চাই। বল তো নয়-এর বর্গমূল কত?
তিন।
পাঁচের বর্গমূল কত সেটা জান?
তিন্নি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি জানি না।
আচ্ছা দেখি, এটা পার কি না। পেনিসিলিন যিনি আবিষ্কার করেছেন, তাঁর নাম কি?
স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং।
হ্যাঁ, হয়েছে। এখন বল দেখি তাঁর স্ত্রীর নাম কি?
আমি জানি না।
সত্যি জানি না?
না, আমি জানি না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত সালে নবেল প্রাইজ পেয়েছেন জান?
জানি। উনিশ শ তের সালে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ের নাম জান?
জানি না।
মিসির আলি হাসতে লাগলেন। তিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। গম্ভীর স্বরে বলল, আপনি হাসছেন কেন?
আমি হাসছি, কারণ তুমি কীভাবে সব প্রশ্নের জবাব দাও, তা বুঝতে পারছি।
তাহলে বলুন, কীভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিই।
আমি লক্ষ করলাম, যে-সব প্রশ্নের উত্তর আমি জানি, শুধু সে-সব প্রশ্নের উত্তরই তুমি জান। যেমন আমি জানি নিয়ের বর্গমূল তিন। কাজেই তুমি বললে তিনি। কিন্তু পাঁচের। বর্গমূল কত তা তুমি বলতে পারলে না, কারণ আমি নিজেও তা জানি না। আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের স্ত্রীর নাম তুমি বলতে পারলে না, কারণ আমি তাঁর স্ত্রী নাম জানি না। ঠিক এইভাবে…….।
থাক, আর বলতে হবে না।
তিন্নি তাকিয়ে আছে। তার মুখে কোনো হাসি নেই! সমস্ত চেহারায় কেমন একটা কঠিন ভাব চলে এসেছে, যা এত অল্পবয়সী একটি বাচ্চার চেহারার সঙ্গে ঠিক মিশ খাচ্ছে না। মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, তুমি মানুষের মনের কথা টের পাও। টের পাও বলেই জানা প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পার। এটা এক ধরনের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা! কেউ-কেউ এ-ধরনের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।
তিনি শীতল গলায় বলল, আপনি খুব বুদ্ধিমান।
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ, আমি বুদ্ধিমান।
আপনি বুদ্ধিমান এবং অহঙ্কারী।
যারা বুদ্ধিমান, তারা সাধারণত অহঙ্কারী হয়। এটা দোষের নয়। যে-জিনিস তোমার নেই, তা নিয়ে তুমি যখন অহঙ্কার কর, সেটা হয় দোষের।
আপনি এখানে কেন এসেছেন?
তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে এসেছি
কিসের সাহায্য?
আমি এখনো ঠিক জানি না। সেটাই দেখতে এসেছি। হয়তো তোমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই! তোমার বাবা শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন।
আমি ডাক্তার পছন্দ করি না।
আমি ডাক্তার নই।
আপনি এখন আমার ঘর থেকে চলে যান। আমার আর আপনাকে ভালো লাগছে না।
আমার কিন্তু তোমাকে ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।
আপনি এখন যান।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান।
তিন্নি কথা কটি বলার সঙ্গে-সঙ্গে মিসির আলি তাঁর মাথার ঠিক মাঝখানে এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করলেন। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল, বমি বমি ভাব হল, আর সেই সঙ্গে তীব্র ও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা যেন কেউ একটি ধারাল ব্লেড দিয়ে আচমকা মাথাটা দুফাঁক করে ফেলেছে। মিসির আলি বুঝতে পারছেন, তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। পৃথিবী তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখছেন সাবানের বুদবুদের মতো বুদবুদ। জ্ঞান হারাবার ঠিক আগমুহূর্তে ব্যথাটা কমে গেল। সমস্ত শরীরে এক ধরনের অবসাদ। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি তাকালেন তিন্নির দিকে। মেয়েটির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। সহজ হাসি নয়, উপহাসের হাসি। মিসির আলি দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, এটা তো তুমি ভালোই দেখালে।
তিনি বলল, এর চেয়েও ভালো দেখাতে পারি।
তা পার। নিশ্চয়ই পার। তুমি কি রাগ হলেই এ রকম কর?
হ্যাঁ, করি।
আমি তোমাকে রাগাতে চাই না।
কেউ চায় না।
সবাই তোমাকে খুশি রাখতে চায়?
হ্যাঁ।
কিন্তু তবু তুমি প্রায়ই রেগে যাও, তাই না?
হ্যাঁ, যাই।
রাগটা সাধারণত কতক্ষণ থাকে?
ঠিক নেই। কখনো অনেক বেশি সময় থাকে।
আচ্ছা তিন্নি, মনে কর এখানে দু জন মানুষ আছে। তুমি রাগ করলে এক জনের উপর, তাহলে ব্যথাটা কি সেই জনই পাবে। না দু জন একত্রে পাবে?
যার উপর রাগ করেছি, সে-ই পাবে, অন্যে পাবে কেন? অন্য জনের উপর তো আমি রাগ করি নি।
তাও তো ঠিক এখন কি আমার উপর তোমার রাগ কমেছে?
হ্যাঁ, কমেছে। তাহলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাস তো, যাতে আমি বুঝতে পারি তোমার রাগ সত্যি সত্যি কমেছে।
তিন্নি হাসল। মিসির আলি বললেন, আমি কি আরো খানিকক্ষণ বসব?
বসার ইচ্ছা হলে বসুন!
মিসির আলি বসলেন। একটি সিগারেট ধরলেন। মেয়েটি নিজের মনে ছবি আঁকছে। সেই গাছের ছবি, লতানো ডাল, পত্ৰহীন বিশাল বৃক্ষ। মিসির আলি ঠিক করলেন, তিনি একটি পরীক্ষা করবেন। এই মেয়েটি যেভাবেই হোক, মস্তিষ্কের কোষে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করতে পারে। উচ্চ পর্যায়ের একটি টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা। ছোট্ট একটি মেয়ে, অথচ কত সহজে মানুষের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। এটাকে বাধা দেবার একমাত্র উপায় সম্ভবত মেয়েটিকে মাথার ভেতর ঢুকতে না-দেয়া। সেটা করা যাবে তখনই, যখন নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যাবে! সমস্ত চিন্তা ও ভাবনা কেন্দ্রীভূত করা হবে একটি বিন্দুতে।
মিসির আলি ডাকলেন, তিন্নি।
তিন্নি মুখ না তুলেই বলল, কি?
তুমি আমার মাথার ব্যথাটা আবার তৈরি কর তো।
কেন?
আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা করব।
কী পরীক্ষা?
আমি দেখতে চাই এই ব্যথার হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় আছে কি না।
উপায় নেই।
সেটাই দেখব। তবে তিন্নি একটি কথা, ব্যথাটা তুমি তৈরি করবে খুব ধীরে। এবং যখনই আমি হাত ভুলব, তুমি ব্যথাটা কমিয়ে ফেলবে।