তাই নাকি? আবার বলছেন তাই নাকি! আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি ডঃ জাবেদ
না, আমি তো ঠিক–।
মিসির আলি খুবই বিব্রত বোধ করলেন, কিন্তু কিছুই করার নেই। এর প্রায় এক বৎসর পর মিসির আলি ময়মনসিংহের এক অ্যাডভোকেটের কাছ থেকে এক চিঠি পেলেন। চিঠির বিষয়বস্তু হচ্ছে বরকতউল্লাহ্ নামের এক ব্যবসায়ী ময়মনসিংহ শহরের বাড়ি মিসির আলিকে দান করেছেন। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে কিছু টাকাও ব্যাঙ্কে জমা আছে। টাকার অঙ্কটি অবশ্য উল্লেখ করা হয় নি। মিসির আলি ভেবেই পেলেন না, অপরিচিত এক ভদ্রলোক শুধু—শুধু তাঁকে বাড়ি দেবেন কেন।
সেই বাড়ি দেখেও তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। বিশাল বাড়ি। অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, বাড়ি অনেক দিন তালাবন্ধ আছে। বাগানের অবস্থা দেখেন না, জঙ্গল হয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, আমাকে বাড়িটা কেন দেওয়া হয়েছে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক বিরক্ত মুখভঙ্গি করলেন। মোটা গলায় বললেন, দিচ্ছে যখন নিন। ইচ্ছা করলে বিক্রি করে দিতে পারেন। ভালো দাম পাবেন! আমার কাছে কাষ্টমার আছে–ক্যাশ টাকা দেবে।
মিসির আলি বাড়ি বিক্রি করার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখালেন না। ক্লান্ত গলায় বললেন, আগে দেখি, বাড়িটা আমাকে কেন দেয়া হল। আজকালকার দিনে কতো আর শুধু শুধু এ-রকম দান খারাত করে না। দানপত্রে কি কিছুই লেখা নেই?
তেমন কিছু না, শুধু বাগানের প্রতিটি গাছের যথাসম্ভব যত্ন নেবার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। উইলের কপি তো পাঠিয়েছি আমি আপনাকে।
মিসির আলি বাড়ি তালাবন্ধ করে ঢাকা ফিরে এলেন। বরকতউল্লাহ লোকটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জোগাড় করলেন। জানতে পারলেন যে, এর একটি অসুস্থ মেয়ে ছিল। মেয়েটির মাথার ঠিক ছিল না। মেয়েটি মারা যাবার পর ঐ বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতরই তার কবর হয়। ভদ্রলোক নিজেও অল্প দিন পর মারা যান। কিন্তু এর সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক? মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। জগতে রহস্যময় ব্যাপার এখনো তাহলে ঘটে!
পাঁচ বছর পরের কথা
পাঁচ বছর পরের কথা।
মিসির আলি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ময়মনসিংহে বেড়াতে এসেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নীলু, হাসিখুশি ধরনের একটি মেয়ে। খুব সহজেই অবাক হয়, অল্পতেই মন-খারাপ করে, আবার সামান্য কারণেই মন ভালো হয়ে যায়।
ময়মনসিংহে আসার নীলুর কোনো ইচ্ছা ছিল না। আসতে হয়েছে মিসির আলির আগ্রহে। তিনি বারবার বলেছেন, তোমাকে মজার একটা জিনিস দেখাব। অনেক চেষ্টা করেও সেই মজার জিনিসটি সম্পর্কে নীলু কিছু জানতে পারে নি। মিসির আলি লোকটি কথা খুব কম বলেন। তিনি প্রশ্নের উত্তরে শুধু হেসে বলেছেন, গেলেই দেখবে। খুব অবাক হবে।
নীলু সত্যি অবাক হল। চোখ কপালে তুলে বলল, এই বাড়িটা তোমার! বল কী। কে তোমাকে এই বাড়ি দিয়েছে?
দিতে হবে কেন, আমি বুঝি কিনতে পারি না?
না, পার না। তোমার এত টাকাই নেই।
বরকত সাহেব বলে এক ভদ্রলোক দিয়েছেন।
কেন দিয়েছেন?
ঐটা একটা রহস্য। রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছি। যখন করব, তখন জানবে। গভীর আগ্রহে নীলু বিশাল বাড়িটি ঘুরে-ঘুরে দেখল। বহু দিন। এখানে কেউ ঢোকে নি, ভ্যাপসা, পুরোনো গন্ধ। দেয়ালে ঘন বুল। আসবাবপত্রে ধুলোর আস্তরণ। বাগানে ঘাস হয়েছে। হাঁটু-উঁচু। পেছন দিকটায় কচু গাছের জঙ্গল। মিসির আলি বললেন, এ তো দেখছি ভয়াবহ অবস্থা!
নীলু বলল, যত ভয়াবহই হোক, আমার খুব ভালো লাগছে। বেশ কিছুদিন আমি এ বাড়িতে থাকব, কি বল?
কী যে বল! এ-বাড়ি এখন মানুষ-বাসের অযোগ্য। মাস দু-এক লাগবে বাসের যোগ্য করতে।
তুমি দেখ না কী করি।
কোমর বেঁধে ঘর গোছাতে লাগল নীলু। তার প্রবল উৎসাহ দেখে মিসির আলির কিছু বলতে মায়া লাগল! যেন এই মেয়েটি দীর্ঘদিন পর নিজের ঘর-সংসার পেয়েছে। আনন্দে-উৎসাহে ঝলমল করছে। এক দিনের ভেতর মালী লাগিয়ে বাগান পরিষ্কার করল। বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে রান্নার ব্যবস্থা করল। রাতে খাবার সময় চোখ বড়-বড় করে বলল, জান, এ বাড়ির ছাদ থেকে পাহাড় দেখা যায়। নীল পাহাড়ের সারি। কী যে অবাক হয়েছি পাহাড় দেখে।
পাহাড়ের নাম হচ্ছে গারো পাহাড়।
আজ অনেকক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখলাম। মালী বাগানে কাজ করছিল, আমি পাহাড় দেখছিলাম।
ভালো করেছ।
ও ভালো কথা, বাগানে খুব অদ্ভুত ধরনের একটা গাছ আছে। ভোরবেলা তোমাকে দেখাব। কোনো অর্কিড-টর্কিড হবে। হলুদ রঙের লতানো গাছ। মেয়েদের চুলে যে রকম বেণী থাকে, সে রকম বেণী-করা। নীলা-নীল ফুল ফুটেছে।
মিসির আলি তেমন কোনো উৎসাহ দেখালেন না। নীলু বলল, আচ্ছা, এই বাড়িতে থেকে গেলে কেমন হয়?
কী যে বল। ঢাকায় কাজকর্ম ছেড়ে এখানে থাকব?
আমি থাকি। তুমি সপ্তাহে-সপ্তাহে আসবে।
পাগল হয়েছ নাকি? এক-একা তুমি এখানে থাকবে?
আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আমার এ—বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
প্ৰথম প্রথম। এ-রকম মনে হচ্ছে। কদিন পর আর ভালো লাগবে না। আমার কখনো এ বাড়ি খারাপ লাগবে না। যদি হাজার বছর থাকি তবুও লাগবে না।
আচ্ছা, দেখা যাবে।
দেখো তুমি।
আসলেই তাই হল। মিসির আলি লক্ষ করলেন, এ-বাড়ি যেন প্রবল মায়ায় বেঁধে ফেলেছে নীলুকে। ছুটিছাটা হলেই সে ময়মনসিংহ আসবার জন্যে অস্থির হয়। এক বার এলে আর কিছুতেই ফিরে আসতে চায় না। রীতিমতো কান্নাকাটি করে। বিরক্ত হয়ে মাঝে-মাঝে তাকে একা রেখেও চলে এসেছেন। ভেবেছেন কী দিন একা থাকলে আর থাকতে চাইবে না। কিন্তু তা হয় নি। এ বিচিত্র বাড়িটির প্রতি নীলুর আকর্ষণ বাড়তেই থাকল। শেষটায় এ রকম হল যে, বৎসরের প্রায় অর্ধেক সময় তাদের কাটে এই বাড়িতে।