প্ৰেশার ছিল না। হঠাৎ করে হয়েছে। যে-জিনিস হঠাৎ আসে তা হঠাৎই যায়। কি বলেন?
না না, খুব সাবধান থাকবেন। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। বরকত সাহেবকে বলছিলাম হাসপাতালে ট্রান্সফার করবার জন্যে। সত্যি করে বলুন, এখন কি বেটার লাগছে?
লাগছে। আগের মতো খারাপ লাগছে না।
ডাক্তার গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, হঠাৎ করে এ রকম হাই প্ৰেশার হবার তো কথা নয়। খুব আনইউজুয়েল।
তিনি একগাদা অষুধপত্র দিলেন। যাবার সময় বারবার বললেন, রেষ্ট দরকার। কমপ্লিট রেষ্ট। কিছু খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ুন। একটা ঘুমের অষুধ দিয়েছি। খেয়ে টানা ঘুম দিন। ভোরে এসে আমি আবার প্ৰেশার মাপব।
বরকত সাহেব বললেন, আপনি তো সারা দিন কিছু খান নি।
এখন খাব। গোসল সেরে খেতে বসবা প্ৰচণ্ড খিদে পেয়েছে। আপনি কি দয়া করে। খাবারটা আমার ঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন?
নিশ্চয়ই করব। আপনার সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম।
মিসির আলি বললেন, আজ না, আমি আগামীকাল কথা বলব।
ঠিক আছে, আগামীকাল।
বরকত সাহেব ঘর থেকে বেরুতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় বললেন, আপনার কষ্ট হল খুব। আমি লজ্জিত।
আপনার লজ্জিত হবার কিছুই নেই। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না।
দীর্ঘ স্নানের পর মিসির সাহেবের বেশ ভালোই লাগল। ক্লান্তির ভাব নেই। মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা আছে, তবে তা সহনীয়। এবং মনে হচ্ছে গরম এক কাপ চা খেলে সেরে যাবে।
খাবার নিয়ে এল নিজাম। মিসির আলি লক্ষ করলেন, নিজাম তাঁকে বারবার আড়চোখে দেখছে। তার চোখে সীমাহীন কৌতূহল! সম্ভবত সে কিছু বলতে চায়, সাহস পাচ্ছে না। মিসির আলি ভারি গলায় ডাকলেন, নিজাম!
ত্ত্বি স্যার?
তুমি কেমন আছ?
জ্বি স্যার, ভালো।
তিনি তোমাকে কখনো মাথাব্যথা দেয় নি?
নিজাম চমকে উঠল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল! সহজভাবে ভাত-তরকারি এগিয়ে দিতে লাগল।
কথা বলছি না কেন নিজাম?
কী বলব স্যার?
ঐ যে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি তোমাকে মাথাব্যথা দেয় কি না। আমার ধারণা, সবাইকেই মাঝে-মাঝে দেয়। ঠিক বলছি না?
জ্বি স্যার, ঠিক বলছেন।
তোমাকেও দিয়েছে?
জ্বি স্যার।
ক’ বার দিয়েছ?
অনেক বার।
তবু তুমি এ-বাড়িতে পড়ে আছ কেন? চলে যােচ্ছ না কেন?
নিজাম জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, আমি ওর অসুখ ভালো করবার জন্যে এসেছি। কাজেই ওর সম্পর্কে সব কিছু আমার জানা দরকার। তোমরা যদি না বিল, তাহলে আমি জানব কী করে?
কী জানতে চান স্যার?
মানুষকে কষ্ট দেবার এই ব্যাপারটা ও কবে থেকে শুরু করেছে?
তিন বছর ধরে হচ্ছে।
প্রথম কীভাবে এটা শুরু হল তোমার মনে আছে?
জ্বি, আছে। রহিমা তিন্নি আপার জন্যে দুধ নিয়ে গিয়েছিল। তিন্নি আপা খাচ্ছিল না। তখন রাগের মাথায় রহিমা তিনি আপকে একটা চড় দেয়। তার পরই শুরু হয়। রহিমা চিৎকার করতে থাকে, গড়াগড়ি করতে থাকে। ভয়ংকর কষ্ট পায়।
রহিমা কি এখনো কাজ করে এ-বাড়িতে?
জ্বি।
এ-রকম কষ্ট কি সে আরো পেয়েছে?
জ্বি স্যার।
তবু সে এ বাড়িতে পড়ে আছে? চলে যায় না কেন?
নিজাম জবাব দিল না। মিসির আলি লক্ষ করলেন, এই প্রশ্নটির জবাব নিজাম এড়িয়ে যাচ্ছে। এত কষ্টের পরও কাজের মানুষগুলি এখানেই আছে। তার কী কারণ হতে পারে? হয়তো অনেক বেশি বেতন দেয়া হচ্ছে, যে-কারণে থাকছে। কিন্তু এটা বলতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
তুমি বেতন কত পাও নিজাম?
জ্বি, মাসে দেড়শ টাকা আর কাপড়চোপড়।
মিসির আলির মনে হল, এটা এমন কোনো বেশি বেতন নয়। কাজেই এরা যে এখানে পড়ে আছে, নিশ্চয়ই তার কারণ অন্য।
নিজাম।
জ্বি স্যার?
তুমি কি আমাকে চা খাওয়াতে পার?
নিয়ে আসছি। স্যার।
আর শোন, রহিমার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই! ওকে পেলে বলবে আমার কথা।
জ্বি আচ্ছা!
নিজাম চট করে চা নিয়ে এল।। লোকটি করিৎকর্মী। চা-টা হয়েছেও চমৎকার। চুমুক দিতে-দিতেই মাথার যন্ত্রণা প্রায় সেরে গেল।
চিনি লাগবে স্যার?
না, লাগবে না। খুব ভালো চা হয়েছে নিজাম। বস তুমি। টুলটায় বস, কথা বলি।
নিজাম বসল না। জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মিসির আলি বললেন, তিন্নির মধ্যে আর কি অস্বাভাবিক ব্যাপার তুমি লক্ষ করেছ?
নিজাম মাথা চুলকাতে লাগল। মিসির সাহেব বললেন, ভালো করে চিন্তা করে বল! সে এমন কিছু কি করে, যা আমরা সাধারণত করি না?
তিন্নি আপা রোদের মধ্যে বসে থাকতে ভালবাসেন।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার জ্যৈষ্ঠ মাসের রোদেও তিন্নি আপা সারা দিন ছাদে বসে থাকেন।
এ ছাড়া আর কী করে?
আর কিছু না।
মনে করতে চেষ্টা করি। হয়তো কোনো ছোট ব্যাপার। তোমার কাছে হয়তো এর কোনো মূল্যই নেই, কিন্তু আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বুঝতে পারছি আমার কথা?
জ্বি স্যার!
রাত একটার দিকে মিসির আলি তিন্নির আঁকা ছবিগুলি নিয়ে বসলেন। সব মিলিয়ে পাঁচটি ছবি। প্রতিটি ছবিই গ্লাছ বা গাছজাতীয় কিছুর। বেশির ভাগ গাছ লতানো। গাছের রঙ হলুদ থেকে লালের মধ্যে। সবুজের কিছুমাত্র ছোঁয়া নেই। তিন্নি হলুদ এবং লাল রঙ দিয়ে ছবি আঁকল কেন? সম্ভবত তার কাছে সবুজ রঙ ছিল না। অবশ্যি শিশুরা অদ্ভুত রঙ ব্যবহার করতে ভালবাসে। তাঁর এক ভাগিনী মানুষ আঁকে আকাশি নীল রঙে। মানুষের চোখে দেয় গাঢ় লাল রঙ।
অবশ্যি এই পাঁচটি ছবি শিশুর আঁকা ছবি বলে মনে হচ্ছে না। শিশুরা এত চমৎকার আঁকে না। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে ঝড় হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়। কোনো শিশু, তা সে যত প্রতিভাবান শিশুই হোক, এ-রকম নিখুঁত ঝড়ের ছবি আঁকতে পারবে না।