তুই তক্ষুণি কেন বেরোলি না ছোড়দা, ও চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে।
কৌশিক ম্লান হেসে বলে, কখন সময় পেলাম বল? সবটাই তো আকস্মিক ঘটে যাচ্ছে। যেখানে বাড়ির বৌয়ের মৃত্যুর সমারোহ, সেখানে বাড়ির রাঁধুনীর
ছিঃ ছোড়দা!
কৌশিক মিনিট খানেক চুপ করে থেকে আস্তে বলে, কিন্তু ক্ষেণু, ওর ঘর সার্চ করতেও আমাদের বাধেনি!
এই ঘর সার্চের ব্যাপারে সুদক্ষিণার ভূমিকা রয়েছে, তাই সুদক্ষিণা আরক্ত মুখে বলে, সে আমি ওকে সন্দেহ করে নয় মোটেই। মা দাদার ওপর রাগ করে।
তা জানি। শুধু ভাবছি ও সে কথা বুঝতে পেরেছিল কিনা। অভিমানে একদম পাথর হয়ে গিয়েছিল তখন।
হওয়াই স্বাভাবিক। আশ্চর্য, সেদিন আমরা সব জায়গা দেখলাম, অথচ ওই–ওই জানলার নীচেটা–
আমি দেখেছিলাম—
দেখেছিলি? তুই দেখেছিলি? কখন?
যখন আসামী কাঠগড়ায়—
ছোড়দা!
সুদক্ষিণা আর্তস্বরে প্রায় চীৎকার করে ওঠে, তবে? তবে কেন তুই… তখন তো বৌদি মারা যায়নি!
না, তা যায়নি। কিন্তু কৌশিক একটু হাসে, সত্য উদঘাটনের প্রতিক্রিয়ায় যদি মারা যায়, এই ভয়ে জানলা থেকে উদাসীন মুখ নিয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু আশ্চর্য দেখ, শেষরক্ষা হল না। বৌদিকেও বাঁচানো গেল না।
ঘুমের ওষুধ এত বেশী বেশী আনা থাকত ছোড়দা?
খুব বেশীর দরকার হয়নি রে ক্ষেণু!
সুদক্ষিণা এই দুদিনেই অনেক বড় হয়ে গেছে। সুদক্ষিণার মুখে সেই পরিণতির ছাপ।
অথচ দেখ ছোড়দা, কারও কোথাও শাস্তি হল না! ডাক্তারও তাকিয়ে দেখল না।
হয়তো ডাক্তারেরও ধৈর্যের শেষ হয়ে গিয়েছিল।
থাক! ডাক্তারের আবার ধৈর্য অধৈর্য! দিব্যি একখানি কামধেনু পেয়েছিল।
ছিঃ ক্ষেণু, মানুষ সম্বন্ধে ও রকম শ্রদ্ধাহীন কথা বলিস না। টাকাই শেষ কথা, এমন মানুষ খুব বেশী নেই।
না থাকলেই মঙ্গল– সুদক্ষিণা ঠোঁট উল্টোয়।
কৌশিক আস্তে বলে, দেখ ক্ষেণু, ঘটনার চেহারা দেখে মানুষকে বিচার করলে বড় ভুল করা হয়। নিজেদের তো কেউই আমরা ভয়ানক একটা পাষণ্ড ভাবি নি, তবু দেখ যদি চৈতালীর দিক থেকে
ওদের কথা শেষ হয় না।
ওদের কথার মাঝখানে কৌস্তুভ এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় বলল, কেউই যে আমরা নিজেকে পাষণ্ড ভাবি না, এ কথাটাও তোর ভুল কুশী!
দাদা!
দুজনেই বলে উঠল ওরা।
সুদক্ষিণা তারপর বলল, খাওয়া দাওয়া না করে কোথায় গিয়েছিলে? এতখানি বেলা হয়ে গেল, মা খাননি।
মা খাননি, এমন কথাতেও বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করল না কৌস্তুভ। সেই ভাবেই বলল, মেয়েটাকে কি এমন করে অনায়াসেই হারিয়ে যেতে দেওয়া হবে ক্ষে?
কে, কে, কার কথা বলছ তুমি? ক্ষেণু চেঁচিয়ে ওঠে, দাদা! কথাটা কি ভূতের মুখে রামনামের মত হল না? দুজনে মিলে তোমরা ষড়যন্ত্র করে তাকে।
সুদক্ষিণা চুপ করে গেল।
মনে পড়ে গেল সেই দুজনের একজন আজ নেই। তার সম্বন্ধে বাকসংযমের প্রয়োজন। সে জিতে গেছে, সে ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করেও সংসারের বিচারের দৃষ্টির উর্ধ্বে উঠে গেছে।
কৌশিক চেঁচাল না।
কৌশিক নিথর হয়ে তাকিয়ে রইল তার দাদার পাথরের মত মুখের দিকে।
কৌস্তুভ বোনের সহসা রুদ্ধবাক উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত চোখে বলে, ধরলাম দুজনে মিলেই। কিন্তু–এও তো সত্যি, ভুল মানুষেই করে। আবার ভুল সংশোধনও মানুষেরই কাজ–
সুদক্ষিণার ব্যঙ্গ তীব্র হয়ে ওঠে, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বলে, এটা কী দাদা? অনুতাপ, না মহত্ত্ব?
ক্ষেণু! এবার কৌশিকের কণ্ঠে শব্দ ফোটে। সে শব্দে নিষেধের সুর।
সুদক্ষিণা কিন্তু এই নিষেধে কান দেয় না। সেই তীব্রতার সঙ্গেই বলে, কেন বারণ করছ ছোড়দা? মুখোশ এঁটে যে চিরদিন সংসারকে ভোলানো যায় না, সেটাও প্রকাশ করার দরকার আছে বৈকি। বৌদিকে যে তুমি একদিনের জন্যেও ভালবাসতে পারনি দাদা, সেটা তোমার চেয়ে আর বেশী কে জানে? তবু তুমি আদর্শ স্বামী সেজে রাতদিন তাকে ঠকিয়েছ। সেই ছলনার মুখোশখানা নেড়ে আহা আহা করে তার মুখ বন্ধ করে রেখেছ। বিদ্রোহ করবার তিলার্ধ সুযোগ দাওনি তাকে। হয়তো সে সুযোগ দিলে তার নার্ভগুলো এত বিকৃত হয়ে উঠত না। আর সেই বিকৃতির বোঝা নিয়ে এমন হাস্যাস্পদও হয়ে উঠত না। তিল তিল করে শুধু যত্নের অত্যাচারে মেরেছ তাকে তুমি, আর শেষ পর্যন্ত।
আবার সহসা থেমে যায় সুদক্ষিণা। মনে পড়ে যে কথা, যে ভয়ঙ্কর কথা, এখনো অনুক্ত আছে, সেটা উদঘাটন করে বসা চরম নিবুদ্ধিতা।
নিরাবরণ নিষ্ঠুর সত্যটা সমস্ত সংসারকে যেন দাঁত খিঁচিয়ে উঠবে।
কিন্তু কৌস্তুভ সেই চরম নির্বুদ্ধিতাটাই করে বসে।
কৌস্তুভ বোনের এই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে যেন মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, হ্যাঁ শেষ পর্যন্ত। কিন্তু পরে মনে হল এতটা না করলেও চলতো। কতটুকুই বা ক্ষমতা ছিল ওর? জানলা পর্যন্ত পৌঁছতেই
সুদক্ষিণা স্থির স্বরে বলে, জানলা পর্যন্ত পৌঁছবার ক্ষমতা তো ওর ছিল না দাদা!
ঠিকই বলেছিস ক্ষে, সে ক্ষমতা ছিল না ওর। তবু গিয়েছিল। দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একেই হয়তো মরীয়া অবস্থা বলে। ঈর্ষার জ্বালায়–
কিন্তু কেন এই ঈর্ষা, কেন এই বিদ্বেষ বলতে পার দাদা?
সব কথাই কি বলা যায় ফেণু? না সব কথা বলার যোগ্য হয়? তবে ঈর্ষাই তো অক্ষমের সম্বল! তাই তোদের অনুরোধ করি, অক্ষম বলে অবোধ বলে তাকে তোরা একটু দয়া করিস। আমি কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাব ঠিক করেছি, হয়তো সেই অবকাশে সংসারের সব জটিলতা সরল হয়ে যাবে, হয়তো সংসার তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবার সুযোগ পাবে। হয়তো মার দুটো ছেলেই ব্যর্থ হয়ে যাবে না। কিন্তু এটা জেনে রাখিস ক্ষে, চেষ্টা করলেই কাউকে ভালবাসা যায় না। আর ইচ্ছে করলেই ভালবাসা ফিরিয়ে আনা যায় না। শুধু সে ভালবাসাকে মোহমুক্ত, নির্মল করে তোলার সাধনাই হচ্ছে মানুষের কর্তব্য।