কেন যেমন আছে-আছে, তেমন থাকা যায় না?
যেমন আছে? মানে তোদর সংসারের রাঁধুনী হয়ে? তা হয়তো যায়, তবে কি জানিস খোকা, মানুষ জিনিসটা তো অঙ্কের সংখ্যা নয় যে তাকে ঠিকমত সাজিয়ে নির্ভুল কষে ফেলা যাবে। মানুষের মধ্যে মন বলে একটা বস্তু আছে।
বেশ, আমার আর কিছু বলার নেই। তবে জেনো, ক্ষের বিয়ের জন্যে অসুবিধেয় পড়তে হবে।
.
কৌস্তুভ ক্ষেণুর বিয়ের কথা বলে। যে কৌস্তুভ জীবনে কখনো এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে না।
সুলক্ষণা বলেন, বুঝতে পারছি খোকা, আজ তুই নেহাৎ মরীয়া হয়েই লড়তে এসেছিস, নইলে এত কথা তুই কবে বলেছিস ব? এত কথা জানলিই বা কী করে? কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস বাবা, অনিবার্য বলে একটা শব্দ আছে। সেটা হচ্ছে সম্পূর্ণ মানুষের হাতের বাইরে।
কৌস্তুভের মা ঠিকই বুঝেছেন, মরীয়া হয়েই এসেছে কৌস্তুভ, কারণ অপর্ণা বলেছে চৈতালীর বিষয়ে একটা হেস্তনেস্ত না হলে, অর্থাৎ তার এ বাড়ির বৌ হওয়াটা রদ না হলে অপর্ণা মরবে। কেঁদে কেঁদে হার্ট খারাপ করে মরবে, উপবাস ধর্মঘট করে মরবে, ঘুমের ওষুধ বেশী করে খেয়ে মরবে, যা হয় কিছু করবেই। অর্থাৎ ওর হাতে মৃত্যুর যা যা উপায় আছে, একে একে প্রয়োগ করবে। একটাও কি লাগবে না?
অগত্যাই তবে কৌস্তুভকে মায়ের কাছে আসতে হয় দরবার করতে। কিন্তু সুলক্ষণ ওর কথাকে উড়িয়ে দিলেন। বললেন অনিবার্যকে মেনে নিতে হয়।
তাহলে?
তবু লড়ল, কৌস্তুভ।
বলল অনিবার্যকেই যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে তো মানুষের করণীয় বলে কিছু থাকে না মা। রোগে চিকিৎসা, অসহনীয় অবস্থাকে সহনীয় করার চেষ্টা, সবই দেখছি তাহলে অনাবশ্যক?
সুলক্ষণা এক মুহূর্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই আজ বড় বেশী উত্তেজিত হয়েছিস বাবা, এখন তর্ক করতে বসলে পরে কষ্ট পাবি। তবে আমার কি মনে হয় জানিস, প্রত্যেকেরই এক একটা নিজস্ব এলাকা থাকে, তার বাইরে যেতে চেষ্টা করলেই অনেক ঝঞ্জাট, অনেক দুঃখ। কুশীর ব্যাপারটা বৌমার এলাকায় নয়, এটাই বৌমাকে বুঝিয়ে বলিস।
সুলক্ষণা চলে যান।
কৌস্তুভের মনে হয় এই মাত্র যেন তার চির স্নেহময়ী মা তাকে একটা চাবুক মেরে চলে গেলেন।
কৌস্তুভের সমস্ত সদ্বিবেচনাই যে বৌয়ের তাড়না অথবা প্রেরণা মাত্র, এইটাই তবে জেনে গেলেন সুলক্ষণা!
.
কিন্তু সত্যিই কি তাই?
কৌস্তুভের নিজের ভেতর কি কোনও প্রেরণা নেই? নেই কোন কিছুর তাড়না?
থাক।
যা কিছুই থাক, যত অসহনীয়, যত তীব্র, যত ক্ষোভ দুঃখ হতাশা, তবু ফিরে যেতে হবে সেইখানে। যেখানে এক অবুঝ স্বার্থপর নির্বোধ কুটিল মন নিজের এলাকার বাইরে বেরিয়ে অকারণ জ্বালায় আছড়ে মরছে।
কৌস্তুভের উদ্ধার নেই সেখান থেকে।
অদৃশ্যলোক থেকে অদৃষ্ট দেবতা তাকিয়ে দেখে
সেই নীল শির-ওঠা চুল উঠে-যাওয়া চওড়া কপাল, সাদা খড়ির মত রঙ।
সেই তার ওপর একখানি স্বাস্থ্যবান পুরুষের হাতের থাবা। আস্তে সন্তর্পণে এই কপালের ওপর হাত বুলোচ্ছে সেই পুরুষ।
ওই চামড়ার নীচে অদৃশ্য যে ললাটলিপি লেখা আছে তাকে কি মুছে দিতে চাইছে ওই হাত?
.
তোমার হাতের সেই চুড়িগুলো কি হল?
ভারী লাগে, খুলে রেখেছি।
হাতটা কিরকম যেন দেখাচ্ছে।
আর হাত! হাতটাই আর বইতে পারছি না।
না না, পোরা। এই একটা মাত্র চুড়িতে হাতটা যেন তোমার বলে মনেই হচ্ছে না। কোথায় রেখেছ?
আমি আর কোথায় রাখব?
অসীম ক্লান্তিভরা কাতর চোখের দৃষ্টি তুলে অর্পণা আস্তে বলে, ওকে রেখে দিতে বলেছি।
ওকে! কাকে?
ওই যে চৈতালীকে!
ও আবার কোথায় রাখল?
কি জানি! ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে অপর্ণার।…শিশুর মত বিশ্বস্ত মুখটা শান্ত, সরলতায় শিথিল হয়ে আসে, রেখেছে কোথাও।
.
এই একটা সুযোগ।
এই উপলক্ষ্যে নিজেকে নিয়ে গিয়ে উপস্থাপিত করা যায়।
এখন সুলক্ষণা পুজোয় বসেছেন।
সকালের পুজো নয় যে সংসারের ডাকে তাড়াতাড়ি উঠবেন, এ সন্ধ্যেপুজো। এ সময়ে কোন ডাক নেই সুলক্ষণার জীবনে, তাই যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকেন সুলক্ষণা পুজোর ঘরে।
সুলক্ষণার বড়ছেলে জানে একথা।
না, অন্য কিছু নয়।
শুধু অর্পণার ব্যবহারের জন্য একটু ক্ষমা চাওয়া চৈতালীর কাছে। শুধু বলা, আমি ওর জন্যে লজ্জিত। চোখের ওপর দেখতে পায় তো।
অদ্ভুত একটি অসহায়তা আর কোমলতায় ঢাকা ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সেই নির্যাতন, বসে বসে সহ্য করা কী কঠিন।
গতকালের দৃশ্যটাই এখন শুধু চোখের ওপর দেখতে পায় কৌস্তুভ।
বিছানা ছেড়ে উঠে ইজিচেয়ারে বসেছিল অর্পণা, ন্যাকড়ার ফালির মত লটপটে হাত দুখানা দুপাশে ঝুলিয়ে। তখন তো সেই ঝকঝকে চুড়ির গোছাটা রয়েছে হাতে। তাই আরও সরু আর শিথিল দেখাচ্ছিল হাত দুটো।
চৈতালী বিছানা ঝাড়ছিল।
অপর্ণার বিছানা, কৌস্তুভের বিছানা। ঘরের দু দেয়ালের দু পাশে দুটো খাট।
অপর্ণা ডাকল, চৈতালী!
ও বলল, বলুন!
এর আগে ডানলোপিলোর গদিতে শুয়েছ কখন?
চৈতালী থমকে তাকাল।
বলল, আগে পরে ও কোনদিন চোখেও দেখিনি বৌদি।
অপর্ণা ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি হাসল।
কী যে বল চৈতালী! কাল রাতে যে আমি ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমোইনি, সেটা বোধহয় টের পাওনি!
আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না বৌদি।
এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে কষ্ট হচ্ছিল অপর্ণার, তাই খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে বলল, আমিও তো কিছুতেই বুঝতে পারি না চৈতালী, রাতে যে তোমাকে আমার দরকার হয় না, তবু তুমি এ ঘরে শুতে আস কেন?