বলুন।
ডঃ জাবেদ সিগারেট ধরিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে গাছের মিল অনেক বেশি।
বলেন কী।
হ্যাঁ, তাই। আসল জিনিস হচ্ছে জীন, যা ঠিক করে কোন প্রোটিন তৈরি করা দরকার। অনেকগুলি জীন নিয়ে হয় একটি ডিএনএ মলিকুল। ডিওক্সি রিবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড। প্রাণের আদি ব্যাপার হচ্ছে এই জটিল অণু। এই অণু থাকে জীবকোষে। তারা ঠিক করে একটি প্রাণী মানুষ হবে, না। গাছ হবে, না সাপ হবে। মাইটোকনিড়িয়া বলে একটি জিনিস মানুষেরও আছে, আবার গাছেরও আছে। মানুষের যা নেই, তা হচ্ছে ক্লোরোপ্লাসট।
আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারার কথাও নয়। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। আপনি চাইলে, আমি আপনাকে কিছু সহজ বইপত্র দিতে পারি।
আমি চাই। আপনি আমাকে আরো কিছু বলুন।
ডিএনএ প্রসঙ্গেই বলি। এই অণুগুলি হচ্ছে প্যাচাল সিঁড়ির মতো। মানুষের ডিএনএ এবং গাছের ডিএনএ প্রায় একই রকম। সিঁড়ির দু-একটা ধাপ শুধু আলাদা। একটু অন্য রকম।
মিসির আলি গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন। এক জন ভালো শিক্ষক খুব সহজেই একজন মনোযোগী শ্রোতাকে চিনতে পারেন!
ডঃ জাবেদ এই মনোযোগী শ্রোতাকে পছন্দ করে ফেললেন।
শুধু এই দু-একটি ধাপ অন্য রকম হওয়ায় প্রাণিজগতে মানুষ এবং গাছ আলাদা হয়ে গেছে। প্রোটিন তৈরির পদ্ধতি হয়েছে ভিন্ন। আপনি আগে বরং কয়েকটা বইপত্র পড়ুন। তারপর আবার আপনার সঙ্গে কথা বলব।
ডঃ জাবেদতিনটি বই দিলেন। দুটি ঠিকানা লিখেদিলেন। একটি লন্ডনের রয়েল বোটানিক্যাল সোসাইটির, অন্যটি ডঃ লংম্যানের। ডঃ লংম্যান আমেরিকান এগ্রিকালচারাল রিসার্চের ডেপুটি ডাইরেক্টর।
মিসির আলি সাহেব তাঁর সঙ্গের ছবিগুলি দু ভাগ করে দু জায়গায় পাঠালেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, দশদিনের মাথায় ডঃ লংম্যান-এর চিঠির জবাব চলে এল।
টমাস লংম্যান
Ph.D. D. Sc.
US Department of Agricultural Science
ND 505837 USA
প্রিয় এম. আলি,
আপনার পাঠানো ছবি এবং চিঠি পেয়েছি। যে সমস্ত লতানো গাছের ছবি আপনি পাঠিয়েছেন, তা খুব সম্ভব কল্পনা থেকে আঁকা। আমাদের জানা মতে ও রকম গাছের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে পেরুর গহীন অরণ্যে এবং আমেরিকার ক্লেইন ফরেস্টে কিছু লতানো গাছ আছে, যার সঙ্গে আপনার পাঠানো গাছের সামান্য মিল আছে। আমি আপনাকে কিছু ফটোগ্রাফ পাঠালাম, আপনি নিজেই মিলিয়ে দেখতে পারেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, রেইন ফরেস্ট এবং পেরুর গাছগুলির রঙ সবুজ, কিন্তু আপনার পাঠানো ছবির গাছের বর্ণ হলুদ এবং লালের মিশ্রণ। এর বেশি আপনাকে আর কোনো তথ্য দিতে পারছি না।
আপনার বিশ্বস্ত
টি. লংম্যান।
পুনশ্চ : আপনি যদি আপনার ছবির মতো গাছের কিছু নমুনা পাঠান, তাহলে আমরা তা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পরীক্ষা করব।
রয়েল বোটানিক্যাল সোসাইটি চিঠির জবাব দিতে কুড়ি দিনের মতো দেরি করল। তাদের জবাবটি ছিল এক লাইনের।
প্রিয় ডঃ এম. আলি,
আপনার পাঠানো ছবির মতো দেখতে কোনো গাছের কথা আমাদের জানা নেই।
আপনার বিশ্বস্ত,
এ. সুরনসেন।
মিসির আলি সাহেব এই কদিনে জীবনের উৎপত্তি এবং বিকাশের উপর গোটা চারেক বই পড়ে ফেললেন। ডিএনএ এবং আরএনএ মলিকুল সম্পর্কে পড়তে গিয়ে লক্ষ করলেন, প্রচুর কেমিস্ট জানা ছাড়া কিছু স্পষ্ট হচ্ছে না। বারবার এ্যামিনো অ্যাসিডের কথা আসছে। এ্যামিনো অ্যাসিড় কী জিনিস তা তিনি জানেন না। অথচ বুঝতে পারছেন, প্ৰাণের রহস্যের সঙ্গে এ্যামিনো অ্যাসিডের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। মিসির আলি নাইন টেনের পাঠ্য কেমিস্ট বই কিনে এনে পড়া শুরু করলেন। কোমর বেঁধে পড়াশোনা যাকে বলে! এই ফাঁকে চিঠি লিখলেন তিন্নির বাবাকে। তিন্নির বাবা তার জবাব দিলেন না। তবে তিনি একটি চিঠি লিখলা। কোনো রকম সম্বোধন চিঠিতে নেই। হাতের লেখা অপরিচ্ছন্ন। প্রচুর ভুল বানান। কিন্তু ভাষা এবং বক্তব্য বেশ পরিষ্কার। খুবই গুছিয়ে লেখা চিঠি, বাচ্চা একটি মেয়ের জন্যে যা বেশ আশ্চর্যজনক। চিঠির অংশবিশেষ এ-রকম–
আপনি আব্বাকে একটি লম্বা চিঠি লিখেছেন। আব্বা সেই চিঠি না-পড়েই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। আব্বা এখন আর আপনাকে পছন্দ করছেন না। তিনি চান না, আপনি আমার ব্যাপারে আর কোনো চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু আমি জানি, আপনি করছেন। যদিও আপনি অনেক দূরে থাকেন, তবু আমি বুঝতে পারি। আপনি যে আমাকে পছন্দ করেন, তাও বুঝতে পারি। কেউ আমাকে পছন্দ করে না, কিন্তু আপনি করেন। কেন করেন? আমি তো ভালো মেয়ে না। আমি সবাইকে কষ্ট দিই। সবার মাথায় যন্ত্রণা দিই। কাউকে আমার ভালো লাগে না। আমার শুধু গাছ ভালো লাগে। আমার ইচ্ছা করে, একটা খুব গভীর জঙ্গলের মাঝখানে গিয়ে বসে থাকি। গাছের সঙ্গে কথা বলি। গাছেরা কত ভালো। এরা কখনো এক জন অন্য জনের সঙ্গে ঝগড়া করে না, মারামারি করে। না। নিজের জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, এবং ভাবে। কত বিচিত্র জিনিস নিয়ে তারা ভাবে। এবং মাঝে-মাঝে এক জনের সঙ্গে অন্য জন কথা বলে। কী সুন্দর সেই সব কথা! এখন আমি মাঝে-মাঝে ওদের কথা শুনতে পাই।
চিঠি এই পর্যন্তই। মিসির আলি এই চিঠিটি কম হলেও দশ বার পড়লেন। চিঠির কিছু অংশ লাল কালি দিয়ে দাগ দিলেন। যেমন একটি লাইন–এখন আমি মাঝেমাঝে ওদের কথা শুনতে পাই। স্পষ্টতই মেয়েটি গাছের কথা বলছে। পুরো ব্যাপারটাই সম্ভবত শিশুর কল্পনা। শিশুদের কল্পনার মতো বিশুদ্ধ জিনিস আর কিছুই নেই। মিসির আলির নিজের এক ভাগনী অমিতা গাছের সাথে কথা বলত। ওদের বাড়ির সামনে ছিল একটা খাটো কদমগাছ। অমিতাকে দেখা যেত গাছের সামনে উবু হয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করছে। মিসির আলি এক দিন আড়ালে বসে কথাবার্তা শুনলেন।