কৌস্তুভও সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল তার পিঠে হাতটা ঠেকিয়ে। শুধু যাবার সময় মাকে উদ্দেশ করে বলল, তুমিও বেশী কষ্ট পেও না মা, যা পারে বংশী করুক।
যা পারে বংশী করুক।
তার মানে? মেয়েটাকে ধরে মারুক বংশী, না কি? বংশী ওর বেশী আর কি, ও ছাড়া আর কি পারবে? দু ঘা মেরে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া?
সুদক্ষিণা কুদ্ধস্বরে বলে ওঠে, হয়ে গেল বাড়ির কর্তার রায় দেওয়া! এবার কর্তার মা কি বলেন দেখি! চোর ধরা পড়লে পুলিস ডাকে না, এমন বাড়িও যে থাকে তা এই আজ দেখছি!
তোরা যাবি?
সুলক্ষণা প্রায় ধমকে ওঠেন, মশা মারতে কামান দাগার প্রবাদটা যে তোরা সত্যি করে তুললি দেখছি!
মশা! সুদক্ষিণা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, এই সব মশামারি পিছনে কত কত বাঘ সিংহীর গ্যাং থাকে জানো তুমি?
সুলক্ষণা যেন মেয়ের এই রাগের বহরে কৌতুক অনুভব করেন। সেই কৌতুকের স্বরেই বলেন, কি করে জানব বল, তোদের মতন তো রাতদিন ডিটেকটিভ গল্পের বই পড়ছি না। আমার বুদ্ধিতে যা কুলোয় তাই করব।
চলে আয় ক্ষেণু, কৌশিক বড় একটা মোচড় দিয়ে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলে, পরিণতি বুঝতেই পারছি। স্রেফ সদর দরজাটি খুলে সসম্মানে বিদায় দেওয়া। আহা উঠোনের ওই শ্যাওলার ওপর দিয়ে কত শ্রম স্বীকার করে এসেছেন মহিলাটি, তা তার আগে বোধ হয় অতিথি সৎকার পর্বটাও ভালই হয়ে যাবে। চল, চল! মা আমাদের উপস্থিতিতে মিটসেটা খুলতে পারছেন না। সকালের জন্যে তোমার কি মজুত আছে মা? রাজভোগ? চমচম্? কেক? ডালমুট?
সুলক্ষণা হেসে ফেলে বলেন, তুই যাবি?
এই তো চলে গেছি।
সুদক্ষিণাও যায়, কিন্তু ওদের মত ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে না। সিঁড়ির ওপরকার ল্যান্ডিঙে বসে থাকে কোণ ঘেঁষে। যাতে নীচের তলার কথাবার্তা শোনা যায়।
কিন্তু সুলক্ষণা হচ্ছেন সুদক্ষিণার মা। বুদ্ধিতে ওর চেয়ে তিনি কাঁচা হবেন এমন আশা নিশ্চয়ই করা যায় না। তাই মেয়েটার হাত চেপে ধরে সরে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকে দৃঢ়স্বরে উনি বলেন, নাম কি তোর?
.
নাম কি তোর!
পাকা বুদ্ধি সুলক্ষণা কি আশা করছেন জিগ্যেসমাত্র উত্তর দেবে সে, নাম কি, বাড়ি কোথায়, বাপ কি করে, বংশপরিচয় কি রকম!
না, তা হয়তো আশা করেননি, তবু কথার মাত্রা হিসেবেই প্রশ্ন করেন, নাম কি তোর?
মেয়েটা জ্বালাভরা চোখ দুটো তুলে, রূঢ় গলায় উত্তর দেয়, নামের কি দরকার আপনার? পুলিসে দেবেন তো দিন, চাকর দিয়ে মার খাওয়াতে হয় তো তাই মারুন।
এতক্ষণে সুলক্ষণার মুখে রাগের ছাপ পড়ে।
গলায় বিরক্তির সুর ফোটে।
বলেন, দেখে তো অন্তত একটু ভদ্রঘরের মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল, কথাবার্তা তো তেমন নয়? শুধু চোরই নয়, ভারী অসভ্যও দেখছি।
মেয়েটা কিন্তু এ ধিক্কারেও বিশেষ দমে না, তেমনি গলাতেই বলে, চুরি করতে এসেছি, তবু ভদ্রঘরের মেয়েই বা আমায় ভাবছেন কেন?
ভাবছিলাম তোর চেহারা দেখে। চুরি অমন অনেকেই করে অভাবে পড়ে। ভিক্ষে করতে বাধলে চুরি করে বসে। কিন্তু কথাবার্তায় কিছুটা সভ্যতা রাখ। নাম কি বল্? চুরি করবার মতন এমন কি তোর অভাব পড়ল ব? পেছনে বাঘ সিংহীর দল আছে কিনা তাও বল্।
মেয়েটা এবার রূঢ়তা ছেড়ে বিদ্রূপ ধরে।
অতবড় মানুষটা বলে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করে না, বলে ওঠে, কেন, ভুলিয়ে-ভালিয়ে দলের নাম বার করে নিয়ে তবে আমায় পুলিসে দেবেন?
সুলক্ষণা নির্নিমেষনেত্রে ওর মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে বলেন, আমার বড় বড় ছেলেরা পর্যন্ত আমায় কত ভয় করে, জানিস?
জানতাম না। দেখলাম।
তবে? তুই আমার বাড়িতে চুরি করতে এসে আমায় অগ্রাহ্য করবি? বাড়ির নিয়ম উলটে দিবি? আমায় ওদের কাছে খেলো করবি? নাম বল্।
মেয়েটা এবার হঠাৎ মাথাটা হেঁট করে।
তারপর ঈষৎ ভাঙা গলায় বলে, চৈতালী!
চৈতালী? ও বাবা, এ যে একেবারে কবিতার পাতা থেকে ঝরে পড়ল! এবার বিদ্রুপের পালা সুলক্ষণার, এত বাহারি নামটি কে রেখেছিল? নাম যে রেখেছিল, সে বুঝি নামকরণ করেই মরে গিয়েছিল? তাই তারপর নামের আর কোনো দায়িত্ব নিতে পারেনি?
মেয়েটা ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, ঠিকই বলেছেন। শুনতে পাই জন্মাবার আগেই মা নামকরণটা করে রেখেছিলেন। বলেছিলেন, চৈত্র মাসে জন্মাবে, ছেলে হলে নাম রাখবো চৈৎ সিং, মেয়ে হলে চৈতালী! তা মেয়ে কি ছেলে, সে আর নাকি বুঝেও যাননি। অজ্ঞানের মধ্যেই
সুলক্ষণা একটু থতমত খান।
নেহাতই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যে প্রশ্নটা করেছিলেন, তার এমন একটা উত্তর পাবেন ভাবেননি। এবার একটু শান্ত কোমল স্বরে বলেন, তোর সব পরিচয় আমায় খুলে বল্ দিকি? শুনি কার প্ররোচনায় পড়ে এই বয়সে
বংশী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হতাশ-চোখে দুই হাতের তেলো উলটে পরমহংসের ভঙ্গী করে বোধ করি বাকী কাজ সারতেই চলে যায়।
অপর্ণা শোবার ঘরে গিয়ে খাট পর্যন্ত না এগিয়ে দরজার সামনে রাখা সরু ডিভ্যানটায় বসে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, আশ্চর্য, সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে চলে এলে তোমরা!
কৌস্তুভ ব্যস্ত হয়ে পাখার রেগুলেটারটা ঠেলে দিয়ে, আর স্ত্রীর হাতের কাছে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলে, পরে কথা বোলো, আগে একটু সুস্থ হয়ে নাও।
অগত্যা জল খেয়ে আর পাখা খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে অপর্ণা বলে, কি করে যে ওকে একা মার কাছে রেখে চলে এলে
বংশী তো রয়েছে।