বাতি নোভাবার পর ঘর কেমন অন্য রকম হয়ে গেল। গা ছমছম করতে লাগল। যেন এই ঘরটি এত দিনের চেনা কোনো ঘর নয়। অন্য কোনো রহস্যময় অচেনা ঘর। বরকত সাহেব সিগারেট ধরিয়ে মৃদু স্বরে বলতে লাগলেন, আমার স্ত্রী খুবই সহজ এবং সাধারণ একজন মহিলা। বলার মতো তেমন কোনো বিশেষত্ব তার নেই। কোনো রকম অস্বাভাবিকতাও তার চরিত্রে ছিল না। তবে আমার শাশুড়ি এক জন অস্বাভাবিক মহিলা ছিলেন। বিয়ের আগে তা জানতে পারি নি। জেনেছি বিয়ের অনেক পরে।
আমার স্ত্রীর জন্মের পরপর আমার শাশুড়ি মারা যান। আমার শাশুড়ি সম্পর্কে এখন আপনাকে যা বলছি, সবই শোনা কথা! আমার স্ত্রীর জন্মের ঠিক আগে আগে আমার শাশুড়ি অদ্ভুত আচার-আচরণ করতে থাকেন। তার ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে রোদে বসে থাকা। এখন তিন্নি যা করে, অনেকটা তাই। আমার শাশুড়ি লোকজনদের বলতে শুরু করেন, তাঁর পেটে মানুষের বাচ্চা নয়, তাঁর পেটে বড় হচ্ছে একটা গাছ। সবাই বুঝল এটা মাথা-খারাপের লক্ষণ। গ্ৰাম্য চিকিৎসাটিকিৎসা হতে থাকল। কোনো লাভ হল না। তিনি বলতেই থাকলেন, তাঁর পেটে বড় হচ্ছে একটা গাছ। যাই হোক, যথাসময়ে আমার স্ত্রীর জন্ম হল-ফুটফুটে একটি মেয়ে। আমার শাশুড়ি মেয়েকে কোলে নিলেন, কিন্তু বললেন, তোমরা বুঝতে পারছ না, এ আসলে মানুষ নয়, এ একটা গাছ এর কিছু দিন পর আমার শাশুড়ি মারা যান।
আপনাকে আগেই বলেছি, আমার স্ত্রী খুব স্বাভাবিক মহিলা ছিল। কিন্তু তিনি যখন পেটে এল, তখন তার ভেতরেও অস্বাভাবিকতা দেখা দিল। এক রাতে সে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, তার পেটে যে বড় হচ্ছে, সে মানুষ নয়, সে একটা গাছ। আমি এমন ভাব দেখলাম যে, এই খবরে মোটেও অবাক হই নি। আমি বললাম, তাই কি?
সে বলল, হ্যাঁ
কী করে বুঝলে?
অনেক দূরের কিছু গাছ আমাকে স্বপ্নে বলেছে। তারা বলেছে, তোমার গর্ভে যে জন্মেছে, তাকে খুব যত্নে বড় করবে। কারণ তাকে আমাদের খুব দরকার।
স্বপ্নে তো মানুষ অনেক কিছুই দেখে। স্বপ্নটাকে কখনো সত্যি মনে করতে নেই।
এটা সত্যি। এটা স্বপ্ন নয়।
ঠিক আছে, সত্যি হলে সত্যি। এখন ঘুমাও।
তিন্নির জন্মের কিছু দিন পর আমার স্ত্রী মারা গেল। তার মৃত্যুর দু দিন আগে তিন্নিকে কোলে নিয়ে আমি তার কাছে গেলাম। হাসিমুখে বললাম, কী সুন্দর একটি মেয়ে, তুমি বলছ গাছ?
আমার স্ত্রী ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসল। শান্ত স্বরে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না। কিন্তু একদিন বুঝবে। আমি হাসতে-হাসতে বললাম, এক দিন সকালবেলা দেখব তিন্নির চারদিকে ডালপালা গজিয়েছে, নতুন পাতা ছেড়েছে?
আমার স্ত্রী তার জবাব দিল না। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলা যেন আমার কথায় সে অসম্ভব রেগে গেছে।
বরকত সাহেব থামলেন। ঘর অন্ধকার, কিন্তু মিসির আলি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন, ভদ্রলোকের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আপনি আমার স্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। আমি যা জানি আপনাকে বললাম। এখন আপনি আমাকে বলুন, কী হচ্ছে?
মিসির আলি কি বলবেন ভেবে পেলেন না। বরকত সাহেব ধরা গলায় বললেন, কিছু দিন থেকে তিন্নি বাগানে একটি গর্তে চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরে আসে অনেক রাতে। আমার প্রায়ই মনে হয়, একদিন সে হয়তো আর ফিরবে না। সেখানেই থেকে যাবে এবং দেখব,–
বরকত সাহেব কথা শেষ করলেন না। তাঁর গলা বন্ধ হয়ে এল। মিসির আলি বললেন, নিন, এক গ্লাস পানি খান। বরকত সাহেব তৃষ্ণার্তের মতো পানির গ্লাস শেষ করলেন।
মিসির আলি সাহেব।
জ্বি বলুন।
তিন্নি এখন আমাকে বলছে বাড়ি ছেড়ে যেতে। সে একা থাকবে এখানে। কাজের লোক থাকবে না, দারোয়ান মালী কেউ থাকবে না। থাকবে শুধু সে একা। এবং আপনি জানেন মেয়েটি যা চায়, তাই আমাকে করতে হবে। ওর অসম্ভব ক্ষমতা। আপনি তার পরিচয় ইতোমধ্যেই হয়তো পেয়েছেন।
হ্যাঁ, তা পেয়েছি।
কী হচ্ছে আপনি আমাকে বলুন, এবং আমি কী করব, সেটা আমাকে বলুন। আমার শরীরও বেশি ভালো না। ব্লাড প্ৰেশার আছে, ইদানীং সুগারের প্রবলেম দেখা দিয়েছে। রাতের পর রাত ঘুমুতে পারি না।
মিসির আলি দৃঢ় গলায় বললেন, হাল ছেড়ে দেবার মতো এখনো কিছু হয় নি।
হালই তো নেই। হাল ধরবেন কীভাবে?
বরকত সাহেব উঠে পড়লেন। বাকি রাতটা মিসির আলি জেগেই কাটালেন। অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে সমস্ত ব্যাপারটা গোছাতে চেষ্টা করলেন। জিগ স পাজল–একটির সঙ্গে অন্যটি কিছুতেই মেলে না। তবু কি কিছু একটা দাঁড় করান যায় না?
একটা পৰ্যায়ে জীবনকে প্রকৃতি দু ভাগে ভাগ করলেন–প্ৰাণী এবং উদ্ভিদ। প্রাণীরা ঘুরে বেড়াতে পারে, উদ্ভিদ পারে না। পরবর্তী সময়ে প্রাণের বিকাশ হল। ক্রমে-ক্ৰমে জন্ম হল অসাধারণ মেধাসম্পন্ন প্রাণীর-মানুষ। এই বিকাশ শুধু প্রাণীর ক্ষেত্রে হবে কেন? কেন উদ্ভিদের বেলায়ও হবে না?
ধরা যাক উদ্ভিদের বেলায়ও বিকাশ হল। এক সময় জন্ম হল এমন এক শ্রেণীর উদ্ভিদ, অসাধারণ যাদের মেধা। এই পৃথিবীতে হয়তো হল না, হল অন্য কোনো গ্রহে। একটি উন্নত প্রাণী খুঁজে বেড়াবে অন্য উন্নত জীবনকে। কারণ তার চাইবে, তাদের আহরিত জ্ঞান অন্যকে জানাতে। তখন তারা কি চেষ্টা করবে না ভিন্ন জাতীয় প্রাণের সঙ্গে যোগাযোগের? সেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে এমন একটি প্ৰাণ। তার দরকার, যে একই সঙ্গে মানুষ এবং উদ্ভিদ। এ জাতীয় একটি প্রাণ সে তৈরি করতে চেষ্টা করবে। তার জন্যে তাকে ডিএনএ অণুর পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রথম পরীক্ষাতেই সে তা পারবে না। পরীক্ষাটি তাকে করতে হবে বারবার।