তবু কী পরিচ্ছন্ন, কী সভ্য সুন্দর!
ওর মাত্রাবোধকে সমীহ করে সুদক্ষিণা।
সুলক্ষণার অভাবিত প্রশ্রয়ের আশ্রয় পেয়েও দিশেহারা হয়নি ও। সুলক্ষণার অতখানি দামী ছেলের কাছে দামী হয়ে উঠেও আত্মহারা হয়নি। অতবড় পাওয়াকে নিজের মধ্যে সংহত রেখে, সেই বাটনা বাটা, কুটনো কোটা, রান্না করা, কাপড় কাঁচার মধ্যেই নিজেকে অমন করে সমাহিত রাখা কি সহজ ক্ষমতার পরিচয়!
সুদক্ষিণাকে যদি হঠাৎ কোনও রাজপুত্র এসে বরমাল্য দেয়?
সুদক্ষিণা কি মাটি দিয়ে হাঁটবে?
এই প্রশ্ন নিয়ে সুদক্ষিণা চৈতালীকে সমীহর চোখে দেখে। ওদের দুজনের ভালবাসাকে তাই স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হয় না।
কিন্তু কৌশিকের মন এখনো প্রশ্নহীন নয়।
কৌশিক ভাবছে এটা কি সত্যি?
নাকি সেই তুচ্ছ বস্তুটা?
একটা তরুণী মেয়ের প্রতি পুরুষের যে সহজাত মোহ, সেই-টা? অথবা করুণা?
ওর সঙ্গে আমার যে অসাম্য, সে কি আমি করুণা দিয়ে অনেকখানি ভরাট করে তুলে ভুল করতে বসেছি?
সুদক্ষিণা বলে, এই ছোড়দা, কবে বলবি মাকে?
ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? সবুরে মেওয়া ফলে।
ওদিকে আর এক খেলা চলছে, খোঁজ রাখিস?
কি?
বড়গিন্নীর সারাক্ষণ চৈতালীকে না হলে চলছে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমার রাগারাগিতে সেই একটা নার্স রাখা হয়েছিল কদিন, দেখেছিলি তো?
দেখে থাকব! ওই জাতীয় একটা জীবকে কদিন যেন ঘুরতে দেখেছিলাম মনে হচ্ছে—
বিদেয় করে দিয়েছে সেটাকে। ওষুধ খাওয়াতে এসেছিল, হাত কামড়ে দিয়েছে তার
ফাইন! সুপারফাইন! দেখা যাচ্ছে কামড় দেওয়া ব্যাপারটা ছোটলোকের একচেটে নয়, স্রেফ মেয়েলোকদের একচেটে।
চৈতালীর এবাড়িতে আসার প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে গেল সুদক্ষিণার। ছোড়দার মুখের দিকে চেয়ে হাসল একটু।
তারপর বলল, সে যাক। সে নার্স তো পত্রপাঠমাত্র পদত্যাগপত্র! বৌদি এখন চৈতালীকে সর্বদা চাইছে, বলছে, সংসারের কাজের জন্যে অন্য লোক রাখো তোমরা–
কিন্তু অহেতুক এই রাহুর প্রেমের হেতু?
জিগ্যেসের সঙ্গে সঙ্গেই নিজের একটা প্রশ্নের উত্তর পায় কৌশিক। কদিন ধরেই দেখছে, চৈতালী যেন দুর্লভ হয়ে উঠেছে, দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না তার। এমন কি মাঝে মাঝে বেঁধে বেড়ে রেখে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, ভাত বেড়ে দিচ্ছে বংশী।
মনে ভেবেছিল, হয়তো এ চৈতালীর নতুন জন্মানো লজ্জা, হয়তো বা নিজেকে গুটিয়ে রাখবার, সরিয়ে রাখবার দুরূহ সাধনা, আর নয়তো বা হা, একথাও ভেবেছিল কৌশিক, নয়তো বা কৌশিককে যাচাই। দুর্লভকে লাভ করবার জন্যে চেষ্টা করে বেড়ায় কিনা কৌশিক, তারই পরীক্ষা!
আজ বুঝল, ওসব কিছু না।
হরিণী ব্যাধের জালে আটক।
কিন্তু আটকের মানে পেল না। ইদানীং বৌদির ঘরে সে কদাচ ঢোকে। নেহাত মরণ বাঁচন শুনলেই তবে। তাই দেখেনি, ওখানে চৈতালীর অবস্থাটা কি।
তাই বলল, হেতু?
সুদক্ষিণা অবশ্য বেশী আলোকপাত করতে পারল না। সব প্রশ্নের যেটা শেষ উত্তর, সেটাই বলে দিল দু হাত উলটে, ঈশ্বর জানেন।
যাক তাহলে সময়মত সেই লোকটাকে একবার শুধিয়ে এলেই হবে।
আহা রে.. তবে শোন্
কী? আমার মনে হয়, বৌদি তোদের সন্দেহ করে।
সন্দেহ করে?
হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়।
তা এসব অধমাধম তুচ্ছ ব্যক্তিদের সন্দেহ করে ওঁর কী লাভ?
বাড়ির বড়গিন্নী, বোধহয় বাড়ির পবিত্রতা বজায় রাখবার দায়টা নিজের বলে গ্রহণ করেছেন। অথবা ভাবছেন, বিশ্বে শুধু নড়িবেক মোর ল্যাজটুকু! এ সংসারের তাবৎ আগ্রহ ঔৎসুক্য আর ভালবাসার ওপর ওঁর একচেটে অধিকার। আর কোথাও কিছু ঘটলেই ওনার নৈবেদ্যে কম পড়ে যায়।
হুঁ, মনস্তত্ত্বজ্ঞানটা যে বেশ জবর হয়ে উঠছে দেখছি।
না রে ছোড়দা সত্যি, আগে এত বুঝতে পারতাম না, সর্বদা ভয় পেতাম ওই বুঝি কি হয় বলে, এখন যেন অরুচি ধরে গেছে। ওর স্বার্থপরতা, আর দাদার কী বলব, কী আর বলব, স্ত্রৈণতাই, ঘেন্না ধরিয়ে দিয়েছে একেবারে। বুঝলাম যে রুগ্ন বৌ, তা বলে ন্যায্য অন্যায্য বলে কিছু থাকবে না? এটুকু বুদ্ধি থাকবে না যে ও ওই রোগ ভাঙিয়েই
এই থাম!
.
এই থাম!
সাবধান করে দেবার সময় এসেছে।
চৈতালী এসে দাঁড়িয়েছে।
দিদি!
কী গো?
এখন কি কেউ বেরোবেন?
কেউ মানে তো ছোড়দা। ওকেই জিগ্যেস করে দেখ।
চৈতালী মৃদুস্বরে বলে, জিগ্যেস করবার আর কী আছে। বলছিলাম যে থার্মোমিটারটা তো ভেঙে গেছে, আর একটা এনে রাখতে
ভেঙে গেছে। শুধু থার্মোমিটারটা? না আর কিছু?
চৈতালী চোখ তুলে বলে, না, আর কি ভাঙবে!
তা বটে, ভাঙতে হলে হাড়। তা অত বোধ করি ক্ষমতা নেই তোমার পেসেন্টের। বড় জোর চামড়াটা একটু ছিঁড়েখুঁড়ে
চুপ করুন।
চৈতালী চলে গেল। দ্রুতপায়ে।
অপর্ণা আস্তে আস্তে ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
.
বৌদি আজকাল ক্রমশই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে
নিঃশ্বাস ফেলে বলে সুদক্ষিণা।
কৌশিকও একটা নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর আস্তে বলে, অথচ ওঁকে বাঁচানো যেত।
যেত?
যেত। যদি ওঁকে নিয়ে এমন শবসাধনার মহোৎসব করা না হত। যদি খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া হত ওঁর।
খাঁচার দরজা খোলা পেলে কী করত ও শুনি?
খাঁচায় বন্ধ পাখীরা যা করে। উড়ে যেত।
না, তা যেত না সুদক্ষিণা বলে, পারত না! ওর কাছে ওই নিয়মিত ছাতু ছোলারও যে রীতিমত মূল্য আছে। আকাশের স্বপ্ন দেখেছে ও, কিন্তু ছাতুর ভাড়টা আঁকড়ে ধরে আছে।
আছে, তাই আছে।