কৌস্তুভ বলে উঠেছিল, সেই মুহূর্তে চুপ করে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব হয়েছিল বলেই বলেছিল, অপর্ণা, কী সব বলছ যা!
অপর্ণা চোখটা একবার খুলে আর একবার বুজে বলেছিল, যা তা বলছি? তা হবে। ফিসফিস কথায় ঘুম ভেঙে গেল, চুপ করে পড়ে পড়ে শুনলাম কত হাসি, কত কথা, বললাম ভগবান আমায় যদি মশারি তুলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াবার ক্ষমতা দিতেন!… দেখতাম কোন্ রাক্ষুসী আমার স্বামীকে
ফেন্ট হয়ে পড়েছিল অপর্ণা তক্ষুণি।
চৈতালীর সঙ্গে কৌস্তুভকেও লাগতে হয়েছিল তার চৈতন্য সম্পাদনের সাধনায়।
আর বার বার মনে হয়েছিল কৌস্তুভের, অজ্ঞান হয়ে গিয়েও যে অপর্ণার চোখটা সম্পূর্ণ বুজে যায় না, সেটা কি লক্ষ্য করেছে চৈতালী?
কৌস্তুভ কি বলে দেবে ওকে, অপর্ণার চোখ দুটো বড্ড বেশী বড় বলেই ওই রকম দেখায়।
বলেই অবশ্য।
জ্ঞান হবার আগেই ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল চৈতালী।
.
তারপর এই।
কিন্তু পৃথিবীতে কি এতও প্রতিবন্ধক!
সুদক্ষিণা বসে আছে ওর কাছে।
এত কিসের হাসি গল্প ওদের?
বার দুই ফিরে এল কৌস্তুভ। তারপর দেখল, সুদক্ষিণা নিজের ঘরে বসে পড়ছে। একা।
নীচে রান্নাঘরে অন্ধকার। বংশীও দেশে গেছে কদিন।
ও তাহলে কোথায় গেল? কোথায় আছে এখন?
দোতলায় নয়, একতলায় নয়, বারান্দায় নয়, সিঁড়িতে নয়, তাহলে?
তিনতলায় কৌশিকের ঘর থেকে ছুরির ফলার মত তীব্র তীক্ষ্ণ একটা আলোর রেখা বারান্দার ওপর এসে পড়েছে।
সেদিকে তাকিয়ে ছুরির ফলার মত জ্বলতে থাকে একজোড়া চোখ। এই তবু জ্বলন্ত চোখের ধার নিয়েও দূর থেকে তাকিয়ে বিন্দুমাত্র দেখা যায় না।
তবে? কাছে যাওয়া ছাড়া উপায়?
একজন বিছানায় পা ঝুলিয়ে, একজন চেয়ারে।
যে চেয়ারে, তার মুখের ওপর জোর পাওয়ারের বিদ্যুৎবাতির সমস্ত আলোটা এসে পড়েছে। পড়েছে শরীরের সমস্ত রেখায় রেখায়। কোলের ওপর পড়ে থাকা শ্যামাভ হাত দুখানা পাথরে গড়া পুতুলের হাতের মত নিটোল মসৃণ। একগাছা করে সরু বালা যেন নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছে সেই মণিবন্ধ দুটি।
ও যেদিন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিল সে তো কতদিন হয়ে গেল! তখন ওর মুখের উঁচু রেখাগুলোর ওপর আলো পড়েছিল, আর ওর হাত দুটো চোখেই পড়েনি।
ওর মুখটা এখন ভরাট আর উজ্জ্বল।
কী বলছে ও? হেসে হেসে?
আর কী বলছে তার উত্তরে বখে-যাওয়া কৌশিকটা? বলছে, হ্যাঁ ঠিক তো। সার্থকনামা মহিলা। চৈতালী ঘূর্ণিই বটে। বাবাঃ একেবারে তচনচ্ কাণ্ড!
কার দোষ শুনি?
দোষ? এর মধ্যে দোষটা কোথা? সবটাই তো গুণ।
গুণ মানে?
মানে গুণতুক, জানো না সে-সব? জানো, ক্ষেণু তাই বলেছিল গোড়ায়। বলেছিল, মেয়েটা নিশ্চয় গুণতুক কিছু জানে ছোড়দা। নইলে মা খামোকা ওকে এত ভজলেন মানে কি? এখন বুঝছি ক্ষেণু কত দূরদর্শী!
আর নিজে? নিজে তো প্রথম দিনেই…
প্রথম দিনের কথা আর তুলো না—
হেসে উঠলো চৈতালী।
যে হাসি কৌস্তুভ কোনদিন চোখেও দেখেনি।
হাসি দেখতে না পেলেও কৌস্তুভ প্রতিনিয়ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর কাজ করা দেখেছে, দেখেছে কত অনায়াস অবলীলায় সংসারের সমস্ত গুরুভার নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়ে সমাধা করে চলেছে। ও। কত শান্ত হয়ে অপর্ণার সেবা করছে। ঘামে না, হাঁপায় না, বসে পড়ে না, নিশ্বাস ফেলে না।
দেখেছে অলক্ষ্য দৃষ্টিতে, ওর নিটোল হাতের ওঠা পড়া, মসৃণ ঘাড়ের কমনীয়তা। শুধু ওর হাসি দেখেনি কোনদিন। দেখেনি হাসলে ওর ঠোঁটটা কত লাবণ্যময় হয়ে ওঠে।
.
ওই হাসি আর ওই লাবণ্যের কাছে কি এগিয়ে আসছে কৌশিক? কৌস্তুভর উচ্ছন্ন যাওয়া ছোট ভাইটা!
কৌস্তুভ দেখবে তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? ছি ছি!
তবে?
নেমে যাবে?
চোখ কান বুজে ছুটে?
না না। চলে যাবার সময়টাও দেবে না বুঝি ওরা।
তবে ঘরেই ঢুকে পড়া ভাল।
দরজার কাছে অন্তত! খুব দরকারী কথার জন্যে ঢোকা যাবে নাই বা কেন?
ঘরে আর কেউ আছে, এ যেন দেখতে পাচ্ছে না কৌস্তুভ। গম্ভীর ভারী গলায় প্রশ্ন করছে, অপর্ণার চুড়িগুলো কোথায় রেখেছ?
চুড়ি!
চমকে উঠল চৈতালী। ছিটকে বেরিয়ে এল চেয়ারটাকে প্রায় ঠেলে দিয়ে। বোবা গলায় বলল, চুড়ি!
হ্যাঁ, ও তখন যেগুলো খুলে রাখতে দিয়েছিল তোমায়!… আচ্ছা থাক, এখন সময় না থাকে পরে দিও।
.
তুমি রাখনি? তোমায় দিইনি আমি?
সর্বশরীর ঘেমে উঠেছে অপর্ণার, নাড়ী বসে গেছে মনে হচ্ছে। বলছে, ভগবান!
সুলক্ষণা একখানা হাতপাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে করতে বলেন, বৌমা, উতলা হয়ো না। একটু ভাবতে চেষ্টা করো, তুমি নিজেই হয়তো
আমি? আমি? তাহলে আমার বালিশের তলা খুঁজে দেখুন।
.
কথাটা সত্যি।
বালিশের তলা ছাড়া আর দৌড় কোথা অপর্ণার? ভারী লাগছে বলে যদি খুলেই রাখে অন্যমনস্ক হয়ে, ওইখানেই রাখবে।
আর কে ঘরে ঢোকে?
কৌস্তুভ।
সুলক্ষণা।
কদাচিৎ সুদক্ষিণা।
সুদক্ষিণাকে দেখলেই বিরক্ত হয় আজকাল অপর্ণা, চোখ এড়ায় না সুদক্ষিণার।
হয়তো যারাই পৃথিবীর আলো বাতাসের উপস্বত্ব ভোগ করে বেড়াচ্ছে, তাদের সকলের ওপরই বিরক্ত অপর্ণা।
অথচ এই কিছুদিন আগেও এ রকম ছিল না সে। তখন শুধুই ঘামত, তখন শুধুই অপরিসীম ক্লান্তিভরা চোখ দুটো তুলে অপ্রতিভের হাসি হাসত।
আর যখন একটু ভাল থাকত, তখন বলত, আমায় কিছু কাজ করতে দিন না মা!
.
সেই সেদিন থেকে অদ্ভুত রকমের বদলে গেছে অপর্ণা। যেদিন থেকে চৈতালীকে বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সুলক্ষণা।