- বইয়ের নামঃ অন্য ভুবন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, রহস্যময় গল্প
কাজের মেয়েটি মিসির আলিকে ডেকে তুলল
দুপুরবেলা কাজের মেয়েটি মিসির আলিকে ডেকে তুলল। কে নাকি দেখা করতে এসেছে। খুব জরুরি দরকার।
মিসির আলির রাগে গা কাঁপতে লাগল; কাজের মেয়েটিকে বলে দেয়া ছিল কিছুতেই যেন তাঁকে তিনটার আগে ডেকে তোলা না হয়। এখন ঘড়িতে বাজছে দুটা দশ! যত জরুরি কোজই থাকুক, এই সময় তাঁকে ডেকে তোলার কথা নয়। মিসির আলি রাগ কমাবার জন্যে উন্টো দিকে দশ থেকে এক পর্যন্ত গুনলেন। গুন-গুন করে মনে-মনে গাইলেন–আজ এ বুসন্তে এত ফুল ফোটে এত পাখি গায়—। এই গানটি গাইলে তাঁর রাগ আপনাতেই কিছুটা নেমে যায়। কিন্তু আজ নামছে না। কাজের মেয়েটির ভাবলেশহীন মুখ দেখে তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। তিনি গম্ভীর গলায় ডাকলেন, রেবা।
জ্বি।
আর কোনো দিন তুমি আমাকে তিনটার আগে ডেকে তুলবে না।
জ্বি আইচ্ছা।
দুটো থেকে তিনটা এই এক ঘন্টা আমি প্রতি দিন দুপুরে ঘুমিয়ে থাকি। এর নাম হচ্ছে সিয়াস্তা। বুঝলে?
জ্বি।
ঘড়ি দেখতে জান?
জ্বি-না।
মিসির আলির রাগ দপ করে নিতে গেল। যে-মেয়ে ঘড়ি দেখতে জানে না, সে তাকে তিনটার সময় ডেকে তুলবে কীভাবে? রেবা মেয়েটি নতুন কাজে এসেছে। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে।
রেবা।
জ্বি?
আজ সন্ধার পর তোমাকে ঘড়ি দেখা শেখাব। এক থেকে বার পর্যন্ত সংখ্যা প্রথম শিখতে হবে। ঠিক আছে?
জ্বি, ঠিক আছে।
এখন বল, যে- লোকটি দেখা করতে এসেছে, সে কেমন?
রেবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মানুষ মানুষের মতোই, আবার কেমন হবে! তার এই সাহেব কী-সব অদ্ভুত কথাবার্তা যে বলে! পাগলা ধরনের কথাবার্তা।
বল বল, চুপ করে আছ কেন?
মিসির আলি বিরক্ত হলে। এই মেয়েকে কাজ শেখাতে সময় লাগবে। তিনি মুখে বললেন, মানুষকে দেখতে হবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, বুঝতে পারছ?
মেয়েটি মাথা নাড়ল। মাথা নাড়ার ভঙ্গি থেকেই বলে দেয়া যায়, সে কিছুই বোঝে নি। বোঝার চেষ্টাও করেনি। সে শুধুভাবছে, এই লোকটির মাথায় দোষ আছে। তবে দোষ থাকলেও লোকটা ভালো। বেশ ভালো। রেবা এ-পর্যন্ত দুটি গ্লাস, একটা পিরিচ এবং একটা প্লেট ভেঙেছে একটা কাপের বেঁটা আলগা করে ফেলেছে। সে তাকে কিছুই বলে নি! একটা ধমক পর্যন্ত দেয় নি। ভালো মানুষগুলি একটু পাগলপাগলই হয়ে থাকে।
মিসির আলি হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিলেন। একটি সিগারেট বের করে হাত দিয়ে গুড়ো করে ফেললেন। তিনি সিগারেট ছাড়বার চেষ্টা করছেন। যখনই খুব খেতে ইচ্ছা করে, তিনি একটি সিগারেট বের করে গুড়ো করে ফেলেন, এবং ভাবতে চেষ্টা করেন একটি সিগারেট টানা হল। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না, শুধু মেজাজ। তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছে।
রেবা।
জ্বি।
এখন আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব, তুমি উত্তর দেবে। তোমার উত্তর থেকে আমি ধারণা করতে পারব, যে- লোকটি এসেছে সে কী রকম।
রেবা হাসল। তার বেশ মজা লাগছে।
প্রথম প্রশ্ন, যে লোকটি এসেছে সে গ্রামে থাকে না শহরে?
গেরামে।
লোকটি বুড়ো না জোয়ান?
জোয়ান।
রোগা না মোটা?
রোগা।
কী কাপড় পরে এসেছে?
মনে নাই।
কাপড় পরিষ্কার না ময়লা?
ময়লা।
হাতে কী আছে? ব্যাগ বা ছাতা, এ-সব কিছু আছে?
না।
চোখে চশমা আছে?
না।
মিসির আলি থেমে-থেমে বললেন, তোমাকে যে-প্রশ্নগুলি করলাম, সেগুলি মনে রাখবে। কেউ আমার কাছে এলে, আমি এইগুলি জানতে চাই। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
এখন যাও, আমার জন্যে এক কাপ চমৎকার চা বানাও। দুধ-চিনি কিছু দেবে না। শুধু লিকার। বানানো হয়ে গেলে চায়ের কাপে এক দানা লবণ ফেলে দেবে।
লবণ?
হ্যাঁ, লবণ।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। বসার ঘরে যে-লোকটি এসেছে তাকে দেখা দরকার। রেবার কথামতো লোকটি হবে গ্রামের, ময়লা কাপড় পরে এসেছে। জোয়ান বয়স। হাতে কিছুই নেই। এই ধরনের এক জন লোকের তাঁর কাছে কী প্রয়োজন থাকতে পারে?
বসার ঘরে যে লোকটি বসে ছিল, সে রোগী নয়। পরনে গ্যাভার্ডিনের স্যুট। হাতে চামড়ার একটি ব্যাগ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। চোখে চশমা। মিসির আলি মনে-মনে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। রেবা মেয়েটির পর্যবেক্ষণশক্তি মোটেই নেই! একে বেশি। দিন রাখা যাবে না। মিসির আলি বসে-থাকা লোকটিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলেন।
তিনি ঘরে ঢোকার সময় লোকটি উঠে দাঁড়ায় নি। দাঁড়াবার মতো ভঙ্গি করেছে। বসে থাকার মধ্যেও একটা স্পর্ধার ভাব আছে। লোকটি তাকিয়ে আছে সরু চোখে। যেন সে কিছু একটা যাচাই করে নিচ্ছে। মিসির আলি বললেন, ভাই, আপনার নাম?
আমার নাম বরকতউল্লাহ! আমি ময়মনসিংহ থেকে এসেছি।
কোনো কাজে এসেছেন কি?
হ্যাঁ, কাজেই এসেছি। আমি অকাজে ঘোরাঘুরি করি না।
আমার কাছে এসেছেন?
আপনার কাছে না- এলে, আপনার ঘরে বসে আছি কেন?
ভালোই বলেছেন। এখন বলুন, কী ব্যাপার। অল্প কথায় বলুন।
বরকতউল্লাহ্ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, আমি কথা কম বলি। আপনাকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না।
তিনি লক্ষ করলেন, লোকটি আহত হয়েছে। তার চোখ-মুখ লাল। মিসির আলি খুশি হলেন। লোকটি বড় বেশি স্পর্ধা দেখাচ্ছে।
বরকতউল্লাহ সাহেব, চা খাবেন?
জ্বি না, আমি চা খাই না। আমার যা বলার তা আমি খুব অল্প কথায় বলে চলে যাব।
মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, অল্প কথায় কিছু বলতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনার অভ্যাস হচ্ছে বেশি কথা বলা! আপনি চা খাবেন কি না, তার জবাব দিতে গিয়ে একটি দীর্ঘ বাক্য বলেছেন। আপনি বলেছেন—জ্বি না, আমি চা খাই না। আমার যা বলার তা আমি খুব অল্প কথায় বলে চলে যাব। এই বাক্যটিতে সতেরটি শব্দ আছে।