কৌশিক মনে মনে বলল, ওঃ খুব যে তেজ। ভস্ম করে ফেলবে যেন। তবু যদি না ভদ্রঘরের মেয়ে হয়ে পরের বাড়িতে চুরি করতে আসতিস।
মনে মনে তুই বলতে দোষ নেই। ভাবল কৌশিক, সবাইকেই বলা চলে। আর এ তো চোর। না, বাংলায় এম. এ. হলেও চট করে চোরের স্ত্রীলিঙ্গ খুঁজে পেল না কৌশিক।
কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়ে ধরে নিল কেন তাকে এরা? একা কৌশিক নয়, সবাই। পুরোপুরি পাকা চোরের মত রাতের অন্ধকারে যে বাসন কাপড় চুরি করতে আসে, তাকে ভদ্রঘরের মেয়ে ভাবার হেতুটা কি? ওর মুখ চোখ ভঙ্গী?
তা ও-রকম মুখ চোখ কি এতই দুর্লভ? রঙ তো বেশ ময়লাই। একটু টিকলো নাক, একটু সুগঠিত ঠোঁট এ তো কত শাকওলি মাছওলিদেরও থাকে।
থাকে।
কিন্তু ওই বিশেষ ভঙ্গীটা তাদের থাকে না বোধ করি। তাই সকলেই মনে মনে ভাবল, ছি ছি, ভদ্রঘরের মেয়ে, এই বয়সের মেয়ে হয়ে কিনা এতটা অধঃপাতের পথে নেমেছে?
অধঃপাতের একটা পথ মেয়েমানুষের জন্যে চিরনির্দিষ্ট আছে, সভ্যতার আদিযুগ থেকে আছে। সে পথে রাজা মন্ত্রীর ঘরের মেয়েকে দেখলেও কেউ অবাক হয় না, ভট্টচার্যির ঘরের মেয়েকে দেখলেও বিচলিত হয় না। জানে, এমন হয়েই থাকে।
কিন্তু এ যে অধঃপাতের অন্য আর একটা শাখা-পথ। এটা তো পুরুষের জন্যেই একচেটিয়া ছিল। তাই এ পথে ওকে দেখে সকলেই অবাক হচ্ছে, বিচলিত হচ্ছে।
.
কৌশিক ডেকেছিল, কিন্তু বংশী নড়ার নাম করেনি। কৌশিক আবার একটা কড়া কটাক্ষ করে তাড়া দেয় বংশীকে, এই বংশী, মরতে না চাস তো চটপট আয়। বিষ শরীরে চারিয়ে গেলে–
শরীরে বিষ চারিয়ে যাবার ভয়ঙ্কর ভয় সত্ত্বেও বংশী নির্বিকার কণ্ঠে বলে, সে যাক! এই সর্বনাশী মেয়েটা যাতে না হাওয়া হয়, সেটা দেখতে হবে তো?
হাওয়া হবে? সুলক্ষণা এবার কথা কন, আমার চোখের সামনে থেকে যদি হাওয়া হতে পারে তো সেই বাহাদুরির জন্যেই সাত খুন মাপ হওয়া উচিত ওর। দেখছি আমি ওকে। যা, তোরা শুতে যা।
শুতে যাব? আমরা শুতে যাব? সুদক্ষিণা ঠিকরে ওঠে, পুলিসে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না ওকে?
পুলিসে? সুলক্ষণা হাসেন, তবে তাই কর তোরা, আমিই নিশ্চিন্দি হয়ে শুতে যাই।
পুলিসে দেওয়া হবে না? বংশী ক্ষেপে.ওঠে, পুলিস এসে ওর ওই দাঁতের পাটি যদি না ভাঙল তো হলটা কি?
হল আর কি-কৌশিক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে বলে, তোমার রক্ত বিষিয়ে মৃত্যু, আর মার অপাত্রে দয়া প্রদর্শন। থানা পুলিসের কথা চিন্তা না করে তোর এখন হাসপাতালের কথা চিন্তা করা উচিত বংশী, কিন্তু নইলে বলা যায় না, হয়তো অদৃষ্টে তোর মৃত্যু আছে।
হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে।
হ্যাঁ, তা কাণ্ডই বৈকি। এমন অপ্রত্যাশিত ব্যাপার কে আশা করেছিল? ঘাড়গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা আসামী হঠাৎ মুখ তুলে বলে ওঠে, মানুষের দাঁতেই যে শুধু বিষ থাকে তা নয়, দেখছি। জিভেও কম বিষ থাকে না!
এ কী দুঃসাহস!
যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর প্রত্যেকেই কী যেন একটা বলতে গেল, আর কাউকেই কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে সুলক্ষণা ঈষৎ কঠিন সুরে বলে উঠলেন, বৃথা কথা বাড়াচ্ছিস কেন তোরা? তুচ্ছ একটা কারণে বাড়িসুষ্ঠু সবাই রাত জেগে রথ দোলের ভিড় করবি নাকি? বৌমা, তুমি আবার নেমে এসেছ কেন বাছা? এক্ষুনি হয়তো বুকের কষ্ট হবে। যাও যাও, শুয়ে পড়গে! খোকা, যা বৌমাকে ধরে ধরে নিয়ে যা সাবধানে।
কৌস্তুভকে সুলক্ষণা খোকাই বলেন চিরকাল। যদিও তিনি মুখে বলেন, খোকা না বলে ওকে আমার জ্যেঠামশাই বললেই ভাল মানায়।
বাস্তবিক ভারী ধীর স্থির গম্ভীর আর বিজ্ঞ সুলক্ষণার এই বড়ছেলে।
তবে– আড়ালে সুদক্ষিণা বলে, একটু যা স্ত্রৈণ।
সুলক্ষণা মেয়ের এই বাঁচালতায় তাড়া দেন। বলেন, ফাজলামির মাত্রা রাখতে হয় ক্ষে। স্ত্রৈণই যদি হয় তো, সে তোদের দাদা সাধে হয়নি। ওই বৌকে রাতদিন আঙুরের বাক্সয় তুলো পেতে না রাখলে? খোকার অতটা যত্ন আছে বলেই না বৌমা তবু একটু হেঁটে নড়ে বেড়ায়। তা নইলে বিছানায় পিঠে এক হয়ে ছাতা ধরত।
সুলক্ষণার এ মন্তব্য বাহুল্য আদৌ নয়। সত্যিই এতটা যত্ন চিকিৎসা না পেলে, অপর্ণার শরীরের অবস্থা কী হত বলা শক্ত। কিন্তু অপর্ণা প্রয়োজনের দশগুণ বেশী যত্ন আদর পায়, সেবা চিকিৎসা পায়। একা স্বামীর কাছেই নয়, সবাইয়ের কাছেই পায়। ছেলের মধ্যে ঔদাসীন্যের নামমাত্র নেই, তবু সুলক্ষণা বলেন, অ খোকা, বৌমা ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি তো? ঘুম ভেঙে একলা রয়েছে হয়তো বলেন, অ খোকা, ডাক্তারবাবু যেন কদিন আসেননি মনে হচ্ছে? খবর দিল একবার।
কৌশিক শুনতে পেলে হাতজোড় করে বলে, মাগো দোহাই তোমার, সেই যে কি বলে, মা মনসায় ধুনোর গন্ধ না কি, সেটা আর অত দিও না তুমি! ভদ্রমহিলাকে দুএকটা দিনও একটু সুস্থ থাকতে দাও।
সুলক্ষণা মৃদু হেসে বলেন, কিসে সুস্থ থাকে, আর কিসে সুস্থ থাকে না, তুই জানিস ভূতটা?
কিন্তু সুলক্ষণাই কি সবটা জানেন?
কই, উনি তো বুঝতে পারলেন না, এখন অপর্ণার আদৌ এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল না। খুব ইচ্ছে করছিল ওই চোর মেয়েটাকে কী প্রকার শাসন করা হয়, তাই দেখতে!
বুঝতে পারলেন না, তাই বললেন, খোকা, ওকে সাবধানে ধরে ধরে নিয়ে যা।
চোখের কোণায় এক ঝলক জল এসে পড়ল অপর্ণার, অভিমানে না অপমানে কে জানে, তবু নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি উঠতে লাগল এক পা এক পা করে।