আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ।
আমি মোটেই অদ্ভুত মানুষ নই। আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ। আমি এসেছি তোমাকে সাহায্য করতে।
আমার কোনো সাহায্য লাগবে না।
পুরি হয়তো লাগবে না। তবু আমি তোমার ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে চাই। এখন তুমি ব্যথা তৈরি কর তো! খুব ধীরে-বীরে।
তিন্নি মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে। বাঁকা ঠোঁট খুব হালকাভাবে কাঁপছে।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তিনি তাঁর সমস্ত মন-প্ৰাণ একটি ব্যাপারে কেন্দ্রীভূত করে ফেললেন। খুব ছোটবেলায় তিনি একটি সাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এখন তিনি ভাবছেন সেই সাপটির কথা। সাপটির হলুদ গা ছিল চক্ৰকাটা। বুকে ভর দিয়ে একেবেঁকে এগিয়ে আসছিল। তাঁকে দেখেই সে থমকে গেল। ঘন-ঘন তার চেরা জিব বের করতে লাগল। মিসির আলি এখন আর কিছুই ভাবছেন না। ঠিক এই মুহূর্তে সাপের চেরা জিব ছাড়া অন্য কিছুই নেই। তিনি জীবিত কি মৃত, সেই বোধও তাঁর নেই। তিনি কল্পনায় দেখছেন। হলুদ রঙের কুৎসিত সাপের চেরা জিব বাতাসে কাঁপছে।
মিসির আলির চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তিন্নি ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। তিন্নি অবাক হয়ে মিসির আলিকে দেখছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এই মানুষটিকে সে কিছু করতে পারছে না! এতক্ষণে ব্যথায় তাঁর ছটফট করা উচিত ছিল, কিন্তু লোকটি এখনো হাত তুলছে না। এর মানে কি এই যে, সে ব্যথা পাচ্ছে না? তা কী করে সম্ভব! তিন্নি ব্যথার পরিমাণ অনেক দূর বাড়িয়ে দিল। তার নিজের মাথাই এখন বিমঝিম করছে। মিসির আলি হাত তুললেন। তিনি পরীক্ষায় পাশ করেছেন। মিসির আলি দুর্বল গলায় বললেন, তিন্নি, আমি এখন যাই! তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে।
তিনি জবাব দিল না। অবাক চোখে তাঁকে দেখতে লাগল।
মিসির আলি বললেন, তিন্নি, আমি কি তোমার আঁকা ছবিগুলি নিয়ে যেতে পারি?
কেন?
আমি নিজের ঘরে বসে সময় নিয়ে ছবিগুলি দেখব।
তাতে কী হবে?
তোমাকে বুঝতে সুবিধা হবে।
তিনি তাঁর হাতে একগাদা ছবি তুলে দিল। মিসির আলি সিড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। ক্লান্তিতে তাঁর পা ভেঙে আসছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তিনি পেছনে ফিরলেন। তিনি ছাদে উঠে গেছে। তার মাথার উপর চক্রাকারে কয়েকটি পাখি উড়ছে।
আশেপাশে পাখি নেই। কিন্তু এই মেয়েটির মাথার উপর পাখি উড়ছে কেন? শালিক পাখি। কিচমিচ শব্দ করছে। মেয়েটিকে দেখে মনে হল, সেও কিছু বলছে পাখিদের। এত রহস্য কেন? মিসির আলি নিজের ঘরের দিকে এগুলেন। তাঁর মন ভারাক্রান্ত। তিনি নিজের ভিতর এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করলেন।
সারাটা দিন ছাদে
সারাটা দিন তিনি ছাদে কাটাল।
এক বার এ-মাথায় যাচ্ছে, আরেক বার ও-মাথায়। মাঝে-মাঝে বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলছে এবং হাসছে। শীতের দিনের রোদ দুপুরের দিকে খুব বেড়ে যায়। সারা গা চিড়বিড় করে। কিন্তু মেয়েটি নির্বিকার। হাঁটছে তো হাঁটছেই। রহিমা দুপুরে ছাদে এসে ভয়ে-ভয়ে বলেছিল, ভাত দিছি, খেতে আসেন। তিন্নি কোনো কথা বলে নি। রহিমা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে। তিন্নি বুঝতে পারছে, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রহিমা মনে মনে বলছে, পিশাচ, পিশাচ মানুষ না, পিশাচ! তিন্নির খানিকটা রাগ লাগছিল। কিন্তু সে সামলে নিল। সব সময় রাগ করতে ভালো লাগে না। তার নিজেরও কষ্ট হয়। চোখ জ্বালা করে।
রহিমা চলে যাবার পরপরই বরকত সাহেব এলেন। তিনি কোনো কথা বললেন না। চিলেকোঠার কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিন্নির মন-খারাপ হয়ে গেল। বাবা আগে তাকে ভয় পেতেন না। এখন পান। খুবই ভয় পান। অথচ সে বাবাকে এক দিনও ব্যথা দেয় নি। কোনো দিন দেবেও না।
তিন্নি।
কি বাবা?
ভাত খেতে এস।
আমার খিদে নেই বাবা। যেদিন খুব রোদ ওঠে, সেদিন আমার খিদে হয় না।
বরকত সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। সেই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে তিন্নির আরো মন-খারাপ হয়ে গেল।
তিন্নি।
কি বাবা?
যে-ভদ্রলোক এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?
হ্যাঁ, হয়েছে।
তাঁকে তোমার কেমন লেগেছে?
ভালো।
তাহলে তাঁকে ব্যথা দিলে কেন? আমি কিছুক্ষণ আগে একতলায় গিয়েছিলাম, ভদ্রলোক মড়ার মতো পড়ে আছেন।
তিনি জবাব দিল না। বরকত সাহেব বললেন, তুমি জান, তিনি কী জন্যে এসেছেন?
জানি। তিনি আমাকে বলেছেন।
তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো তোমার যত কথা আছে, সব ওকে বলবে। কিছুই লুকোবে না।
আচ্ছা!
তোমার স্বপ্নের কথাও বলবে।
তিনি বিশ্বাস করবেন না, হাসবেন।
না, হাসবেন না। উনি একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। তোমার সব কথা উনি বুঝবেন। আমি যা বুঝতে পারিনি, উনি তা পারবেন।
তিনি বলল, উনি কি গাছের মতো জ্ঞানী?
বরকত সাহেব মৃদুস্বরে বললেন, তোমার গাছের ব্যাপারটা আমি জানি না। তিন্নি। কাজেই বলতে পারছি না। গাছের মতো জ্ঞানী কি না। আমার ধারণা, গাছের জীবন থাকলেও তা খুব নিম্ন পর্যায়ের। জ্ঞান-বুদ্ধির ব্যাপার সেখানে নেই।
বাবা।
বল মা।
আমার স্বপ্নের ব্যাপারটা কি আজই ওকে বলব?
না, আজ না-বললেও হবে। কাল বল। আজ ভদ্রলোক ঘুমুচ্ছেনা! আমার মনে হয় সারা দিনই ঘুমুবেন! তুমি ব্যথা দেবার পর উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
তিনি লজ্জিত হল। কিছু বলল না। বরকত সাহেব বললেন, তুমি কি ছাদেই থাকবে?
হ্যাঁ। তুমি যাও, ভাত খাও।