ছবি দেখে মনে হয়, ঝড়ের সময়টায় এই ছবির শিল্পী উপস্থিত ছিল। হাওয়ার যে ঘূর্ণি উঠেছে, তাও সে লক্ষ করেছে। মিসির আলি সাহেব মনে মনে একটি থিওরি দাঁড় করাতে চেষ্টা করলেন। তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন, ছবিগুলি কোনো শিশুর মনগড়া ছবি নয়, কল্পনার ছবি নয়। এই গাছ, এই ঝড়, বাতাসের এই ঘূর্ণি ছবির শিল্পী দেখেছে।
যদি তাই হয়, তাহলে এ গাছগুলি কি? পৃথিবীর গাছে সবুজ রঙ থাকবে। ছায়াতে জন্মানে কিছু কিছু হলুদ গাছ তিনি দেখেছেন, কিন্তু এ রকম কড়া সূর্যের আলোয় হলুদ গাছ তিনি দেখেছেন বলে মনে করতে পারলেন না।
প্রতিটি ছবিতে দুটি সূর্য। গনুগনে সূর্য। এর মানে কী? পৃথিবীর কোনো ছবিতে দুটি সূর্য থাকবে না। তাহলে কি এই থিওরি দাঁড় করানো যায় যে, ছবিতে যে-দৃশ্য দেখা যাচ্ছে তা অন্য কোনো গ্রহের? তা কেমন করে হয়?
তিন্নি অন্য কোনো গ্রহের মেয়ে, এই যুক্তি হাস্যকর। তিন্নি পৃথিবীরই মেয়ে, এতে কোনো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। এই গ্রহের মেয়ে হয়ে বাইরের একটি গ্রহের ছবি সে কেন আঁকছে? কীভাবে আঁকছে?
মিসির আলি গম্ভীর মুখে দ্বিতীয় সিগারেটটি ধরলেন। সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ছকে ফেলা যাচ্ছে না।
তিনি সিগারেট টানতে টানতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এবং ভাবতে চেষ্টা করলেন—এইসব অল্পবয়সী একটি মেয়ের কল্পনার ছবি, এর বেশি কিছু নয়। মেয়েটির কল্পনাশক্তি খুব উচ্চ পর্যায়ের, যার জন্যে সে এত চমৎকার কিছু ছবি আঁকতে পারছে। ভোরবেলায় তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।।
মিসির আলির ঠাণ্ডা লাগছে। হু-হু করে বইছে উত্ত্বরে হাওয়া। কিন্তু এই ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ লাগছে। চারদিক খুব চুপচাপ। আকাশে চাঁদ থাকায় চমৎকার জ্যোৎস্না হয়েছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না ভেঙে-ভেঙে পড়ছে। কী অপূর্ব একটি দৃশ্য! মিসির আলি নিজের অজান্তেই হাঁটতে-হাঁটতে একটা ঝাঁকড়া জামগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠিক তখন অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। তিনি স্পষ্ট শুনলেন, তিনি বলছে, কি, আপনার ঘুম আসছে না? তিনি আশেপাশে কাউকেই দেখলেন না। দেখার কথাও নয়। এই নিশিরাত্রিতে তিনি নিশ্চয়ই নিচে নেমে আসে নি। তিনি বললেন, কে কথা বলল?
মিসির আলি খিলখিল হাসির শব্দ শুনলেন। এর মানে কী? তিন্নির হাসি কোথেকে ভেসে আসছে? মিসির আলি বললেন, তুমি তিন্নি?
হ্যাঁ।
কোত্থেকে কথা বলছ?
আপনি এত বুদ্ধিমান, অথচ কোত্থেকে কথা বলছি, বুঝতে পারছেন না?
না, বুঝতে পারছি না। তুমি কোথায়?
আমি আমার ঘরেই আছি। কোথায় আবার থাকব?
মিসির আলি একটা বড় ধরনের চমক পেলেন। মেয়েটি তার ঘর থেকেই কথা বলছে। সেইসব কথা তিনি পরিষ্কার শুনছেন। টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ। অদ্ভুত তো!
মেয়েটিও নিশ্চয়ই তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার জন্যে নিশ্চয়ই চোঁচাতে হবে না। মনে-মনে ভাবলেই তিন্নি বুঝবে। মিসির আলি কথা বলা শুরু করলেন। এ-রকম অদ্ভুত কথোপকথন তিনি আগে কখনো করেন নি।
মিসির আলি : কেমন আছ তিন্নি?
তিন্নি : ভালো।
মিসির আলি : এখনো জেগে আছ?
তিন্নি : হ্যাঁ, আছি।
মিসির আলি : কেন?
তিন্নি : আমারও আপনার মতো ঘুম আসছে না।
মিসির আলি : রোজই জেগে থাক?
তিন্নি : মাঝে-মাঝে থাকি।
মিসির আলি : তোমার ছবিগুলি বসে-বসে দেখলাম।
তিন্নি : আমি জানি।
মিসির আলি : খুব সুন্দর হয়েছে।
তিন্নি : তাও জানি।
মিসির আলি : এগুলি কোথাকার ছবি?
তিন্নি : বলব না।
মিসির আলি : কেন, বলতে অসুবিধা কি?
তিন্নি : বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
মিসির আলি : ছবিতে দেখলাম দুটি সূর্য।
তিন্নি : হ্যাঁ, দু’টি।
মিসির আলি : দুটি কেন?
তিন্নি : দুটি থাকলে আমি কী করব? একটি আঁকব?
কথাবার্তা এই পর্যন্তই। মিসির আলি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। কিন্তু আর কোনো যোগাযোগ হল না। তিনি বেশ কয়েক বার ডাকলেন, তিন্নি তিন্নি। কোনো জবাব নেই।
মিসির আলি নিজের বিছানায় ফিরে এলেন। ঘুম চটে গিয়েছে। শুয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তিনি আবার ছবি নিয়ে বসলেন। যদি নতুন কিছু বের হয়ে আসে। যে-মাটির উপর গাছগুলি দাঁড়িয়ে আছে, তার রঙ কী? আকাশের রঙ কী? গাছপালার ফাঁকে কোনো কীটপতঙ্গ আছে কি? যদি থাকে, তাদের রঙ কী?
আপনি এখনো জেগে আছেন?
তিনি চমকে উঠলেন।
তিন্নি আবার কথা বলা শুরু করেছে। হ্যাঁ, এখনো জেগে আছি।
তোমার ছবি দেখছি।
কেন দেখছেন? এক বার দেখাও যা এক শ বার দেখাও তা।
উঁহু, তুমি ঠিক বললে না। প্রথম বার অনেক কিছু চোখে পড়ে না।
আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
ঘুম আসছে না।
আমি কিন্তু আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।
পার নাকি?
হ্যাঁ, পারি। দেব?
না, তার দরকার নেই। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে।
তাহলে কথা বলুন।
আমার সঙ্গে তুমি যেভাবে কথা বলছি, অন্যদের সঙ্গেও কি সেইভাবে কথা বল।
না।
কেন বল না।
বলতে ইচ্ছা করে না।
মিসির আলি চেষ্টা করতে লাগলেন আজেবাজে প্রশ্নের ফাঁকে-ফাঁকে দু-একটি জরুরি প্রশ্ন করে খবরাখবর বের করে আনতে। কিন্তু মেয়েটি খুব সাবধানী। সে অনায়াসে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবু এর মধ্যে একটি হচ্ছে-তিনি শুধু মানুষ নয়, পশুদের সঙ্গেও (যেমন বেড়াল) যোগাযোগ করতে পারে। মিসির আলি জিজ্ঞেস করলেন, বেড়াল তোমার কথা বুঝতে পারে?
হুঁ, পারে।
তুমি ওর কথা বুঝতে পার?
বেড়াল কোনো কথা বলে না। তবে সে যা ভাবে তা বুঝতে পারি। অবশ্যি সব সময় পারি না।