তাহলে?
সেই গভীর বিদারণ রেখার ওপর দিয়েই চিরদিন পথ চলতে হবে চৈতালীকে।
যেটা অসম্ভব।
যেটা অবাস্তব।
.
তবু আবার এল কৌশিক।
বলল, চৈতালী, এমনও তো হতে পারে, এতক্ষণ ধরে ঠাট্টা করছিলে তুমি। বৌদির জিনিসটা লুকিয়ে রেখে মজা দেখছ।… এমনও হতে পারে, আমাদের পরীক্ষা করছ তুমি। আমরা তোমায় কতটুকু বিশ্বাস করি, তার পরীক্ষা!
চৈতালী হেসে উঠল।
বলল, আর এমনই কী হতে পারে না, লোভের জিনিস সামনে আসে নি বলেই রক্তের গুণ জেগে ওঠে নি, ঘুমিয়ে ছিল। সামনে আসতেই
কৌশিক ক্ষুব্ধস্বরে বলে ওঠে, ওকথা আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।
চৈতালী আবার হেসে ওঠে, কেন কর না? প্রকৃতির নিয়ম উলটে যাবে নাকি তোমার বোকা বিশ্বাসের জন্যে? শোন নি, বাঘের ছানাকে দুধভাত খাইয়ে রাখলে সে পালক প্রভুর হাত চাটে, কিন্তু দৈবাৎ একদিন রক্তের আস্বাদ পেলে, সেই প্রভুরই ঘাড় ভাঙে।
ঠিক এই কথাই সুলক্ষণা বলেন।
শুনেছি পোষা বাঘ হঠাৎ একবার রক্তের আস্বাদ পেলে
কৌশিককেই বলেন।
কৌশিক উদ্ধত গলায় বলে দেয়, বৌদিকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না।
সুলক্ষণা গম্ভীর গলায় বলেন, হয়তো আমিও করি না। কিন্তু বৌদি তার গহনা নিয়ে গিয়ে আর কোনখানে লুকিয়ে এসেছে, সেটাও তো বিশ্বাস করার কথা নয়?
বেপরোয়া কৌশিক বলে ওঠে, কে বলতে পারে, দাদাই করেছে কিনা!
সুলক্ষণা হঠাৎ তীব্র কটু গলায় বলেন, তাহলে তুমিই বা নয় কেন?…
হঠাৎ রাগ চড়ে গেছে তার। হয়তো নিজের আশাভঙ্গে, কিংবা ছেলের ব্যাকুলতায়।
মা, তুমি কি সত্যিই তাহলে স্বীকার করছ, মানুষ চিনতে তুমি ঠকেছিলে?
সুলক্ষণা ছেলের যন্ত্রণাহত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, কোথাও কোনখানে ঠকিনি, বা কোনদিন ঠকব না, এত বুদ্ধির অহঙ্কার আমার নেই কুশী।
.
তারপর আর ঘুরে বেড়াতে পারে নি কৌশিক। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। আর সারাক্ষণ আশা করছিল দরজার কাছে একটি পদধ্বনি এসে থামবে।
কিন্তু থামল না।
মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ আগে কোথাও থেমে গেছে সেই পায়ের শব্দ। চিরদিনের মত।
৪. অনেক রাত্রে
অনেক রাত্রে কে জানে কি জন্যে নীচে নেমেছিল কৌস্তুভ। ভাড়ারঘরে এখনো আলো জ্বলছে!
বংশী নেই, এত রাত্তিরে কে কী করছে!
ঘরে এসে দেখল, চৈতালী কুটনো কুটছে বসে বসে।
এই এত রাত্তির অবধি এই সব করছে চৈতালী?
অথচ আজই ওকে কতখানি অপমান করা হয়েছে।
কৌস্তুভ আস্তে বলে, এখন এ সব কেন?
চৈতালী ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস মেখে বলে, করে রাখছি। সকালে উঠে মাসীমাকে যাতে বেশী অসুবিধেয় পড়তে না হয়!
বংশী কবে আসবে?
কি জানি!
আজ তোমার ওপর যা অত্যাচার হয়ে গেল!
চৈতালী বঁটি ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে কঠিন রুক্ষ গলায় বলে বসে, তবু তো আশ মেটে নি বলে মনে হচ্ছে। তাই বুঝি আরও যা যা বাকী আছে–
এ রকম বলছ কেন?
বলছি কেন? আপনি জানেন না এত রাত্রে এভাবে দুটো মানুষকে একত্রে দেখলে, লোকে তার কি অর্থ করে?
আমি তো চলে যাচ্ছি। আমি শুধু একটা কথা তোমায় বলতে এসেছিলাম—
জানি কি বলতে এসেছেন।
জানো?
হ্যাঁ। বলতে এসেছেন আমি যেন এখান থেকে রাগ করে চলে না যাই।
চৈতালী!
আপনার ছোট ভাই ঠিক এই সুরে ডাকে আমায়।
কৌস্তুভ আরক্ত মুখে বলে ওঠে, অপমানের শোধ নিলে? যাক, হয়তো এ আমার পাওনাই ছিল। তবু বলছি, হা ওই কথাই বলতে এসেছিলাম, রাগ করে চলে যেও না।
চৈতালী খুব ঠাণ্ডা মৃদু গলায় বলে, না, রাগ করে চলে যাব কেন?
.
-না, রাগ করে নয়—
কাগজের টুকরোটা মুঠোয় চেপে ধরে সুলক্ষণা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সাদা দেয়ালের দিকে।
তারপর দেখলেন, সকালের জন্যে পরিপাটি রান্নার গোছ সাজানো। দেখলেন নিজের কোকালের পুরনো সরু যে দুগাছি বালা পরতে দিয়েছিলেন চৈতালীকে, সেই বালা দুগাছি বাসনের তাকে পড়ে আছে!
কাগজের টুকরোটায় চাপা দেওয়া ছিল যে চাবির থোলোটা, সেটা সুলক্ষণার হাত লেগেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
কাগজটা আর একবার চোখের সামনে তুলে ধরলেন–লেখা রয়েছে–না, রাগ করে নয়, লজ্জায়! চোরের মেয়েকে আদর করে ঘরে জায়গা দিয়েছিলে, এখন তোমাদের সংসারের কত সোনা চুরি করে নিয়ে চলে যাচ্ছি। তোমার লোকসান, আমার সারা জীবনের সম্বল।
কী এ?
স্বীকারোক্তি? এ কোন্ সোনা?
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সুলক্ষণা ভাঙা গলায় ডেকে উঠলেন, ক্ষেণু!
ক্ষেণু এল।
বলল, মা?
সুলক্ষণা কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, চলে গেছে।
সুদক্ষিণা বোবা চোখ মেলে তাকাল, চলে গেছে!
.
চলে গেছে!
হ্যাঁ, চলে গেছে।
কে জানে কখন!
কে জানে কোথায়!
তার সেই চিরকালের খড়কুটোর বাসা তো ভেঙে গেছে, উড়ে গেছে নিশ্চিহ্ন হয়ে!
আবার কোথায় কোত্থানে জুটবে নতুন বাসা?
আর কি কেউ অজানা অচেনা একটা যুবতী মেয়েকে বলে বসবে, আমার কাছে থাকবি?
তা হয়তো বা বলবে।
এই শহরে পাপের বাসার তো অভাব নেই। প্রলোভনের হাতছানি দিয়ে কেউ হয়তো ডেকে নিয়ে যাবে। আর আদি অন্তকাল থেকে মেয়েমানুষের জন্যে অধঃপাতের যে একটাই পথ নির্দিষ্ট আছে, সেই পথের নিশানা চিনিয়ে দেবে।
সুলক্ষণা হেরে গেলেন।
সুলক্ষণা তো প্রমাণ করে দেখাতে পারলেন না, মানুষ অমৃতের সন্তান।
কিন্তু কে বলতে পারে, অমৃতের অধিকার পেল না বলে অভিমানে মৃত্যুটাকেই হাতে তুলে নিল চৈতালী।
এই শহরতলির আশেপাশে রেললাইনের তো অভাব নেই? মরণ ফাঁদ পেতে তো পড়ে আছে মাইলের পর মাইল।