সেখানেও সুবিধে না হয়, আছে খানা ডোবা পুকুর।
বাঁচবার ঘরের দেওয়াল পাথরে গাঁথা, তার দরজা খুঁজে পাওয়া কঠিন। মরবার রাস্তা খোলা চওড়া মসৃণ। তার কোথাও কোনখানে আগল নেই।
চৈতালী হয়তো সেই আগলহীন রাস্তাটাই বেছে নিয়েছে। এপথে মিলে যাবে তার সারাজীবনের পরাধীনতার মুক্তি, সমস্ত নিরুপায়তার মুক্তি।
আমি আমার এ কথা বোঝবার এই একটাই পথ।
.
কিন্তু চৈতালী এমন একটা কী প্রাণী যে তাকে নিয়ে আরও অনেক ভাবা হবে?
কে দিচ্ছে সে অবসর?
সংসার, সমাজ, না তার ভাগ্য?
কেউ দেবে না।
সংসার যদি বা একটা নিশ্বাস ফেলে একবার অন্তত অন্ধকার আকাশটার দিকে তাকায়, যদি ভাবে এ ভুলটা তো না করতেও পারতাম আমরা।
চৈতালীর কুগ্রহে গড়া ভাগ্য সে নিঃশ্বাস ছিনিয়ে নেবে আর একজনের জন্যে। সে নিঃশ্বাসকে হাহাকারে পরিণত করে তুলবে সেই ভাগ্যমন্তের সন্ধানে।
চৈতালী হয়তো মরে গেছে ভেবে কতক্ষণ ভাবনাবিলাস করবে সংসার, সংসারের সবচেয়ে দামী লোকটাই যদি সত্যি মরে গিয়ে টেক্কা দেয় তার ওপর?
রাত্তিরে ওরা সকলেই যথানিয়মে খেয়ে শুয়েছিল। কে জানে কে ওই রাত্রির আকাশটার দিকে তাকিয়ে বসেছিল, আর কে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন ছিল।
অপর্ণাকেই শুধু ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল ঘুমের ওষুধ খাইয়ে। খুব হয়তো দরকার বুঝেছিল অপর্ণার স্ত্রৈণ স্বামী। স্ত্রীর এতটুকু অসুবিধে দেখলেই যে দিশেহারা হয়ে ওঠে।
তা ঘুমন্ত আর জাগন্ত যাই হোক, সব প্রাণীগুলোই তো নিথর হয়ে ছিল। রাত্রির স্তব্ধতা। ক্লেদাক্ত হয়ে ওঠে নি, অপবিত্র হয়ে ওঠে নি, রূঢ় আলোকপাতে, চঞ্চল পদপাতে।
রাত্রির কমনীয়তা একটুও কুৎসিত হয়ে ওঠে নি কারও ভয়ার্ত স্বরে।
.
কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
শেষরাত্রির স্তব্ধতা ক্লেদাক্ত হয়ে উঠল। শেষরাত্রির কমনীয়তা কুৎসিত হয়ে উঠল।…
সমস্ত ঘরের আলো জ্বলে উঠল রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে। সমস্ত বাড়িটা মুখর হয়ে উঠল চঞ্চল পদপাতে।
প্রথম ধাক্কা পড়ল সুলক্ষণার দরজায়।
সুলক্ষণা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন নির্লিপ্ততায় শুনলেন সে শব্দ, কিন্তু আচ্ছন্নতা কতক্ষণ থাকে? ঘন ঘন ধাক্কা এসে পড়ে দরজার ওপর, ঘুমের ওপর, স্তিমিত উদাসীনতার ওপর।
মা, ওকে দেখবে এসো!
সুলক্ষণা অবিন্যস্ত আঁচল লুটোতে লুটোতে বেরিয়ে এলেন, দালানের আলোটা জ্বেলে দিলেন, তারপর ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, খোকা!
সুদক্ষিণা বেরিয়ে এল ওঘর থেকে।
তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, দাদা?
কৌশিক তিনতলা থেকে নেমে এল। চিৎকার করল না, শুধু দৃঢ় গলায় বলল, কখন?
কৌস্তুভ বলল, জানি না।
.
অপর্ণা আর ঘামবে না।
কোনদিনও না।
অপর্ণার চোখ দিয়ে আর জল গড়াবে না।
একবিন্দুও না।
অপর্ণার বুকের ওঠাপড়াটা আর মৃত্যুর সংকেতে সকলকে দিশেহারা করে তুলবে না। তবে কৌস্তুভ আর ব্যস্ত হয়ে ওঘরে গিয়ে বসবে কেন? দরকার নেই। তাই ঘরের বাইরে এসে বসে ছিল কৌস্তুভ মাথার চুলগুলো মুঠোয় চেপে।
আর কারও কথার উত্তর দেবার ছিল না।
ভাইয়ের কথার উত্তর দিল কৌস্তুভ। বলল, কি জানি! টের পাই নি। ঘুমের মধ্যে কখন—
সুলক্ষণা ঘরে ঢুকে গেছেন।
বসে আছেন।
একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন।
তাকিয়ে আছেন সদ্য মৃতার সাদা খড়ির মত মুখটার নীল হয়ে যাওয়া রঙের দিকে নয়, তাকিয়ে আছেন দেয়ালে ঝোলানো ওদের বিয়ের সময়কার সেই রঙিন ছবিটার দিকে!
ওই ছবিটার মধ্যে এত কী পাচ্ছেন সুলক্ষণা যে, দেখে দেখে আর শেষ করতে পারছেন না?
সুদক্ষিণা এক জায়গায় বসে থাকতে পারছে না। ও ঘরে ঢুকছে, বেরিয়ে আসছে। বসছে, দাঁড়াচ্ছে।
সুলক্ষণা একবার ক্লান্ত গলায় বললেন, এখানে বসতে না পারিস, বাইরে গিয়ে বসগে যা।
বসতে পারছি না– বলল সুদক্ষিণা।
তারপর বলল, আশ্চর্য! এতবার এত সমারোহ হল, কিছু হল না! আর সত্যি যখন একেবারে চলে গেল, তখন–চুপি চুপি চোরের মত
সুলক্ষণা বুঝি একটু হেসে বললেন, মৃত্যু রাজা, মৃত্যু চোর! ও কখনো ঘোড়ায় চেপে দেউড়ি দিয়ে আসে, কখনো নিঃশব্দ পায়ে পেছনের দেয়ালে সিঁদ কাটে!
.
তারপর আস্তে আস্তে ভোর হল, সকাল হল।
আর সকালের এই স্পষ্ট সাদা আলো যেন এতক্ষণে এদের বাস্তব জগতের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিল।
জানিয়ে দিল, অকারণ দেওয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করার সময় আর নেই। জানিয়ে দিল মৃত্যু শুধু স্তব্ধ সুন্দর নয়, মৃত্যু সশব্দ কর্কশ।
সাদা গোলাপে ঢাকা শবদেহ সামনে নিয়ে শুধু বসে থাকার শান্ত ইচ্ছা হাস্যকর পাগলামি।
এই দেহ, এই খাট, এই সাজানো ঘর এখুনি তছনছ করে ফেলতে হবে। হৃদয়সম্পর্কহীন কতকগুলো লোক জড় করে এনে সাহায্য নিতে হবে তাদের, তারপর বিধানের পুঁথি খুলে বসে হিসেব করতে হবে, এরপর কী করণীয়।
অপর্ণা আর ঘামবে না।
অপর্ণার নাড়ি আর দ্রুত স্পন্দিত হবে না, অপর্ণার হৃদ্যন্ত্র থেমে যাব যাব বলে আর ভয় দেখাবে না, তবু ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। বহুদিন যাবৎ এ সংসারের নিত অতিথি তিনি। এবার সময় হয়েছে শেষ কর্তব্য সাধনের।
ডাক্তার এলেন।
আর ঠিক সেই তখন, যখন ডাক্তারের জুতোর শব্দ সিঁড়িতে শোনা যাচ্ছে, কৌশিক অপর্ণার ঘরে এসে ঢুকল। চুপ করে তাকিয়ে দেখল এক মিনিট, টেবিলের কাছে চলে এল, ঘুমের ওষুধের শিশিটা তুলে ধরল। নামিয়ে রাখল আরও একরাশি শিশি বোতল কৌটোর দঙ্গলের মধ্যে।