কিরে, আজ তুই এমন মুখ কালো করে রেখেছিস কেন? রাগ করেছিস? তুই এমন কথায়-কথায় রাগ করস কেন? কেউ বকেছে? কী হয়েছে বল তো ভাই শুনি।
অমিতা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। যেন সে সত্যি-সত্যি শুনতে পাচ্ছে গাছের কথা! মাঝে-মাঝে মাথা নাড়ছে। এক সময় সে উঠে দাঁড়াল এবং বিকট চিৎকার করে বলল, কে কদমগাছকে ব্যথা দিয়েছে? কে পাতাসুদ্ধ তার ডাল ছিঁড়েছে? কান্নাকাটি আর চিৎকার। জানা গেল অ্যাগের রাতে সত্যি-সত্যি কদমগাছের একটি ডাল ভাঙা হয়েছে। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। কিছুদিন পর গাছটি আপনা-আপনি মরে যায়। অমিতা নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে বড় অসুখে পড়ে যায়। জীবন—মরণ অসুখ! মাসখানিক ভুগে সেরে ওঠে। গাছপ্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়।
মিসির আলি ঠিক করলেন, অমিতার সঙ্গে দেখা করবেন। ছোটবেলার কথা জিজ্ঞেস করবেন। যদিও এটা খুবই সম্ভব যে, অমিতার শৈশবের কথা কিছু মনে নেই। সে এখন থাকে কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ায়। তার স্বামী পুলিশের ডিএসপি। সে নিজে কোনো এক মেয়ে-স্কুলে পড়ায়। মিসির আলি ঠিক করলেন, অমিতার সঙ্গে দেখা করেই চলে যাবেন ময়মনসিংহ। তিন্নির সঙ্গে কথা বলবেন। দু-একটা ছোটখাটো পরীক্ষাটরীক্ষা করবেন! তিন্নির মার আত্মীয়স্বজনের খোঁজ বের করতে চেষ্টা করবেন। তিন্নিকে দিয়ে আরো কিছু ছবি আঁকিয়ে পাঠাবেন ডঃ লংম্যানের কাছে। অনেক কাজ সামনে। মিসির আলি দুমাসের অর্জিত ছুটির জন্যে দরখাস্ত করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চাকরির পদটি হচ্ছে অস্থায়ী। পার্ট টাইম শিক্ষকতার পদ।। দু মাসের ছুটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেবে না। হয়তো চাকরি চলে যাবে। কিন্তু উপায় কী? এই রহস্য তাঁকে ভেদ করতেই হবে। ছোট্ট একটি মেয়ে কষ্ট পাবে, তা হতেই পারে না।
অমিতা
অমিতা অবাক হয়ে বলল, আরে মামা, তুমি।
মিসির আলি বললেন, চিনতে পারছিস রে বেটি?
কী আশ্চর্য মামা, তোমাকে চিনিব না! তোমাকে নিয়ে কত গল্প করি মানুষের সাথে।
তিনি হাসলেন। অমিতা বলল, বিনা কারণে তুমি আমার কাছে আস নি। ভূমি সেই মানুষই না! কি জন্যে এসেছ বল।
এখনি বলব?
না, এখন না। আমি স্কুলে যাচ্ছি। আজ আর ক্লাস নেব না, ছুটি নিয়ে চলে আসব। তুমি ততক্ষণে গোসলটোসল করে বিশ্রাম নাও। আমার ঘর-সংসার দেখ! ঘন-ঘন চা খাওয়ার অভ্যাস এখনো আছে?
হুঁ, আছে।
কাজের ছেলেটাকে বলে যাচ্ছি, সে প্রতি পনের মিনিট পরপর চা দেবে।
তোর ছেলেপুলে কই?
অমিতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার ছেলেপুলে নেই মামা, হবেও না কোনো দিন। তুমি তো খোঁজখবর রাখ না, কাজেই কিছু জান না। যদি জানতে, তাহলে আর ……
সে কথা শেষ করল না। মিসির আলি লক্ষ করলেন, মেয়েটির গলা ভারি হয়ে এসেছে। কত রকম দুঃখ-কষ্ট মানুষের থাকে। তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল।
তোর বর কোথায়?
ও টুরে গেছে—চৌদ্দগ্রামে। সন্ধ্যাবেলায় ফিরবে। তুমি কি থাকবে সন্ধ্যা পর্যন্ত?
না, আমার একটা জরুরি কাজ আছে।
তা তো থাকবেই। তোমাকে যে আমি কত ভালবাসি মামা, অথচ তুমি–
অমিতার গলা আবার ভারি হয়ে গেল। এই মেয়েটার মনটা অসম্ভব নরম।
মিসির আলি গোসল সেরে ঘুরে-ঘুরে অমিতার ঘর-সংসার দেখলেন। বিরাট দোতলা বাড়ি। প্রতিটি ঘর চমৎকার করে সাজানো। লাইব্রেরি-ঘরটি দেখে তাঁর মন ভরে গেল। বই বই আর বই। তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।
কাজের ছেলেটির নাম চেরাগ মিয়া। সে সত্যি-সত্যি পনের মিনিট পরপর চা নিয়ে আসে। দু। কাপ চা খেয়ে মিসির আলি ধমক দিলেন আর লাগবে না। দরকার হলে আমি চাইব। লাভ হল না। পনের মিনিট পর আবার সে এক কাপ চা নিয়ে এল।
দুপুরে খেতে বসে অমিতার সঙ্গে তিনি গাছের সঙ্গে কথা বলার প্রসঙ্গটা তুললেন। অমিতা অবাক হয়ে বলল, এইটি জানবার জন্যে তুমি এসেছ আমার কাছে?
হুঁ।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি মামা? পাগলরাই শুধু এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ছোটাছুটি করে।
পাগল হই আর যা-ই হই, যা জানতে চাচ্ছি সেটা বল! তুই যে ছোটবেলায় গাছের সঙ্গে কথা বলতি, সেটা মনে আছে?
হ্যাঁ, আছে।
আচ্ছা, গাছ কি তোর সঙ্গে কথা বলত?
অমিতা হাসিমুখে বলল, গাছ আমার সঙ্গে কথা বলবে কি? গাছ আবার কথা কলা শিখল কবে?
তার মানে, গাছের কোনো কথা তুই শুনতে পেতি না?
কীভাবে শুনব মামা? তুমি শুনতে পাও? এইসব ছোটবেলার খেয়াল। এটা নিয়ে তুমি মাথা ঘামোচ্ছ কেন?
এমনি।
উঁহু। এমনি—এমনি মাথা ঘামাবার মানুষ তুমি না। নিশ্চয়ই কিছু-একটা আছে, যা তুমি আমাকে বলতে চাচ্ছি না। ও কি মামা, তোমার কি খাওয়া হয়ে গেল?
হ্যাঁ।
অসম্ভব। এগার পদ রান্না করেছি। তুমি খেয়েছ মাত্র পাঁচ পদ। এখনো ছটা পদ বাকি আছে।
মরে যাঘ অমিতা।
মরে যাও আর যাই কর– খেতে হবে। জোর করে আমি মুখে তুলে খাইয়ে দেব। আমাকে তুমি চেন না মামা।
মিসির আলি হাসলেন। অমিতা গম্ভীর মুখে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে সত্যি-সত্যি জোর করে মুখে তুলে দেবে। মিসির আলি মৃদু স্বরে বললেন, গাছ তাহলে তোর সঙ্গে কোনো কথা বলত না?
অমিতা বিরক্ত স্বরে বলল, না। গাছ আমার সঙ্গে কেন কথা বলবে বল তো? আমি কি গাছ? ভালো করে তাকিয়ে দেখ তো আমার দিকে, আমাকে কি গাছ বলে মনে হয়?
মিসির আলি কিছু বললেন না। তাকিয়ে রইলেন মেয়েটির দিকে। তাঁর এই ভাগনিটি তার সুন্দর। দেবীর মতো মুখ ঘন কালো তরল চোখ। মুখের ভাবটি বড় স্নিগ্ধ।