তিন্নি, আমি চলে যাচ্ছি।
মেয়েটি বলল, আমি জানি।
আমি তোমার ছবিগুলি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি।
তাও জানি।
কিছুদিনের মধ্যে আমি আবার আসব। তখন দেখবে, সব ঝামেলা মিটে গেছে!
তিন্নি কিছু বলল না। মিসির আলি বললেন, গাছপালা তুমি খুব ভালবাস, তাই না?
মাঝে মাঝে বাসি, মাঝে-মাঝে বাসি না।
তুমি কি ওদের সঙ্গে কথা বলতে পার?
এখানে যে-সব গাছপালা আছে, তাদের সঙ্গে পারি না।
তাহলে কাদের সঙ্গে পার?
মেয়েটি জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। মিসির আলি বললেন, তুমি আমার অনেক প্রশ্নের জবাব দাও না কেন দাও না বল তো? কোনো বাধা আছে কি?
তিনি সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফিসফিস করে বলল, আপনি আমাকে ভালো করে দিন। অসুখ সারিয়ে দিন।
মিসির আলির খুবই মন-খারাপ হয়ে গেল। বাচ্চা একটি মেয়ে বাস করছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগতে-যে-জগতের সঙ্গে আশেপাশের চেনা জগতের কোনো মিল নেই। মেয়েটি কষ্ট পাচ্ছে। তার কষ্টের ব্যাপারটি কাউকে বলতে পারছে না। সে নিজেও হয়তো জানে না পুরোপুরি।
তিনি, আমি যাই?
মেয়েটি কিছু বলল না। মিসির আলি লক্ষ করলেন, তিনি নিঃশব্দে কাঁদছে।
ঢাকায় ফেরার টেনে উঠবার পর মিসির আলির মনে পড়ল, তিন কাপ চায়ের দাম তিনি দিয়ে আসেন নি। রশিদ নামের বুড়ো মানুষটি আগামীকাল তোরবেলায় যখন দেখবে, কেউ আসছে না, তখন না-জানি কি ভাববে। মিসির আলির মন গ্লানিতে ভরে গেল। কিন্তু কিছুই করার নেই। ঢাকা মেইল ছুটে চলেছে। পেছনে পড়ে আছে নদীর ধারে গড়ে-ওঠা চমৎকার একটি শহর।
ডঃ জাবেদ আহসান
ডঃ জাবেদ আহসান অবাক হয়ে বললেন, আপনি আমার কাছে ঠিক কী জানতে চান, বুঝতে পারছি না। কয়েকটি গাছপালার হাতে-আঁকা ছবি দিয়ে গিয়েছেন, আর তো কিছুই বলেন নি।‘
ছবিগুলো ভালো করে দেখেছেন?
ভালো করে দেখার কী আছে?
মিসির আলি লক্ষ করলেন ডঃ জাবেদ বেশ বিরক্ত। ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা তেমন কোনো কাজকর্ম করেন না, কিন্তু সব সময় ব্যস্ততার একটা ভঙ্গি করেন। ডঃ জাবেদ এই মুহূর্তে মুখের এমন ভাব করছেন, যেন তাঁর মহা মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, এই গাছগুলি সম্পর্কে কিছু বলুন। ছবিতে আঁকা গাছগুলির কথা বলছি।
কী বলব, সেটাই বুঝতে পারছি না! আপনি কী জানতে চাচ্ছেন?
এই জাতীয় গাছ দেখেছেন কখনো?
না।
বইপত্রে এ রকম গাছের কোনো রেফারেন্স পেয়েছেন?
দেখুন, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ ধরনের গাছ আছে। সব কিছু আমার জানার কথা নয়। আমার পিএইচ.ডি.র বিষয় ছিল প্লান্ট ব্রিডিং। সে-সম্পর্কে আপনাকে আমি কিছু বলতে পারি। আপনি একটি বাচ্চা মেয়ের আঁকা কতগুলি ছবি নিয়ে এসেছেন। সেই ছবিগুলি দেখে আমাকে গাছ সম্পর্কে বলতে বলছেন। এ-ধরনের ধাঁধার পেছনে সময় নষ্ট করার আমি কোনো অর্থ দেখছি না।
মিসির আলি বললেন, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন?
বিরক্ত হচ্ছি, কারণ আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন।
মিসির আলি বললেন, আপনি তো বসে-বসে টিভি দেখছিলেন। তেমন কিছুতো করছিলেন না। সময় নষ্ট করার কথা উঠছে না।
মিসির আলি ভাবলেন, এই কথায় ভদ্রলোক ভীষণ রেগে যাবেন। গেট আউট জাতীয় কথাবার্তাও বলে বসতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তেমন কিছু হল না। ডঃ জাবেদকে মনে হল, তিনি খানিকটা অপ্ৰস্তুত হয়েছেন। অপ্ৰস্তৃত মানুষেরা যেমন খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাশতে থাকে, ভদ্রলোক সে-রকম কাশছেন। কাশি থামাবার পর বেশ মোলায়েম স্বরে বললেন, একটু চা দিতে বলি?
জ্বি-না। চা খাব না।
একটু খান, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা পড়েছে। চা ভালোই লাগবে। বলুন, চায়ের কথা বলে আসি।
চা এল। শুধু চা নয়, চায়ের সঙ্গে নানান রকমের খাবারদাবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাড়ির এই একটি বিশেষত্ব আছে। এরা অতিথিকে চায়ের সঙ্গে নানান রকম খাবার দাবার দেয়, যা দেখে কেউ ধারণাও করতে পারে না যে, এই সম্প্রদায় আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু।
মিসির আলি সাহেব, চা নিন।
তিনি চা নিলেন।
বলুন, স্পেসিফিক্যালি আপনি কী জানতে চান।
পৃথিবীতে ঠিক এ-জাতীয় গাছ আছে কি না তা কে বলতে পারবে? অর্থাৎ আমি জানতে চাচ্ছি, গাছপালার ক্যাটালগজাতীয় কিছু কি আছে, যেখানে সব-জাতীয় গাছপালার ছবি আছে? তাদের সম্পর্কে তথ্য লেখা আছে?
হ্যাঁ, নিশ্চয় আছে। এ-দেশে নেই! বোটানিক্যাল সোসাইটিগুলিতে আছে। ওদের একটি কাজই হচ্ছে গাছপালার বিভিন্ন স্পেসিসকে সিসটেমেটিকভাবে ক্যাটালগিং করা!
আপনি কি আমাকে কিছু লোকজনের ঠিকানা দিতে পারবেন, যাঁরা আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন?
হ্যাঁ, পারি। আপনি যাবার সময় আমি ঠিকানা লিখে দেব। আর কী জানতে চান?
মানুষ এবং গাছের মধ্যে পার্থক্য কী?
প্রশ্নটা আরো গুছিয়ে করুন।
মিসির আলি থেমে-থেমে বললেন, আমরা তো জানি গাছের জীবন আছে। কিন্তু আমি যা জানতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে, গাছের জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবনের মিলটা কোথায়?
চট করে উত্তর দেওয়া যাবে না। এর উত্তর দেবার আগে আমাদের জানতে হবে। জীবন মানে কি? এখনো আমরা পুরোপুরি ভাবে জীবন কী তা-ই জানি না।
বলেন কী। জীবন কী জানেন না।
হ্যাঁ, তাই। বিজ্ঞান অনেক দূর আমাদেরকে নিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো অনেক কিছু আমরা জানি না। অনেক আনসলভ্ড্ মিস্ট্রি রয়ে গেছে। আপনাকে আরেক কা চা দিতে বলি?