ফিরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। আস্তে একটু হাসির মত করে বলল, আপনার কাজ কমে গেল এবার!
যে মৃত্যু প্রতিক্ষণ উঁকি দিয়েছে, যে প্রতিদিন দুএকবার করে দেখে গেছে বন্ধ তালাটা কতখানি মজবুত, মোচড় দিয়ে গেছে খানিকটা করে ভেঙে পড়ে কি না দেখতে, সে মৃত্যুকে আবার যাচাই করবার কি আছে?
ডাক্তার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন একবার, বুকপকেট থেকে কলমটা বার করলেন।
ছাড়পত্র চাই।
প্রাণটা ছেড়ে যাবার পরও দেহটার জন্যে ছাড়পত্রের দরকার। ওটা যত্ন করে সঙ্গে নিতে হবে।
.
ডাক্তার চলে গেলেন। এবার সমারোহের দরজা খুলে দেওয়া হল। লোকে ভরে গেল বাড়ি। নীল হয়ে যাওয়া কপাল সাদা চন্দনের ছাপে ঢেকে গেল। ওর সেই সাদা খড়ির মত কপালটাই আবার ফুটে উঠল যেন।
অপর্ণার বিয়ের সময়ের অধিবাসের শাড়িটা বার করে দিলেন সুলক্ষণা, যেটা পরিয়ে ওই রঙিন ফটোখানা একদিন তুলিয়েছিলেন অপর্ণার শ্বশুর।
এবাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন একদিন, আজ তার যত্ন করে খুঁজে আনা বৌ চলে গেল।
সুলক্ষণা শেষবারের মত কপালে একটা হাত রেখে ধীর কণ্ঠে বললেন, যিনি খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসেছিলেন, তোমায়, তাকে এবার খুঁজে বার করগে তুমি।
কৌশিক মার পিঠে একটা হাত ঠেকিয়ে বলল, সব মৃত্যুই কি একই জায়গায় পৌঁছয় মা?
সুদক্ষিণা কথাটা শুনতে পেল।
ভাবল, একথা বলল কেন ছোড়দা? চৈতালীর কথা মনে পড়ল না ওর।
.
তারপর। অনেক দুর্ভোগের পর
অনেক রাত্রে বাড়ির সব আলো যখন নিভে গেছে, ছাতের দালানের সিঁড়ির, শুধু মৃতের ঘরের আলো নেবানো বারণ বলে কিসের যেন একটা ক্ষীণ আলো জ্বলছে, তখন সুলক্ষণা সে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
এসে তিনি দেখলেন, তাঁর বড় ছেলে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে।
এই স্তব্ধতার ছবি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুলক্ষণা, তারপর সাবধানে কাছে এসে ডাকলেন, খোকা!
ফিরে দাঁড়াল কৌস্তুভ।
এত অস্পষ্ট আলোয় ওর মুখ দেখতে পেলেন না সুলক্ষণা। নরম গলায় বললেন, ঘুম। আসছে না থোকা?
না।
খুব বেশী সহজ হবার জন্যেই বোধ করি বড় বেশী সাধারণ গলায় কথা বলল কৌস্তুভ।
বলল, না। সারাদিন অনেক ঝঞ্জাট গেল। মাথাটা বড্ড ধরে গেছে।
তারপর বলল, মা জানলার কাছে এসো!
কি? জানলার কাছে কি?
সুলক্ষণা যেন ভয় পেলেন।
কৌস্তুভ ভয় পেল না। কৌস্তুভ যেন হাসল। বলল, নীচের কার্নিসের দিকে তাকিয়ে দেখ।
সুলক্ষণা জানলার কাছে এলেন।
জানলার গরাদের খাঁজে মুখটাকে রাখলেন। লোহার এই শিকগুলৈ বাধা। তা হোক, তবু দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না! কার্নিসটা চওড়া।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সুলক্ষণা সেই নীচের দিকে। ওঁর মনে হল ওখানে যেন অনেকগুলো আগুনের ফুলকি জ্বলছে।
আমি জানতাম! আমি জানতাম! যেন মনের মধ্যে উচ্চারণ করছেন সুলক্ষণা, এই রকমই একটা কিছু যে হবে আগেই ভেবেছিলাম আমি!
মনের মধ্যে উচ্চারণ করলেন যেন।
তবু এই সদ্য মৃত্যুর ছমছমানি ভরা, একেবারে নিস্তব্ধ ঘরের পটভূমিকায় সেই উচ্চারণ শুনতে পেল কৌস্তুভ।
বাতাসের মত শব্দে বলল, যদি দেখতে না পেতাম!
সুলক্ষণা নিশ্বাস ফেলে বললেন, যদি শুধু আমিই দেখতে পেতাম! তারপর বললেন, কখন?
কাল কাল রাত্তিরে!
সুলক্ষণা বিড়বিড় করে বললেন, তাহলে আমার সব ধারণা ঠিক!
কৌস্তুভ জানলা থেকে সরে এল। বিছানায় বসে পড়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিক। আমি জানতাম, তুমি বুঝতে পারবে। তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। কিন্তু মা, জানো? কৌস্তুভের গলার স্বরটা যেন ছায়ার মত শোনালোজানো, আজ আবার তাকিয়ে দেখতে দেখতে অদ্ভুত একটা মায়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এইটুকুর বেশী ক্ষমতা যার ছিল না, তাকে একটা মানুষই বা ভাবলাম কেন আমি!
সুলক্ষণা অন্ধকারে আন্দাজে ছেলের গায়ে একটা হাত রাখলেন। বললেন, তুইও তো মানুষ খোকা! রক্তমাংসের মানুষ!
.
কিন্তু অনেকক্ষণ পরে ঘরে কথার সাড়া আনলেন সুলক্ষণা।
কিন্তু ওরা ওঠবার আগে, ওরা জাগবার আগে ওর তো একটা ব্যবস্থা করতে হয় খোকা!
না মা! ওদের কাছে স্বীকার করব আমি, প্রকাশ করব। ওরা কেন মিছামিছি একজনকে দোষী ভেবে
সুলক্ষণা দৃঢ়স্বরে বললেন, তা হয় না খোকা!
কিন্তু কেন হয় না মা?
হয় না বলেই হয় না বাবা!
কিন্তু মা, জীবন বড়, না মৃত্যু বড়?
সুলক্ষণা বললেন, বড় ছোট বিচার করা শক্ত খোকা, শুধু জানি, মৃত্যু সম্মানের, মৃত্যু শ্রদ্ধার।
.
বংশী আসেনি, আর কেউ নেই, এখন সুদক্ষিণাকেই সকাল বেলা চা ঢালতে হবে।
আর বসে পড়ে বলা যাবে না, কই কোথায়?
ক্লান্ত মন আর ক্লান্ত ভঙ্গী নিয়ে চা ঢালতে ঢালতে সুদক্ষিণা আস্তে বলে, যখন বৌদির ঘরে কেউ থাকবে না, তখন তোকে একবার ওঘরে নিয়ে যাব ছোড়দা, একটা ভয়ঙ্কর জিনিস দেখাব।
কৌশিক চোখ তুলে বলে, জানি!
জানিস? জানিস তুই?
জানতাম! জানলাম!
কখন! কখন জানলি তুই?
এক সময়।
মাকে বলেছিস?
রুদ্ধ কণ্ঠ সুদক্ষিণার, রুদ্ধশ্বাস।
কৌশিক ম্লান হেসে বলে, পাগল হয়েছিস!
বলবি না? শুধু শুধু একটা মেয়েকে
কত লোকই তো শুধু শুধু কত কষ্ট পায় ক্ষে, কত লাঞ্ছনা সহ্য করে, ওটা তো পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কথা নয়। কিন্তু যে পৃথিবীর আওতা ছাড়িয়ে চলে গেছে, তাকে কেন আর?
তাই বলে তুই নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবি?
হয়তো এখন আর চেষ্টা করার কোন মানেও নেই। খুব মর্মান্তিক ধিক্কারের মুহূর্তে মানুষ চরম পথটাই বেছে নেয়।