আমার শরীর ভালোই। আমার শরীর খারাপ হওয়ার তো কোনো কারণ ঘটে নি!
আপনি ঢাকায় এত দিন কী করলেন??
তেমন কিছু করতে পারি নি, খোঁজখবর করছি।
খোঁজখবর তো যথেষ্টই করা হল, আর কত?
আপনি মনে হয়। আশা ছেড়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ, ছেড়ে দিয়েছি। এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই। আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন। সেই জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার পারিশ্রমিক হিসেবে আমি একটি চেক আপনার জন্যে তৈরি করে রেখেছি, নিজাম আপনাকে দেবে। আমি চাই না এ-ব্যাপারটি নিয়ে আপনি আর মাথা ঘামান।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
ভাগ্যকে স্বীকার করে নেবার চেষ্টা করছি। যা ঘটেছে, এটা আমার ভাগ্য।
ভাগ্যটা কী জানতে পারি কি?
না, জানতে পারেন না। আমি ঐ সব নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না। সমস্ত ব্যাপারটা থেকে আমি হাত ধুয়ে ফেলতে চাই।
মিসির আলি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, গোড়া থেকেই আপনি অনেক কিছু আমার কাছ থেকে গোপন করেছেন, যেটা উচিত হয় নি।
বরকত সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আমি ধারণা করেছিলাম আপনি নিজেই তা ধরতে পারবেন। এখন দেখছি আমার ধারণা ঠিক নয়। আপনি কিছুই ধরতে পারেন নি।
একেবারেই যে ধরতে পারি নি, তা নয়। আমার ধারণা, আপনার স্ত্রী আপনাকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি মেয়েটি বড় হলে কেমন হবে। অর্থাৎ আজকের এই সমস্যার ব্যাপারটি সম্পর্কে আপনার স্ত্রী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
এই জাতীয় ধারণা হবার পেছনে আপনার যুক্তি কী?
যুক্তি অবশ্যই আছে। এবং বেশ কঠিন যুক্ত।
বলুন, শুনি আপনার কঠিন যুক্তি।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। বরকত সাহেবের চোখের দিকে তাকালেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবং শান্ত স্বরে বললেন, আমি প্রথমেই লক্ষ করলাম, আপনি আপনার মেয়ের অস্বাভাবিকতাগুলি মোটামুটি সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন, তেমন বিচলিত হন নি। আমাকে ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে জানান নি। এ থেকেই মনে হয়েছে, আপনার মেয়ের এইসব অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত। এই প্ৰস্তুতি কোথেকে আসতে পারে? আমার মনে হয়েছে। কেউ নিশ্চয় আগেই আপনাকে বলেছে। কে বলতে পারে? আমার মনে হয়েছে আপনার স্ত্রীর কথা। কারণ আপনার স্ত্রী হচ্ছেন—
বরকত সাহেব মিসির আলির কথা শেষ করতে দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন এবং কঠিন স্বরে বললেন, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, আপনি এখন যান, পরে কথা বলব।
মিসির আলি নিঃশব্দে উঠে এলেন। চলে গেলেন বাগানে। বড়ই গাছটি খুঁজে বের করবেন। তিনি বড়ই গাছের একটা গর্তে দাঁড়িয়ে থাকে, ঐ গর্তটিও পরীক্ষা করে দেখবেন। কিন্তু সেই সুযোগ হল না। ভয়াবহ একটি ব্যাপার ঘটল। প্ৰকাণ্ড একটা ময়াল সাপ হঠাৎ যেন আকাশ ফুড়ে নেমে এল। মিসির আলি চমকে উঠলেন। তাঁর চোখ থেকে চশমা খুলে পড়ল, আর ঠিক তখন মনে হল–এই দৃশ্যটি সত্যি নয়।
ময়মনসিংহ শহরের একটি বাড়িতে এত বড় একটি ময়াল এসে উপস্থিত হতে পারে না। তা ছাড়া কোনো সাপ পেটে ভর দিয়ে নিজের মাথাটা এত উঁচুতে তুলতে পারে না। এই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই তিন্নির তৈরি করা। মেয়েটি এই ছবি দেখাচ্ছে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন, আর ঠিক তখন তিন্নির হাসি শোনা গেল। মেয়েটি তার ঘরে বসেই হাসছে, তিনি শুনতে পাচ্ছেন। তিন্নির হাসি থামল। সে রিনারিনে গলায় বলল, খুব ভয় পেয়েছেন?
তা পেয়েছি।
কিন্তু যতটা ভয় পাবেন ভেবেছিলাম, ততটা পাননি। আপনি বুঝে ফেলেছেন যে এটা মিথ্যা সাপ।
হ্যাঁ, তাও ঠিক।
আপনার এত বুদ্ধি কেন বলুন তো?
জানি না।
সব মানুষের যদি আপনার মতো বুদ্ধি হত, তাহলে খুব ভালো হত। তাই না?
মিসির আলি হেসে ফেললেন। হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বললেন, তুমি আমাকে ভয় দেখালে কেন?
আপনি বলুন কেন। আপনার এত বুদ্ধি, আর এই সহজ জিনিসটা বলতে পারবেন।
আন্দাজ করতে পারছি। তুমি চাও না। আমি ঐ গর্তটি দেখি, যেখানে তুমি রোজ দাঁড়াও। তাই না?
হ্যাঁ, তাই।
দেখ তিন্নি, আমি তোমার ব্যাপারটা বুঝতে চাই। কিন্তু তুমি আমাকে বুঝতে দিচ্ছ না। তুমি আমাকে সাহায্য না করলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না। আমার এত ক্ষমতা নেই।
তিন্নি ক্লান্ত গলায় বলল, কোনো মানুষ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। যারা পারত, তারা করবে না।
কারা পারত?
তিন্নি জবাব দিল না।
মিসির আলির মনে হল, মেয়েটি কাঁদছে।
মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন
মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দরজায় খুটাখুটি শব্দ শুনে জেগে উঠলেন। অনেক রাত। ঘড়ির ছোট কাটা একের ঘর পার হয়ে এসেছে। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, কে? কোনো জবাব এল না। কিন্তু দরজার কড়া নড়াল। মিসির আলি অবাক হয়ে দরজা খুললেন। অন্ধকারে বরকত সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন।
সরি, আপনার ঘুম ভাঙালাম বোধহয়।
কোনো অসুবিধা নেই, আপনি আসুন।
বরকত সাহেব ইতস্তত করে বললেন, ঘুম আসছিল না, ভাবলাম আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করি।
খুব ভালো করেছেন। বসুন।
বরকত সাহেব বসলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করছেন। বসে আছেন মাথা নিচু করে। এক জন অহঙ্কারী লোক এভাবে কখনো বসে না। মিসির আলি বললেন, আমার মনে হয়, আপনি আপনার স্ত্রীর কথা কিছু বলতে চান। বলুন, আমি শুনছি।
বরকত সাহেব চুপ করে রইলেন। তাঁর মাথা আরো একটু বুকে পড়ল। মিসির আলি বললেন, আমি বরং বাতি নিভিয়ে দিই, তাতে কথা বলতে আপনার সুবিধা হবে। আলোতে আমরা অনেক কথা বলতে পারি না। অন্ধকারে সহজে বলতে পারি।