চৈতালী মৃদু গম্ভীর হয়ে হেসে বলে, আগুন জ্বালাবারই বা ক্ষমতা কই? দেখে মায়া হয়। আমার কি মনে হয় জানো?
কি?
যদি ধৃষ্টতা বলে না ধরো তো বলি—
গৌরচন্দ্রিকা রাখো, সময় কম!
মনে হয় ওঁর কোন অতীত ইতিহাস আছে।
না না। আগে এমন ছিল না। স্বাস্থ্যভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেহ বাতিক ঢুকিয়ে মনটাকে ছারখার করে ফেলল।
সারবার কী কোন আর আশাই নেই?
আছে! মানে ছিল হয়তো। কিন্তু কোথায় সে সম্ভাবনা? অবিশ্যি সেটা আমার অনুমান। মনে হয় সত্যিকার একটু ভালবাসা পেলে ও হয়তো সেরে উঠত। কিন্তু পুতুলকে সত্যি ভালবাসা দিতে পারে, এমন মানুষ কোথায় পাওয়া যায় বল? আগে ছিল মোমের পুতুল, এখন হয়েছে কাগজের পুতুল। অথচ আবার একটা দিক বেশ তৈরি। ছলনা ধরতে পারে!
সত্যিকারের ভালবাসবার মত লোক কোথাও জোগাড় কর না?
হয় না! এদিকে আবার গোসাঁই বংশের মেয়ে, ঐহিক পারত্রিক সর্ববিধ বিশুদ্ধতা রাখাই ওঁর জীবনের লক্ষ্য। সরলতা আর কুটিলতার এক আশ্চর্য সমন্বয় ওই মহিলাটি। কিন্তু থাক, অনেকক্ষণ পরচর্চা করা গেছে।
তা গেছে। এ সব কথা বলতে ভয় করে। তবু দাদা আর তুমি, দুজনে এক মায়ের ছেলে ভাবতে অবাক লাগে
হঁ, তা লাগতেই পারে। একজন সুমহান হিমাচল, অন্যজন ক্ষুদ্র উইঢিবি, একজন বিশাল সমুদ্র, অন্যজন তুচ্ছ গোম্পদ, একজন বিরাট বটবৃক্ষ, অন্যজন হতভাগ্য তৃণদল, একজন
হয়েছে হয়েছে, থাক। সব বুঝতে পেরেছি। উঃ!
কি, এখন পস্তাচ্ছো তো? ভাবছো এই বাজে বাক্যবাগীশটাকে নিয়ে
আঃ থামো! অত বোলা না, আমার ভয় করে, আমার বিশ্বাস হয় না।
বিশ্বাস হয় না? উইটিবিকে গোষ্পদকে তৃণদলকে তোমার বিশ্বাস হয় না?
চৈতালী শান্ত চোখ তুলে বলে, না, ভাগ্যকে আমার বিশ্বাস হয় না!
এত ভয় কেন?
.
ভয় কেন?
চৈতালী শুধু একটা নিঃশ্বাস ফেলে। কেমন করে বোঝাবে ভয় কেন! এখনো যে ওর মন বলছে এত কেন দিতে আসছ ভগবান? এমন অদ্ভুত অসম্ভব দান তো চাইনি আমি। শুধু একটু নিশ্চিন্ত আশ্রয়, শুধু একটু স্নেহছায়া, শুধু একটুকু সান্নিধ্য, একটুকু চোখের সুখ, এই পেয়েই ধন্য থাকতাম আমি, কাটিয়ে দিতে পারতাম সারাজীবন। তোমার এই প্রচণ্ড দয়ার ভার কি বইতে পারব আমি? জীবনের প্রারম্ভ থেকে কিছু না পেয়ে পেয়ে, পাওয়াটাই যে ভয়ের হয়ে গেছে। তোমার এই অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টির খেলায় আমি কি জিততে পারব? বুঝি হেরে যাব!
.
এই বাড়িরই অন্য এক ঘরে আরও একজন তখন ঠিক ওই কথাই ভাবছিল, আমি তা হলে হেরে যাব! সব দিকেই হার হবে আমার! শাশুড়ী আমায় ভালবাসার ভান করেন, জানি সব মিথ্যে, ওই আঁস্তাকুড়ের জীবটাকে আমার থেকে অনেক বেশী ভালবাসেন তিনি। এরপর ওই রাক্ষুসীই এ বাড়ির সর্বেসর্বা হবে, আমার সামনে, আমার চোখের ওপর সংসারের সব আদর দখল করে নেবে। কৌশিকের সঙ্গে আমার ছোেট বোনটার সম্বন্ধ করাবো ভেবেছিলাম, সে আশায় ছাই পড়ল। সুপর্ণা এ বাড়ির বৌ হয়ে এলে আমার সব কিছু বজায় থাকত। আর
অনেকটা চোখের জল উপচে আসায় অনেকক্ষণ গেল সামলাতে। তারপর ভাবল অপর্ণা, ওই লক্ষ্মীছাড়া বিচ্ছিরি মেয়েটা কি ভাসুর বলে মানবে? ওকেও গ্রাস করবে! যেমন এখন করছে। অথচ কেউ ওর দোষ দেখতে পাবে না। মাকে ও তুক করেছে, বাকীগুলোকে তো বশীকরণ মন্তর দিয়েছে। কে বলতে পারে, ও কো-ঘরের মেয়ে!
আমি তবে কী করব গো? কী করব! হে ভগবান, আমায় তুমি সারিয়ে দিতে পার না! দিতে পার না অগাধ স্বাস্থ্য, প্রচুর শক্তি? ইচ্ছে করলে কী না পার তুমি! তোমার ভাঁড়ারে কত ঐশ্বর্য, তবু এত কৃপণ কেন গো তুমি, এত নিষ্ঠুর কেন?
.
কৌস্তুভ কোনদিন মাকে কোন প্রশ্ন করে না, আজ এসেছে প্রশ্ন করতে।
মা, এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তটাই তুমি তাহলে পাকা রাখলে?
সুলক্ষণা তাঁর বড় ছেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আস্তে মৃদু হেসে বলেন, পাকা বাবার জন্যেই তো সিদ্ধান্ত রে খোকা!
কুশী পাগল হতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে তুমিও পাগল হবে, এটা খুব আশ্চর্য লাগছে!
জগতে প্রতিদিনই কত রকমেব আশ্চর্য ঘটনাই তো ঘটছে খোকা!
এটা বোধকরি সব কিছুকে হার মানাবে। তোমার ভাবী পুত্রবধূর ইতিহাস বোধ হয় ভুলে গেছ!
ভুলবো কেন রে? সেই মানুষটা কি আছে আর?
তোমরাই বল স্বভাব যায় না মলে–
ব্যতিক্রমও থাকে। তাছাড়া কোনটা স্বভাব, কোল্টা অভাব, সেটাও বুঝতে চেষ্টা করতে হয় বৈকি। পরিবেশ মানুষকে যে কী ভাবে কী করায়–
কৌস্তুভ ঈষৎ উত্তেজিতভাবে বলে, মনে হচ্ছে অপর্ণাকে নিয়ে আমাকে এরপর অন্যত্র থাকতে হবে
ওমা! সুলক্ষণাও অবাক হন এবার, বৌমার সঙ্গে যোগাযোগ কোন্খানে? সংঘর্ষই বা কোথায়?
আমরা ভুলতে পারি, কিন্তু ও তো ভুলতে পারে না ও গোস্বামী বাড়ির মেয়ে।
সুলক্ষণা উত্তেজিত হন না, সুলক্ষণা গম্ভীর হন, কিন্তু ওর হাতে খেতে, সেবা যত্ন নিতে, আমার গোসাই বেয়াইয়ের মেয়ে তো কই আপত্তি করেনি খোকা?
খাওয়া আর ইয়ে–মানে ঘরের বৌ করে
সুলক্ষণা এক মুহূর্ত নির্নিমেষ চোখে তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই বড় হয়েছিস, তোর পরামর্শ নেওয়া অবশ্য আমার উচিত। বল্ তবে, ওকে কি চলে যেতে বলব?
চলে যেতে? চলে যেতে বলেছি আমি?
কৌস্তুভ আর একটু লাল হয়।
তবে? সুলক্ষণা শান্ত নির্বিকার গলায় বলেন, তা ছাড়া? কী তবে করবে ও এরপর?