অমিতা বলল, মামা, তুমি মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করবার জন্যে ছোটাছুটি কর, অথচ তোমার আশেপাশে যারা আছে, তাদের কথা কিছুই ভাব না।
ভাবি না কে বলল?
না, ভাব না। ভাবলে এই ছ বছরে একবার হলেও আসতে আমার কাছে। মিসির আলি দেখলেন, অমিতার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েগুলি এত নরম স্বভাবের হয় কেন, এই নিয়ে অন্যমনস্কভাবে তিনি খানিকক্ষণ ভাবলেন। একটি মেয়ের ডিএনএ এবং একটি পুরুষের ডিএনএ-র মধ্যে তফাৎ কী, তাঁর জানতে ইচ্ছে হল। পড়াশোনা করতে হবে, প্রচুর পড়াশোনা। জীবন এত ছোট, অথচ কত কি আছে জানার।
তিন্নি সারা দিন ছাদে বসে আছে
তিন্নি আজ সারা দিন ছাদে বসে আছে। সে ছাদে গিয়েছে সূর্য ওঠার আগে। এখন প্রায় সন্ধ্যা, কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ড়ুবে যাবে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একবারও সে নিজের জায়গা থেকে নড়ে নি। তার ছোট্ট শরীরটি পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে। মাঝেমাঝে বাতাসে তার চুল উড়ছে। এ থেকেই মনে হয়–এটি পাথরের মূর্তি নয়, জীবন্ত একজন মানুষ। সকালে কাজের মেয়ে নাশতা নিয়ে ছাদে এসে ক্ষীণ গলায় বলেছিল, আপা, নাশতা আনছি।
তিন্নি কোনো জবাব দেয় নি। কাজের মেয়েটি আধা ঘন্টার মতো অপেক্ষা করল। এর মধ্যে কয়েক বার নাশতা খাবার কথা বলল। তিন্নির কোনো ভাবান্তর হল না।
দুপুরবেলা বরকত সাহেব নিজেই এলেন। শান্ত গলায় বললেন, খেতে এস মা।
তিনি নিশ্চুপ! বরকত সাহেব তার হাত ধরলেন। হাত গরম হয়ে আছে। বেশ গরম যেন মেয়েটির এক শ তিন বা চার জ্বর উঠেছে। তিনি গাঢ় স্বরে বললেন, তোমার কি শরীরটা খারাপ মা?
তিন্নি না-সূচক মাথা নাড়ল।
এস, ভাত দেওয়া হয়েছে। দু জনে মিলে খাই!
সে আবার না-সূচক মাথা নাড়ল। বরকত সাহেব মেয়েকে নিজের দিকে টানতেই হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলেন। যেন হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিসিটি চলে গেল কপালের মাঝখান দিয়ে। তিনি মেয়ের হাত ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি তখন খুব সহজ গলায় বলল, বাবা, তুমি চলে যাও।
চলে যাব?
হুঁ।
তুমি আসবে না?
না।
কিছু খাবে না?
খিদে নেই।
এক গ্লাস দুধ খাও। দুধ পাঠিয়ে দিই?
না।
বরকত সাহেব নিচে গেলেন। এ কী গভীর পরীক্ষায় তিনি পড়লেন। মেয়ের এই বিচিত্র অসুখের সত্যি কি কোনো সমাধান আছে? তাঁর মনে হতে লাগল, সমাধান নেই। এই অসুখ বাড়তেই থাকবে, কমবে না। মিসির আলি নামের মানুষটির কিছুই করার ক্ষমতা নেই। মেয়েটিকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলে কেমন হয়? ইউরোপআমেরিকার বড়-বড় ডাক্তাররা আছেন। তাঁরা দিনকে রাত করতে পারেন—এই সামান্য কাজটা পারবেন না? খুব পারবেন। তিনি নিজে দুপুরে কিছু খেতে পারলেন না। মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হতে লাগল। বিকেলের দিকে সেই যন্ত্রণা খুব বাড়ল। তিনি কয়েক বার বমি করলেন। অসম্ভব রাগে তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। কার উপর রাগ? সম্ভবত নিজের ভাগ্যের উপর। এত খারাপ ভাগ্যও মানুষের হয়?
তিন্নি সন্ধ্যা মেলাবার পর নিজের ঘরে ঢুকল। আজ অনেক দিন পর তার আবার ছবি আঁকতে ইচ্ছা হচ্ছে। রঙ—তুলি সাজিয়ে সে উবু হয়ে মেঝেতে বসল। তার সামনে বড় একটি কাগজ বিছানো। সে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে, অতি দ্রুত তুলি বোলাতে শুরু করল। প্রথমে মনে হচ্ছিল, কিছু লাইন এলোমেলোভাবে টানা হচ্ছে। এখন আর তা মনে হচ্ছে না। এখন কাগজে লতানো গাছের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আকাশে দুটি সূৰ্য। তার আলো তেরছাভাবে গাছগুলির উপর পড়েছে।
তিনি মৃদুস্বরে বলল, তোমরা কেমন আছ?
ছবির গাছগুলি যেন উত্তরে কিছু বলল। তিন্নি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট।
গাছগুলি যেন তার উত্তরেও কিছু বলল। খুব কঠিন কোনো কথা। কারণ তিন্নিকে দেখা গেল দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠেছে। সেই কান্না দীর্ঘস্থায়ী হল না। সে ছবিটি কুচিকুচি করে দিয়ে শান্ত হয়ে নিচে নেমে গেল। কারণ সে বুঝতে পারছে, তার বাবা ঠিক এই মুহূর্তে তাকে নিয়ে ভাবছেন। সেই ভাবনাগুলি ভালো নয়। তার বাবা সমস্যার কাছ থেকে মুক্তি চান। কিন্তু যে-পথ তিনি বেছে নিতে চাচ্ছেন তাতে কোনো লাভ হবে না।
বাবা।
বরকত সাহেব চমকে ফিরলেন। তাঁর ঘর অন্ধকার। তিনি ইজিচেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনি তাঁর সামনের খাটে পা ঝুলিয়ে বসল। বরকত সাহেব অস্বস্তির সঙ্গে তাঁর মেয়ের দিকে তাকাতে লাগলেন।
কিছু বলবে?
বলব।।
বল শুনি চেয়ারে বাস। বসে বল।
তিনি খুব নরম গলায় বলল, তুমি আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাও?
হুঁ। বড় ডাক্তার দেখাব। পৃথিবীর সেরা ডাক্তার।
ডাক্তার কিছু করতে পারবে না।
কী করে বুঝলে?
আমি জানি। আমার কোনো অসুখ করেনি। আমি তোমাদের মতো না, আমি অন্য রকম।
সেটা আমি জানি।
না, তুমি জানি না। সবটা জান না।
ঠিক আছে, না জানলে জানি না। এত কিছু জানার আমার দরকার নেই। আমার টাকার অভাব নেই! তোমাকে আমি বড়-বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ইউরোপ আমেরিকা।
আমি এইখানেই থাকব। আমি কোথাও যাব না।
বরকত সাহেব কড়া চোখে তাকালেন। তাঁর নিঃশ্বাস ভরি হয়ে এল। কপালে ঘাম জমতে লাগল। তিন্নি বলল, তোমরা কিছুতেই আমাকে এখান থেকে নিতে পারবে না। তোমাদের সেই শক্তি নেই।
বরকত সাহেব কিছু বললেন না। তিন্নি শান্ত সুরে বলল, এই বাড়িটাতে আমি একা থাকতে চাই বাবা।