তিনি কি এ রকম একজন কেউ? মহাজ্ঞানী উদ্ভিদগোষ্ঠীর পরীক্ষার একটি বস্তু? মানুষ যদি উদ্ভিদ নিয়ে, ইঁদুর নিয়ে ল্যাবরেটরিতে নানান ধরনের পরীক্ষা করতে পারে- ওরা কেন পারবে না?
কিন্তু তারা পরীক্ষাটা করছে কীভাবে? এক জন মানুষ ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের গায়ে একটি সিরিঞ্জে করে রিএজেন্ট ঢুকিয়ে দিতে পারে। কিন্তু উদ্ভিদ কি তা পারবে?
হয়তো পারবে। মাইক্রোওয়েভ রশ্মি দিয়ে আমরা দূর থেকে যন্ত্র চালু করতে পারি। ওদের হাতেও হয়তো তেমন ব্যবস্থা আছে।
মিসির আলি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এসে বসলেন। আকাশে চাঁদ উঠেছে। বাগানটিকে ভারি সুন্দর লাগছে। এত সুন্দর যে মন খারাপ হয়ে যায়।
আপনি-আজ আর না, তাই না?
মিসির আলি চমকে। তিন্নির গলা!
তুমিও তো দেখছি জেগে আছ?
হ্যাঁ, আমি জেগেই থাকি।
মিসির আলি কথাবার্তা চালাতে লাগলেন। এ জাতীয় কথাবার্তায় তিনি এখন অভ্যস্ত। আগের মতো অস্বস্তি বোধ হয় না। বরঞ্চ মনে হয়, এই তো স্বাভাবিক। বরঞ্চ কথা বলার এই পদ্ধতি অনেক সুন্দর। মুখোমুখি এসে বসার দরকার নেই। দুজন দু জায়গায় থেকে কথা বলে চমৎকার সময় কাটান।
তিন্নি, আমি যে এতক্ষণ তোমার বাবার সঙ্গে গল্প করলাম।– সেটা কি তুমি জান?
হ্যাঁ, জানি। সব কথা শুনেছি।
আমি তোমাকে নিয়ে যা ভেবেছি, তাও নিশ্চয়ই জান?
হ্যাঁ, তাও জানি। সব জানি!
আমি কি ঠিক পথে এগুচ্ছি? অর্থাৎ আমার থিওরি কি ঠিক আছে?
কিছু-কিছু ঠিক। বেশির ভাগই ঠিক না।
কোন জিনিসগুলি ঠিক না, সেটা কি আমাকে বলবো?
না, বলব না।
কেন বলবে না?
তিন্নি জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, তুমি কি চাও না, আমি তোমাকে সাহায্য করি?
না, চাই না।
এক সময় কিন্তু চেয়েছিলো।
তখন খুব ভয় লাগত, এখন লাগে না।
মিসির আলি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর খুব শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বুঝতে পারছি, তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন হচ্ছে। তুমি বদলে যাচ্ছ। শেষ পর্যন্ত কী হবে তুমি কি জান?
জানি।
তুমি কি আমাকে তা বলবে?
না।
আচ্ছা, এইটুকু বল, তুমি কি একমাত্র মানুষ, যার উপর এই পরীক্ষাটি হচ্ছে? না তুমি ছাড়াও আরো অনেককে নিয়ে এ রকম হয়েছে বা হচ্ছে?
অনেককে নিয়েই হয়েছে এবং হচ্ছে। এবং, এবং–
বল, আমি শুনছি।
এমন একদিন আসবে, পৃথিবীর সব মানুষ এ-রকম হয়ে যাবে।
তার মানে!
তখন কত ভালো হবে, তাই না? মানুষের কোনো খাবারের কষ্ট থাকবে না। মানুষ কত উন্নত প্ৰাণী, কিন্তু সে তার সবটা সময় নষ্ট করে খাবারের চিন্তায়। এই সময়টা সে নষ্ট করবে না। কত জিনিস সে জানবে। আরো কত ক্ষমতা হবে তার।
কী হবে এত কিছু জেনে?
তিনি খিলখিল করে হেসে উঠল!
মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?
হাসি আসছে, তাই হাসছি। মানুষ তো এখনো কিছুই জানে না, আর আপনি বলছেন, কী হবে এত জেনে।
তুমি বুঝি অনেক কিছু জেনে ফেলেছ?
হ্যাঁ।
কি কি জানলে বল!
তা বলব না। আপনি এখন ঘুমুতে যান।
আমার ঘুম পাচ্ছে না, আমি আরো কিছুক্ষণ কথা বলব তোমার সঙ্গে।
না, আপনি আর কথা বলবেন না। আপনি এখন ঘুমুবেন এবং সকালে উঠে ঢাকা চলে যাবেন। আর কখনো আসবেন না।
আসব না মানে?
ইচ্ছা করলেও আসতে পারবেন না। আমার কথা কিছুই আপনার মনে থাকবে না।
কী বলছি তুমি।
আপনাকে আমার দরকার নেই।
তিন্নি হাসতে লাগল। মিসির আলি সারা রাত বারান্দায় বসে রইলেন। অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে হতে লাগল, মেয়েটি যা বলছে, তা-ই হবে।
মানুষ যখন কোনো জটিল এক্সপেরিমেন্ট করে, তার সাবধানতার সীমা থাকে না। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে, যেন তার এক্সপেরিমেন্ট নষ্ট না হয়। কেউ এসে যেন তা ভঙুল না। করে দেয়। যারা এই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে এই ভয়াবহ এক্সপেরিমেন্ট করছে, তারাও তাই করবে। কে রক্ষা করবে। মেয়েটিকে?
ভোররাতের দিকে মিসির আলির শরীর খারাপ লাগতে লাগল। তাঁর কেবলি মনে হল, ঢাকায় কী যেন একটা কাজ ফেলে এসেছেন। খুব জরুরি কাজ। এক্ষুণি ফিরে যাওয়া দরকার। কিন্তু কাজটি কী, তা মনে পড়ছে না। তিনি সকাল আটটায় ঢাকা রওনা হয়ে গেলেন। বরকত সাহেব বা তিনিী–কারো কাছ থেকে বিদায় পর্যন্ত নিলেন। না। তিন্নির ব্যাপারটা নিয়ে বড়-বড় খাতায় গাদাগাদ নোট করেছিলেন। সব ফেলে গেলেন, কিছুই সঙ্গে নিলেন না। ঢাকায় পৌঁছার আগেই প্রচণ্ড জ্বরে জ্ঞান হারালেন।
টেনের একজন সহযাত্রী দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে পৌঁছে দিলেন ঢাকা মেডিকেলে। তিনি প্রায় দু মাস অসুখে ভুগলেন, সময়টা কাটল একটা ঘোরের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হতে তাঁর আরো দু মাস লাগল। কিন্তু পুরোপুরি বোধহয় সুস্থ হলেনও না। কিছু কিছু জিনিস তিনি মনে করতে পারেন না। যেমন এক দিন অমিতা তাঁকে দেখতে এসে বলল, শুধু শুধু আজেবাজে কাজে ছোটাছুটি কর, তারপর একটা অসুখ বাধাও। সেইবার হঠাৎ কুমিল্লা এসে উপস্থিত। যেভাবে হঠাৎ আসা, সেইভাবে হঠাৎ বিদায়। আমি তো ভেবেই পাই না–।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কুমিল্লা! কুমিল্লা কোন যাব!
সে কী, তোমার মনে নেই!
না তো।
তুমি মামা একটা বিয়েটিয়ে করে সংসারী হও। নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানো এক বার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা! তিনি রাগী গলায় বললেন, যাক, আপনার দেখা পাওয়া গেল। বইগুলি তো ফেরত দিলেন না, কেন?
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, কী বই?
কী বই মানে! বোটানির দুটি বই নিয়ে গেলেন না আমার কাছ থেকে?