- বইয়ের নামঃ উত্তরণ
- লেখকের নামঃ আশাপূর্ণা দেবী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. দোতলা আর তিনতলা
উত্তরণ – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
ওদের দোতলা আর তিনতলার সব আলো নিভে গিয়েছিল তখন। ঘরের দালানের সিঁড়ির। বেশ কিছুক্ষণ আগেই গিয়েছিল। এমন কি কৌশিকের দাদা কৌস্তুভের বেশী রাতে পড়াশোনার ভারী শেড দেওয়া টেবল ল্যাম্পের আলোর রেশটাও দেখা যাচ্ছিল না আর গ্যারেজের মাথার নীচু ঘরটার জানলা দিয়ে।
শুধু নীচের তলায় রান্নাঘরের আলোটা তখন জ্বলছিল তার স্বল্পশক্তি নিয়ে।
সব দিকের সব কাজ মিটিয়ে বংশী রান্নাঘর ধাওয়া মোছা করে রাখছিল আগামী সকালের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে। মাঝরাত পর্যন্ত না খেটে এখন উপায় নেই বংশীর। রান্নার লোকটা চলে গেছে কৌশিকদের, প্রায় মাসখানেক হতে চলল। বেচারা বংশীই এখন একমেবাদ্বিতীয়।
বাড়িতে আর কাজ করবার মত আছে কে?
সুলক্ষণা-কৌশিক কৌস্তুভ আর সুদক্ষিণার মা সুলক্ষণা, বিধবা হয়ে অবধি মাছ-মাংস ছোঁয়া ত্যাগ করেছেন, নিজের সামান্যতম রান্নাটুকু করে নেওয়া ছাড়া রান্নার দিকে আর কিছু হয় না তার দ্বারা।
সুদক্ষিণা তো আছে নিজেকে নিয়ে।
কলেজ, কোচিং ক্লাস, গানের স্কুল সব কিছু সামলে মরবার সময় নেই তার।
বাকী ওর বৌদি।
কৌস্তুভের স্ত্রী অপর্ণা।
ঘর-সংসারের বেশীটা দায়িত্ব যার নেবার কথা। তা যার যা দায়িত্ব নেবার কথা, সে যদি তা নিতে পারে, সংসারে তো সমস্যা বলে কিছুই থাকে না। কিন্তু সংসারে সমস্যা আছে, থাকে। এদের সংসারে আসল জায়গাতেই শূন্যতা।
অপর্ণা কোনদিন সুলক্ষণার ডান হাত হয়ে উঠতে পারল না। পারল না সংসারের কোন দায় ঘাড়ে নিতে। অপর্ণা চিররুগ্ন। বিছানায় পড়ে না থেকে অপর্ণা যেকদিন এঘর-ওঘর করে বেড়াতে পারে, শোবার ঘরে না খেয়ে খাবার ঘরে এসে খায় সে-কদিন এদের উৎসবের দিন।
অপর্ণা যদি কোনদিন কৌস্তুভের জামায় একটা বোম বসিয়ে দেয়, কৃতার্থ হয়ে যায় সংসার। অপর্ণা যদি একদিন চাদানী থেকে চা ঢালতে যায়, বাড়িসুষ্ঠু সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে তুমি কেন, তুমি কেন বলে। অপর্ণা যে বেঁচে আছে, এটাই যেন সংসার পাওনার অতিরিক্ত পাচ্ছে।
অতএব পুরনো চাকর বুড়ো বংশী ছাড়া আর কে? তাই সবাই যখন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি দেখি করছিল, বংশী তখন সকালের রসদ জোগাচ্ছিল।
রোজই তাই করে।
কিন্তু কই, কোনদিন তো আচমকা এমন আর্তনাদ করে ওঠে না বংশী! আর্তনাদটা যে অস্বাভাবিক, আর মাত্রা ছাড়ানোতাতে যে সন্দেহ নেই, তার প্রমাণ কৌশিকের ছুটে আসা। ঘুম সম্পর্কে কৌশিকের একটা বিশেষ সুনাম আছে, তা ছাড়া সে তিনতলায় শোয়। চিৎকারটা অতএব সেখানেও গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে।
দোতলার প্রশ্ন তোলা নিষ্প্রয়োজন।
ঘুমছোটা চোখ নিয়ে ওরা ছুটে এল দোতলা থেকে, তিনতলা থেকে অপর্ণাও ডাক্তারের নিষেধ ভুলে সিঁড়ি নামল। না নেমে থাকতে পারবে কেন?
কে বলতে পারে বংশীকে সাপে কামড়েছে, না ডাকাতে ছোরা মেরেছে!
কি!
কি!
কি হয়েছে!
একযোগে সকলের মুখ থেকে উচ্চারিত হল প্রশ্নটা। কিন্তু উত্তর শোনবার আর প্রয়োজন হল না। উত্তর ওরা দেখতে পেল সবাই।
সাপ নয়! ডাকাত নয়! চোর।
চোর পড়েছে বাড়িতে, এই নিশুতি রাতের সুযোগে। তবে ধরাও পড়েছে বংশীর কাছে।
.
বাড়িতে চোর পড়া এমন কিছু নতুন কথা নয়, চোর ধরা পড়াও খুব একটা অসম্ভব নয়। কিন্তু মেয়ে চোর ধরা পড়ার মত ঘটনা সচরাচর ঘটে না!
সেই অঘটন ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তের জন্য বরফ হয়ে গেল সকলেই। অবশ্য মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই সুলক্ষণা ধিক্কার দিয়ে উঠলেন, এই বংশী, ছিঃ!
সুলক্ষণার এই ধিক্কারে বোধকরি বংশীর চেতনা এল, নিজের প্রতি লক্ষ্য পড়ল, আর হুঁশ হল ওই কমবয়সী মেয়েটাকে সে একেবারে বাহুবন্ধনে বন্দী করে বুকে সাপটে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়েটার ক্রুদ্ধ ঝটপটানিতেও বন্ধন শিথিল করছে না।
বন্ধনটা শিথিল করে দিল বংশী।
এখন পৃষ্ঠবল আছে।
এখন ওই চোর মেয়েটার পালাবার পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে দুদুটো পুরুষ। অতএব এখন বংশী দায়িত্বমুক্ত। এখন মুখটাকে যতটা সম্ভব করুণ আর গলাটাকে যতটা সম্ভব বাষ্পচ্ছন্ন করা চলে। বংশীর পক্ষে ওই যতটা সম্ভব দুটো করে বংশী হাতের ওপর হাত বুলোত বুলোতে ক্ষুব্ধ গলায় বলে, বংশীর তো সবই ছিঃ! আর হারামজাদা মেয়েটা যে আমার হাতখানা কামড়ে নিল কুকুরের মতন, তা তো কেউ
কামড়ে!
কামড়ে নিয়েছে।
বংশীর সেই বিকট আর্তনাদের রহস্য ভেদ হল।
সুলক্ষণা মুখ ফিরিয়ে হাসি গোপন করলেন, সুদক্ষিণা প্রায় ধমকে উঠল, অসভ্যর মত খারাপ কথা বলিস না বংশী! আর কৌশিক ছাড়া পাওয়া প্রাণীটার দিকে একটা তীব্র দৃষ্টি হেনে নিয়ে বলে উঠল, মানুষের দাঁতের বিষও বাঘ ভালুকের থেকে কিছু কম বিষাক্ত নয়রে বংশী। শীগগির চলে আয় আমার সঙ্গে, ডেটল লাগিয়ে নিবি।
.
ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা একবার চারিদিকে তাকিয়েছিল ছুটে পালাবার জন্যে, দেখেছে পথ বন্ধ। যেখান দিয়ে ঢুকেছিল, উঠোনের সেই ছোট দরজাটা, যেটা জঞ্জাল ফেলে এসে বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে বংশী ওর খুবই সুবিধে করে দিয়েছিল, ঠিক তার সামনাসামনি দালানের দরজায় বংশীর বিশাল বপুখানি দেদীপ্যমান।
কাজেই চেষ্টা করা পাগলামি বুঝেই মেয়েটা ঘাড় গুঁজে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। কৌশিকের এই মন্তব্যে একবার চোখ তুলে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিল।