বরকত সাহেব বললেন, আপনি যান, বিশ্রাম করুন। সকালবেলা আপনার সঙ্গে কথা হবে!
কালোমতো লম্বা একটি ছেলে তাঁর ঘর দেখিয়ে দিল।
একতলার একটি কামরা, পুরোনো দিনের কামরাগুলি যেমন হয়-দৈর্ঘ্যে-প্রন্থে বিশাল। বিরাট দক্ষিণমুখী জানোলা। ঘরের আসবাবপত্র সবই দামী ও আধুনিক। খাটে ছ। ইঞ্চি ফোমের তোষক। ব্লকিং-চেয়ার। মেঝেতে দামী স্যাগ কাৰ্পেট মফস্বল শহরে এ— সব জিনিস ঠিক আশা করা যায় না।
বাথরুমে ঢুকে মিসির আলি আরো অবাক হলেন। ওয়াটার হিটারের ব্যবস্থা আছে। চমৎকার বাথটাব। মিসির আলির মনে হল, অনেক দিন এ ঘরে বা বাথরুমে কেউ আসে নি! এমন চমৎকার একটি গেষ্টরুম এরা শুধু-শুধু বানিয়ে রেখেছে।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু গরম পানির ব্যবস্থা যখন আছে, তখন একটা হট শাওয়ার নেয়া যেতে পারে। মিসির আলি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সারালেন। শরীর ঝরঝরে। লাগছে। এক কাপ গরম চা পেলে বেশ হত।
বাথরুম থেকে বের হয়েই দেখলেন টেবিলে চায়ের আয়োজন। পটভর্তি চা, প্লেটে নোনতা বিস্কিট, কুচিকুচি করে কাটা পনির। তৃত্যশ্রেণীর এক জন যুবক তাঁকে ঢুকতে দেখেই চা ঢালতে শুরু করল। তিনি লক্ষ করলেন, লোকটি আড়চোখে তাঁর দিকে বারবার তোকাচ্ছে! চোখে চোখ পড়ামাত্র চট করে মাথা নামিয়ে নিচ্ছে।
তোমার নাম কি?
নাজিম।
শুধু নাজিম?
নাজিমুদ্দিন
কত দিন ধরে এ-বাড়িতে আছ?
জ্বি, অনেক দিন।
অনেক দিন মানে কত দিন?
পাঁচ বছর।
এ-বাড়িতে ক জন মানুষ থাকে?
নাজিম জবাব দিল না। চায়ের কাপে চিনি ঢেলে এগিয়ে দিল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে এখন চলে যাবে। মিসির আলি দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িতে ক জন মানুষ থাকে?
স্যার, আমি কিছু জানি না।
আমি কিছু জানি না মানে? তুমি পাঁচ বছর এ বাড়িতে আছ, অথচ জািন না। এ বাড়িতে কী জন মানুষ থাকে?
জ্বি না। স্যার, আমি জানি না।
বরকত সাহেব এবং তাঁর মেয়ে- এই দু জন ছাড়া আর কী জন মানুষ থাকে?
আমি স্যার কিছুই জানি না।
মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। চায়ে চুমুক দিলেন। সিগারেট ধরলেন। তিনি সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করছেন, সেটা মনে রইল না। এই লোকটি কোনো কিছু বলতে চাচ্ছে না কেন? বাধা কোথায়?
না, আমি অসময়ে ঘুমুব না।
সকালের নাশতা দেওয়া হবে সাড়ে সাতটায়।
ঠিক আছে।
আসি স্যার, পাশের ঘরেই আছি! দরকার হলে কলিং-বেল টোপবেন। দরজার কাছে কলিং-বেল আছে।
তিনি মাথা নাড়লেন। কিছু বললেন না। ঘড়িতে বাজছে পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদী নিশ্চয়ই খুব কাছে। ভোরবেলা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে ভালো লাগবে। এই শহরে এর আগে তিনি আসেন নি। অপরিচিত শহরে ঘুরে বেড়াতে চমৎকার লাগে।
গেট বন্ধ। গেটের পাশের খুপরি—ঘরটায় দারোয়ান নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। মিসির আলি উঁচু গলায় ডাকলেন, দারোয়ান, দারোয়ান, গেট খুলে দাও।
দারোয়ান বেরিয়ে এল, কিন্তু গেট খুলল না! যেন সে কথা বুঝতে পারছে না।
গেট খুলে দাও, আমি বাইরে যাব!
গেট খোলা যাবে না।
খোলা যাবে না। মানে? কোন যাবে না?
বড়সাহেবের হুকুম ছাড়া খোলা যাবে না।
তার মানে? কী বলছি তুমি? এটা কি জেলখানা নাকি?
দারোয়ান কোনো উত্তর না-দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। যেন মিসির আলির সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার ব্যাপারে তার কোনো অনুগ্রহ নেই।
তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন এক-একা। তাঁর সামনে ভারি লোহার গেট। সমস্ত বাড়িটিকে যে-পাঁচিল ঘিরে রেখেছে, তাও অনেকখানি উঁচু। সত্যি সত্যি জেলখানাজেলখানা ভাব। মিসির আলি আবার ডাকলেন, দারোয়ান—দারোয়ান! কেউ বেরিয়ে এল না। ভোর সাতটা পর্যন্ত মিসির আলি বাড়ির সামনের বাগানে চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়ালেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করলেন। এই বাড়িটি গাছগাছালিতে ভর্তি। কিন্তু কোনো গাছে পাখি ডাকছে না। শুধু যে ডাকছে না। তাই নয়, কোনো গাছে পাখি বসে পর্যন্ত নেই। অথচ ভোরবেলার এই সময়টায় পাখির কিচিরমিচিরে কান ঝালাপালা হবার কথা! অথচ চারদিক কেমন নীরব, থমথমে।
স্যার, আপনার নাশতা দেয়া হয়েছে।
কোথায়?
দোতলায়।
চল যাই।
আমি যাব না। স্যার। আপনি এক যান। ঐ যে সিঁড়ি।
সিঁড়িতে পা রেখেই মিসির আলি থমকে দাঁড়ালেন। সিঁড়ির মাথায় একটি বালিকা দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি দারুণ রূপসী। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল টানা টানা চোখ। দেবীমূর্তির মতো কাটা-কাটা নাক-মুখ। মেয়েটি দাঁড়িয়েও আছে মূর্তির মতো। একটুও নড়ছে না। চোখের দৃষ্টিও ফিরিয়ে নিচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, কেমন আছ তিন্নি?
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?
হ্যাঁ, ভালোই আছি।
আপনাকে গেট খুলে দেয় নি, তাই না?
মিসির আলি উপরে উঠতে উঠতে বললেন, দারোয়ান ব্যাটা বেশি সুবিধার না। কিছুতেই গেট খুলল না।
দারোয়ান ভালোই। বাবার জন্যে খোলে নি। বাবা গেট খুলতে নিষেধ করেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। বাবার ধারণা, গেট খুললেই আমি চলে যাব।
তুমি বুঝি শুধু চলে যেতে চাও?
না, চাই না। কিন্তু বাবার ধারণা, আমি চলে যেতে চাই।
মেয়েটি আবার মাথা দুলিয়ে হাসল। মেয়েটি এই দারুণ শীতেও পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে আছে। খালি পা। মনে হচ্ছে সে শীতে অল্প অল্প কাঁপছে।