মা মা বলে!
ঠিক বলেছ চৈতালী! এতক্ষণে ধাঁধাটার উত্তর পেয়ে গেলাম! ভাবছিলাম, মা কি রাগ করে?… মা কি নির্লিপ্ত হয়ে?… মা কি অভিমানে?… এখন বুঝতে পারছি, মা সব বুঝতে পেরেছেন, মা বলে। এ সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন মা বলে!
কিন্তু আমার বড় ভয় করছে।
জানি তোমার ভয় করবে। কিন্তু অভয় তো তোমার হাতের কাছেই চৈতালী! তাকে তুমি একটুও কেয়ার করছ না কেন? একবার যদি বলতে পারো, সব তুমি বুঝবে, তাহলেই দেখো ভয় সহজে কেটে যাবে।
কি জানি! যেন মনে হচ্ছে, চিরকাল বুঝি এই ছাতের ঘরের দরজার চৌকাঠটা ডিঙোলেই আমার বুক কাঁপবে, পা অবশ হতে চাইবে।
সর্বনাশ! তাহলে তো দেখছি ঘর বদলাতে হবে।
এই! বাঃ! তাই বললাম বুঝি? না গো না, এখানটা আমার স্বর্গ!
তুমি বলছ ভয় করছে, আমি ভাবছি বাবাঃ বাঁচা গেল। তখন আর দুটো কথার পর তিনটে কথা কইতে গেলেই বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটবে না?
আহা ইস্! তোমারও যেন
আমারও যেন মানে? হতো না নাকি ভেবেছ? নেহাত পৌরুষের মর্যাদাটুকু বজায় রাখতে মুখে বেপরোয়ার ভাব দেখাতে হত!
উঃ কী ওস্তাদ!
ওস্তাদ না হলে চোরকে বাটপাড়ি করে নিতে পারি?
এই, ভাল হবে না বলছি! খালি খালি চোর চোর বলা চলবে না—
একশো বার চলবে! এই তো বলছি–চোর চোর চোর!
.
চোর চোর চোর!
অপর্ণার রক্তহীন মস্তিষ্কে যেন বোলতা ঘুরছে,চোর চোর! সেই চোর মেয়েটা! মায়ের রুপোর গেলাসটা চুরি করতে গিয়ে হাতে-নাতে যে ধরা পড়েছিল। তবু মা ওকে ঘরের অন্দরে এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখন ও মার সোনার কৌটো চুরি করছে!
আমি যদি ভাল থাকতাম।… চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল অপর্ণার। স্নায়ুশিরা রক্তহীন, তবু চোখের ওই জলটা ফুটন্ত লোনা। ওই জলটা ওর রগের পাশটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।
আমি যদি ভাল থাকতাম, ওকে মেরে ফেলতাম আমি! ছাত থেকে ঠেলে ফেলে দিতাম! গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিতাম!…
আমি অক্ষম।
তাই ও আমার সামনে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর অটুট স্বাস্থ্য নিয়ে, ওর নিটোল গড়ন নিয়ে। যেদিন এল, সেদিন ও আমারই মত রোগা ছিল। আমার স্বামীর টাকায় ভাত খেয়ে খেয়ে অতখানি হয়ে উঠেছে ও। অতখানি পুষ্টি, অতখানি লাবণ্য আদায় করে নিয়েছে।
আর এখন
.
বৌদি–আপনার গা মোছর সময় হয়েছে।
চৈতালী এসে দাঁড়াল গামলা তোয়ালে স্পঞ্জ নিয়ে।
হাতের কাছে এমন কিছু নেই যে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারা যায় ওকে। তাই কিছু না পেয়ে শুধু ঝিমঝিমিয়ে ঘেমে উঠল অপর্ণা।
আর এদিকে অনেকক্ষণ খাটতে হল চৈতালীকে সেই ঘাম মুছিয়ে কিঞ্চিৎ সুস্থ করে তুলতে।
তারপর, সুস্থতার পর অপর্ণা সেই সেবার হাতটা ঠেলে দিয়ে বলল, মুছব না। ইচ্ছে নেই।
কাল মোছা হয়নি।
না হোক, অপর্ণা তার সরু সরু কাঠির মত আঙুল কটা বাড়িয়ে চেপে ধরল ওর হাত। শীর্ণ মুখে একটা বিকৃত হাসি হেসে বলল, কাল রাত্তিরে তুই কতক্ষণ ছিলি এঘরে?
রাত্তিরে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর!
আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পর আর আমি থাকতে যাব কেন বৌদি? মশারি গুঁজে দিয়ে
থাকতে যাবি কেন? মশারি গুঁজে দিয়ে? আমি কিছু বুঝি না ভেবেছিস?
হাতটা আর ধরে থাকতে পারে না, ছেড়ে যায়।
বৌদি পাগলামি করবেন না। দেখুন তো কী অবস্থা হচ্ছে শরীরের! এই সব আবোলতাবোল ভেবে মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছেন কেন?
.
বুকের তোলপাড় থামতে সময় লাগে অপর্ণার। আবার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। খামচে ধরে ওর শাড়ীর আঁচলটা।
মিথ্যে কষ্ট! মিথ্যে কষ্ট পাচ্ছি আমি? আমি কি দেখতে পাই না, দিন রাত্রি, চব্বিশ ঘণ্টা তোর ওই দেহটাকে ও চোখ দিয়ে গিলে খায়!
আঃ বৌদি!
ধর্মের নামে শপথ করে বল, একথা সত্যি নয়? বল্ তোর মরা বাবার নাম করে, একথা মিথ্যে! কি, মুখ হেঁট হয়ে গেল তো? জানি জানি, সব জানি। ঘুমের আমার দরকার নেই, তবু আমায় ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে রেখে
আপনি যদি এসব কথা ফের বলেন, আমি আর আসব না এঘরে।
তা আসবি কেন? তোর তো একজন নয়! আমার বোকাহাবা শাশুড়ীটার দুটো ছেলেকেই তো গ্রাস করছিস তুই! দুটোকেই তো
চুপ করে যায় অপর্ণা।
বৌদি! বৌদি!
ধরে নাড়া দেয় চৈতালী। বাইরে গিয়ে ডাকে, ক্ষেণু, শীগগির একবার এসো তো!
.
ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?
কৌশিক অনেক চেষ্টায় একবার আটক করে। বলে, ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?
কী আর! বৌদি হঠাৎ মূর্ছা গিয়েছিলেন–
অকারণ?
ওঁর মূৰ্ছা যাওয়ার কারণ থাকে নাকি?
থাকে না। দৃশ্যত থাকে না, কিন্তু অলক্ষ্য লোকে কিছু থাকে। দাদার ব্যবহারে যদি ওঁর অভিযোগের কোন পথ থাকত, যদি অবহেলার অপরাধে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারতেন দাদাকে, তা হলে হয়ত এত মূৰ্ছা যেতেন না বৌদি। ভেতরের বাষ্পেচ্ছাসটা কিছু প্রশমিত হত। কিন্তু দাদা ব্যক্তিটি এমন পারফেক্ট ভদ্রলোক যে–
তোমার তো সাহসের অভাব নেই। একদিন দাদাকে নির্জনে ধরে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দাও না।
বোঝাতে গেলে আকাশ থেকে পড়বে।
ওটা বাড়িয়ে বলছ। খুব খারাপ লোক নাকি?
কৌশিক এবার গম্ভীর হয়।
বলে, না, লোক খারাপ বললে অবিচার করা হয়, খারাপ হচ্ছে ওনার ভাগ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের মত খারাপকে খারাপ বলে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে, উনি সেটাকেই পরম সুখ বলে মেনে নেওয়ার ভান করতে বসেই অবস্থা জটিল করে তুলছেন। বৌদিকে যদি এতটা এমন না করতেন, সত্যি দুঃখের কান্না কেঁদে হালকা হয়ে বাঁচত বৌদি। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তাই কান্নার পাথরের ভার বয়ে বয়ে কখনো আগুন জ্বালছে, কখনো হয়তো মুছা যাচ্ছে।