আমার স্বামী খুব ভাল্ভাবে পাশ করলেন। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং – এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান পেয়ে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর একটা চাকরি হল। আমরা আমাদের বাড়ি ছেড়ে কলাবাগানে দু-কামরার ছোট একটা ঘর ভাড়া নিলাম। আমি সংসারে মন দেয়ার চেষ্টা করলাম। প্রচুর কাজ এবং প্রচুর অকাজ করি। রান্নাবান্না করি। সেলাইয়ের কাজ করি। আচার বানানোর চেষ্টা করি। যে-ঘর একবার মোছা হয়েছে সেই ঘর আবার ভেজা ন্যাকড়ায় ভিজিয়ে দিই। কাজের একটা মেয়ে ছিল তাকেও ছাড়িয়ে দিলাম। কারণ একটাই, আমি যাতে ব্যস্ত থাকতে পারি।
সারাদিন ব্যস্ততায় কাটে। রাতের বেলায়ও আমার স্বামী আমাকে অনেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখেন। শারীরিক ভালবাসার উন্মাদনা এখন আমার নেই- তবু ভান করি যেন প্রবল আনন্দে সময় কাটছে। আসলে কাটে না। হঠাৎ হঠাৎ আমি আমার বাচ্চার কান্না শুনতে পাই। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় অবশ হয়ে আসে।
আমার স্বামী বিরক্ত গলায় বল্লেন,কী হল? এরকম করছ কেন?
আমি নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করি। তিনি তিক্ত গলায় বলেন, এইসব ঢং কবে বন্ধ করবে? আর তো সহ্য হয় না! মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে।
আমি কাঁদতে শুরু করি। তিনি কুৎসিত গলায় বললেন – বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদো। সামনে না। খবরদার চকের সামনে কাদবে না।
ভাড়াবাসায় বেশিদিন থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। আমি প্রায় জোর করেই নিজের বাড়িতে ফিরে গেলাম। যে-বাড়িতে আমার ছোট্ট বাবার কবর আছে সেই বাড়ি ছেড়ে আমি কী করে দূরে থাকব!
নিজের বাড়িতে ফেরার পরপর আলস্য আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোনো কাজেই মন বসে না। আমি বেশির ভাগ সময় বসে থাকি আমার বাবুর কবরের পাশে। দোতলার সিঁড়ি থেকে ক্রুদ্ধ চোখে আমাকে দেখেন আমার স্বামী। তার চোখে রাগ ছাড়াও আর যা থাকে তার নাম ঘৃণা।
অনীশ – ০৭
মাথার যন্ত্রণা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে মিসির আলি তাঁর নোটবই লিখে ভরিয়ে ফেলছেন। রূপার লেখা বারবার পড়ছেন। স্বামীর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। মেয়েটির এই ভয়াবহ সমস্যায় স্বামীর অংশ কতটুক তা বের করা দরকার।
রূপার পুর লেখাটা স্বামীর প্রতি ঘৃণা নিয়ে লেখা, তার পরেও বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি তার স্ত্রীকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্টের কথামতো আলাদা বাসা ভাড়া করেছে।
মিসির আলি তাঁর নোটবইতে লিখলেন – আমাকে ধরে নিতে হবে মেয়েটি মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ নয়। সে পৃথিবীকে তার অসুস্থ মানসিকতা নিয়ে দেখছে এবং বিচার করছে। স্বামীকেও সে একই ভাবে দেখছে। সে তার স্বামীর ছবি যেভাবে এঁকেছে তাতে তাকে ঘৃণ্য মানুষ বলে মনে হচ্ছে, অথচ এই মেয়ে তার মা’র ছবি এঁকেছে গভীর মমতায়। মা’র ছবি এত মমতায় আঁকা সত্ত্বেও মা’র ভয়াবহ রূপ বের হয়ে এসেছে। আমার কাছে জয়নাল ছেলেটিকে হৃদয়বান ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। এই ছেলে দুজন নিঃসঙ্গ মহিলাকে আনন্দ দেবার জন্যে হাসির গল্প করে। তাদের হাসাতে চেষ্টা করে। ছেলেটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে – তার স্ত্রীর সন্তানটি তার নয়। তার পরেও সে স্ত্রীকে গ্রহণ করেছে। ভালভাবেই গ্রহণ করেছে। এবং বলছে মেয়েটা ভাল।
রূপা শিশুর কান্না শুনছে। এটা কেন হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। মিসির আলি নোটবইতে কবে কবে কান্না শোনা গেল তা লিখে রাখতে শুরু করলেন। এর থেকে যদি কিছু বের হয়ে আসে।
‘স্যার, ট্রেইন দেইখ্যা আসছি।’
মিসির আলি লেখা থামিয়ে অবাক হয়ে বললেন, কী দেখে এসেছ?’
‘ট্রেইন । রেলগাড়ি। আপনে বললেন রেলগাড়ি দেখতে। চলন্ত রেলগাড়ি কী রঙ দেখা যায় দেখতে কইলেন। দেখলাম।’
‘কী দেখলে? কালো দেখা যায়?’
‘জি না, সবুজ দেখা যায়। সবুজ জিনিস, চলন্ত অবস্থায় যেমন সবুজ, থামন্ত অবস্থায়ও সবুজ। এইটা হইল আপনার সাধারণ কথা।’
মিসির আলি চিন্তিত মুখে বললেন, সাধারণ ব্যাপারেও মাঝে মাঝে কিছু অসাধারণ জিনিস থাকে বজলু। সেই অসাধারণ জিনিস খুঁজে বের করতে আমার ভাল লাগে। সারাজীবন তা-ই খুঁজেছি। কখনো পেয়েছি কখনো পাইনি। চলন্ত ট্রেন তোমাকে দেখতে বললাম কেন জান?
‘জি না।’
‘আমি লক্ষ করেছি উড়ন্ত টিয়াপাখি কালো দেখা যায়। সবুজ রঙ গতির কারণে কালো হয়ে যায় কিনা, সেটাই আমার দেখার ইচ্ছা ছিল।’
‘উড়ন্ত টিয়াপাখি কালো দেখা যায় জানতাম না স্যার।’
‘আমিও জানতাম না। দেখে অবাক হয়েছি। আচ্ছা বজলু তুমি যাও, আমি এখন জরুরি একটা কাজ করছি। একটি মেয়ের সমস্যা নিয়ে ভাবছি।’
বজলু বলল, গৌরীপুর থাইক্যা ডাক্তার সাহেব আসছেন। আপনেরে দেখতে চান।
‘এখন দেখা হবে না।’
‘আপনার মাথাধরার বিষয়ে কথা বলতে চান।’
‘এখন কথাও বলতে পারব না। আমি ব্যস্ত। অসম্ভব ব্যস্ত।’
বজলু মানুষটার মধ্যে ব্যস্ততার কিছু দেখল না। কাত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। হাতে একটা খাতা। এর নাম ব্যস্ততা? বজলু মাথা চুলকে বলল, রাতে কী খাবেন স্যার?
‘চা খাব।’
‘ভাত-তরকারির কথা বলতেছিলাম। হাঁস খাইবেন স্যার? অবশ্য বর্ষাকালে হাঁসের মাংসে কোনো টেস্ট থাকে না। হাঁস খেতে হয় শীতকালে। নতুন ধান উঠার পড়ে। নতুন ধান খাওয়ার কারণে হাঁসের শরীরে হয় চর্বি…’
‘তুমি এখন যাও বজলু।’
মিসির আলি খাতা খুললেন।