সেদিন অপর্ণা শুধু অবাক হয়ে বলেছিল, ওই চোরটা? শুধু কাজের জন্যে?
সুলক্ষণা বলেছিলেন, কিসের জন্যে কি, সব কি আর বোঝানো যায় বৌমা! ধর শুধু কাজেরই জন্যে, সে দরকারও তো অস্বীকার করা যায় না? আমি আর কতকাল তোমাদের সংসার দেখতে পারব! সংসারের জন্যে লোকজন দরকার, তোমার জন্যেও একটি লোকের দরকার।
.
হ্যাঁ, এই ধরনের কথাই বলেছিলেন সুলক্ষণা। তারপর থেকেই যেন দ্রুত বদলে যাচ্ছে অপর্ণা, আরও বদলে গেছে চৈতালীকে নিজের ঘরে ডেকে এনে। আর ক্রমশই কাহিল হয়ে যাচ্ছে।
এখন আর ওর দৌড় বালিশের তলার বেশী নয়। খোঁজা হল সেখানে। অপর্ণাকে আস্তে বসিয়ে তোশকের তলা, গদির তলা পর্যন্ত। দেখা হল খাটের তলা, যদি গড়িয়ে গিয়ে থাকে।
সুলক্ষণা এতক্ষণ অপর্ণাকে বলছিলেন, এবার চৈতালীকে বললেন, ভাল করে ভেবে দেখ দিকি। তাড়াতাড়িতে কোথাও রেখেছিস কিনা–।
চৈতালী সুলক্ষণার দিকে স্থির দৃষ্টি মেলে বলল, ভাল করে ভেবে দেখেছি, মাসীমা।
কিন্তু যাবে কোথায় বল্ বংশীর কথা মুখে আনাও পাপ, তবু বংশীও তো নেই দু-তিন দিন। ঈশ্বর সত্যিই মঙ্গল করেছেন যে ও নেই এখন।
.
ঈশ্বর মঙ্গল করেছেন।
বংশীকে বাঁচিয়েছেন!
ভাবল চৈতালী। এই কথাই তাহলে বলতে চাইছেন সুলক্ষণা।
এ ঘরের দরজায় বাড়ির সবকটা প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে।
সুদক্ষিণা এসেছে সুলক্ষণার তীক্ষ্ণ প্রশ্ন শুনে, কৌশিক চৈতালীর সেই বোবা গলায় উচ্চারিত চুড়ি শুনে।
কিন্তু নেমে আসার আগে পর্যন্ত অবেনি, এ রকম একটা নাটকের অভিনয় দেখতে পাবে।
তাহলে গেল কোথায়!
এ কথা সুলক্ষণা উচ্চারণ করলেন, অনুচ্চারিত রইল অন্য আর একজনের মনে। কিন্তু উচ্চারণের সময়ই বা কোথায়? এদিকে যে আর এক বিপদ। অপর্ণার চোখ চাওয়ানো যাচ্ছে না। বাতাস দিয়ে নয়, চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে নয়। নাড়ীর গতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
অতএব কৌশিককে এখন ছুটতেই হবে ডাক্তারকে একটা খবর দিতে।
কৌস্তুভ তো নাড়ী ধরে বসে আছে।
আর সুদক্ষিণা বাতাস করতে করতে ভাবছে, বৌদির গায়ে যদি আর সকলের মত রক্ত থাকত, তাহলে অনেক, অনেকদিন আগে মারা যেত বৌদি। রক্ত নেই বলেই যম ওকে অবহেলায় ফেলে দিয়ে চলে যায়।
ওরা মৃত্যুর পদধ্বনি গুনছে! আর সুলক্ষণা লোকলজ্জা ভুলে তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন অপর্ণার ঘরের বাক্স আলমারি দেরাজ শেলফ ড্রেসিং টেবল! বড়লোক বাবার বাড়ি থেকে অনেক দামী দামী আসবাব পেয়েছিল অপর্ণা। তার চাবি নিয়ে সেই সব খুলে সুলক্ষণ দেখলেন।
নেই।
নেই! কোথাও নেই।
অপর্ণা তো আর তার চুড়িগুলো স্যাকরাবাড়িতে বেচে দিয়ে আসে নি।
তবে তোদের ঘরেই খোঁজা হোক– সুলক্ষণা সুদক্ষিণার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, আর কোথায় খুঁজতে যাব ব?
খোঁজো!
সুদক্ষিণা নিজের ঘরের বইপত্র বিছানা বাক্স তুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে।
বলে, দেখ বাবা, দেখে নাও। কপালে এও ছিল! যত সব পাগলামি।
কিন্তু এতক্ষণে কৌস্তুভ একটা কথা বলে, চুড়িগুলো চুরি যাওয়াটা তো পাগলামি নয়?
এ কথার উত্তর দেবে কে?
চুড়িগুলো যে সকাল পর্যন্তও জলজ্যান্ত প্রত্যক্ষ ছিল।
আমার ঘরটা দেখা হয় নি।
চৈতালী বলে ভাবশূন্য মুখে।
আর সেই সময়, ডাক্তার যখন সবে এসে দাঁড়িয়েছেন, ওষুধ দেন নি, তখন রোগী হঠাৎ চোখ মেলে ভাঙা ভাঙা ক্ষীণ গলায় বলে ওঠে, রাখলে কি ঘরে রাখবে তুমি?
ডাক্তারের সমস্ত মুখস্থ।
সপ্তাহে তিনদিন আসতে হয় তাঁকে। দরকার বোধ করলে আরও। যেমন আজ। যথারীতি পরীক্ষা করে বলেন, ঠিক আছে। সামান্য একটু বেশী উইক লাগছে। হজমের গোলমালে হতে পারে। পুরিয়াটা দিয়ে দেবেন একবার।
আর রাত্রে? কৌস্তুভ বলে, ঘুম না এলে?
নেহাত না এলে বড়িটা দেবেন। না দিলেই ভাল হয়। না দিতেই চেষ্টা করবেন। পালসটা একটু–কিছু না, ঠিকই আছে। ওই যা বললাম, খুব দরকার বিবেচনা করলে
দরকার বিবেচনা করলে।
ভাবলো কৌস্তুভ।
দরকার কাকে বলে?
.
বলা যায় না। সুদক্ষিণা বলে, অপরাধের বীজ রক্তে থাকে। এমনও হয় হয়তো সারাজীবন বড় বড় লোভ ত্যাগ করে শেষ জীবনে সামান্যর জন্যে
আছে। এরকম দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি আছে সুলক্ষণার জানার জগতে। সুলক্ষণা মুহূর্তের লোভের কাহিনী জানেন, রক্তের ঋণ শোধের কথা জানেন, সোনার জন্যে আদি অন্তের পৃথিবীতে কত কুশ্রীতা, কত নির্লজ্জতা, কত নিষ্ঠুরতা আর নির্বুদ্ধিতার ঘটনা ঘটছে, তার খবর বার্তা জানেন।
কিন্তু চৈতালী?
কিন্তু নয় কেন? কৌস্তুভ আস্তে আস্তে বলে, জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। নেহাত নিরীহ একটা লোকও মানুষ খুন করতে পারে, নেহাত সাধু একটা লোকও চুরি করতে পারে। আর এর তো চমৎকার একটা হিস্ট্রিই রয়েছে। যাদের রক্তে চুরির নেশা থাকে, তারা অজ্ঞাতসারেও চুরি করতে পারে। তা ছাড়া তোমার কাছের এই কিছুদিন ছাড়া ওর আগের জীবনের কিছুই তো জানো না তুমি? কে বলতে পারে, দলের লোকের প্ল্যান অনুযায়ীই
খোকা চুপ কর–বলে উঠে আসেন সুলক্ষণা।
চৈতালীকে যে ঘরটা দিয়েছিলেন, সেই ঘরটায় আসেন। সারা ঘরে সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে চৈতালী।
সুলক্ষণা আস্তে বলেন, আচ্ছা, তোর কি মনে হয় বল্ দেখি চৈতালী?
চৈতালী মুখ তুলে বুঝি একটু হেসেই বলে, মনে যা হয়, তা কি বলতে আছে মাসীমা?