কর সেটা তোমার মনের গুণ। কিন্তু আমি মনে করি না, আমাদের সংসারে দাসত্ব করে খুব একটা ধন্য হচ্ছ তুমি।… ওই সব হাবিজাবি কাজগুলো কমিয়ে এই জ্ঞানরাজ্যের সীমানায় এসে দাঁড়াও একটু, দেখবে তোমার এখনকার হিসেব সব অর্থহীন হয়ে যাবে।
.
সেই জ্ঞানরাজ্যের চাবিকাঠিটি হাতে তুলে দিতে চাইছে ওরা। চৈতালী কি অবহেলা করবে তাকে?
বইগুলো নিয়ে বসে।
মনে হয়, বাবা যদি মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি বসিয়ে না রাখতেন, আমিও হয়তো দিদির মত
সুলক্ষণা কোন একসময় হয়তো উঠে পড়েন। পাশ থেকে দেখতে পান, চৈতালী বইখাতা নিয়ে বসে আছে চুপচাপ! শুকনো, ম্লান মুখ।
স্বাস্থ্য খুবই ভাল হয়েছে ওর এখন, কিন্তু যখন একা থাকে, মুখটা বড় ম্লান দেখায়। যন্ত্রণার কপাল মেয়েটার। জীবনের মোটা যন্ত্রণার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্ম আর এক যন্ত্রণা কুরে খেতে বসেছে ওকে।
ভারী মমতা হয় তখন।
মনে হয়, আমি কেন ওর ওপর বিরক্ত হচ্ছি, ওর তো বয়েস কম, এই তো ভালবাসবার সময়। ওর সামনে যদি, ওর এই ঠিক ভালবাসায় বিকশিত হয়ে ওঠবার বয়সে, কৌশিকের মত ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়, কি করে নিজেকে রুখবে ও?
না, ওকে আমি দোষ দিতে পারি না।
ও তো মেয়েমানুষ।
মেয়েমানুষ যে ভালবাসায় ধন্য হয়ে যাবার জন্যই জন্মায়।
সুলক্ষণার এই মতবাদ শুনলে হয়তো লোকে হেসে উঠবে। বলবে, এ যুগে অন্তত তোমার ওই পচা থিয়োরি অচল। এ যুগের বহুমুখী প্রতিভাধর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখ। কত দিকে নিজেকে বিকশিত করে তুলছে তারা, স্বয়ংসম্পূর্ণতার দৃষ্টান্ত নিয়ে।
পুরুষের ভালবাসা তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বস্তু।
বলবে।
বলুক কিন্তু তা হয় না।
প্রকৃতির নিয়ম উলটোয় না।
একটি পুরুষের ভালবাসা ভিন্ন কোনও মেয়েই সম্পূর্ণ নয়। অনুসন্ধান করো, দেখবে তার আপাত একক জীবনের অন্তরালে স্পন্দিত হচ্ছে একটি প্রেম–আকাশের কোলে ধ্রুবতারার মত, নাট্যপ্রবাহের পেছনে আবহ সঙ্গীতের মত।
সেই প্রেম তার সমস্ত জীবন ব্যেপে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রাখে কল্যাণের দূরত্ব বজায় রেখে। রাখে গোচরে অগোচরে, জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে।
সে প্রেম সমাজবিরোধী কাজ করে তার জীবনের মানসীকে ধুলোয় টেনে নামায় না, শুধু হৃদয়ের উপস্থিতি দিয়ে ভরিয়ে রেখে দেয়।
নিঃস্বার্থ?
নিঃস্বার্থ প্রেম হয় না বলবে?
কিন্তু নিঃস্বার্থ কোথায়? সেই তার মানসী প্রিয়ার সুন্দর হয়ে ওঠা, মহৎ হয়ে ওঠা, উজ্জ্বল হয়ে ওঠাই তো তার স্বার্থ।
যে মেয়ে সত্যি একক, সত্যি নিঃসঙ্গ, সে কৃতী হতে পারে, উজ্জ্বল হয় না। সাফল্য অর্জন করতে পারে, সার্থক হয় না। সে তার অনেক জ্ঞানবুদ্ধি কর্মদক্ষতা, অনেক প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি প্রাধান্য, অনেক যশ অর্থ সম্মানের বোঝা নিয়েও শুকিয়ে যায়, বুড়িয়ে যায়, নিষ্প্রভ হয়ে যায়।
মেয়েদের জীবনে মূল জীবনীরস ভালবাসা। সমাজ তাই ভয় পায়। তাই সদাসর্বদা শাসনের তর্জনী তুলে বসে থাকে, তাই অহরহ নিক্তি ধরে বিচার করে দেয়, কোনটা বৈধ, কোনটা অবৈধ, কোনটা শ্রেয়, কোনটা অশ্রেয়, কিসে কল্যাণ, কিসে অকল্যাণ।
না করে উপায় নেই। নইলে বাঁধ ভাঙবে মেয়েরা, কূল ছাপাবে। বাঁশীর ডাককে উপেক্ষা করবার শক্তি খুঁজে পাবে না।
.
এত সব ভাবেন সুলক্ষণা। বুদ্ধি দিয়ে, বিচার দিয়ে।
কিন্তু চোখের সামনে ওই হাসি ঠাট্টা কৌতুক কলগান কিছুতেই যেন ভাল লাগে না।
চৈতালীকে মেয়ের আসনে বসাতে পেরেছিলেন এক মুহূর্তে, তার অতখানি ত্রুটির বোঝা সত্ত্বেও পেরেছিলেন। কিন্তু বৌয়ের আসনে বসাবার কথা ভাবতেই পারছেন না। সমস্ত মনটা যেন সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে।
তাই বারবার ভাবতে চেষ্টা করছেন সুলক্ষণা–আমার বড়ছেলের বৌকে এনেছিলাম আমি সেরা কুলীনের ঘর থেকে, সমাজের উঁচু চূড়ো থেকে!
.
হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। একেবারে উঁচু চুড়ো থেকেই অপর্ণাকে এনেছিলেন এঁরা।
তাই নীচু হবার উপায় হল না অপর্ণার। নীচু হতে পারছে না বলেই জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অসতী মেয়ের কাহিনী শুনলে শিউরে উঠতে হয় ওকে, কুমারী মেয়ের কলঙ্ক কথা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়, তাই আঙুর আপেল বেদানা ছানা ডিম দুধ মাছ মাংসের সমারোহের মধ্যে ডুবে থেকেও শরীরে ওর রক্ত হয় না। আর অনেক উঁচু থেকে এসেছে বলেই বোধ করি এই নীচু তলার মানুষদের বিশ্বাস করতে পারে না সুলক্ষণার বড়বৌ।
চেষ্টা করেছিল।
বিয়ের পর প্রথম কিছুদিন চেষ্টা করেছিল। সাধনা করেছিল উজ্জ্বল হয়ে ওঠবার, পারল না। ব্যর্থ হল। বিছানা নিল।
তবু উঁচুঘরের কথাই ভাবেন সুলক্ষণা।
হাড়ে মজ্জায় যে সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে আছে, তাকে তিনি উড়িয়ে দিতে পারেন না। মেয়ে আর বৌকে সমান কোঠায় ফেলতে পারেন না।
.
সুদক্ষিণা কিন্তু মার থেকে উদার।
সুদক্ষিণা সমাজ-সংস্কারমুক্ত বলে নয়, সুদক্ষিণা আধুনিকা বলেও নয়, সুদক্ষিণার মনটা সহানুভূতিপ্রবণ বলেই। ও ভাবে মরুকগে বাবা, হলেই বা। ছোড়দা যখন ঘেন্না করছে না, তখন দোষ কি? তোমাদের পুরাকালের শান্তরেও তো আছে বাবা স্ত্রীরত্নং দুঙ্কুলাদপি!
চৈতালী কি রত্ন?
তা যে মেয়ে যাকে ভালবাসল, প্রধানত সেই তো তার কাছে রত্ন হয়ে উঠল। তা ছাড়া কেনই বা রত্ন নয়?
কী পরিবেশে মানুষ হয়েছে ও!