সূর্য এখনো ওঠে নি। মিসির আলি দ্রুত পা ফেলছেন। ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদী মনে হচ্ছে এখনো ঘুমিয়ে। দিনের কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয় নি। কাল রাতের বৃষ্টির জন্যেই বুঝি চারদিক ঝিলমিল করছে। মিসির আলি গত রাতটা প্রায় অম্বুমেই কাটিয়েছেন। কিন্তু তার জন্যে খারাপ লাগছে না। শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই, তিনি খুঁজছেন। চা-ওয়ালাকে। পাওনা টাকাটা দিয়ে দেবেন।। গল্পগুজব করবেন। তাঁর মনে একটা আশঙ্কা ছিল, হয়তো এই চাওয়ালা বুড়োর আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। বাকি জীবন মনের মধ্যে এই ক্ষুদ্র ঘটনা কাঁটার মত বিধে থাকবে। আশঙ্কা সত্যি হল না। বুড়োকে পাওয়া গেল। কেতলিতে চায়ের পানি ফুটে উঠেছে। কেতলির নল দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বুড়োর মুখ হাসি-হাসি।
কেমন আছেন বুড়োমিয়া?
আল্লায় যেমন রাখছে। আপনের শইল বালা?
জ্বি, ভালো। আমাকে চিনতে পারছেন না? ঐ যে চা খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে গেলাম!
গিয়েছিলাম। কাল এসেছি। আপনার টাকা নিয়ে এসেছি। চা কি হয়েছে?
বুড়ো চায়ের কাপে লিকার ঢালতে লাগল। মিসির আলি বললেন, আপনি নিশ্চয়ই মনে-মনে আমাকে খুব গালাগালি করেছেন।
জ্বি-না মিয়াসাব! অত অল্প কারণে কি আর গাইল দেওন যায়? আমি জানতাম আপনে আইবেন।
কী করে জানতেন?
বুঝা যায়। এই কথাটি ঠিক। অনেক কিছুই বোঝা যায়। রহস্যময় উপায়ে বোঝা যায়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মিসির আলির মনে হল, তিন্নির ব্যাপার তিনি খানিকটা বুঝতে পারছেন। আবছাভাবে বুঝছেন।
কি ভাবেন মিয়াসাব?
না, কিছু না। উঠি।
মিসির আলি চায়ের দাম মিটিয়ে রওনা হবেন, ঠিক তখন মাথা ঝিম করে উঠল। তিমির পরিষ্কার ক্লিনরিনে গলা, আপনি ভালো আছেন? মিসির আলি আবার বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। বুড়ো বলল, কি হইছে?
শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। আমি খানিকক্ষণ বসি?
বসেন, বসেন।
মিসির আলি মনে-মনে তিমির সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
গত রাতে তুমি আস নি কেন?
ইচ্ছা করছিল না।
না এসেও তো কথা বলতে পারতে। তাও বলা নি।
ইচ্ছা করছিল না।
এখন ইচ্ছা করছে?
হ্যাঁ করছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
বল, কথা বল! আমি শুনছি।
আমি এখন এখানকার গাছের কথা বুঝতে পারি।
বাহ্, চমৎকার তো!
তাই রোজ সন্ধ্যাবেলায় বাগানে যাই। ওদের কথা শুনি!
দিনের বেলা শুনতে পাও না?
না, দিনের বেলায় ওরা কোনো কথা বলে না, চুপ করে থাকে। ওরা কথা বলে শুধুসন্ধ্যার দিকে। রাতে আবার চুপ করে যায়। ওরা তো আর মানুষের মতো না, যে, সারা দিন বকবক করবে।
তা তো ঠিকই। ওরা কী কথা বলে তোমার সঙ্গে?
আমার সঙ্গে তো কোনো কথা বলে না। ওরা কথা বলে নিজেদের মধ্যে, আমি শুনি।
কী নিয়ে কথা বলে?
অদ্ভুত জিনিস নিয়ে কথা বলে। বেশির ভাগই আমি বুঝতে পারি না।
তবু বল! আমার শুনতে ইচ্ছা করছে।
জীবন কী, জীবনের মানে কী– এইসব নিয়ে তারা কথা বলে। নিজেদের মধ্যে কথা বলে!
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আর কথা বলে মানুষদের নিয়ে। পশুপাখিদের নিয়ে। এরা পৃথিবীর মানুষদের কথা জানে। এরা কী বলে, কী করে– এইসব জানে। মানুষদের নিয়ে ভাবে।
বাহু, চমৎকার তো।
একটা গাছ যখন মারা যায়, তখন সারা জীবনে যা জানল–তা অন্য গাছদের জানিয়ে যায়। মানুষদের যখন কষ্ট হয়, তখন তাদের কষ্ট হয়। মানুষদের যখন আনন্দ হয়, তখন তাদেরও আনন্দ হয়।
মানুষ যখন একটা গাছকে কেটে ফেলে বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে, তখন তারা মানুষদের উপর রাগ করে না?
না। তারা রাগ করতে পারে না। তারা তো মানুষের মতো নয়। তারা শুধু ভালবাসে। জানেন, তাদের মনে খুব কষ্ট।
কোন বল তো?
কারণ, খুব শিগগিরই পৃথিবীতে কোনো মানুষ থাকবে না। কোনো জীব থাকবে না। পৃথিবী আস্তে-আস্তে গাছে ভরে যাবে। এই জন্যেই তাদের দুঃখ।
মানুষ থাকবে না কেন?
এরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাবে। অ্যাটম বোমা ফাটাবে। পৃথিবী ছাড়াও তো আরো অনেক গ্রহ আছে যেখানে এক সময় মানুষ ছিল, এখন নেই। এখন শুধু গাছ।
গাছদের জন্যে এটা তো ভালোই, তাই নয় কি তিনি? শুধু ওরা থাকবে, আর কেউ থাকবে না।
তিন্নি দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, না, ভালো না। ওরা সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চায়। সারা জীবনে ওরা যত জ্ঞান লাভ করেছে, এগুলি মানুষকে বলতে চায়। কিন্তু বলার আগেই মানুষ শেষ হয়ে যায়। ওরা বলতে পারে না। এই জন্যে ওদের খুব কষ্ট।
মানুষকে ওরা ওদের কথা বলতে পারছে না কেন?
বলতে পারছে না, কারণ মানুষ তো এখনো খুব উন্নত হয় নি। ওদের অনেক উন্নত হতে হবে। কিন্তু তা হবার আগেই তো ওরা শেষ হয়ে যায়।
এইসব কথা কি তোমার আশেপাশের গাছদের কাছ থেকে জানলে?
না। অন্য গাছ আমাকে বলেছে। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন ওরা বলে।
তুমি যে-সব গাছের ছবি আঁক, সেইসব গাছ?
তিন্নি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। বুড়ে চাওয়ালা বলল, শইলডা কি অখন ঠিক হইছে?
হ্যাঁ, ঠিক আছে। যাই বুড়োমিয়া।
কাইল আবার আইসেন। না, কাল আসতে পারব না। কাল আমি ঢাকা চলে যাব। আবার যখন আসব, তখন কথা হবে।
বরকত সাহেবের সঙ্গে দেখা হল চায়ের টেবিলে। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গভীর। ভালোমতো চোখ তুলে তাকাচ্ছেন না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে মিসির আলির উপর বেশ বিরক্ত। মিসির আলি এই বিরক্তির কারণ ঠিক ধরতে পারলেন না। মিসির আলি বললেন, আপনার শরীর কেমন?