বরকতউল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। তাঁর দ্রু কুঞ্চিত হল। মিসির আলি মনে-মনে হাসলেন। কাউকে বুদ্ধির খেলায় হারাতে পারলে তাঁর খুব আনন্দ হয়।
বরকতউল্লাহ্ সাহেব, আপনি কী চান?
আপনার সাহায্য চাই। তার জন্যে আমি আপনাকে যথাযথ সম্মানী দেব। আমি ধনাঢ্য ব্যাক্তি না-হলেও দরিদ্র নই! আমি চেকবই নিয়ে এসেছি।
ভদ্রলোক কোটের পকেটে হাত দিলেন। মিসির আলির খানিকটা মন-খারাপ হয়ে গেল। ধনবান ব্যক্তিরা দরিদ্রের কাছে প্রথমেই নিজেদের অর্থের কথা বলে কেন ভাবতে লাগলেন।
বরকতউল্লাহ্ বললেন, আমি কি আমার সমস্যাটার কথা আপনাকে বলব?
মিসির আলি বললেন, তার আগে জানতে চাই, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আমি এমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি নই যে, ময়মনসিংহের এক জন লোক আমার নাম জানাবে।
বরকতউল্লাহ্ নিচু স্বরে বললেন, আমি খুঁজছি এক জন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট, যাঁর কাছে আমি অকপটে আমার কথা বলতে পারব। যে আমার কথায় লাফিয়ে উঠবে। না, আবার অবিশ্বাসের হাসিও হাসবে না। আমি জানি, আপনি সে-রকম এক জন মানুষ। কী করে জানি, তা তেমন জরুরি নয়।
মিসির আলির মনে হল লোকটা বেশ বুদ্ধিমান, গুছিয়ে কথা বলতে জানে। যার মানে হচ্ছে, গুছিয়ে কথা বলার অভ্যোস তার আছে। লোকটি সম্ভবত এক জন ব্যবসায়ী। সফল ব্যবসায়ীদের নানান ধরনের লোকজনের সঙ্গে খুব গুছিয়ে কথা বলতে হয়।
বরকতউল্লাহ্ সাহেব, আপনি কি এক জন ব্যবসায়ী?
হ্যাঁ, আমি এক জন ব্যবসায়ী।
কত দিন ধরে ব্যবসা করছেন?
প্রায় দশ বছর। এখন করছি না।
কিসের ব্যবসা?
আপনি আমাকে জেরা করছেন কেন বুঝতে পারছি না।
আপনার সমস্যা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব কি না, তা জানার জন্যে জেরা করছি। যদি আপনাকে আমার পছন্দ হয়, তবেই আপনার কথা শুনিব। সবার সমস্যা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পেলেও না?
না। আমার সম্পর্কে ভালোরকম খোঁজখবর আপনি নেননি; যদি নিতেন, তাহলে জানতেন যে, আমি টাকা নিই না।
বরকতউল্লাহ্ সাহেব দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। তিনি তাঁর সামনে বসে থাকা রোগাটে লোকটিকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কথাবার্তা বলছে অহঙ্কারী মানুষের মতো, কিন্তু বলার ভঙ্গিটি সহজ ও স্বাভাবিক।
আপনি টাকা নেন না কেন, জানতে পারি কি?
নিশ্চয়ই পারেন। টাকা নিলেই এক ধরনের বাধ্যবাধকতা এসে পড়ে। আমি তার মধ্যে যেতে চাই না। অন্যের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা আমার পেশা নয়, শখ। শখের ব্যাপারে কোনোরকম বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। কি বলেন?
ঠিকই বলছেন। আমি আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেব। কী জানতে চান বলুন?
আপনার পড়াশোনা কতদূর?
এম এ পাশ করেছি। পলিটিক্যাল সায়েন্স।
আপনি বলছেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন, কেন?
এই প্রশ্নের জবাব আপনাকে পরে দেব। অন্য প্রশ্ন করুন।
আপনি বিবাহিত?
হ্যাঁ। আমার ন বছর বয়েসী একটি মেয়ে আছে।
আপনার সমস্যা এই মেয়েকে নিয়েই, নয় কি?
জ্বি হ্যাঁ। কী করে বুঝলেন?
মেয়ের কথা বলার সময় আপনার গলার স্বর পাল্টে গেল, তা থেকেই আন্দাজ করছি। আপনার স্ত্রী মারা গেছেন কত দিন হল?
প্রায় নয় বছর হল। স্ত্রী মারা গেছেন, সেটা কী করে বলতে পারলেন?
বাচ্চাদের কোনো সমস্যা হলে মা নিজে আসেন। এ ক্ষেত্রে আসেন নি দেখে সন্দেহ হয়েছিল। তা ছাড়া বিপত্নীক মানুষদের দেখলেই চেনা যায়।
আমি কি এবার আমার ব্যাপারটা বলব?
বলুন।
সংক্ষেপে বলতে হবে?
না, সংক্ষেপে বলার দরকার নেই। চা দিতে বলি?
জ্বি-না, আমি চা খাই না। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিতে বলুন, খুব ঠাণ্ডা। তৃষ্ণা হচ্ছে।
আমার ঘরে ফ্ৰীজ নেই। পানি খুব ঠাণ্ডা হবে না।
ভদ্রলোক তৃষ্ণার্তের মতোই পানির গ্লাস শেষ করে দ্বিতীয় গ্লাস চাইলেন। মিসির আলি বললেন, আরেক গ্লাস দেব?
আর লাগবে না।
আপনি তাহলে শুরু করুন। আপনার মেয়ের নাম কি?
তিন্নি।
বলুন তিন্নির কথা।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সম্ভবত মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন। কিংবা বুঝে উঠতে পারছেন না, ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করবেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, ভদ্রলোকের কপালে সূক্ষ্ম ঘামের কণা জমতে শুরু করেছে। মিসির আলি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, ন বছর বয়েসী একটি মেয়ের এমন কী সমস্যা থাকতে পারে যা বলতে গিয়ে এমন অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়।
বলুন, আপনার মেয়ের কথা বলুন।
ভদ্ৰলোক বলতে শুরু করলেন।
আমার মেয়ের নাম তিন্নি।…
ওর বয়স ন বছর মেয়ের জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। মেয়েটিকে আমি নিজেই মানুষ করি। আমি মোটামুটিভাবে এক জন স্বচ্ছল মানুষ। কাজেই আমার পক্ষে বেশ কিছু কাজের লোকজন রাখা কোনো সমস্যা ছিল না। তিন্নিকে দেখাশোনার জন্যে অনেকেই ছিল। কিন্তু তবু মেয়েটির বেশির ভাগ দায়িত্ব আমিই পালন করেছি। দুধ ঘানানো, খাওয়ানো, ঘুম পড়ানো-সবই আমি করতাম। বুঝতেই পারছেন, মেয়েটি আমার খুবই আদরের। সব বাবার কাছেই তাদের ছেলেমেয়ের আদর থাকে, কিন্তু আমার মধ্যে বাড়াবাড়ি রকমের ছিল।
মিসির আলি বললেন, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এখন নেই?
ভদ্ৰলোক এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তাঁর মেয়ের কথা বলে যেতে লাগলেন। তিনি এমন একটি ভঙ্গি করলেন, যেন প্রশ্নটি শুনতে পান নি।
তিন্নির বয়স যখন এক বৎসর, তখন লক্ষ করলাম, ও অন্যান্য শিশুদের মতো নয়। সাধারণত এক বৎসর বয়সেই শিশুরা কথা বলতে শুরু করে। তিনির বেলা তা হল না। সে কথা বলা শিখল না। বড়-বড় ডাক্তাররা সবাই দেখলেন। তাঁরাও কোনো কারণ বের করতে পারলেন না। মেয়েটি কানো শুনতে পায়। তার ভোকাল কর্ড ঠিক আছে। কিন্তু কথা বলে না! কেউ কিছু বললে মন দিয়ে শোনে—এই পর্যন্তই। …