ই এন টি স্পেশালিষ্ট প্রফেসর আলম বললেন, অনেক বাচ্চাই দেরিতে কথা শেখে। এর বেলাও তাই হচ্ছে। দেরি হচ্ছে। আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে দিন-রাত কথা বলবেন ও শুনে-শুনে শিখবে।…
আমি প্রফেসর আলমের পরামর্শমতো প্রচুর কথা বলতাম। গল্প পড়ে শোনোতাম। সিনেমায় নিয়ে যেতাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। মেয়েটি একটি কথাও বলল না।…
ওর যখন ছ বছর বয়স তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। দিনটি আমার পরিষ্কার মনে আছে–জুলাই মাসের তিন তারিখ, শুক্রবার। আমি দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমুচ্ছি। শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। জ্বরজ্বর ভাব। হঠাৎ তিনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগল, এবং পরিষ্কার গলায় বলল, বাবা, অসময়ে ঘুমুচ্ছ কেন?…
আপনি বুঝতেই পারছেন আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। প্রথমে ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি। তিনি কথা বলেছে। একটি দুটি শব্দ নয়, পুরো বাক্য বলেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেছে। কোনো রকম জড়তা নয়, অস্পষ্টতা নয়। বিস্ময় সামলাতে আমার দীর্ঘ সময় লাগল। আমি এক সময় বললাম, তুই কথা বলা জানিস?…
তিনি হাসি মুখে বলল, হ্যাঁ। কেন জানব না?…
এত দিন কথা বলিস নি কেন?…
তিনি তার জবাব দিল না। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল, যেন সে খুব মজা পাচ্ছে। এটা যেন চমৎকার একটা রসিকতা, কথা না-বলে বাবাকে বোকা বানানো।–
মিসির আলি সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে আমার সময় লাগল। তবে আমি ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ। আমি কোনো কিছু নিযেই হৈচৈ শুরু করি না। প্রথমে নিজে বুঝতে চেষ্টা করি। কিন্তু তিমির ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝলাম না। হঠাৎ করে কথা বলা শুরু করা ছাড়াও তার মধ্যে অনেক বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা ছিল।
এই পর্যন্ত বলেই বরকতউল্লাহ সাহেব থামলেন। পানি খেতে চাইলেন। মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বরকতউল্লাহ সাহেব নিচু গলায় আবার কথা শুরু করলেন।
আমি লক্ষ করলাম, তিন্নি সব প্রশ্নের জবাব জানে।
মিসির আলি বললেন, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। সব প্রশ্নের জবাব জানে মানে?
আপনাকে উদাহরণ দিলে ভালো বুঝবেন। ধরুন, আমি তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, ষোলর বর্গমূল কত? সে এক মুহূর্ত ইতস্তত না-করে বলবে চার–যদিও সে অঙ্কের কিছুই জানে না। যে-মেয়ে কথা বলতে পারে না, তাকে অঙ্ক শেখানোর প্রশ্নই ওঠে না।…
আপনাকে আরেকটি উদাহরণ দিই। এক দিন বাসায় ফিরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, বল তো মা আজ নয়াবাজারে কার সঙ্গে দেখা হয়েছে? সে সঙ্গে-সঙ্গে বলল, হালিম সাহেবের সঙ্গে।…
হালিম আমার বাল্যবন্ধু। তিন্নি তাকে চেনে না। তার সঙ্গে আমার মেয়ের কোনো দিন দেখা হয় নি। হালিমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, এটা তিন্নির জানার কোনো কারণ নেই। মিসির আলি সাহেব, বুঝতেই পারছেন, আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তার কিছুদিন পর আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।…
রাতের বেলা তিন্নিকেনিয়ে খেতে বসেছি। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমি হারিকেন জ্বালানোর জন্যে বললাম! কেউ হারিকেন খুঁজে পেল না। প্রয়োজনের সময় কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। টর্চ আনতে বললাম–তাও কেউ পাচ্ছে না। আমি বিরক্ত হয়ে ধমকাধিমকি করছি। তখন তিন্নি বলল, বাতি চলে গেলে সবাই এত হৈচৈ করে। কেন?…
আমি বললাম, অন্ধকার হয়ে যায়, তাই।…
অন্ধকার হলে কী অসুবিধা?…
অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, সেটাই অসুবিধা।…
তুমি দেখতে পাও না?…
শুধু আমি কেন, কেউই পায় না। আলো ছাড়া কিছুই দেখা যায় না মা।…
তিনি খুবই অবাক হল, বিস্মিত গলায় বলল, কিন্তু আমি তো অন্ধকারেও দেখতে পাই। আমি তো সব কিছু দেখছি!…
প্রথম ভাবলাম, সে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু না, ঠাট্টা নয়। সে সত্যি কথাই বলছিল। সে অন্ধকারে দেখে। খুব পরিষ্কার দেখে।
বরকতউল্লাহ সাহেব থামলেন। রুমাল বের করে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলেন। মিসির আলি বললেন, আপনার মেয়ের প্রসঙ্গে আরো কিছু কি বলবেন? তিনি না-সূচক মাথা নাড়লেন।
আর কিছুই বলার নেই?
আছে। কিন্তু এখন আপনাকে বলতে চাই না।
।কখন বলবেন?
প্রথম আপনি আমার মেয়েকে দেখবেন। শুর সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর আপনাকে বলব।
ঠিক আছে। আপনার মেয়ের এখন বয়স হচ্ছে নয়। মেয়ের অস্বাভাবিকাতাগুলি তো আপনার অনেক আগেই চোখে পড়েছে। কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন?
না। ডাক্তার এর কী করবো?
কোনো সাইকিয়াটিষ্ট?
না। আপনিই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর কাছে আমি এসেছি।
মেয়ের এই ব্যাপারগুলি আপনি মনে হচ্ছে লুকিয়ে রাখতে চান।
হ্যাঁ, চাই। কোন চাই, তা আপনি আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন।
আপনি মেয়ের মা সম্পর্কে কিছু বলুন।
কী জানতে চান?
জানতে চাই তিনি কেমন মহিলা ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনো রকম অস্বাভাবিকতা ছিল কি না।
না, ছিল না। তিনি খুবই স্বাভাবিক মহিলা ছিলেন।
আপনি ভালোমতো জানেন?
হ্যাঁ, ভালোমতোই জানি। আমি এগার বছর আমার স্ত্রীর সঙ্গে কাটিয়েছি। তিন্নি আমাদের শেষ বয়সের সন্তান। এগার বছরে এক জন মানুষকে ভালোমতো জানা যায়।
তা জানা যায়। আচ্ছা, আপনার মেয়ের এই ব্যাপারগুলি কি বাইরের অন্য কাউকে বলেছেন?
না, কাউকেই বলি নি। আপনি বুঝতেই পারছেন, এটা জানাজানি হওয়ামাত্রই একটা হৈচৈ শুরু হবে। পত্রিকার লোক আসবে, টিভির লোক আসবে। আমি ভাবলাম, কিছুতেই এটা করতে দেওয়া উচিত হবে না। এখন মিসির আলি সাহেব, দয়া করে বুলুন–আপনি কি আমার মেয়েটাকে দেখবেন?