কিন্তু আমি যে ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারছি না।
আমার ভাগ্য!
এবার যেন সুলক্ষণার চোখে একটা রুক্ষতা দেখা দেয়। যা এতক্ষণের মধ্যে দেখা যায়নি। সেই সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত সুলক্ষণার চোখে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে, উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, অস্বস্তি দেখা দিয়েছে, চিন্তা দেখা দিয়েছে, কিন্তু রুক্ষতা এক মুহূর্তও দেখা দেয়নি।
এখনই দেখা গেল।
বললেন, ভাগ্য বলে চুপ করে বসে থাকলে তো চলবে না বাছা, গেল কোথায় সেটা তো দেখতে হবে?
দেখুন!
একটুকরো আগুনের মত কথাটা এসে লাগে সুলক্ষণার ওপর, দেখবার যা যা পদ্ধতি আছে, প্রয়োগ করুন সে সব।
আগুনের সঙ্গে হাসি ঝলসাল একটু।
সুলক্ষণার মনে হয়, এ যেন তাঁর নিত্য দেখা চেনা মেয়েটা নয়। সেই একদিনের দেখা অচেনা মেয়েটা।
যে বলেছিল, পুলিসে দিতে ইচ্ছে হয় পুলিসে দিন, চাকর দিয়ে মারাতে ইচ্ছে হয় মারুন, নামের কী দরকার?
সুলক্ষণা জ্বলে ওঠেন।
সুলক্ষণার উঁচু মাথাটা চিরতরে হেঁট হয়ে গেছে আজ, সুলক্ষণার বড় সাধের হিসেব তালগোল পাকিয়ে গেছে।
এখন সেই তালগোল পাকানো হিসেবের ওপর এসে এসে ভিড় করছে সেই সব শোনা আর জানা কাহিনী।
কাদের বিশ বছরের পুরনো চাকর চার আনা ওজনের সোনার লোভে মনিবের ছেলেকে খুন করেছিল, কার নিজের ভাইপো শুধু সিন্দুকের চাবিটা হাতাবার জন্যে কাকার গলা কেটেছিল। কোথাকার মঠের সাধু আজীবন কৃচ্ছসাধনের মহৎ পথ বেয়ে চলে এসে বৃদ্ধকালে বিগ্রহের গহনা চুরির অপরাধে বিতাড়িত হয়েছিলেন আর কোন্ পরম নিষ্ঠাবতী বালবিধবা সারা যৌবনকাল নির্জলা একাদশী করে আর কঠোর নিয়মে কাটিয়ে এসে, প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়ে কলঙ্কের কালি মুখে মেখে কুলত্যাগ করেছিল, সেই সব এখন ভাবতে হচ্ছে সুলক্ষণাকে।
রোধ করতে পারছেন না এই চিন্তার ঢেউ।
সে ঢেউ সুলক্ষণাকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে, শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে।
সেই দমবন্ধ অবস্থায় সুলক্ষণা কিছুতেই আর মনে করতে পারছেন না, মানুষ অমৃতের সন্তান।
এখন বরং ভাবছেন, ভগবান খুব রক্ষা করেছেন। নেহাত সুলক্ষণাকে হাত ধরে ফিরিয়ে আনা যাবে না বলেই এতবড় একটা ধাক্কা দিয়ে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।
কত বড় একটা ভুলই ঘটতে বসছিল।
কত বড় বিপদ।
আর কৌশিক?
প্রথমটায় সে তো ব্যাপারটার গুরুত্বই দেয়নি! ভেবেছিল বৌদির এটি একটি নতুন অবদান।
গহনা হারানোর ছুতোয় বুঝি আর এক নতুন কান্নার পথ আবিষ্কার!
কিন্তু সে ধারণার ওপর বিরাট একটা ধাক্কা এসে লাগল।
দেখতে পেল, চৈতালীকে আবার সবাই যেন তার পুরনো ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাকিয়ে দেখছে।
ভয়ানক একটা যন্ত্রণা বোধ করল কৌশিক, ওই অবনতমুখীর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কর্তব্যের ডাক, মায়া মমতা আকুলতা সব কিছুর অনেক উর্ধ্বে। ছুটতে হল তখন ডাক্তারবাড়ি।
আর ডাক্তারকে নিয়ে যখন ফিরল, তখন চৈতালী অদ্ভুত রকমের বদলে গেছে। যেন ওর সমস্ত সত্তাকে ঘিরে একটা পাথরের পাঁচিল বানিয়ে ফেলেছে চৈতালী। তার ওপিঠে আর কারুর প্রবেশাধিকার রইল না বুঝি।
ডাক্তারের বাণী শ্রবণ করে যখন ছিটকে এদিকে এল, দেখল চৈতালীর সেই ছোট্ট ঘরটার দরজায় সুদক্ষিণা কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে, আর ঘরের মিথ্যা মালিক একটি একটি করে জিনিস খুলে ছড়িয়ে মেলে ধরছে তার সামনে!
কৌশিক রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করেছিল, কী হচ্ছে এসব ক্ষেণু?
চৈতালী মুখ তুলে মৃদু হেসে বলেছিল, সার্চ!
সুদক্ষিণা বোধ করি ছোড়দার সামনে লজ্জা পেয়েছিল, তাই বিরক্ত স্বরে বলে উঠেছিল, সব ঘরই তো খোঁজা হচ্ছে, তোমার ঘরও হল, এতে এত ব্যঙ্গ করবার কিছু নেই। আমার ঘরও তো তছনছ করলাম, কই অপমান তো বোধ করলাম না?
চৈতালী বলল, তোমার মহত্ত্ব!
সুদক্ষিণা রাগ করে সরে গেল।
কৌশিক কেমন এক নিরুত্তাপ দৃষ্টি মেলে বলে, চৈতালী! এই বিচ্ছিরি সমস্যাটা কি সংসারে এলেই চলত না? না এলেই ভাল হত না কি?
চৈতালী একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিল, কত জিনিসই তো না এলে ভাল হত। তবু সেই ভালটা আর হয় কই? আমিই তো তার প্রমাণ।
কিন্তু চৈতালী–
কী আশ্চর্য! আচ্ছা মানুষ তো আপনি? বাড়ির রাঁধুনী, তাও আবার চোর, তার ঘরে আপনি কেন?
কৌশিক থতমত খেয়েছিল।
তবু হেসেও ছিল।
বলেছিল, হয়তো ঘরের ঘরণীর মনে সাড়া জাগাতে!
ছিঃ!
কিন্তু সেই ছিঃটা উলটে ফিরে এল চৈতালীর কাছে। শেষ পর্যন্ত কৌশিক বলে উঠল, ছি ছি।
না, চোর বলে নয়। ওর রূঢ়তায়, ওর কঠোরতায়। অথচ কৌশিকের সঙ্গে এই রূঢ়তা কি সত্যিই কোন কারণ ছিল? কৌশিক তো সন্দেহ করতে আসে নি? কৌশিক শুধু প্রশ্ন করতে এসেছিল, সবাই সন্দেহ করছে কেন?
ঘটনা সংস্থাপনটা হল কী ভাবে?
চৈতালী ভুল বুঝল!
না, চৈতালী কৌশিককে ভুল বোঝে নি।
চৈতালী তার আগের ভুল বুঝতে পেরে সাবধান হল। চৈতালী বুঝতে পারল, ভয়ানক একটা ফাটলের ওপর মাটি চাপা দিয়ে প্রাসাদ গাঁথতে বসা ভুল। চৈতালী বুঝতে পারল, যে গাছের শিকড় নেই, সে গাছের আয়ু অনিশ্চিত।
অপর্ণার হারানো গহনা কোনখান থেকে না কোনখান থেকে পাওয়া যাবেই।
কিন্তু চৈতালীর ওপর থেকে হারানো বিশ্বাস কি আর ফিরে পাবেন সুলক্ষণা? ফিরে পাবে কৌশিক?
আর যদি সেই গহনাটা না পাওয়া যায়? যদি কৌস্তুভ ঘুমন্ত স্ত্রীর গা থেকে খুলে নিয়ে গিয়ে বেচে এসে থাকে? (যেটা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কোন সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না চৈতালী তার বোবা প্রশ্নের।)