তিন্নি, তোমার শীত লাগছে না?
বল কী! এই প্ৰচণ্ড শীতে তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?
না। আপনি নাশতা খেতে যান। বাবা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। দেরি হচ্ছে দেখে মনে-মনে রেগে যাচ্ছে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, তাই!
মেয়েটি হাঁটতে শুরু করল! ধবধবে সাদা রঙের ফ্রকে তাকে দেবশিশুর মতো লাগছে। মিসির আলি মেয়েটির প্রতি গাঢ় মমতা বোধ করলেন। তাঁর ইচ্ছে করল। মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতে। কিন্তু এ-মেয়ে হয়তো এ-সব পছন্দ করবে না। একে দেখেই মনে হচ্ছে, এর পছন্দ-অপছন্দ খুব তীব্র।
নাশতার আয়োজন প্রচুর।
রুটি মাখন থেকে শুরু করে চিকেন ফুই, ফিস ফ্রাই সবই আছে। বিলেতি কায়দায় দু জনের সামনেই এক বাটি করে সালাদ। লম্বা-লম্বা গ্লাসে কমললেবুর রস। রাজকীয় ব্যাপার! শুধু খাবারদাবার এগিয়ে দেবার জন্যে কেউ নেই। বরকত সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, বসে আছেন কেন? শুরু করুন।
তিমির জন্যে অপেক্ষা করছি।
ও আসবে না।
আসবে না কেন?
খেয়ে নিয়েছে। আমার মেয়ের সঙ্গে কি আপনার কথা হয়েছে?
হ্যাঁ।
কেমন দেখলেন আমার মেয়েকে?
ভালো।
বরকত সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। নিচু গলায় বললেন, ওর মধ্যে কি কোনো অস্বাভাবিকতা আপনার নজরে পড়েছে?
না।
ভালো করে ভেবে বলুন!
ভেবেই বলছি। তবে পারিপার্শ্বিকে কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ করছি।
যেমন?
যেমন আপনার গাছগুলিতে কোনো পাখি নেই। একটি পাখিও আমার চোখে পড়ে নি।
বরকত সাহেব চমকালেন না। তার মানে তিনি ব্যাপারটি আগেই লক্ষ করেছেন। আগে লক্ষ না-করলে নিশ্চয়ই চমকাতেন। অর্থাৎ মানুষটির পর্যবেক্ষণ-শক্তি ভালো। এই জিনিসটি চট করে কারোর চোখে পড়বে না। মিসির আলি বললেন, এ ছাড়াও অন্য একটি ব্যাপার লক্ষ করেছি।
বলুন শুনি।
আপনার বাড়ির কাজের লোকটি, যার নাম নাজিম, সে অত্যন্ত ভীত ও শঙ্কিত।
এটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এ-বাড়ির সবাই আমাকে ভয় করে।
কেন?
পৃথিবীর নিয়মই হচ্ছে ক্ষমতাবানকে ভয় করা। আমি ক্ষমতাবান।
ক্ষমতাটা কিসের?
অর্থের। অর্থের ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় ক্ষমতা।
আপনার ধারণা, যেহেতু আপনার প্রচুর টাকা, সেহেতু সবাই আপনাকে ভয় করে?
অন্য কারণও আছে, আমি বেশ বদমেজাজি।
আপনার মেয়ে তিনি, সেও কি বদমেজাজি?
বরকত সাহেবের ভক্ত কুচকে উঠল। তিনি জবাব দিতে গিয়েও দিলেন না। হালকা স্বরে বললেন, চা নিন। নাকি কফি খেতে চান?
চা খাব! আপনি বলেছিলেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন করেন কী?
কিছুই করি না। এখন আমি ঘরেই থাকি।
এবং কাউকে ঘর থেকে বেরুতে দেন না।
এ-কথা বলছেন কেন?
কারণ দারোয়ান আমাকে বেরুতে দেয় নি।
ওকে বলে দিয়েছি যেন গেট না খোলে।
কেন বলেছেন?
তিন্নির জন্যে বলেছি। আমার ভয়, গেট খোলা পেলেই সে চলে যাবে। আমি আর কোনোদিন তাকে ফিরে পাব না।
সে কি এর আগে কখনো গিয়েছে?
না।
তাহলে কী করে আপনার ধারণা হল, গেট খোলা পেলে সে চলে যাবে?
আমাকে আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আমাকে প্রশ্ন করবার জন্যে তো আপনাকে আনি নি। আপনাকে আনা হয়েছে আমার মেয়ের জন্যে।
আনা হয়েছে বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। আমি নিজ থেকে এসেছি।
বরকত সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, আপনি দয়া করে আমার মেয়ের ঘরে চলে যান। ওর সঙ্গে কথা বলুন।
ও কি তার ঘরে একা থাকে?
হ্যাঁ, একাই থাকে।
মিসির আলি উঠে দাঁড়াতেই বরকত সাহেব বললেন, প্লীজ, একটি কথা মন দিয়ে শুনুন। এমন কিছুই করবেন না, যাতে আমার মেয়ে রেগে যায়।
এ কথা বলছেন কেন?
ও রেগে গেলে মানুষকে কষ্ট দেয়।
কীভাবে কষ্ট দেয়?
নিজেই বুঝবেন, আমার বলার দরকার হবে না।
তিন্নির ঘরটি বিরাট বড়। এক পাশে ছোট্ট একটি কালো রঙের খাটে সুন্দর একটি বিছানা পাতা। নানান ধরনের খেলনায় ঘর ভর্তি। বেশির ভাগ খেলনাই হচ্ছে তুলার তৈরী জীবজন্তু। শিশুদের ঘর যেমন অগোছাল থাকে, এ ঘরটি সে-রকম নয়। বেশ গোছানো ঘর। মিসির আলি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তিন্নিকে দেখলেন। মেয়েটি গভীর মনোযোগে ছবি আঁকছে। এক বারও তাকাচ্ছে না। তাঁর দিকে। মিসির আলি বললেন, তিনি, ভেতরে আসব?
তিন্নি ছবি থেকে মুখ না-ভুলেই বলল, আসতে ইচ্ছে হলে আসুন।
ইচ্ছে না হলে আসব না?
তিন্নি কিছু বলল না। মিসির আলি ভেতরে ঢুকলেন। হাসিমুখে বললেন, বসব কিছুক্ষণ তোমার ঘরে?
বসার ইচ্ছে হলে বসুন!
তিনি বসলেন। হাসিমুখে বললেন, কিসের ছবি আঁকছ?
গাছের।
দেখি কেমন ছবি?
দেখতে ইচ্ছে হলে দেখুন।
তিন্নি তার ছবি এগিয়ে দিল। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন, অদ্ভুত সব গাছের ছবি আঁকা হয়েছে। গাছগুলিতে কোনো পাতা নেই। অসংখ্য ডাল। ডালগুলি লতানো। কিছু কিছু লতা আবার চুলের বেণীর মতো পাকানো।
সুন্দর হয়েছে তো গাছের ছবি!
আপনার ভালো লাগছে?
হ্যাঁ।
এ-রকম গাছ কি আপনি এর আগে কখনো দেখেছেন?
না, দেখি নি।
তাহলে আপনি কেন জিজ্ঞেস করলেন না—কী করে আমি না— দেখে এমন সুন্দর গাছের ছবি আঁকলাম?
শিশুরা মন থেকে অনেক জিনিস আঁকে।
তিন্নি হাসল। তিনি প্রথম মেয়েটির মুখে হাসি দেখলেন। তিন্নি হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ছে। মিসির আলি বললেন, তুমি এত হাসছ কেন?
হাসতে ভালো লাগছে, তাই হাসছি।
তিনি নিজেও হাসলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন, আমি শুনেছি তুমি সব প্রশ্নের উত্তর জান।
কে বলেছে? বাবা?
হ্যাঁ। তুমি কি সত্যি-সত্যি জান?
জানি। পরীক্ষা করতে চান?