত করে গুঁজে দিয়ে বলে, কেন ফ্যাচফ্যাচ করছিস? দেখলি না একটা ভদ্রলোকের ঘরের সাধারণ মেয়ে। ডাকাতও নয়, গুণ্ডাও নয়। হয়তো নেহাতই অভাবের জ্বালায়, না হয় তো কারুর প্ররোচনার ঠেলায় মরিয়া হয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
উঃ! একেবারে গণকার!
আচ্ছা দেখিস, শেষ পর্যন্ত আমার গণনা সত্যি হয় কি না।
তা কৌশিকের গণনা অনেকটাই সত্যি।
সুলক্ষণারও।
যতই জীর্ণ বিবর্ণ শাড়ী হোক, তবু চৈতালীর সে শাড়ী স্কুল কলেজের মেয়েদের মত ঘুরিয়ে পরা, যতই রুক্ষ জট-পাকানো চুল হোক তবু সে চুল দুটো বেণী করে দু কাঁধে ফেলা, আর যতই শীর্ণ হোক, তবু মুখে একটা বুদ্ধিমার্জিত লাবণ্য। এ মেয়ে অনেক দিনের পাকা অপরাধী নয়, এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন সুলক্ষণা। কেন কে জানে, যে মেয়েটা রাতের অন্ধকারে তার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল, আর তার নিজেরই ব্যবহারের রুপোর গ্লাসটা আর বাটি দুটো নিয়ে পালাচ্ছিল, তার ওপর কেমন একটা মমতা অনুভব করছিলেন সুলক্ষণা। তাই ওর কথার মাঝখানে সত্যিই মিষ্টি খেতে দিয়ে জল দিলেন ওকে। ঈষৎ হেসে বললেন, ভয় নেই, বিষের নাড় নয়। খা, খেয়ে বাকী কথা বল্।…মাসীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এসে তোর উচ্ছন্ন-যাওয়া বাপটা যখন তোকে তার আড্ডায় এনে ফেলল, তখন কত বয়েস তোর?
আট!
তা বলি উচ্ছন্ন তো গেছল সে, সুলক্ষণা সহসা স্বর কঠোর করে বলেন, চোর-ছ্যাচোড়দের দলে এনে ফেলে সবদিকে নষ্ট করেনি তো তোকে? মেয়ে বেচে খায়, এমন লোকেরও তো অভাব নেই জগতে? সেইটাই জিজ্ঞেস করছি।
চৈতালী মুখ তুলে পরিষ্কার চোখে স্থির গলায় বলে, না, বরং বাঘের মত আগলে রাখে।
আর এই যে রাতদুপুরে ছেড়ে দিয়েছে?
চৈতালীর এতক্ষণকার শুকনো চোখ দুটো এই তুচ্ছ কথায় সহসা জলে ভরে যায়। মাথা নীচু করে আস্তে বলে, বাড়িতে নেই, হাসপাতালে আছে।
হাসপাতালে!
হ্যাঁ, খুব অসুখ। দলের একজনের সঙ্গে ঝগড়া করে মাথা ফাটিয়েছিল, ধরা পড়বার ভয়ে ডাক্তার দেখায়নি, তারপর বিষিয়ে গিয়ে
সুলক্ষণা একটু চুপ করে থেকে বলেন, নাম কি বাপের?
তা বলতে পারবো না।
বলতে পারবি না? ধরা পড়ার ভয়? আর ওই যে হাসপাতালে গেছে?
অন্য নামে। দলের লোকেরা অন্য নাম দিয়ে ভর্তি করে দিয়ে এসেছে। এখন বলছে ইজেকশন দিতে হলে বাড়ি থেকে খরচা দিতে হবে!
সুলক্ষণা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, তাই বুঝি খরচ জোগাড় করতে বেরিয়েছিলি?
চৈতালী চুপ করে থাকে!
তা আসল নাম না হয় না বললি, কোন্ নামে কোন্ হাসপাতালে আছে তা বলবি তো?
না, না! চৈতালীর মুখে ফুটে ওঠে একটা অসহায় আতঙ্ক, ওরা যদি দেখে আর কেউ খোঁজ করছে, মেরে ফেলবে আমাকে।
হু! সুলক্ষণা আর একবার একটু চুপ করে থেকে বলেন, কিন্তু এখন আছিস কোথায়? বাপ তত বাঘের মত আগলে রাখত–
চৈতালী মাথা নীচু করে বলে, সেই তো কষ্ট!
আমার কাছে থাকবি?
চৈতালী চমকে চেয়ে বলে, কি?
বলছি আমার কাছে থাকবি?
কী বলছেন? আপনি কি পাগল?
কেন রে, পাগলের কি দেখলি? চুরি করে খাওয়ার চেয়ে খেটে খাওয়া কিছু খারাপ? অমনি তো খেতে দেব না তোকে, কাজ করিয়ে নেব। রান্নাবান্না জানিস নিশ্চয়ই!
একটা চোরকে বাড়িতে পুষতে সাহস হবে আপনার? আমি যা কিছু বলেছি, সে সব যে বানানো গল্প নয়, তাই বা কি করে বুঝছেন আপনি?
সুলক্ষণা হেসে উঠে বলেন, সে আর বুঝবো কি করে ব! সংসারে অসুবিধেয় পড়লে যে রাস্তা থেকে লোক ধরে রাখতে হয়, কে তাদের গ্যারান্টি হচ্ছে? আর গল্প বানানোর কথা বলছিস? তা আমার নিজের ছেলেই যদি বাইরে থেকে ঘুরে এসে গল্প বানিয়ে বলে, ধরতে পারব? তবে? তা হলে তো পৃথিবীতে সদা সশঙ্কিত হয়েই বাস করতে হয়। তার চেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করে ফেললেই ল্যাঠা চুকে গেল।
চৈতালীর জীবনে চৈতালী এমন কথা কখনো শুনেছে? মানুষকে অবিশ্বাস করতে হয় তাই জানে সে।
চৈতালী হঠাৎ সুলক্ষণার পায়ের কাছে নীচু হয়ে প্রণাম করে গাঢ় স্বরে বলে, মা!