নৈবেদ্যের ত্রুটি সহ্য করবে, এমন ক্ষমতা নেই অপর্ণার। অথচ অপর্ণা খাঁচার শিকে ডানা ঝাঁপটায়।
কিন্তু সেই ঝাপট যার গায়ে লাগে, সে এক অদ্ভুত সহিষ্ণুতার অবতার। একবার বলে ওঠে না, আঃ!
বলে ওঠে না, এই চুপ!
.
সুলক্ষণার আজকাল আবার একটু কাজ বেড়েছে।
বংশীর অসুখ, চৈতালী বেশীর ভাগ অপর্ণার ঘরে। নেমে এসে ভাঁড়ারে বসে ময়দা মাখছিলেন তিনি, চৈতালী এসে দাঁড়াল। এসেছিল অপর্ণার জন্যে জারক লেবু নিতে, ভুলে গেল, থমকে দাঁড়াল।
বলল, মা!
মা বলে অনেক দিন ডাকেনি। এমন নিভৃতির সুযোগই ঘটেনি অনেক দিন। চিরকঠিন সুলক্ষণার হঠাৎ চোখের কোণে জল এসে গেল এই ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর দিতে পারলেন না।
চৈতালী কাছে বসে পড়ল, রুদ্ধকণ্ঠে বলল, মা, আমার হয়তো এবার চলে যাওয়া উচিত।
.
সুলক্ষণার অভিমান, এটা একটা আশ্চর্য বস্তু! ওঁর মেয়ে-ছেলেরা কেউ দেখেছে কিনা সন্দেহ, তবু সেই আশ্চর্য বস্তুটা চোখে দেখতে পেল চৈতালী।
সুলক্ষণা বললেন, কেন, চলেই বা যাবি কেন? তুই তো এখন বড় গাছে নৌকো বেঁধেছিস!
চৈতালী একটুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর দাঁড়িয়ে উঠে আস্তে বলল, মা, বৌদি একটু জারক লেবু চাইছেন।
সুলক্ষণা এ মুহূর্তে একথা প্রত্যাশা করেননি। চকিত হলেন। মুখে চোখ তুললেন, দেখলেন ভয়হীন বেদনাহীন ব্যাকুলতাহীন অদ্ভুত এক নির্লিপ্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চৈতালী। আগুন লাগা ঘরের সামনে বুঝি এমনি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ।
সুলক্ষণা শঙ্কিত হলেন।
সত্যি চলে যাবে না তো মেয়েটা? বনের পাখী ভালবাসায় বশ হয়ে আটকে পড়েছিল। সুলক্ষণা যদি সে ভালবাসা তুলে নেন, যদি হাতের ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দেন, উড়ে যাওয়া তার পক্ষে বিচিত্র কি?
কিন্তু?
কিন্তু আরও এক কঠিন শেকলে তো বাঁধা পড়ে গেছিস রে বাপু! সে শেকল ছিঁড়তে পারবি?
সুলক্ষণার মনে হল ওর মুখে শেকল ছিঁড়ে বাইরে এসে দাঁড়ানোর ছাপ। চোখে জল নেই, মুখে রেখা নেই, শুধু একটা শূন্যতা।
বিচলিত হলেন একটু।
বললেন, বোস!
তারপর বললেন, চলে যাবি বলে তো খুব শাসাচ্ছিস, পারবি চলে যেতে?
চৈতালী শূন্যে দৃষ্টি তুলে বলল, তা সত্যি সহজে পারব না, কষ্ট হবে ঠিকই।
তা চলে যাবার কি হল হঠাৎ?
মা! তুমি তো সবই বুঝতে পারো।
সুলক্ষণার চোখেও একটা গভীর শূন্যতার ছায়া ঘনিয়ে এল। খুব আস্তে বললেন, যেন নিজেকেই তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি সবই বুঝতে পারি। বুঝতে পারছি। কিন্তু হেরে তুই পালিয়ে যাবি কেন?
আমি কি একটা মানুষ মা? তাই হার-জিতের কথা? তুমি দয়া করে রেখেছিলে, কৃতার্থ হয়ে ছিলাম, এখন দেখছি তোমার সুখের সংসারে অশান্তি আনলাম আমি, শান্ত ঘরে ঝড়। তবে? শুধু নিজের স্বার্থের মুখ চেয়ে লড়াই করে জিততে যাব?
.
সুলক্ষণা অবাক হলেন।
চৈতালী যে এত ভাবতে পারে, সে ভাবনাকে এত সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারে এ যেন তার কাছে অভাবনীয় ঠেকল।
হঠাৎ মনে হল, যে মেয়েটাকে এই কত দিন যেন আগে এই ঘরে টেনে এনে হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, তোর নাম কি বল? এ যেন সে মেয়েটা নয়।
তার মুখের আদল চুরি করে আর একজন কে বসে আছে তার কাছে। একে চেনেন না সুলক্ষণা।
এই অচেনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটা অসতর্ক কথা বলে বসলেন সুলক্ষণা।
বললেন, তা জিততেই হবে। স্বার্থ তো শুধু আর এখন একা তোর নয়। আমার ছেলেটা যে তোর স্বার্থে মাথা মুড়িয়ে বসে আছে।
মা!
সুক্ষণা ওর লুটিয়ে-পড়া মাথাটার ওপর একটা হাত রেখে বলেন, আমি সব জানি চৈতালী! শুধু–মিথ্যে বলব না, মনকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। বাধছিল। কিন্তু ভেবে দেখছি, মিথ্যে সংস্কারই যদি সব সিংহাসন দখল করে থাকবে, তাহলে বুদ্ধি বিবেচনা, মায়া মমতা, এরা কোথায় ঠাই পাবে?
মা!
হ্যাঁ মা? আর কোনদিন মাসীমা নয়।
মা! আমায় মাপ করো। ছেড়ে দাও। তোমার মাথা হেট হবে, এমন কাজ করবার সাধ্য আমার নেই।
সুলক্ষণা শান্ত হাসি হেসে বলেন, আমার মাথাটা কিসে হেঁট হবে, আর কিসে উঁচু হবে, সে বিধান কি তোর কাছে নিতে যাব আমি? এ তো শুধু তোর কথা নয়, এ যে আমার কুশীরও কথা! আমার নিজের সন্তানের কাছেই যদি আমি আমার স্নেহ নিয়ে, উদারতা নিয়ে, ক্ষমা নিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারলাম, বাইরের পাঁচজনের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মূল্যটা কী? সে তো মেঘের প্রাসাদ! যে কোনও সময় বাতাসে উড়ে যাবে, আকাশে মিলিয়ে যাবে।
মা, আমি কি করে মুখ দেখাব তোমার কাছে? আমি যে এ ভাবতেই পারছি না?
সুলক্ষণা এবার একটু হালকা হলেন।
একটু হাসলেন।
বললেন, আমার উদোমাদা বোকা ছেলেটার সঙ্গে দিব্যি তো আমার আড়ালে প্রেম করতে পারছিলি? এখন বিয়ের বেলায় আর ভাবতে পারছিস না! মুখ দেখাতে লজ্জা করছে!
হাতের তালুতে আগুন থাকে, হাতের তালুতে উত্তাপও থাকে। আঙুলের ডগায় থাকে সেই উষ্ণতা, যে উষ্ণতা থাকে শীতের সকালের প্রথম রোদে, বৃষ্টির সন্ধ্যায় ঘরের আরামে।
তাই আর ছাড়ুন বলতে ইচ্ছে হয় না।
শুধু সেই হাত ধরা হাতটায় মুখটা রাখতে ইচ্ছে করে।
চৈতালী!
উ!
চৈতালী!
বল।
খুব অদ্ভুত লাগছে না তোমার?
আমার জীবনের কোনটা অদ্ভুত নয়?
তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, কি করে বুঝতে পারলেন বল তো? কি করে এ সিদ্ধান্তে এলেন?